মন_ছুঁয়েছে_সে #পর্বসংখ্যা_৭ #মৌরিন_আহমেদ

#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_৭
#মৌরিন_আহমেদ

ফুসকা খেতে এসেছে অনন্ন্যা-কানিজ। আজকে ট্রিট দিচ্ছে কানিজ নিজেই। সেদিনের ঘটনার পর দুদিন পার হয়ে গেলেও আর ভার্সিটি মুখো হয় নি ওরা দুজন! ঐ ঘটনা নিয়ে দুজনেই বেশ ভীত। তবে এর মাধ্যমে ধ্রুবের প্রতি অনন্যার মনের সুপ্ত অনুভূতির বেশ উন্নতি হয়েছে। ও তো শুরু থেকেই ধ্রুবকে ফলো করত। সেই প্রথম যখন ধ্রুব ওদের এলাকায় ভাড়া নিলো তখন থেকে।

অবশ্য ধ্রুব ছেলেটা পছন্দ করার মতোই। তবে সেদিনের পর থেকে আর একবারও ছেলেটার সাথে দেখা হয় নি ওর! যেহেতু ভার্সিটি যায় নি তাই দেখাও হয় নি। তবে বাড়ির ছাদ থেকে বেশ কয়েকবারওকে বাসা থেকে ঢুকতে ও বেরোতে দেখেছে। দূর থেকে ওকে দেখেই বারবার মুগ্ধ হয়েছে সে! আর মনে মনে ভেবেছে পরবর্তীতে সামনে পেলে কীভাবে ধন্যবাদ জানাবে ওকে!

অবশ্য এ নিয়ে কানিজের কোনো মাথাব্যথা নেই। সেদিন ধ্রুবের উপস্থিতির কারণেই যে ওরা ইফতির হাত থেকে সহজেই বাঁচতে পেরেছে সেটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নয় সে। হ্যাঁ, মানুষের মাঝে স্বাভাবিক যে কৃতজ্ঞতা বোধ আছে সেটা ওরও আছে। সে জন্য কখনো সামনা সামনি কথা বলার সুযোগ হলে ধন্যবাদ জানাবে সেটা মনে মনে ভেবে রেখেছে। কিন্তু এটা নিয়ে অনন্যার তার সাথে আরেকবার কথা বলার সুযোগ হবে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বিনয়ী সেজে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করার পরিকল্পনা গুলো নিয়ে যথেষ্ট বিরক্ত ও। মেয়েটা বড্ডো সরল! এতটা সরলতা নিয়ে কারো প্রেমে পড়া উচিৎ না!

অবশ্য ব্যাপারটা ওকে বুঝিয়েও লাভ নেই। বেচারি শুধু শুধু মন খারাপ করবে। তাই ধ্রুবের প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও অনন্যার সামনে টিটকারী মারতে হয় ওকে! নয় তো প্রশংসা করলে ও সুযোগ পেয়ে যাবে। সারাক্ষণ ওর সেই হিমুর গুণগান করতে করতে মাথা খেয়ে ছাড়বে! তাই টিটকারী করেই ধ্রুবকে ওর মনে প্রশ্রয় না দেয়ার ইঙ্গিত দেয়!

ফুসকা খেতে খেতে সেদিনের ঘটনাটা নিয়ে কথা হয় ওদের। অনন্যা ওকে জিজ্ঞেস করে,

– তাহলে কাল ভার্সিটি যাবি তুই?

– তুই যাবি?

মুখে ঢুকানো ফুসকা চিবোতে চিবোতে প্রশ্ন করে কানিজ। ওও আরেকটা আস্ত ফুসকা মুখে পুরে দিয়ে বলে,

– যাব বলেই তো বলছি!… তাছাড়া দুদিন ক্লাস মিস হয়ে গেছে। সেগুলোর নোটস তো কালেক্ট করতে হবে!

– ঠিকই বলেছিস নোটস কালেক্ট করাও তো জরুরি। আচ্ছা… তাহলে কালকেই যাই?… কী বলিস?

– ওকে!

বলেই মুচকি হাসে অনন্যা। কানিজকে হঠাৎ কেন যেন চিন্তিত লাগে। ভাবুক গলায় বলে,

– এ দু’দিনে ইফতির সাথে তোর দেখা হয়েছিল?… বাসার সামনে?..

