মন পাড়ায় পর্ব ১৬+১৭

#মন_পাড়ায়
#পর্ব_১৬
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

অদ্ভুত এক ব্যাপার আছে এই মেয়েটার মাঝে। যা তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে যায়। নিজের থেকে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সে। তার জীবনের সব প্রথম ভুলের কারণটি বোধহয় এই মেয়েটিই।

খাবার শেষ হওয়ার পর প্রভা প্লেট নিয়ে উঠে যেতে নিলেই অর্ক বলল, “আরেকটু খাব।”
তার খিদে মোটেও ছিলো না। কিন্তু প্রভা নিজ হাত থেকে আরেকটু খেতে ইচ্ছে করছিল তার। তার মায়ের মৃত্যুর পর এই প্রথম সে কাওকে নিজের যত্ন নিতে দিচ্ছে।
প্রভা গেল আরেকটু খাবার আনতে।

কিছু মুহূর্তে গড়াতেই অর্ক দেখে বিনয়ের মা’য়ের কল আসছে। সে প্রতিদিন একবার হলেও রাত নয়টার মধ্যে তাকে কল দিয়ে খোঁজ খবর নেয়। আজ ভুলেই গিয়েছিল সে। কল ধরে সালাম দিলো। ওপাশ থেকে বিনয়ের মা বললেন, “বাবা আজ কী এই মায়ের কথা ভুলে গিয়েছিলে?”

অর্কের নিজের প্রতি অপরাধবোধ হচ্ছিলো। বিনয়ের মৃত্যুর পর থেকে আজ পর্যন্ত অর্ক তাদের খোঁজ নিতে ভুলে নি অথচ আজ ভুলে গেল? সে ইতস্তত করে বলল, “খালা মাফ করে দিয়েন আসলে একটু প্রভার আত্নীয়দের বাসায় যেতে হয়েছে তো তাই।”

“ওহ বাবা বুঝেছি। তুমি কত কষ্ট করছো আমার ছেলের অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। সাবধানে থেকো বাবা ওই মেয়েটাকে যত ভালো দেখা যায় ততটা ভালো না।” কাঁদোকাঁদো কন্ঠে আবার বলল, “আমরাও তো এক নমনীয় মেয়েই এনেছিলাম, বছর না গড়াতেই তার আসল রূপ দেখানো শুরু করে দিলো। আমাদের এত গোছালো পরিবারকে এলোমেলো করে দিলো। পুরো এলাকা জানে ওর অত্যাচারের কথাগুলো। বলেছিলাম যৌথ পরিবার ভালো না লাগলে আলাদা হয়ে যেতে তাও যেন আমার ছেলেটা সুখে থাকে। তাও হলো না। একা থাকলে তো কাজ করতে হবে। সব কিছু ঠিক ছিলো বাবা, সব সহ্য করেছি। পরে যেয়ে আমার ছেলেটার নামে কলঙ্ক লাগিয়ে দিলো। বিনয় তো তোমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু তুমি তো চেনো ওকে। কোনো মেয়ের পিছনে ঘুরেছে কখনো? আর অবশেষে আমার ছেলেটাকে আমার থেকে এত দূরে নিয়ে গেল। আমার ছেলেটা চলে গেল পিছনে ফালিয়ে গেল এত বড় পরিবার। সারাক্ষণ চিন্তা আর চিন্তা। ফাতেমার বিয়ে কীভাবে দিব সে চিন্তাতেই ঘুম হয় না। আমার ছেলেটা থাকলে এত চিন্তা করতে দিত আমাকে?” ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো বিনয়ের মা।

অর্ক তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “খালা আমিও তো আপনার ছেলের মতো। আর ফাতেমার বিয়ের চিন্তা কেন করছেন? আমি তো বলেছি আপনাকে ওর বিয়ে আমি দিব। আপনি এইসব নিয়ে চিন্তা করেন না।”

“তোমার দয়াতেই তো বেঁচে আছি বাবা, নাহয় বিনয় যাওয়ার পর—-” এতটুকু বলেই আবারও কেঁদে উঠলো বিনয়ের মা।

