মন_কেমনের_বৃষ্টি পর্ব ৩৯+৪০+শেষ

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
অন্তিম পর্ব
#পুষ্পিতা_প্রিমা

আলিয়া চৌধুরীর অনুরোধে যেতে হয় চৌধুরী বাড়ি। আদিকে অনেক কাহিনী নিয়ে যেতে হয়েছে। সে নাছোড়বান্দা যাবেনা মানে যাবেনা। কিন্তু যখন ইশা যাবে বলে জেদ ধরল অবশেষে তাকে রাজী হতেই হলো। পরী তো বেজায় খুশি। আদি তার কন্ঠস্বর শুনে হেঁটে গেল বারান্দায়। পরী বিজ্ঞদের মতো হেঁটে ফোনে কথা বলছে। ফোনটা ঠোঁটের কিছুটা আগে। বলার সময় ফোনটা মুখের উপর আনছে। আবার শোনার সময় কানের পাশে। ফোনটা ধরা দুইহাতে। লাউডস্পিকার হওয়ার কারণে আদি শুনতে পাচ্ছে কাদের সাথে কথা বলছে পরী। পরী একনাগাড়ে প্রশ্ন করছে রিককে।

‘ পাপপা রিইইই কুথাই? মামমা কুথাইই? বউউউ কুথাইইই? দাদ্দা কুথাইইই। রিই নাই? মামমা নাই? বউউউ নাই? দাদ্দা নাই?

খান বাড়িতে সবাই খাবার টেবিলে বসা। তারা হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে একে অপরের উপর পরীর অনবরত প্রশ্ন শুনে। যখন তাদের হাসির শব্দ কানে এল পরীর। তার ঠোঁট বাকা হলো। নাক কেঁপে কেঁপে উঠল। দুঃখী দুঃখী নিয়ে ভাব হাত উপরে তুলে বলল,

‘ পাপপা মাবববো। দুক্কু,,,,,

রিক আরেকদফা হাসল। পরীর পেছনে দাঁড়ানো আদি ও হাসল। রিক বলল,

‘ সবাই আছে। মা সবাইকে কেন খুঁজছে?

পরী কিছু একটা ভাবল। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল আদির দিকে। আদি শিখিয়ে দিল,

‘ বিয়ে।

পরী আদির মুখে মুখে বলল,

‘ বিইইয়ে,

রিক প্রশ্ন করল,

‘ কার বিয়ে মা?

আদি শিখিয়ে দিল।

‘ আমার।

পরী আদির মুখে মুখে বলল,্

‘ আমমাল। আমমাল বিইইয়ে। উম। উম। আমমাল। পরীইইর।

সবার হাসির চোটে খাবার টেবিল নড়েচড়ে উঠল। শুধু রিপ নীরবে হাসল।

পরী শান্তকন্ঠে ফোনটা দুহাতে ধরে কানের পাশে চেপে ধরে মাথাটা কাত করে বলল,

‘ পাপপপা রিইই নাই?????

রিক হাসল। বলল, আছে তো। কথা বলবে?

পরী বলল, ‘ ববববো।

রিপ যখনই মা ডেকে উঠল। পরীর অভিমান হলো। ফলসরূপ কান্না আসল। পরী কান্না কন্ঠে বলল,

‘ রিইই মাবববো।

‘ কেন আমি করেছি। মাববে কেন?

আদি শিখিয়ে দিল,

‘ রিইই আমার বিয়েতে আসবে না?

পরী ঠোঁট টেনে টেনে বলল,

‘ রিইই আমমাল বিতে আববে না ??

রিপ প্রথমেই বুঝল না। কিন্তু পরে যখন বুঝল তখন হাসল। বলল,

‘ আসব। মায়ের বিয়ে বলে কথা আসতে তো হবেই। মায়ের বরটা কোথায়? বর নেই???

পরী হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলল,

‘ নাই নাই। বররর নাই। নাই নাই।

_______________

পায়েসের বাটি হাতে নিয়ে রুমে ডুকতেই ইশার চোখে পড়ল বাবা মেয়ের কান্ডকারখানা। পরী আদির বুক থেকে মুখ সরিয়ে এবার পুরো উঠে পড়ে আদির গায়ের উপর। গায়ের উপর উঠে আদির বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। ছোট্ট হাতটা আদির মুখের উপর দিয়ে মিনমিন করে বলল, পাপ্পি।
আদি হাতটাতে চুমু দিল। পরী আরেক হাত দিল। আদি সেটাতে ও দিল। পরী মুখ তুলল। তার গালের লালা লাগিয়ে দিল আদির গালে। তারপর খিলখিল করে হেসে উঠল। আদির চুল টেনে গালে দেওয়ার মতো করে বলল,

‘ আমমা। আববা আমমম।

ইশা দৌড়ে এল। বলল,

‘ আপনারা আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন কেন? ফ্রেশ হয়ে আবার কেউ ঘুমোয়?

