#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৩৩
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
সে লজ্জামাখা হিম সময়ে সে মানুষটার চোখে ডুব দিয়ে ঝিনুকের বুকে বয়েছিল এক উষ্ণময় অনুভূতি। তার ভয় করছিলো এই হৃদয়ের দ্রুত কম্পন সৈকত না শুনে নেয়। সে এমনিতেই লজ্জায় মাখা আর মাখতে চায় না এই লজ্জার রঙ।
ঝিনুক চোখ নামিয়ে বলল, “সম্ভবত মিথিলা ডাকছে আমার যাওয়া উচিত।”
ঝিনুক উঠে যেতে নিলেই সৈকত তার হাত ধরে ফেলল, “আমার হাতের উষ্ণতা পেয়ে দেখি তোমার গাল দুটো আরও বেশি লাল হয়ে গেছে।”
ঝিনুক উওর দিলো না। হাত ছাড়িয়ে চলে গেল। ভাবনারঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিজের হাতটিই আলতো করে ছুঁয়ে অতীতের সে মধুর স্পর্শ অনুভব করল আর দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
.
.
ফোন বেজে উঠলো। অর্ক দেখলো সৈকত তাকে ছাড়ার পর অনেকটা অস্বস্তি বোধ করছে। হয়তো তাদের মাঝে আজ এতটা দূরত্বের কারণে। সময়ের সাথে সাথে সকল সম্পর্ক পরিবর্তন হয়। কারও সম্পর্ক দৃঢ় হয় তো কারও দুর্বল। এই দৃঢ়তা বা দুর্বলতা নির্ভর করে সম্পর্কে থাকা দুটো মানুষের উপর বা পরিস্থিতির উপর।
অর্ক পকেট থেকে ফোমন বের করে দেখে প্রভা কল দিয়েছে। কল রিসিভ করে জিজ্ঞেস করল, “খোঁজ পেয়েছ?”
“পরিশ ভাইয়া বাংলাদেশে এসেছে।” কথাটা শুনতেই অর্ক চমকে উঠলো। রাগান্বিত স্বরে বলল, “তোমার এখন এই কথা মনে পড়েছে? আমরা এতক্ষণ ধরে খুঁজছি তোমার মাথায় আসে নি যে পরিশ বাংলাদেশে এসেছে সেটা আমাদের জানানো উচিত।”
সৈকত অবাক হয়ে বলল, “পরিশ বাংলাদেশে এসেছে? নিশ্চয়ই ঝিনুক ওর কাছে।”
অর্ক আবারও ধমকের সুরে বলল, “প্রভা তুমি এত বেখেয়ালিপনা কীভাবে দেখাতে পারো? আমরা এত চিন্তায় ছিলাম। আমাদের জানানোটা তো উচিত ছিলো তোমার।”
প্রভা নম্র সুরে বলল, “আমি জানতাম না। ঘরে কেউই জানতো না। পরিশ ভাইয়া সবে কল দিয়ে জানায় যে ঝিনুক তার সাথে আছে। জিজ্ঞেস করায় বলে যে স্যারপ্রাইজ দিতে এসেছিলো। এসে যখন জানে যে ঝিনুকের বিয়ে……” এইখানেই থেমে গেল প্রভা। আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলে, “আপনি বাসায় আসুন। আমি ঠিকানা নিয়েছি। কাল যাব সেখানে।”
“কাল না এখন যাচ্ছি আমরা। তুমি আমাকে ঠিকানা পাঠিয়ে দেও।”
“এখন গেলে আপনি আমায় বাসায় এসে নিয়ে যান। ভাইয়া ভীষণ রাগে আমার তার সাথে কথা বলতে হবে।”
“বিনু ও অদিনের কী হবে?” অর্কের প্রশ্নে প্রভা উওর দিলো, “দুইজনই ঘুমিয়ে পড়েছে। মা’কে বললে উনি সাথে থাকবে দুইজনের।”
অর্ক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “ঠিকাছে। আমরা আসছি।” অর্ক ফোন রেখে সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলল, “চল।”
সৈকত তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “সম্পূর্ণ কথা বা পরিস্থিতি বিবেচনা করার পূর্বে সিদ্ধান্ত নেওয়া আপনার পুরনো স্বভাব। এই স্বভাব নিয়ন্ত্রণ করতে শিখুন, নাহয় আবারও নিজের অজান্তেই কাছের কাওকে হারিয়ে ফেলবেন।”
“তুই প্রভার কথা বলছিস? এতটুকু কথায় ও মন খারাপ করবে না। জলদি চল, পরিশ আবার যদি ঝিনুকের কোনো ক্ষতি করে!”