অর্ক বলল, “খালা কান্না করা বন্ধ করুন। বিনয় থাকলে অবশ্যই আপনাকে কান্না করতে দেখে কষ্ট পেত। প্লিজ খালা কাঁদবেন না।”

“আচ্ছা বাবা তুমি এখন আরাম কর তাহলে।”

“খালা একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিলো। প্রভা কোন ভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করেছে? না মানে ওর সম্পর্কে কিছু তথ্য লাগতো।”

“বাবা আমি তো এইসবের খোঁজ খবর রাখি না। কিন্তু ও ওদিকের ভার্সিটির কথাই তো বলতো। সেখানে যাওয়ার কথা বলেছিলাম একবার। যে আজেবাজে কথা বলা শুরু করেছিল আমার কান থেকে রক্ত বের হওয়াটা শুধু বাকি। ওসব আর শুনতে পারি নি তাই আর জিজ্ঞেস করি নি কখনো। ওর জীবন ও নিজের মতোই চলতো।”

“ওহ, আচ্ছা ঠিকাছে খালা। আপনি ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।”

“ঠিকাছে বাবা।”
অর্ক ফোন রেখে দিলো। চোখ বন্ধ ঘাড়ে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরলো। সে বুঝতে পারছে না কী করবে? একদিকে প্রভা অন্যদিকে বিনয়, নূহা ও তাদের পরিবার। যাদের সাথে তার অনেক বছরের পরিচয়। আর প্রভা—-তার সাথে তো বিয়েটাও তাদের জন্য করা। তাহলে কেন তার পথ থেকে সরে যাচ্ছে সে?
কেন?

প্রভা এসে তার পাশে আবারও বসলো। বলল, “খাবার নিয়ে এসেছি। মুখটা তুলুন, খাইয়ে দিচ্ছি।”

“আমি খাব না। তুমি এইখান থেকে যাও।”

“কিন্তু আপনিই তো বলেছেন খাবেন। একটু খেয়ে নিন।”

“বলছি না যাও এইখান থেকে।”

“কিন্তু—–” এর পরে কিছু বলতে যাবে আর অর্ক হাত দিয়ে খাবারের প্লেটটা ফেলে দিলো। আবারও চিৎকার করে বলল, “মানা করেছি কানে যায় না? আমার সামনে এইসব নাটক করতে আসবে না। যাও এইখান থেকে।”

প্রভা ঠিক বুঝতে পারলো না হঠাৎ কী হলো অর্কের। সারাটাদিন তো ঠিকই ছিলো। সে দুর্ঘটনার পর আজ প্রথম অর্ক তার সাথে ভালোভাবে কথা বলছিলো। তাহলে আবার হঠাৎ করে কী হলো?

“আপনার কী হয়েছে? ঠিকাছেন?” প্রভা মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো। অর্ক তার হাতটা জোরে আঁকড়ে ধরলো। বলল, “তুমি আমার জীবন এলোমেলো করে দিয়ে জিজ্ঞেস করছ আমি ঠিকাছি কি’না? না ঠিক নেই কারণ তুমি আমায় ঠিক থাকতে দিচ্ছো না। তুমি আমাদের কারও জীবনে না থাকলে কোনো সমস্যাই হতো না। আজ বিনয় ও নূহা দুইজনই আমার কাছে থাকতো। তুমি সব বরবাদ করে দিয়েছ, সব। দয়া করে আমার চোখের সামনে আর এসো না।”
অর্ক প্রভার হাত ছেড়ে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো।