পরী তারদিকে তাকাল ঘাড় ঘুরিয়ে। ধমক দিয়ে বলল, ইশআআ ভোববব।

ইশা ভড়কে গেল। পরীর পিঠে একটা আলতোকরে চাপড় দিল। বলল, চোপপপ।

পরী উঠে গেল হুড়মুড় করে। ইশাকে আলতোকরে হাতের বাহুতে চাপড় মেরে বলল,

‘ ইশআআ মাবববো।

ইশা হেসে দিল। পরীর গালটা জোরে টেনে দিয়ে বলল,

‘ মেরে দিয়েছি তোমাকে।

পরী দাঁড়াল। ইশার গাল টেনে দিয়ে বলল, মেলেছি।

ইশা পায়েসের বাটি হাতে নিয়ে বলল,

‘ দেব না তোমাকে। আমি একাই খাব।

পরী ঠোঁট টেনে তাকাল আদির দিকে। ইশা বলল, আমি কাউকে ভয় পাইনা। এগুলো আমার জন্য রেঁধেছি আমি। আমাকে মেরেছে কেন দেব না।

পরী বিছানার উপর ধপ করে বসল। আদিকে বিচার দিল,

‘ আববা ইশআআা মাববে। মাববে না?

আদি উঠে এল। বলল, অবশ্যই মারব। আমার মেয়েকে যে মেরেছে তাকে তো মারতেই হবে।

ইশা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। বলল, আপনি মারবেন আমাকে? শখ কত?

পরী হাত তালি দিল। আদি শার্টের হাতা গুটাল। বলল,আমার মেয়েকে মেরেছ কেন? তোমাকে খুব মাববো।

পরী খিলখিল করে হেসে উঠল। আদি ইশার হাত থেকে পায়েসের বাটি কেড়ে নিল। সেন্টার টেবিলে রেখে দিল। ইশার কোলের কাছে শুয়ে বলল,

‘ মাথা টিপে দাও তো দেখি। স্বামী সেবা করো। নাহলে মাববো।

পরী গালে এক আঙুল দিয়ে চেয়ে রইল আববার দিকে। বলল, ইশআআ মাববে না???

আদি হাসল। উঠে বসল। পরীর চোখের উপর হাত রেখে ইশাকে টেনে জোরে চুমু খেল ঠোঁটের উপর। বেশ সময় নিয়ে ছাড়ল। ইশা উঠার জন্য তাড়া লাগিয়ে বলল, বেয়াদব লোক একটা। পরী আছে দেখছেন না।

আদি হো হো করে হাসল। বলল, মেয়েকে ভিলেন ভাবছ কেন? শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবো।

ইশার শাড়ির আঁচল টেনে ধরল পরী। ইশাকে টেনে বসিয়ে দিল। বলল, আমমি মাবববো।

আদির চোখের উপর ছোট্ট হাতটা দিল, তারপর ইশার গালে টুপ করে চুমু খেয়ে নিজেই নিজেই খিলখিল করে হাসল। হাত তালি দিয়ে বলল, ইশআআআ দুক্কুনি দুক্কুনি। উম উম। ইশা দুক্কুনি।

আদি আওয়াজ করে হেসে পুরো ঘর এক করে। বলে, দেখেছ মিষ্টি। এবার বলো লাভ হলো না কি ক্ষতি হলো। শুধু শুধু বেয়াদব লোক উপাধি দিলে। জামাইকে কেউ এভাবে বলে??