“পরিশ যেমনই হোক না কেন, আমার এতটুকু বিশ্বাস আছে ও ঝিনুকের ক্ষতি করবে না। কিন্তু কাল ঝিনুকের এইখানে থাকাটা প্রয়োজনীয়। নবীনবরণের অনুষ্ঠান আছে এবং আমি ঝিনুককে কারও কাছে হারতে দেখতে পারব না। ওর পরাজিত হওয়াটা সবচেয়ে বেশি অপছন্দ।” বলেই সৈকত হাঁটতে শুরু করল। গাড়িতে যেয়ে উঠে বসল। অর্কও সাথে এলো। অর্ক গাড়িতে বসতেই সৈকত বলল, “ছোট ছোট আঘাতও অনেক বড় চিহ্ন রেখে যায়। একটি সম্পর্ক ভাঙ্গার জন্য একটি বড় কারণ প্রয়োজন হয় না, ছোট ছোট আঘাতও একটি সম্পর্ককে ধীরে ধীরে শেষ করতে পারে। সাথে শেষ করে দিতে পারে সম্পর্কে জড়িত মানুষগুলোকেও।”
“প্রভার উপর রাগ হলাম দেখে এই কথা বলছিস?” অর্কের সৈকতের কথা ধরতে না পেরে প্রশ্নটা করল। সৈকত তাচ্ছিল্য হেসে জানালার বাহিরে তাকিয়ে বলল, “এত বড় ব্যবসা চালান ঠিকই কিন্তু এতটুকু কথার অর্থ ধরতে পারলেন না? যাই হোক জলদি চলুন।”
অর্ক গাড়ি চালাচ্ছে। বাসা থেকে প্রভাকে রিসিভ করে যাচ্ছে ঝিনুককে নিতে। প্রভাদের বাসার রাস্তাতেই আদিলদের বাসা পরে। সেখানেই যাচ্ছে তারা।
সৈকত বলল, “ভাবি আপনি কি রাস্তায় কিছু খাবেন? যেহেতু রাতে…..” বলতে বলতে পিছনে তাকিয়ে থেমে গেল সৈকত। পিছনে তাকিয়ে দেখে প্রভা ঘুমিয়ে পড়েছে। গাড়ির জানালায় মাথা লাগছে বারবার। সে মৃদু কন্ঠে বলল, “মিঃঅর্ক আপনি ভাবির কাছে যান আমি গাড়ি চালাচ্ছি।”
“আমার অসুবিধা হচ্ছে না। তুই একটু আরাম কর।”
“ভাবির অসুবিধা হচ্ছে দেখে বলছি।” সৈকতের কথা শুনে অর্ক গাড়ির কাঁচ দিয়ে প্রভাকে দেখে গাড়ি থামাল। নিজে যেয়ে পিছনে বসলো এবং সৈকত ড্রাইভিং সিটে এসে বসলো।
গাড়ি স্টার্ট করতেই প্রভা আরেক দফা জানালার কাঁচে প্রভার মাথা লাগতে নিলেই অর্ক জানালার কাঁচে হাত রাখে আর প্রভার মাথাটা যত্নে নিজের বুকে রাখে। প্রভা একটু নড়ে-চড়ে অর্কের শার্ট আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। অর্ক মৃদু হাসে। একহাত দিয়ে প্রভাকে ধরে রাখে আর অন্যহাত দিয়ে তার অগুছালো চুলগুলো ঠিক করে দিলো।
সৈকত আয়নায় এই দৃশ্যটা দেখছিলো। সে মৃদু হাসলো ও সামনে তাকাল।
প্রভার ঘুম ভাঙ্গে কিছু শব্দে। সে চোখ খুলতেই দেখে অর্ক তার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়লো। সাথে সাথে অর্ক চোখ সরিয়ে নিলো। তাকে কিছুটা অস্বস্তিতে ভুগতে দেখা গেল।