প্রভা তার হাতের দিকে তাকালো। ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ একটু আগে খুলে ফেলেছিল, সে কেটে যাওয়া স্থান থেকে আবার একটু রক্ত বের হচ্ছে। যা সে নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে উঠে সামনে গেল। মেঝের উপর থেকে খাবার উঠাতে শুরু করল প্লেটে। সে তার কাজ করতে করতে বলল, “রাগ কখনো খাবারের উপর দেখাতে নেই। এই পৃথিবীতে হাজারো মানুষ দু’বেলার খাবার পায় না। আপনি নিজেও আজ বলেছিলেন এই পর্যায়ে আসতে কষ্ট করেছেন। এই কষ্ট সে কষ্ট থেকে অনেক বেশি। খাবারের অনাদর করতে নেই। এইটা আল্লাহর দান।”
প্রভা প্লেটটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। এসে ফ্লোর মুছে দিয়ে বারান্দায় চলে গেল। সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। আজ অর্ক তাকে আর ডাকল না।

প্রভা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে রইলো। সে ভেবেছিলো সে অদিন ও বিনুক কাছে ঘুমাবে অথচ মা তাদের সাথে ঘুমিয়ে পড়েছে। মা’য়ের যদি একটুও সন্দেহ হয় যে তার ও অর্কের মাঝে কিছু সমস্যা আছে তাহলে চিন্তা করে করে নিজের শরীর খারাপ করবে। তাই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে রইলো।

অর্ক এপাশ ওপাশ হচ্ছিলো শুধু। তার ঘুম আসছিলো না মোটেও। চোখ বারবার যাচ্ছিলো বারান্দার দিকে। আবার ঘড়ির দিকে। বারোটার বেশি বাজে, তারপরও মেয়েটা আসছে না। এতক্ষণ ধরে কী করছে বারান্দায়?
অর্ক যাবে না যাবে না বলে উঠে পড়লো। বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “সমস্যা কী ঘুমাতে আসছ না কেন?”

প্রভা পিছনে ফিরল। বিস্মিত দেখালো তাকে। সে বলল, “আপনিই তো বললেন আপনি আমাকে দেখতে চান না। অদিন ও বিনুর সাথে মা ঘুমাচ্ছে, অন্যকোথাও জায়গা নেই তাই এইখানে দাঁড়িয়ে আছি।”

অর্ক কী বলবে বুঝতে পারলো না। কেউ বিশ্বাস করবে এই মেয়েটাই কতগুলো জীবন নষ্ট করেছে? অন্যকেউ কেন তার নিজেরও মাঝেমধ্যে বিশ্বাস হয় না। বহু কষ্টে নিজেকে বিশ্বাস দেওয়াতে হয়।

অর্ক জিজ্ঞেস করল, “তুমি তাহলে চিন্তা করেছ সারারাত এইখানে কাটাবে না ঘুমিয়ে?”

“আমার সাধারণত ঘুম বেশি হয় না। তিন থেকে চার ঘন্টা হয়। আবার মাঝেমধ্যে ঘুমই হয় না। তাই আমার সমস্যা নেই।”

“এইটা কোনো ভালো লক্ষ্মণ না সে এমন হেসে বলছ। বাসায় যেয়ে ডাক্তারের কাছে যাব। এখন ঘুমাতে আসো।”

প্রভা কথা না বাড়িয়ে অর্কের পিছনে রুমে গেল। দুইজন দুইদিকে পিঠ করে শুয়ে পড়ল। প্রায় দশ মিনিট পর অর্ক প্রভার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল, “তোমার ঘুমের সমস্যা কবে থেকে?”

প্রভার উওর এলো না। অর্ক আবারও জিজ্ঞেস করল, “ঘুমিয়ে পড়েছ?”

প্রভার মৃদু কন্ঠে উওর দিলো, “না।”

“তাহলে উওর দিচ্ছো না কেন? কবে থেকে এই সমস্যা?”