ইশার রাগ লাগল। সে বালিশ ছুড়ে মারল আদির দিকে। বলল, মারাত্মক বেয়াদব আপনি।

পরী, আদি দুজনই হাসতে হাসতে একে অপরের উপর ঢলে পড়ল।

______________

রাইনা কোনো কথা বলল না ইশার সাথে। কেমন যেন গোমড়া গোমড়া ভাব। ইশার কষ্ট লাগল। মিনুমা তা বুঝতে পারল। রাইনাকে গিয়ে বলল,

‘ আবার তুই এমন করছিস কেন? মেয়েটার সামনে অমন চেহারা খারাপ করে থাকিস না।

রাইনা বলল,

‘ না চেহারা খারাপ করছিনা। এমনিই ভালো লাগছে না। ইশার কোনো দোষ নেই।

মিনুমা বলল, তোর অমন চেহারা দেখে ইশা মন খারাপ করে চলে গেল। নিজেকে হয়ত দোষ দিচ্ছে।

রাইনা বলল, এখানে আমার কি করার আছে। কথা বলতে ইচ্ছে না হলে কি জোর করে বলব? আর ও তো ছোট। কো আগে কথা বলবে? আমি না ও?

মিনুমা আর কোনো কথা বাড়াল না। চলে গেল।
ইশা মন খারাপ করে বসে রইল। আলিয়া এল। হাতে একটা গহনা আর একটি লাল শাড়ি। ইশার হাতে দিয়ে বলল, আদির বউয়ের জন্য রেখেছিলাম এই দুটো। নাও। আজকের ফাংশনে পড়ো।

ইশা নিতে চাইল না।

‘ আমার এসব গহনা পড়ার অভ্যাস নেই। তাছাড়া যেদিন মন থেকে ছেলের বউ মানতে পারবেন সেদিন দেবেন ম্যাডাম। তার আগে আমি আপনার হাত থেকে এসব নিতে পারব না। দুঃখিত আমি।

আলিয়া অবাক হলো ইশার আচরণে। তারচাইতে বেশি অবাক হলো ‘ম্যাডাম ‘ ডাক শুনে। সে বলল,

‘ আমি তোমার শ্বাশুড়ি না? পরীর দাদু। আদির মা।

ইশা হাসল। বলল, জানি।

আলিয়া অন্যকিছু বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। যাওয়ার আগে শুধু বলল, রাইনা আমাকে মা ডাকে। তোমাকে ডাকতে বলছিনা। যেদিন মা মনে হবে সেদিন ডেকো।

ইশা চুপ থাকল। আলিয়া চলে গেল। ইশার চোখ জলে টলমল করে উঠল। পিছু ফিরতেই আদির মুখোমুখি। টলমলে জল মোছার সময় হয়ে উঠল না।
ইশা পাশ কেটে চলে যেতে চাইল। আদি তাকে টেনে দুহাতের বন্ধনে আবদ্ধ করল। বলল, সব ভুলে যাও মিষ্টি। সবকিছু নতুন করে শুরু হোক। সবাই ভালো থাকবে। আমরা ও ভালো থাকব।

ইশা কোনো কথা বলেনা। নীরব কান্নায় ভাসিয়ে দেয়। আজ কান্নাটা খুশির। সুখের।

_________________

সবাই এল চৌধুরী বাড়িতে। রিক,মুনা,নীরা,তালহা বেগম ও এল। জহির মিয়া এল না। রিপকে দেখা গেল না।
ইশা ছুটে গেল তাদের কাছে। রিপকে না দেখে মন খারাপ হলো। কাউকে কিছু বলল না । নীরা আড়চোখে দেখল ইশাকে। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল রিপকে নিচে।
ইশা সাথে সাথে তাকাল। আদির সাথে কথা বলছে রিপ। ইশা কেঁদে দিল খুশিতে। পা কেঁপে উঠল। কাঁপাকাঁপা পায়ে সে ছুটে গেল নিচে। রিপদা বলে ডেকে উঠল। রিপ ফেরার সাথে সাথে ইশা জাপটে জড়িয়ে ধরল রিপকে। কেঁদে দিল পুরো বাচ্চাদের মতো। রিপের চোখের কোণায় ও জল চিকচিক করে উঠল। আদি হাসল ইশার কান্ড দেখে। এই মেয়েটা তার রিপদাকে এতটা ভালোবাসে। রিপ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বলল,

‘ কেমন আছিস ইশু????