প্রভা খেয়াল করল সে অর্কের বুকে শুয়ে আছে। সামনের সিট থেকে সৈকত জিজ্ঞেস করল, “ভাবি ঘুম ভেঙ্গেছে আপনার?” সৈকতের কন্ঠ শুনে চমকে তাকাল সৈকতের দিকে। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিলো। সৈকত তাদের এমন অবস্থায় দেখেছে ভাবতেই তো সে লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। সে লজ্জা পেয়ে সাথে সাথে সরে গেল। ঝুঁকে হাঁটুতে কনুই রেখে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করল তাও এমন ভাবে যেন কেউ না দেখে।
অর্ক প্রভাকে এমন করতে দেখে হাসলো। তার শাড়ির আঁচল নিয়ে তার মুখ ঢেকে দিলো।
প্রভা একটু অবাক হলো। তারপর ঘোমটা থেকে উঁকি মেরে তাকাল অর্কের দিকে। অর্ক মৃদু হাসছে।
অর্কের এমন হাসি দেখে প্রভা নিজেও মুচকি হাসলো।
প্রভা তার ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখল পরিশের মেসেজ। সে বলল, “সৈকত আমাদের বাড়ির দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিও। ঝিনুককে পরিশ ভাইয়া বাসায় নিয়ে গেছে।”
বাসায় যেয়ে তারা দেখতে পায় থমথমে পরিবেশ। দরজা খুলতেই প্রভা তার মায়ের ম্লান মুখ দেখে হাজারো প্রশ্ন করে বসে। সৈকত সেদিকে ধ্যান না দিয়ে ঝিনুকের কথা জিজ্ঞেস করে। জিজ্ঞেস করার পর জানতে পায় সে নিজের রুমে।
সৈকত দৌড়ে যায় ঝিনুকের রুমে। দেখে ঝিনুক দাঁড়িয়ে আছে জানালার কাছে। সৈকত দৌড়ে যেয়ে ঝিনুকএর বাহু ধরে তাকে একনজর দেখে নেয়। এক টানে বুকে জড়িয়ে নিয়েপ্রশান্তির নিশ্বাস ফেলল সে। আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলল, “আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো হারিয়ে ফেলেছি তোমায়। আমার নিশ্বাসও যেন আটকে আসছিলো।”
আবার ছেড়ে ঝিনুকের দুই গালে হাত রেখে তার কপালে এক ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো। আবার তাকে জড়িয়ে ধরতে নিলেই ঝিনুক জোরে ধাক্কা দিলো সৈকতকে।
সৈকত বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ঝিনুকের দিকে। আবার কাছে এসে বলল, “কী হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন?” সৈকত আবার ঝিনুকের গালে হাত দিতে নিলো আর ঝিনুক হাত সরিয়ে বলল, “খবরদার আমাকে ছুঁবে না।
“তোমাকে পরিশ কী আবার উল্টাপাল্টা কিছু বুঝিয়েছে?”