প্রভা সাথে সাথে উওর দিলো না। কিছু মুহূর্ত সময় নিয়ে উওর দিলো, “যখন থেকে রাতের নিরবতায় আর শান্তি খুঁজে পাই না।”
অর্ক আর কোনো প্রশ্ন করল না।
.
.
সৈকত বারান্দা থেকে এসে দেখে ঝিনুক বিছানার এক কোণে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে। সে কিছু না বলে মেঝে থেকে কাঁচের টুকরোগুলো পরিষ্কার করে নিলো। তারপর ঝিনুকের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “সরি পরী আমার তোমার সাথে এইভাবে কথা বলাটা উচিত হয় নি। প্লিজ মাফ করে দেও।”

সৈকত একহাত দিয়ে ঝিনুকের হাত ধরতেই ঝিনুক এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে ফেললো। ভেজা গলায় বলল, “তুমিও আমার বাবার মতো। পার্থক্য এতটুকুই তাকে আমি ঘৃণা করি কিন্তু তোমাকে ঘৃণা করতে পারি না। এইজন্য নিজের প্রতি ঘৃণা হয় আমার।”

সৈকত কিছু না বলে উঠে লাইট বন্ধ করে নিলো। এরপর আবারও বিছানায় উঠে ঝিনুকের হাত ধরলো আর ঝিনুক দ্বিতীয়বার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে নিলো।
তৃতীয়বার। চতুর্থবার। পঞ্চমবার।
ষষ্ঠবার আর বাঁধা দিল না। সৈকত ঝিনুকের হাত ধরে তাকে বুকে টেনে নিলো। তাকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো। ঝিনুক এইবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো। সে ভেজা গলায় বলল, “আমি তোমাকে খুব করে ঘৃণা করতে চাই কিন্তু পারি না কেন?”

সৈকত ঝিনুকের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল। মৃদু হেসে বলল, “ভালোবাসো যে তাই।”
ঝিনুকের পিঠে হাত রেখে তাকে আরও কাছে টেনে নিলো সৈকত। ঝিনুক বাঁধা দিল না, তাকে ফিরে জড়িয়েও ধরলো না। শুধু তার কান্না বাড়তে থাকলো সময়ের সাথে।
#মন_পাড়ায়
#পর্ব_১৭
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

পরেরদিন রাতে, ঝিনুক বসে ছিলো সেই ছাদের ছোট পুকুরের সিঁড়িতে বিষন্নতা নিয়ে। তার পায়ে আলতা মাখা। সে তাকিয়ে আছে জলের দিকে। আবারও পা ডুবিয়ে দিবে সে এই জলে। আলতা মিশে যাবে জলের সাথে। সে জলে পায়ের পাতা জলে ডুবাতে নিবে আর সৈকতের কন্ঠে থেকে গেল, “কী করছ?”

ঝিনুক চোখ তুলে তাকালো। আকাশের জ্যোৎস্নায় অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সৈকতকে। সে কমলা রঙের সোয়েটার পরে আছে, তার উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণে এই রঙ মানিয়েছে বটে কিন্তু তার কাছে সৈকতকে সাদা রঙে ভালো লাগে। ভালো লাগে বললে কম হবে। যখনই আগে সে সাদা রঙের শার্ট পরে তার সামনে আসতো সে নিজেই বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকতো সৈকতের দিকে। তার মনে হয়, এত কিছুর পরও যদি সৈকত এখনো সাদা রঙের শার্ট পরে তাহলেও সেভাবেই বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকবে।

সৈকত আবারও জিজ্ঞেস করল, “কী করছ?”

“তোমাকে বলার প্রয়োজনবোধ করি না।”

সৈকত এসে বসলো ঝিনুকের সামনে। বলল, ”
জাদুময় প্রেমের ধ্বনি
তোমার আলতা মাখা চরণ দেখিয়া হয় প্রাণ হানি।
এই কথাটা বলেছিলাম তোমাকে কয় বছর আগে। তাই বলে বারবার আলতো মেখে জলে ভেজাও তাই না? লাভটা কী হয়?”