– নাহ্। বাসা থেকেই বেরোই নি। দেখা হবে কি করে?… আর… তাছাড়া ও শা’লা, বাড়িতেও থাকে না। আসলে ও বাড়িতে কেউই থাকে না।… ব্যাটা তো থাকেই না, বাপটাও থাকে না!.. বাপ-ব্যাটা যেমন ডালে-ডালে, পালে-পালে বেড়ায় তাতে কেউ কারো খোঁজ নেয় বলে তো মনে হয় না!…

– দেখা না হলেই ভালো! সেদিন যেভাবে বজ্জাতি করেছিল আমি তো ভয়ই পেয়েছিলাম… কী না কী করে!

– হুম…. ভাগ্যিস ধ্রুব এসেছিল! নয় তো এতদিনে নিউজ পেপারের হেডলাইন হয়ে থাকতে হতো!… খবরের কাগজে বড় বড় অক্ষরে লেখা হতো…”দুই তরুণী…” উফফ!

একটা শ্বাস নেয় অনন্যা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,

– তোর কিন্তু ধ্রুবকে ধন্যবাদ দেয়া উচিৎ।… সে যদি সেদিন ঠিক সময়ে না আসতো কপালে দুঃখই ছিল!…

– রাখ তোর ধ্রুব! তোর ঢং দেখে মনে হচ্ছে ব্যাটা আমাদের ফাইট করে বাঁচিয়েছে!.. ফাইট তো দূর, তুলে নিয়ে যাবার কথা শুনে কী না নিজেই ভয় পেয়ে গেল!.. ধাক্কা মেরে বলে কি না ‘পালাও’? ওভাবে দৌড়ে তো আমরাই আসতেই পারতাম, তার কী দরকার?

– তাহলে আগে দৌড়াস নি কেন? ওর আসা পর্যন্ত দাড়িয়ে কেন ছিলি?… আসলেই তুই একটা অকৃতজ্ঞ!

মুখ ফুলিয়ে প্রতিবাদ করে অনন্যা। কানিজ বিরক্ত হয়ে বলে,

– হয়েছে….বাদ দে তো!…

– হুহ্!

বলেই অন্য দিকে তাকায় ও। কানিজ বুঝতে পারে ওর অভিমানটা কিন্তু কিছু বলে না। সব অভিমানকে পাত্তা দিতে নেই!

___________________________

অনন্যা একা একা হেঁটে যাচ্ছে। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়লো রাস্তার অপর পাশে একটা খাবার দোকান। নাম ‘হাবিব এন্ড সন্স’। আপাত দৃষ্টিতে এই দোকানটার কোনো বিশেষত্ব না থাকলেও অনন্যার কাছে দোকানটার বিশেষ মর্যাদা আছে। হিমু সিরিজের বেশ কয়েকটা জায়গায় ভবঘুরে হিমুর অতি পরিচিত হাবিব ভাইয়ের দোকানের কথা বলা ছিল। সেই হাবিব সাহেব হিমুকে অসম্ভব রকমের ভালোবাসতেন। চরিত্রটি পুরোপুরি কাল্পনিক হলেও অনন্যা এই দোকানটাকে বিশেষ চোখে দেখে। কারণ ধ্রুবকে সে প্রায়ই এই দোকানটায় আসতে দেখে। যেহেতু ও অনেক আগে থেকেই ধ্রুবকে ফলো করে তাই ধ্রুব সম্পর্কে মোটামুটি অনেক খবরই জানে সে। কথায় আছে, তোমার সম্পর্কে একজন গোয়েন্দাও ততোটা জানবে না যতটা জানবে সে, যে তোমায় গোপনে ভালোবাসে। সে হয় তো তোমার সম্পর্কে এমন কিছু জানে, এমন কিছু মনে রাখে যা হয় তো তুমি নিজেও রাখ না।

ধ্রুব সম্পর্কে অনন্যা এতো কিছু জানে না। কারণ ছেলেটা বেশ অদ্ভুদ আর তার চাল-চলনও অন্যরকম। এ পর্যন্ত যতোদিন ওকে ফলো করেছে ততদিনই কোনো না কোনোভাবে ও ওকে হারিয়ে ফেলেছে। ছেলেটা এলোমেলো ভঙ্গিতে হাঁটে। কোথায় যায় আসলেই তার কোনো ঠিক নেই। আর ওর এই স্বভাবটাই অনন্যার বেশি পছন্দের!

দোকানটার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবছিল অনন্যা। মনে মনে এটাও আসা করছিল যেন ধ্রুবকে দোকানটায় পাওয়া যায়! ও যখন দোকানটা প্রায় পার করে ফেলেছে এমন সময় হঠাৎ সত্যি সত্যিই ধ্রুবকে সেখান থেকে বের হতে দেখা গেল!