“ভাইয়া তোমাদের মতো না। তুমি আর আমার বাবা দুইজন একরকম। তুমি এখন এইসব নাটক করছ কারণ তুমি তোমার লালসা মিটাতে চাও। আমি তোমাকে ডিভোর্সের কথা বলেছি এইজন্য তুমি চাচ্ছো তুমি যত জলদি পারো আমাকে ভোগ করে নেও যা দুইবছর আগে পারোনি সে কাজ এখন করতে চাইছ। যেমনটা আমার বাবা আমার মা……” বলতে বলতে দম বন্ধ হয়ে এলো তার। সে এক ঢোক গিললো। কথাটা সম্পূর্ণ করতেও ঘৃণা হয় তার। আবার বলল, “তোমার স্পর্শ থেকেও আমার ঘৃণা হয়, এইটা ভেবে যে কতগুলো মেয়েকে ছুঁয়ে এসে আমাকে ছুঁয়ে দিতে চাও। আমি তোমার কাছে একটা ভোগের বস্তু ছাড়া কিছু না। কিন্তু এখন আর না মিস্টার সৈকত। আমি এখন আর তোমার এই অভিনয়ের জালে ফেঁসে যাব না। আর না। অন্যমেয়ের সাথে হয়তো পারবে কিন্তু তুমি ভালোবাসার নামে এইসব নোংরামি করতে পারবে না আমার সাথে। এইসব ভেবেও আমার ঘৃণা হয় তোমার স্পর্শ থেকে। আমি ভয় পাই তোমার ছোঁয়া থেকেও।”
সৈকত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ঝিনুকের দিকে। তারপর হেসে দিলো অথচ তার চোখে জল ছলছল করছে। সে ভেজা কাঁপানো কন্ঠে বলল, “তুমি জানো আমি আগে ভাবতাম সে দিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন যে দিন আমি তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি অনুভব করেছি সেদিন। কিন্তু আমার ইচ্ছা করছে আজ সে দিনটি আমার জীবনের পৃষ্ঠা থেকে মুছে দেই। তুমি এতদিন আমার চরিত্রের উপর প্রশ্ন তুলেছ আমি কখনো তোমাকে কিছু বলি নি, আমার ভালোবাসার উপর প্রশ্ন তুলেছ আমি কিছু বলি নি কিন্তু আজ তুমি আমার ভালোবাসার অপমান করেছ। আমার ভালোবাসা তোমার কাছে নোংরামি?”
ঝিনুক উওর দিলো না। সে মুখ ফিরিয়ে নিলো। সৈকত আবারও বলল, “ঠিকাছে আমার স্পর্শ থেকে তোমার ঘৃণা লাগলে আমি আর কখনো তোমার কাছে আসব না। তুমি একবার বললেই হতো ঝিনুক কিন্তু আমার স্পর্শ থেকে তো তোমার ভয় পাওয়ার প্রয়োজন ছিলো না।” সৈকতের সম্পূর্ণ মুখ লাল হয়ে গেছে। সে তার হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখ মুখে নিলো আর বলল, “হয়তো ভাগ্য এমন খেলা না খেললেও পারতো। তোমাকে আমার ভাগ্যের রেখায় না রাখলে না দেখা করালেও পারতো, দেখা করালে না ভালোবাসা হলেও পারতো, ভালোবাসার পর না ছিনিয়ে নিলেও পারতো, ছিনিয়ে আবার ফেরত দিয়ে আবারো আমার ভালোবাসার অপমান না করালেও পারতো। আমি তোমাকে আগেও বলেছিলাম তুমি আমার থেকে দূরে থাকো সমস্যা নেই, আমাকে আপন না করো সমস্যা নেই, আমাকে ভালো না বাসো সমস্যা নেই তবুও এমন কিছু করো না যেন আমি তোমাকে ভালোবেসে অনুতাপ করি। আজ আমার অনুতাপ হচ্ছে আমি তোমাকে ভালোবেসেছি বলে। তুমি আমার মন পাড়ায় রাজত্ব করার অধিকার দিয়েছি বলে। ”
কথা শুনতেই ঝিনুকের যেন দম আটকে গেল। সে মুহূর্তে সে যেন ভেতর থেকে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। অথচ তা অদৃশ্য। না কষ্ট কেউ দেখতে পায়, না শুনতে পায় অথচ কষ্টই মানুষের ভেতরটা একপ্রকার শেষ করে দেয় অথচ তার আশেপাশে সব স্বাভাবিক থাকে….এমনকি সে নিজেও।
ঝিনুক তাকাল সৈকতের দিকে। সৈকত কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো ঝিনুকের দিকে। চোখ বন্ধ করে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলেই সে চলে গেল।
ঝিনুক তাকিয়ে রইলো তার চলে যাওয়ার দিকে। সে সাথে সাথে মেঝেতে বসে পরলো। সে নিজের ভেতরে এক শূন্যতা অনুভব করছে।
#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৩৪
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
প্রভা ও অর্ক ড্রইংরুমে যেয়ে দেখে প্রভার বাবা সোফায় বসে আছে এবং পরিশ তার সামনে দাঁড়ানো। তাকে রাগান্বিত দেখাচ্ছে। প্রভা জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া তুমি না বলে কেন ঝিনুককে আনলে? আমরা কত চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম জানো?”