“আমার মাঝে তোমার পছন্দের সব কিছু নিজের চোখে মিটতে দেখে তৃপ্তি পাই আমি।” বলেই ঝিনুক জলে পা ডুবিয়ে দিলো।

জলে ভিজে যখন আলতা উঠে গেল তখন সে পা উঠিয়ে বলল, “আবারও মিটিয়ে দিলাম। সাথে মিটাতে চাই তোমার স্মৃতিগুলোও।

সৈকত মৃদু হাসলো। মাথা ঝুঁকিয়ে আলতো করে চুমু খেল ঝিনুকের পায়ে।
সাথে সাথে ঝিনুক চোখ বন্ধ করে নিলো আবেশে।
সৈকত বলল, “তোমার সবটাই আমি ভালোবাসি। ভালো, খারাপ সব। তুমি নিজেকে মিটিয়ে দিলেও আমি তোমাকেই ভালোবাসবো।”

ঝিনুকের বুকের মাঝারে আজব এক শিহরণ উঠলো। সে জানে কথাগুলোর মূল্য শূন্য। সৈকতের কাছে হয়তো কথাগুলো বলাটা সহজ, কিন্তু তার কাছে অনেক মূল্যবান। সে জানে, মানে, বুঝে কিন্তু মনটার কী? এই মন তো বুঝতে চায় না। এই মানুষটা যে তার মন পাড়ায় সম্পূর্ণ জায়গা দখল করে রেখেছে।

ঝিনুক পা সরিয়ে নিলো। উঠে যেতে নিলেই সৈকত বলল, “ইকবাল কল করেছিলো, আগামীকালই ভার্সিটির কোনো কাগজে তোমার সই লাগবে। আমাদের আজই বের হতে হবে। প্রভা ভাবিরা আগামীকাল বা পুরশু আসবে। তৈরি হয়ে নেও। রাতের খাবার খেয়েই রওনা দিব।”
ঝিনুক কিছু না বলেই চলে গেল।

সৈকত পুকুরটার দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

রাতের নয়টার দিকে সৈকত ও ঝিনুক বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলো। একটা রিকশায় ঠিক করলো। ঝিনুক শুধু নিজের ব্যাকপ্যাকটা নিলো। তার কাপড়-চোপড় সব প্রভা আসার সময় নিয়ে আসবে। খালু তাদের বাসস্ট্যান্ডে ছাড়তে যেতে চেয়েছিলো সৈকতেই মানা করে দিলো। তার থেকে বিদায় নেওয়ার পর বাহিরে এলো। ঝিনুকও বিদায় নিলো। বাহিরে এসে দেখে প্রভা ও অর্ক দাঁড়িয়ে আছে। প্রভা সৈকতকে বলল, “পৌঁছে গিয়েই কল কর আর ঝিনুকের খেয়াল রেখ।”

ঝিনুক বলল, “আপু আমি নিজের খেয়াল রাখতে পারি। আমার আর বাচ্চা না।”

প্রভা হেসে ঝিনুকের গালে হাত রেখে বলল, “এত বড়ও তো না।” আবারও সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলল, “ও শীত লাগলেও না সোয়েটার পরে, আর না শাল জড়িয়ে নেয়। আরও জানালা খুলে রাখে এরপর ঠান্ডা লেগে যায়। এমনটা করতে দিও না।”

“জানি ভাবি। আপনার বোন অনেক জেদি। আপনি বলে দিন পরে তো আমার কথা শুনবে না। একবার জ্বর উঠলে এক সাপ্তাহের আগে তো কমে না আরও মুখ পুরো লাল হয়ে যায়। আরও ঔষধ খেতেও ওর হাজারো অজুহাত।”

প্রভার হাসিটা উড়ে গেল। বিস্ময় নিয়ে বলল, “তুমি কীভাবে জানো? বিয়ের আগে তো তোমার সাথে দেখা হওয়ার সময় তো ও কখনো অসুস্থ ছিলো না।”

সৈকতকে অস্বস্তিতে ভুলতে দেখা গেল। ঝিনুক ভীতিকর দৃষ্টিতে একবার সৈকতের দিকে তাকিয়ে আবার প্রভার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি বলেছি আপু।”

“ওহ আচ্ছা। সাবধানে থাকিস কিন্তু।” ঝিনুককে বলে সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর তুমিও। ওর খেয়াল রাখতে যেয়ে নিজের খেয়াল নিতে ভুলবে না।”