ইশা কাঁদল আর ও জোরে। কাঁদার জন্য কিছু বলতে পারল না। সবাই তাকিয়ে দেখল ইশার কান্না। যেন নতুন বউ বিয়ের পর এই প্রথম ভাইকে দেখছে। আর ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। রিপ খানিকটা হেসে বলল,

‘ কি করছিস? এভাবে কেউ কাঁদে? তুই কি ছোট বাচ্চা। তুই কি পরী? তুই তো পরীর মা।

ইশা ছাড়ল না তাকে। শুধু কাঁদল। কোনোকথা বেরোলো না তার মুখ দিয়ে। রিপকে আঁকড়ে ধরে রাখল। তা দেখে দুচোখ জলে টলমল করে উঠল নীরার। সে চোখ ফিরিয়ে নিল। ছিঃ এসব ভাবা ও অন্যায়। যেখানে রিপ ওকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে তার একপাক্ষিক ভালোবাসার কথা। সেখানে ইশুর কোনো দোষ নেই।
রিপ তুলল ইশাকে। চোখের জল মুছে দিল। বলল, কি হাল করেছিস চেহারার? তুই কি পাগল??

ইশা কেঁদে কেঁদে বলে, তুমি আমায় ক্ষমা করেছ তো রিপদা?

রিপ হাসল। বলল, কিসের ক্ষমা? তোর উপর তো আমার রাগ হয়েছিল সেদিন। আমাদের ছেড়ে যাওয়ার কথা তুই কি করে ভাবতে পারিস? তুই জানিস না তোর উপর কতগুলো মানুষের ভালো থাকা জড়িয়ে আছে।

ইশা আর ও জোরে কাঁদল। রিপের বুকে আবার ঢলে পড়ল। রিপ তার মাথায় হাত রাখল। বলল, তোর উপর কোনোকালেই আমার কোনো রাগ ছিল না। আমি তোকে সারাটাজীবন ভালো থাকতে দেখতে চেয়েছিলাম। তুই ভালো আছিস তো ইশু?

ইশা উত্তর দিতে পারল না সেই প্রশ্নের। আজ যে বৃষ্টি নামে নি। বৃষ্টি নামার কোনো অবকাশ যে নেই। আকাশের বুক ছিড়ে বৃষ্টি নামুক না? তখন না হয় বলবে, আজ আমি খুব সুখী রিপদা। খুব ভালো আছি আমি। তুমি ও ভালো থেকো।

__________________

ছয়মাস কেটে যাওয়ার পর আজিজ চৌধুরী আর আফি ছাড়া পেল। তার কয়েকদিন আগে হন্য কোথাও একটা যেতে দেখা গেল ইশাকে। আদি তার পথ আটকিয়ে জানতে চেয়েছিল, কোথায় যাচ্ছ মিষ্টি??
ইশা তার কথার সঠিক জবাব না দিয়ে শুধু বলেছিল।
‘ পথ আটকাবেন না ডক্টর। আমি আপনাকে সব বলব।
আদির রাগ লেগেছিল সেদিন। ইশার সাথে সে যেতে চাইল। কিন্তু ইশা তাকে ও যেতে দিল না। আদির কষ্ট লাগল। অভিমানে বুক ভার হলো।
যখন আফি আর আজিজ চৌধুরী বাসায় ফিরল। পুরো বাড়ি থমথমে পরিবেশ। ছোট্ট পরীর খুব প্রিয় আফফি। রেহানের কষ্ট হয় যখন আফি রেহানকে আদর না করে পরীকে করে। পরীকে নিয়ে সারাক্ষণ বিজি থাকে আফি। পরী ও আফির সাথে খুনসুটিতে মেতে থাকে। মাঝেমাঝে ডাকে, বাড়ে পাপা।
আফির ভালো লাগে এই ছোট্ট মেয়েটাকে সেই প্রথম থেকেই। নিজে নিজেই অপরাধবোধে ভুগে। এই ছোট্ট মেয়েটা যদি কখনো জানতে পারে তার মায়ের সাথে হওয়া অন্যায়ের কথা তাহলে কি কখনো ক্ষমা করবে বাড়ে পাপাকে। পরী কথা না বললে তো বাড়ে পাপা সেটা সহ্য করতে পারবে না। পরীর চোখে ঘৃণা দেখতে পারবে না আফি। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল সে থাকবে না এখানে। চলে যাবে রাইনা আর রেহানকে নিয়ে।
আজিজ চৌধুরী সামনে যাইনা ইশার। যেন লুকিয়ে লুকিয়ে থাকে। পরী ডাকে, বুলো। বুলো। নাল চুল। নাল দাঁলি। বুলো। বুলো।
আজিজ চৌধুরীর রাগ ও লাগে। হাসি ও পাই। ইশা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। আজিজ চৌধুরী সামনাসামনি দেখা হয়ে যাওয়ার পর বলে,
”’ আমি বলার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু কথা বলার কোনো সুযোগ ছিল না।
ইশা হাসল। বলল, আমি সব জেনে গিয়েছি মিঃ চৌধুরী।