“আর তোরা যে না বলে ওকে বিয়ে দিয়ে দিলি তার কী? তোদের সাহস কত বড় তোরা ওর জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?”
“আমি যতটুকু জানি ঝিনুকের গার্জিয়ান আপনার মা-বাবা, আপনি না। তাই আপনার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন তাদের আছে বলে আমার মনে হয় না।” অর্ক কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল পরিশকে। পরিশ অর্কের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “বিয়েতে আপনার সাথে দেখা হয় নি। আশা করি, আপনি আমার বোনকে সুখে রাখবেন।”
অর্ক হেসে একটি সোফায় বসে বলল, “অবশ্যই। আমাদের পরিবারে আপনার দুই বোনই সুখে থাকবে।”
পরিশ কপাল কুঁচকে তাকাল অর্কের দিকে। আবার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল, “ঝিনুককে আর আপনাদের সামলানো লাগবে না।”
প্রভার বাবা দাঁড়িয়ে বলল, “তোকে কেউ এইসব জিজ্ঞেস করে নি। এই ঘরে কখন কী হবে না হবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমি এখনো আমি আছি।”
“তোমার বয়স হয়েছে বাবা এইজন্য তোমার এতটুকু বিবেক হারিয়ে গেছে যে নিজের ঘরের মেয়েকে অন্যকোথাও পাঠানোর পূর্বে দেখা উচিত ছেলেটা কেমন? আগে প্রভার জীবন শেষ করছ এখন আবার ঝিনুকের জীবন শেষ করতে চাচ্ছো তুমি?”
পরিশের কথার ধরণ দেখে প্রভা চমকে উঠলো। বিশেষ করে অর্কের সামনে পরিশ এমনভাবে কথা বলবে সে ভাবতেও পারে নি। সে পরিশের সামনে যেয়ে শান্ত গলাতেই বলল, “ভাইয়া তুমি এইভাবে বাবার সাথে কথা বলতে পারো না। আমার সাথে যা হয়েছে তা আমার ভাগ্যে ছিলো। এইখানে বাবার তো কোনো দোষ নেই। আর সৈকত তো ভালো ছেলে। আমি ওকে ছোট থেকে দেখে এসেছি। ঝিনুক ওর সাথে সুখে থাকবে। আর আমার মনে হয় দুইজন একে অপরকে মেনেও নিয়েছে।”
“তুই মুখের উপর কথা বলা শিখলি কবে থেকে?”
“না ভাইয়া আমি তো……” প্রভা কথা বলা শেষ হওয়ার পূর্বেই পরিশ ধমকের সুরে বলল, “তুই আমাকে শিখাবি এখন আমার কী করা উচিত আর কি না? এত বুদ্ধি থাকলে তোর স্বামী অন্য মেয়ের কাছে যায় কীভাবে? দুই বছর ধরে মাথায় বসে বসে খেয়েছিস নিজের দুই বাচ্চা নিয়ে এখন এই ঘর থেকে যাওয়ার পরও তোর শান্তি নেই? বিয়ে করেছিস নিজের সংসারে মনোযোগ দেয়। আমাদের ঘরের ব্যাপারে নাক ঘলানোর প্রয়োজন নেই।”
প্রভার মা চিন্তিত সুরে বলল, “ঘরের জামাইয়ের সামনে এইসব কী শুধু করলি তোরা?”