সৈকত একগাল হাসি নিয়ে বলল, “যা হুকুম আমার ভাবি।”
প্রভা হাসলো।

অর্ক সৈকতের কাঁধে হাত রেখে বলল, “আমি বলেছিলাম তোদের বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়ে আসি শুনলি না তো।”

সৈকত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার অর্কের হাতের দিকে তাকালো। নিজে পিছিয়ে গেল। কাঠখোট্টা কন্ঠে বলল, “আপনার আমাদের কথা চিন্তা করতে হবে না। আমরা এখন আর ছোট নেই যে আমাদের দিয়ে আসতে হবে।”

ঝিনুক বলল, “এইটা কোন ধরনের কথা সৈকত?”

সৈকত উওর না দিয়ে উঠে রিকশায় বসলো। বলল, “দেরি হয়ে যাচ্ছে উঠে আসো, পরে বাস ছুটে যাবে।”

ঝিনুক অর্ককে বলল, “জিজু আপনি আমার আপিকে সময় দিন বুঝলেন, আমরা একাই যেতে পারব।”
অর্ক জোরপূর্বক হাসলো। এরপর ঝিনুকের খালামণি এলো। জোর করে তাদের কিছু খাবার ধরিয়ে দিলো রাস্তার জন্য। বিদায় নিয়ে চলে গেল সৈকত ও ঝিনুক।

প্রভার মা বলল, “আল্লাহ আমি চুলা জ্বালিয়ে রেখে এসে পড়লাম।” বলেই তাড়াহুড়ো করে চলে গেল।

অর্ক বাসার ভিতরে যেতে নিলেই প্রভা বলল, “আজকের রাতটা ভীষণ সুন্দর। সামনেই অনেক সুন্দর একটা জায়গা আছে। সকালে তা ভীষণ সুন্দর লাগে, রাতে কখনো দেখি নি। আমার সাথে যাবেন একটু?”

“রাতেও তোমার এইসব শেষ হয় না? রাতের অন্ধকারে তুমি কী দেখবে? আমি কোথাও যেতে পারব না। বাসার ভিতরে যাও।”

প্রভার মুখ মলিন হয়ে গেল। সে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল, “ঠিকাছে।” আর মেইন গেইটের ভিতরে ঢুকলো।

অর্কের প্রভার এমন মলিন মুখটা অপছন্দ হলো। সে নিজেকে বহু আটকানোর চেষ্টা করলো। যাই হোক ডাকবে না—ডাকবে না সে প্রভাকে। তবুও লাভ হলো না। প্রভা যখন দরজার কাছে অর্ক তখনই ডাক দিলো, “প্রভা……”

প্রভা ফিরে তাকালো। অর্ক রাস্তার দিকে চোখ রেখে ঘাড়ে এক হাত দিয়ে আমতা-আমতা করে বলল, “আন্টিকে বলে আসো তুমি আমার সাথে সামনে ঘুরতে যাচ্ছ।”

“সত্যি?”

অর্ক তাকালো প্রভার দিকে। প্রভার ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে আছে। প্রভাকে এই মুহূর্তে কোনো কিশোরীর মতো লাগছে। এতটুকু কথায় এত আনন্দ কেউ পায় তার জানা ছিলো না। সে নিজে বড় বড় খুশিতেও এত আনন্দ পায় না। প্রভার খুশি দেখে তার নিজের ঠোঁটের কোণে হাসিও এঁকে এলো। সে বলল, “হ্যাঁ। দেখ তো বিনু আর অদিন আসবে না’কি?”