‘সেদিন আমার চেকআপ করা রিপোর্টটি আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল যে ছেলেটি সে আপনারই লোক। তারপর আবার যে রিপোর্টটি দিয়ে গিয়েছিল সেটি নকল রিপোর্ট। ডক্টর মেহতাব সেই রিপোর্ট দেখে বলেছিল আমার ফুসফুসের ক্যান্সার হয়েছে। আপনি এমনটা কেন করেছেন সেটা ও আমি জানি।
পরীকে যখন আপনারা পাবেন না মনে হলো। তখন আমাকে দিয়ে ও কি হবে। তাই ডক্টরের জীবনটা আইমির সাথে জুড়ে দেওয়ার জন্য আপনি আমাকে ফুসফুসের ক্যান্সারের মিথ্যে রিপোর্ট দেখালেন যাতে আমি ভয় পেয়ে গুটিয়ে নিই নিজেকে। ডক্টরের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিই। কিন্তু তার বিপরীতটা হলো। সত্য কখনো চাপা থাকেনা। কি আশ্চর্য! ভাবা যায় আমি আজ আপনার সামনে আপনার বাড়িতে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। আমার কিন্তু একটু ও ভয় হচ্ছে না। আমি ভয় পাচ্ছিনা। কারণ আজ ডক্টর আছে আমার পাশে। আমি আমার স্বামীর ঘরে দাঁড়িয়ে।

আজিজ চৌধুরী হাসলেন। বললেন, দূরে পাঠাতে গিয়ে যে আর ও কাছে আনলাম এটার জন্য আমাকে থ্যাংকস দেওয়ার কথা। আর তুমি কথা শোনাচ্ছ আমায়। ভুলে যেওনা তুমি তোমার শ্বশুরের সাথে কথা বলছ। আজিজ চৌধুরীর কথায় ইশা হেসে ফেলল। আজিজ চৌধুরী ও হাসল। ইশা চলে গেল ব্যঙ্গ হাসি হেসে। আজিজ চৌধুরীকে তারপর ও ঘিরে রইল একরাশ অনুতাপ।

________________

আদির ব্যবহার দেখে মনে হলো সে স্বাভাবিক আচরণ করছে না ইশার সাথে। ইশা বারবার জানতে চেয়ে ও কোনো লাভ হলোনা। ইশা তার গাল জড়িয়ে ধরে নাকের সাথে নাক ঘষে জানতে চাইল,

‘ আইমি কোথায় ডক্টর? মনে পড়ে না তাকে?

আদি অভিমানী চোখে তাকায় ইশার দিকে। এমন সময় আর কথা পেল না মিষ্টি।
ইশা বলল,
‘ আমি সেদিন আইমির কাছে গিয়েছিলাম। আইমি এব্রোড ডক্টর।
আদি অন্যদিকে মুখ করে বলল, জানি।
ইশা হাসল। বলল, ও আপনাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছে ডক্টর। হয়ত ওর ভালোবাসার ধরণটা অন্যরকম।

আদি চুপ থাকল। ইশা বলল,

‘ ফোন দিয়ে তার সরিটা একসেপ্ট করে নেবেন। আমি অনুরোধ করছি। প্লিজ ডক্টর।

আদি দুপাশে মাথা নাড়াল। বলল,
‘ ঠিক আছে।
ইশা হাসল। আদির বুকে আলতোভাবে মাথা রেখে বলল,

‘ ডক্টর খুব খুব ভালো।

____________________

আকাশে মেঘের ঘনঘটা। চারপাশ ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছে। ঘোর বর্ষা নামবে। রুক্ষ প্রকৃতিতে আজ বহুদিন পর বৃষ্টি নামবে। প্রকৃতি স্নিগ্ধ রূপ ধারণ করবে আবার।