পরিশ বলল, “তোমার মেয়েকে বুঝাও। বড় ভাইয়ের সাথে তর্ক না করে যেন নিজের সংসারে মনোযোগ দেয়, নাহলে আবারও আগের মতো হলে আমি ওর বোঝা টানতে পারব না।”
“ভাইয়া আমি তো শুধু বলছিলাম যে ঝিনুককে…..” পরিশ আবারও কথা কাটলো প্রভার। সে ভীষণ রাগান্বিত স্বরে বলল, “আবারও এক কথা। বলেছি না নিজের সংসারের চিন্তা কর। এই ঘরের কোনো কথায় কথা বলার অধিকার তোর নেই। কথা কানে যায় না তোর?”
পরিশ এতই জোরে কথাটা বলল যে প্রভা ভয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল। কাঁপতে শুরু করল ভয়ে। নিজের এক হাতের আঙুল দিয়ে অন্যহাত খামচে ধরলো।
অর্ক প্রভার সামনে এসে দাঁড়ালো। নিজের দুই পকেটে হাত রেখে কঠিন দৃষ্টিতে পরিশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর আপনার কী মনে হয় যে আপনার এই অধিকার আছে যে আপনি আমার স্ত্রীর সাথে এইভাবে কথা বলতে পারবেন?”
পরিশের কন্ঠস্বর মুহূর্তে স্বাভাবিক হয়ে গেল। সে বলল, “আসলে মার মাথা গরম হয়ে গেছিলো। ক্ষমা করবেন। কিন্তু ও আমার ছোট বোন। ওর উপর অধিকার আমার আছে।”
“তাহলে আপনি এই কথা কীভাবে বলতে পারেন যে প্রভার এই ঘরে কোনো ব্যাপারে কথা বলার অধিকার নেই? ও এই ঘরের মেয়ে। আর ঝিনুকের বড় বোন। যতটুকু অধিকার আপনার আছে ততটুকু ওরও আছে এই ঘরের উপর এবং ঝিনুকের উপরও।” অর্কের কথা শেষ হতেই প্রভার বাবা সোফায় বসে ছোট এক নিশ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে বলল, “আর আমার যতটুকু মনে আছে আমি এখনো আমার পেনশন পাই সেই টাকা দিয়ে আমি প্রভা ও আমার নাতি-নাতনীদের দায়িত্ব নিয়েছি। তোর বোঝা ও কীভাবে হলো? আর এই ঘর আমার। আমার সব সন্তানেরই এইখানে একরকম অধিকার আছে। তোর, প্রভার, ঝিনুকের সবার।”
প্রভার মা বলল, “উফফ একটু চুপ করো না। ছেলেটা এত বড় যাত্রা করে এসেছে।” আবার পরিশের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা তুই এমন জেদ করিস না। এইসব বলিস না। শান্ত হো বাবা, শান্ত হো।”
“মা তুমি যাই বলো না কেন ঝিনুককে আমি কোথাও যেতে দিচ্ছি না।”
অর্ক হেসে পরিশের কাঁধে হাত রেখে বলল, “আসুন আপনার সাথে একটু আলাদা কথা আছে আমার।”
অর্ক পরিশকে আলাদাভাবে নিয়ে গেল। প্রভার মা প্রভাকে জিজ্ঞেস করল, “কী কথা বলবে? তুই কী বলেছিস যে পরিশ ঝিনুককে…… ” সম্পূর্ণটা বলতে যেয়েও থেমে গেল প্রভার মা। সামনে বলতে যেয়ে নিজেরই যেন কেমন লাগছে। প্রভার চুপি দেখে তিনি বলল, “তুই কেন বলতে গেলি? জামাইবাবু কী ভাববে?”