“আমি এক্ষুনি আসছি।”

অর্ক নিজেও বুঝতে পারলো না কেন প্রভার হাসিটা এত গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে। এটা তো তার সবচেয়ে বেশি অপছন্দের হওয়ার কথা ছিলো। অর্ক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। প্রভা ফিরে এলো কিছুক্ষণ পর। বলল, “অদিন কার্টুন দেখছে আর বিনু পড়ছে। ও আসবে না। শালটা জড়িয়ে নিন। বাহিরে ঠান্ডা আর সেদিকটা খোলামেলা বাতাস আরও বেশি বইবে।”

বাতাস বইছিল তীব্র বেগে। শুকনো পাতাগুলো উড়ছে ভীষণভাবে। দুপাশে গাছের সারি। মাঝে ইটের রাস্তা। যেখান দিয়ে হাঁটছে এক সাদা পাঞ্জাবি পরা পুরুষ ও হাল্কা গোলাপি রঙের সুতি শাড়ি পরা নারী। আকাশের সকল জ্যাৎস্না যেন তাদের উপরই পরছে। অর্ক তার পিছনে দুই হাত নিয়ে একটুখানি কেশে বলল, “ভুল বলো নি জায়গাটা অসম্ভব সুন্দর।”

প্রভা নিজের শালটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো। সে ভাবতে পারি নি এত ঠান্ডা পরবে আজ, নাহয় এত পাতলা শাল নিয়ে আসতো না। সে বলল, “আজ একটু বেশিই সুন্দর। সম্ভবত পাতা সব ঝরে পরেছে তাই বলে।”

অর্ক প্রভার দিকে একপলক তাকালো। হেসে আবারও সামনে তাকিয়ে বলল, “আকাশের চাঁদটাও আজ সুন্দর।”

“তা আর বলতে? চন্দ্রমা যেন আজ আমাদের উপরই তার সকল জ্যোৎস্না লুটিয়ে দিচ্ছে।”

“একটা গান গাও।”

প্রভা বিস্ময় নিয়ে তাকালো অর্কের দিকে। বলল, “আমি তো গান গাইতে পারি না। কখনোই গাই নি।”

“আজ গাইতে সমস্যা কোথায়? আমি তোমার আবদার পূরণ করেছি তুমি করবে না?”

প্রভা রাস্তার দিকে তাকালো। এক হাত দিয়ে অন্য হাতের কনুই ধরে গান ধরলো…..

‘কেন রোদের মতো হাসলে না
আমায় ভালোবাসলে না
আমার কাছে দিন ফুরালেও আসলে না
এই মন কেমনের জন্মদিন
চুপ করে থাকা কঠিন
তোমার কাছে খরস্রোতাও গতিহীন
নতুন সকাল গুলো কপাল ছুঁলো তোমারই
দূরে গেলেও এটাই সত্যি তুমি আমারই
শুধু আমারই
রোদের মতো হাসলে না
আমায় ভালোবাসলে না
আমার কাছে দিন ফুরালেও আসলে না……’

এতটুকুতেই দম বন্ধ হয়ে এলো প্রভার। শেষের লাইনগুলো ভেজা কন্ঠে মনে হচ্ছিলো। অর্ক তাকিয়ে রইলো প্রভার দিকে। বেদনা, অস্বস্তি, বিরক্ত মিশ্রিত তার দৃষ্টি। এই গানটা যে বিনয়ের জন্য ছিলো তা বুঝতে বাকি নেই তার। অর্ক মুখ ফিরিয়ে গভীর নিশ্বাস ফেললো।

প্রভা ভেজা কন্ঠে বলল, “আমার মনে নেই আর।”

অর্ক দাঁড়িয়ে পড়ল।
প্রভা অর্ককে পাশে না পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পিছনে ফিরে অর্ককে দেখে আবার তার কাছে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হলো?”

অর্ক এক পা এগিয়ে এলো। নিজের শালটা খুলে প্রভার মাথায় রাখলো। প্রভা বলল, “কী করছেন?”

অর্ক প্রভার চোখে চোখ রাখল। বলল,
‘রোদের মতো হাসলে
বৃষ্টি হয়ে ছুঁতে পারব না যে তোমায়,
তোমার কাছে আসলে
ফিরে যেতে পারব না যে আবার,
দূরে গেলেও তো আমি তোমারই
কাছে থেকেও যে বলতে পারিনি মনের কাহিনী,
দূর থেকেই জানাব তোমায় হৃদয়ের আখ্যান
মেঘের খামে লিখে পাঠাবো ভালোবাসার উপাখ্যান।’

চলবে……

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here