সত্যি সত্যি ঝপঝপ ঝপঝপ বৃষ্টি নামল চারপাশে। তুমুল বর্ষা। আদি ছাতা হাতে দৌড়ে এল ইশার কাছে। বলল,
‘ মিষ্টি তুমি বেড়াতে আসার নাম করে বৃষ্টিতে ভিজছ?
খান বাড়ির গেইট পেরিয়ে বের হয়ে এল একটি ছেলে। পড়বে সাদা পান্জাবী। সে ডাকল, ইশু এভাবে ভিজছিস কেন? গাড়িতে উঠে বস।

ইশা কারো কথা শুনল না। আদিকে বলল, ডক্টর আজ ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরব।
আদির সাথে কথা বলা শেষ করে ইশা দৌড়ে গেল রিপের কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

‘ রিপদা দেখো আজ বৃষ্টি এসেছে। মন কেমন করা বৃষ্টি। তোমাকে বলেছিলাম না কোনোদিন যদি শতবাধা পেরিয়ে সে কাঙ্ক্ষিত দিনটি আসে। আকাশের বুক ছিড়ে ঝপঝপ বৃষ্টি নামে সেদিন তোমাকে বলতে আসব, রিপদা দেখো আমি খুব সুখী। আজ আমি ডক্টরকে শুনতে পায়। আজ সে আছে আমার পাশে। আমি ভালো আছি রিপদা,তুমি ভালো থেকো। তুমি ভালো আছ তো রিপদা।
আজ সেই দিন এসেছে। তুমি সত্যি ভালো আছ তো রিপদা??
রিপের পিছু পিছু এসে দাঁড়ায় নীরা ছাতা হাতে। ইশার পিছু আদি এসে দাঁড়ায় ছাতা হাতে।
রিপ তাকায় ইশার হাস্যজ্জ্বল মুখের দিকে। কাঁপাকাঁপা হাতটা ইশার মাথায় রাখে। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে উত্তর দেয়,
‘ আমি,, আছি ভালো। তুই ভালো থাক। আমাদের,,,,,,, আমাকে ভালো রাখ। আদিকে আগলে রাখ।

ইশা হাসিকান্নায় একাকার হয়ে জড়িয়ে ধরে রিপদাকে। তারপর মাথা তুলে বলে,

‘ আমি ভালো থাকব। তাকে ভালো রাখব। তুমি ও ভালো থেকো। নীরাকে ভালো রেখো।

আদির হাত থেকে ছাতা কেড়ে নেয় ইশা। কিছুদূর যেতে যেতে হাত মেলে দেয়। বৃষ্টিজল শুষে নেয়। আদিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে তার গলায় মুখে রেখে বলে, ডক্টর আজ মন কেমনের বৃষ্টি এসেছে। তাই মন কেমন করা কথাটি বলার সময় এসেছে।
আদি বুঝতে পেরে হাসে। ভেজা কপালটাতে ঠোঁটের ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে বলে, ভালোবাসি।
ইশা তার বুকে মুখ লুকায়। মিনমিন করে বলে, আমি ও বাসি। খুব খুব বেশি। ভালোবাসি।
____________

নীরার হাত থেকে ছাতা পড়ে যায়। সে বলে, আপনার জন্যই এনেছিলাম ছাতা। আপনি তো ভিজে গিয়েছেন। আর লাগবে না।
রিপ নীরার দিকে তাকাল। বলল, আমি সরি নীরা।
নীরা অবাক চোখে তাকাল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘ আমি কথা দিয়েছিলাম আপনাকে। আপনি না বাসলে ও আমি বেসে যাব। আপনি ভালো না বাসুন। আমি আর জোর করব না। যেদিন মনে হবে আমাকে আপনার প্রয়োজন সেদিন আমি আসব আপনার কাছে। তার আগে না। আমি সরি। আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম বলে।

নীরার কন্ঠে একরাশ কান্না আর অভিমান। রিপ তার যাওয়া আটকাল। এক হাত দিয়ে টেনে ধরল তাকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার ঘাড়ে মুখ রেখে তাকাল ওই চলে যাওয়া স্বামী স্ত্রীর দিকে। ধোঁয়াশা হলো ওই মেয়েটি। সে সিদ্ধান্ত নিল আজ থেকে সে ভালো থাকবে, আজ থেকে সে নীরাকে ভালো রাখবে। নীরা লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। এই লোকটার হঠাৎ কি হলো?
রিপ আর ও শক্ত করে ধরল নীরাকে। নীরার ঘাড়ে চোখদুটো চেপে ধরে আবার ও তাকাল ওই দুইজনের দিকে। আজ ম্লান হলো ইশু নীরাতে। রিপের চোখ থেকে দুফোটা খুশির জল গড়াল। আজ ইশু ভালো আছে। রিপের কাছে এর চাইতে খুশির খবর আর কি হতে পারে? এবার থেকে নিজেকে ভালো রাখার পালা।
ইশা যেতে যেতে পিছু ফিরে তাকাল বারংবার। আচ্ছা সবাই কি ভালো আছে? কারো সাথে অন্যায় হয়ে গেল না তো? কেউ তাকে ডাকছে না তো নীরবে? নিঃশব্দে?