“মা তুমি উনাকে নিয়ে চিন্তা করো না। আমি ঝিনুক ও সৈকতকে দেখে আসছি।”
প্রভা যেতেই প্রভার মা চিন্তিত সুরে প্রভার বাবাকে বলল, “এখন কী হবে? পরিশ কখনো রাজি হবে না ঝিনুককে যেতে দিতে।”
প্রভার বাবা উওর দিলেন না।
প্রভা ঝিনুকের রুমে যেয়ে দেখে ঝিনুক নিচে বসে আছে। সৈকত কোথাও নেই। সে ঝিনুক সামনে যেয়ে বসে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে তুই কাঁদছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে তোকে? ভাইয়া কিছু বলেছে? আর সৈকত কোথায়?”
ঝিনুক উঠে দাঁড়ালো। বিছানার কাছে যেয়ে দাঁড়ালো। বলল, “ভাইয়া বলেছে সৈকতের সাথে সম্পর্ক না রাখা ভালো।”
প্রভাও উঠে বলল, “ভাইয়ার রাগ নিয়ে চিন্তা করিস না। ভাইয়া বললেও নিয়ে যাব তোকে আমরা। তোর আর সৈকতের বিয়ে হয়েছে। চাইলেই তো তোদের আলাদা করতে পারে না। এইটা বিয়ে কোনো পুতুল খেলা না।”
“আমি ওর সাথে সম্পর্ক রাখতে চাই না আপি।” কথাটা শোনা মাত্রই যেন প্রভা আকাশ থেকে ভেঙে পড়লো। এতদিন সৈকত ও ঝিনুককে দেখে বুঝেছিলো তাদের বিয়েটা যদিও জোরপূর্বক হয়েছে তবুও তো একে অপরকে পছন্দ করতে শুরু করেছে অথবা ভালোবাসতে শুরু করেছে। একে অপরের দিকে যেভাবে তাকায়, একে অপরের যেভাবে যত্ন করে, একে অপরের জন্য যেভাবে চিন্তা করে সবটা দেখে মনে হয়েছিলো যে ওরা একে অপরকে পছন্দ করতে শুরু করেছে অথবা ভালোবাসতে শুরু করেছে। কিন্তু এখন সে নিজেও বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে!
প্রভা ঝিনুকের সাথে শান্ত মাথায় কথা বলতে চাইত তাই এখন কিছু না বুঝানোটা ভালো মনে করল। সে বলল, “ঠিকাছে এই বিষয়ে আমরা পরে কথা বলব। তুই তৈরি হয়ে থাক আমরা কিছুক্ষণ পর বের হব। আগামীকাল না’কি আবার কোন অনুষ্ঠান আছে তার জন্য দেরি হয়ে যাবে। ”
“আমার কোনো ইচ্ছে নেই যাওয়ার। আর তুমি আপাতত ঐ বাসায় আর দুলাভাইকে এই ব্যাপারে কিছু বলো না। সময় হলে আমি বলব। আমরা কাল সকালে যাই আপি? আমার এখন ভালো লাগছে না।”
প্রভা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিকাছে আরাম কর।” আর চলে গেল। ড্রইংরুমে যেয়ে দেখল। বাবা ও অর্ক বসে আছে। তার মা পিছনে এসে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল, “পরিশ রাজি হয়ে গেছে ঝিনুকের যাওয়ার জন্য। এখন যেয়ে তোর রুমটা পরিষ্কার করে দেয়। আমি খাবার গরম করছি। জামাইকে জিজ্ঞেস করায় বলে কেউ খেয়ে আছিস নি। তুই আমাকে বলবি না? সৈকত ও ঝিনুককেও ডাক দেয়।”
“সৈকতের কিছু কাজ ছিলো দেখে চলে গেছে মা।”
“এত রাতে কেন গেল?”
প্রভা মাথা নামিয়ে নিলো। কী উওর দিবে বুঝতে পারলো না। অর্ক প্রভার চেয়েরার উদাসীনতা দেখে কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলোও বলল, “আমি পাঠিয়েছি। বাবার একটা কাজ ছিলো।”
“ওহ আচ্ছা। বাবা তুমি প্রভার রুমে যেয়ে আরাম করো একটু। আমি পরিশের কিছু কাপড় পাঠাচ্ছি প্রভাকে ছিলো। পোশাক পরিবর্তন করে ভাত খেতে আসো। আয় প্রভা আমার সাথে আয়।” প্রভা মায়ের পিছনে গেল।
প্রভা রুমে দেখে দেখে অর্ক বিছানায় বসে ফোনে কিছু একটা করছে। সে বিছানায় কাপড় রেখে বলল, “ড্রেস চেঞ্জ করে ফেলুন। আরাম লাগবে।”
অর্ক প্রভার কন্ঠ শুনে ফোনটা পাশে রেখে জিজ্ঞেস করল, “সৈকত কোথায় গেছে?”