ছেলেটার পরনে আজ গ্রে কালারের পাঞ্জাবি। সাথে কাঁধে ঝুলানো সেই চিরপরিচিত মান্ধাতা আমলের পাটের ব্যাগ! ধ্রুব দোকানটা থেকে বেরিয়েই আকাশের দিকে তাকালো। পড়ন্ত বিকেলের রোদখানার অবস্থা বুঝতে বুঝতে বাঁ হাতটা চুলে চালিয়ে দিল। সুন্দর একটা ভঙ্গিমায় চুলগুলোকে ব্যাক ব্রাশ করে রাস্তাটা পার হলো।

অনন্যা এতখন হাঁটা থামিয়ে ওকেই পর্যবেক্ষণ করছিল। ও ঠিক কোনদিকে যাবে সেটা বোঝার জন্য সূক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। যখন দেখলো ধ্রুব এদিকেই আসছে তখন ডাক দিলো,

– এই যে ধ্রুব সাহেব!

ডাক শুনেই সোজা সামনের দিকে তাকালো ধ্রুব। যেন সে জানতো অনন্যা এদিকেই আছে! ওকে দেখে সৌজন্যতা করে মুচকি হাসলো অনন্যা। প্রতি উত্তরে তাকেও হাসতে হলো। তাই দেখে ও দাড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করতে লাগলো ধ্রুবের ওই পর্যন্ত আসার জন্য। কিন্তু সে মহাশয় এতই ধীরগতিতে হাঁটছে যে নিজে আর ধৈর্য্য ধারণ করতে পারলো না অনন্যা। উল্টো দিকে হেঁটে দুরত্ব কমিয়ে নিলো। একদম ওর সামনা সামনি এসে দাড়ালো। মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটিয়ে বললো,

– ধন্যবাদ, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ!… সেদিন সঠিক সময়ে আপনি না আসলে খারাপ কিছু একটা হয়ে যেতে পারতো। আমি সত্যিই আপনার কাছে কৃতজ্ঞ!

প্রতি উত্তরে একগাল হাসলো ধ্রুব। অনন্যা আড়চোখে তার সেই মুগ্ধ ময় হাসিটা দেখলো। ছেলেটার হাসিটা এতো সুন্দর কেন ব্যাপারটা ভেবে পায় না ও। যতো বারই দেখে ততবারই মুগ্ধ হয়!

ধ্রুব হাসি থামিয়ে বললো,

– আপনি যেমন ভাবে বিষয়টা নিয়েছেন আমি মোটেই তেমন কিছু করি নি!… শুধু ধাক্কা মেরে বলেছিলাম ‘পালাও’। এটা মোটেই সাহসিকতার কাজ নয়!

– তবুও.. ওই মুহূর্তে ওই উপস্থিত বুদ্ধিটা আমাদের ছিল না। একচুয়ালি ভয়ে কাবু হয়ে পড়েছিলাম। মাথাই কাজ করছিল না। শুধু প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল বদগুলোর উপর!

– আমাদের সমস্যা কি জানেন? কাজের সময় কাজ না করা… যখন যা দরকার আমরা তা করি না… আর ঠিক তাই বিপদে পড়ি!..আমাদের মতোই আমাদের মস্তিষ্কও দরকারের সময় কাজ করা বন্ধ করে দেয়!

বলেই ধ্রুব আবারও হাসলো। সে হাসির দিকে তাকিয়ে অনন্যাও হাসার চেষ্টা করলো। তবে অন্য একটা বিষয়ও নজরে এড়ালো না। সেটা হলো ধ্রুবের ব্যাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে গোল করে মোড়ানো একটা কাগজ। সম্ভবত আর্টপেপার টাইপ কিছু। ও কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

– আচ্ছা, আপনি কি আর্ট করেন? আর্টিস্ট?

প্রশ্ন শুনে ধ্রুবের ভ্রূ জোড়া কুঁচকে এলো। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের ব্যাগের দিকে একপলক তাকালো। বললো,

– জ্বী না। ওসব আর্ট ফার্টে আমার আগ্রহ নেই!… এটা কোনো পোট্রেটও নয়। সাধারণ কাগজ। একটু দরকার হয়েছিল তাই!…

– ওহ্ আচ্ছা।

অনন্যার সন্দেহ তবুও যায় না। ও বেশ স্পষ্ট করেই কাগজের রোলটার ভেতর স্কেচের অংশ দেখতে পাচ্ছে। তাই ধারণা করছে ওখানে কোনো কিছুর ছবি-টবি আছে। তবে ওকে নিরাশ করলো ধ্রুব। হয় তো ও চায় না কাগজটার সম্পর্কে ওকে জানাতে। বিশেষ কারো ছবি হতেই পারে!

#চলবে——-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here