____________________

আলিয়ার কোল থেকে নিচে নেমে গেল পরী। বাইরে বৃষ্টির ভেতর বেরিয়ে পড়ল। রেহান দাঁড়ানো বাইরে। তার হাতে ছোট্টখাট্টো একটা গিটার। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সে গিটারে সুর তুলছে টুংটাং। ছোট্ট পরী ব্বেই ব্বেই বলে রেহানের সামনাসামনি গিয়ে বসল। তার পিছুপিছু মিনি ও এল। ডাকল,প্রিন্স, প্রিন্সেস।

পরী রেহানকে ডিস্টার্ব করল না। গালে হাত বসে শুনল গিটারের সুর। ছোট্ট্ রেহান তেমন পটু না। তবে চোখ খুলে সামনের বসা একটি ছোট্ট্ পরীকে দেখে তার মনে হলো আজকের গিটারের সুরটা ভারী সুন্দর। ভারী সুন্দর।
গিটারের সুর বন্ধ হয়ে এলে পরী উঠে দাঁড়াল। ডাকল,ব্বেই ব্বেই।
মিনি ও ডাকল, বেই,বেই।

রেহান পরীর সামনে বসল। বলল, তুমি আমাকে ভাই ডাকবে না পরী? নাম ধরে ডাকবে।
পরী কি বুঝল কে জানে?
ডাকল, নেআান নেআন।
রেহান হাসল। বলল, আমি তোমাকে বোন ডাকব না। পরী বলে ডাকব। তুমি রাগ করবে না তো?
পরী মাথা নাড়াল। রেহান বলল, পরী তুমি খুব সুন্দর। একদম পরীর মতো।
পরী মুখে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল, বলল,
‘ যাহহহ, মাবববো।
রেহান হেসে ফেলল। বলল, পরী আমি চলে যাব এব্রোডে। ড্যাড রাখবে না এখানে। স্টাডি কমপ্লিট করে অনেক বড় হলে আসব। তুমি থাকবে তো পরী।
পরী তার হাতদুটো আলগা করে দেখল রেহানকে। বলল,
‘ নেআান ভোবব।
রেহান হাসল। পরীকে বসাল তার সামনে। বলল,
‘ পরী আমি আসব। সত্যিই আসব। তুমি নেআনকে ভুলে যেওনা। তুমি থেকে যেও।আমি আসব এক মন কেমনের দিনে। সেদিন মন কেমন করা বৃষ্টি ঝড়বে। তুমি তখন অনেক বড় হয়ে যাবে। একটি সাদা শাড়ি পড়বে, আর কয়েকটা বকুল ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে ওই বকুল তলায়। আমি আসব। সত্যিই আসব। পরী শুনতে পাচ্ছ?
পরী চোখ পিটপিট করে তাকাল রেহানের দিকে। বলল,
‘ নেআন দাবে না। দাবে না। মাবববববববো। পররীইই দুক্কু। মিননননি নেআন দুক্কু।

মিনি ডানা ঝাপটাল,ডাকল, পরীইই বউ। রেহান বর। পরীইই বউ। রেহান বর।।

সমাপ্ত,,,
(মিস ইউ পরী। খুব খুব মিস করব পরীকে।)

প্রিয় পাঠক এতদিন ধরে যারা পাশে ছিলেন তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। অনেকে বলেছেন গল্পটি শেষ না করতে। কিন্তু আমার ভালো লাগছে না। একগেঁয়েমি লাগছে।
আমি মনে করি গল্পটি এতটুকুতে থেমে গেলেই সুন্দর।

যারা পেইজে লাইক দেননি তারা দিয়ে দিবেন।
শীঘ্রই নতুন গল্প নিয়ে আসব। ততদিন ভালো থাকবেন। পাশে থাকবেন। ভালোবাসা। ভালোবাসা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here