“দুইজনের মধ্যে সম্ভবত কিছু হয়েছে। আমি মা ঘুমালেই ওকে কল দিব। তবে আপনি ভাইয়াকে কী বলে মানিয়ে নিলেন? আমি কখনো ভাবি নি ভাইয়া মেনে যাবে।”
অর্ক ঝুঁকে প্রভার মুখোমুখি হয়ে মৃদু হেসে বলল, “তা সিক্রেট বলা যাবে না।”
প্রভা বলল, “তাহলে ধন্যবাদ বললাম তাকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য। ”
“শুধুই ধন্যবাদ? কোনো উপহার দিবে না?” কপাল ভাঁজ করে বলল অর্ক।
“উপহার? কী উপহার লাগবে আপনার?”
অর্ক প্রভার ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়ে দিয়ে বলল, “এইটা।”
সাথে সাথে কেঁপে উঠলো প্রভা। এমনটা সে মোটেও আশা করে নি। মুহূর্তে তার দেহের ভেতরে অজানা এক বিদ্যুৎ বয়ে গেল মনে হলো। তার গাল দুটো লাল হলো। তার চোখদুটো হলো লজ্জামাখা। সে সাথে সাথে চোখ দুটো নামিয়ে নিলো।
এমন দৃশ্য দেখে অর্কের দুষ্টুমির ইচ্ছে যেন আরও তীব্র হলো। সে মিটিমিটি হেসে আলতো করে প্রভার ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে দিয়ে বলল, “বুঝেছ তো কী উপহার চাই?”
প্রভা একপলক অর্কের দিকে তাকিয়ে দৌড় দিলো রুমের বাহিরে।
অর্ক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হেসে দিলো প্রভার এমন কান্ডে। সে জানতো প্রভা এমন কিছুই করবে। সে ঝুঁকে নিজের ফোনটা হাতে নিতে যাবে তখন আবারও শব্দ পেল প্রভার নুপুরের। সে উঠে ফরে তাকিয়ে দেখে প্রভা তার দিকে আসছে। সে বাঁকা হেসে মশকরার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, “কী উপহার দিতে ফেরত আসলে না’কি?”
প্রভা তার পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়ায়। অর্কের চুলের পিছনে হাত গুঁজে তার মাথা একটু নামিয়ে চোখ বন্ধ করে তার গালে একটু চুমু খেল। আবার সাথে সাথে ছেড়ে দিলো। ছাড়ার পর আশেপাশে তাকাতে শুরু করল লজ্জা লুকানোর চেষ্টায়।
অর্ক কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে যায়। প্রভা এমন কিছু করবে সে ভাবতেও পারে নি। সে গালে হাত দিয়ে প্রভার যাওয়ার দিকে তাকালো। তার ঠোঁটের কোণে এক মোহনীয় হাসি।
প্রভা এমন হাসি দেখে লজ্জায় মেখে গেল যনে। এই মুহূর্তে লজ্জা লুকাতে পালানোটাই ভালো মনে করল সে। তাই দৌড়ে গেল বাহিরে।
অর্কের হাসিটা ঠিক তখনই মলিন হয়ে গেল যখন প্রভা দৌড়ে পালালো আর তার নুপুরের শব্দ বাজতে শুরু করল, ছনছন করে…..
এই শব্দটি বারবার তাকে মনে করিয়ে দেয় তার ভালোবাসার মানুষটি অন্যকারো প্রেমের বাঁধনে জড়িয়ে আছে।
চলবে……
[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]
***