মন_ছুঁয়েছে_সে #পর্বসংখ্যা_৮

#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_৮
#মৌরিন_আহমেদ

ফ্ল্যাটের কলিংবেল টিপে বাসার সামনে দাড়িয়ে আছে ধ্রুব। পাঁচ মিনিট হলো দাড়িয়ে আছে তবুও করিম চাচার পাত্তা নেই। ব্যালকনিতে এসে চাবি নামিয়ে দিলেনও না, আবার দরজাও খুলছেন না। বিরক্ত হয়ে উল্টো মুখ দাড়িয়ে রাস্তাটা দেখতে লাগলো। তখনই নজরে পড়লো একটা ছেলেকে যে কি না এইমাত্র হাইওয়ে ছেড়ে গলির ভেতর ঢুকলো। ছেলেটার চালচলন বেশ দেখার মত। পরনে সাদা রংয়ের একটা টিশার্ট, যার বুকের উপর লেখা ‘d boyz’। তার উপর টকটকে লাল রঙের একটা শার্ট। সাথে একটা জিন্স, যেটার দুই হাঁটুর দিকটায় ছেড়া। গলায় রুমাল পেঁচানো। চুলগুলো জেল দিয়ে স্পাইক করে রাখা।

ধ্রুব খুব সুক্ষ চোখে খেয়াল করলো ছেলেটার মুখে বেশ কয়েকটা কাটা দাগ! বাম ভ্রুটা মাঝখান দিয়ে কাটা। দু’কানে ছোট ছোট ইয়ার রিং। হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। ছেলেটা হাঁটছে আর শীষ বাজিয়ে গান গাইছে। মাঝে মাঝে সিগারেটে টান দিয়ে নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া উড়াচ্ছে।

দেখতে দেখতেই ছেলেটা ওকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলো। এতক্ষণে ধ্রুবর আরেকটা জিনিস চোখে পড়লো আর সেটা হলো ছেলেটা ঠিক ভাবে হাঁটছে না। তার পা দু’খানা টলছে। ঠিক ভাবে পা মেলানোর তালটা না মিলিয়ে এলোমেলো ভঙ্গিতে হাঁটছে। ওর এই ভঙ্গি দেখেই যা বোঝার বুঝে ফেললো ধ্রুব। ওপরের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভেবে ফেললো মুহুর্তেই। চট করে উলটো ঘুরে হাঁটা লাগালো ছেলেটার পেছন পেছন।

ছেলেটা ততক্ষণে অনন্যাদের বাড়ির মোড় টা পাড় করে ফেলেছে। এখন আর তাকে দেখা যাচ্ছে না। ধ্রুব দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করলো। ছেলেটা ডান দিকে যাচ্ছে, মানে বস্তিতে ঢুকবে! এটা ছাড়া তো আর ওদিকে যাওয়ার জায়গা নেই!

অনন্যাদের বাড়ির পেছনে একটা মাঠ। মাঠ বলতে বাউন্ডারি ঘেরা একটা ফাঁকা জায়গা। তারপরেই একটা বস্তি। ঘিঞ্জি ঘিঞ্জি করে টিন দিয়ে তৈরি ঘরগুলো। কোথাও কোথাও শনের চাল-বেড়া। আবার সিমেন্টের বস্তা দিয়েও কোন অংশ মোড়ানো। পুরোপুরি বস্তি এলাকা বলতে যা বুঝায় এটা ঠিক তাই। মুটে-মজুর, সুইপার থেকে শুরু করে শহরের পাতি মাস্তানগুলোর রাত পোহাবার জায়গা।

জায়গাটা একজন ধনী ব্যবসায়ীর। ইফতেখার চৌধুরী। অনন্যাদের বাড়ির ঠিক অপজিটের আলিশান বাড়িটা তারই। বুঝতেই পারছেন, বখাটে ইফতি এই ইফতেখার চৌধুরীরই একমাত্র সন্তান! আর বস্তিতে আশ্রয় পাওয়া উঠতি বয়সের কিশোর-তরুণ গুলো ওই ইফতিরই পোষা চামচা।

ছেলেটা যখন মাঠ পার করছে তখনই নিশব্দে দৌড়ে ওর খুব কাছে চলে এলো ধ্রুব। গলার স্বর নরম করে ডাকলো,

– এই যে ভাই!

ডাকটা হয় তো কানে পৌঁছল না ছেলেটার। কেননা সে তার স্বরে গান গাইছে… ‘পিরিতি কাঁঠালের আঠা, লাগলে পরে ছাড়ে না!’ বেসুরো গলার গান। শুনে খুব বিরক্ত হচ্ছে ধ্রুব। তবুও আবার ডাক দিল,

– এই যে পিরিতি ভাই?

এই ডাকে বেশ কাজ হলো। ছেলেটা অন্যরকম একটা ভাব নিয়ে ঘুরে তাকাল। ওকে দেখেই বেশ কর্কশ কন্ঠে বললো,

– কারে ডাকেন? আমারে?

– জ্বী।

বলেই ছেলেটার দিকে এগিয়ে এলো। খুব স্লো ভয়েজে জিজ্ঞেস করলো,

– আপনার বাড়ি কী ওই বস্তিতে নাকি? ওখানেই যাচ্ছেন?

– হ, ক্যান?

ভ্রূকুটি করলো ছেলেটা। এবার মনে মনে বেশ খুশি হলো ছেলেটা। বললো,

– না.. মানে.. ওখানে কি কোনো ঘর-টর খালি আছে?… আমার আসলে একটা খালি ঘর লাগত…

ছেলেটার দৃষ্টি প্রখর হয়ে উঠলো। ধ্রুবকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বললো,

– ফাইজলামি করেন, মিয়া?.. এতো সুন্দর ফুলবাবু সাইজা বস্তিতে ঘর ভাড়া চান?… আমারে কি মুরগি মনে হয় আপনার? মুরগি?

– আরে ভাই চেতেন ক্যান?.. সত্যিই বলছি আমার একটা ঘরের খুব দরকার।…

তারপর কিছুক্ষণ থেমে আশেপাশে তাকালো। কেউ নেই দেখে ছেলেটার দিকে আরেকটু চেপে গিয়ে কানে কানে বললো,

– বেশি না মাত্র একটা!.. একটু ফাঁকা-টাকা দেখে লাগবে। মাঝে মাঝে এসে একটু রাতটা থাকবো.. এই..

– মাইয়া আনবেন না কি?… রেট কইলাম তাইলে বেশিই পড়বো!

বলেই বিশ্রী ভাবে হাসলো ছেলেটা। ধ্রুব কিছু না বলে লাজুক ভাবে মাথা চুলকালো। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আবারও হাসলো ছেলেটা। ধ্রুব লাজুক চোখে বললো,

– আছে না কি ঘর?

– আছে মানে? আমাদের ওইখানে ওইরকম ম্যালা ঘর পাইবেন!.. ম্যালা মাইনষে আসে, খালি একটু খরচা করন লাগে.. আপনে চাইলে মাইয়ার ব্যবস্থাও করা যাইবো!..

– তাহলে তো খুবই ভালো হয়!
ধ্রুবকে খুবই খুশি খুশি লাগে। সে হঠাৎ আরো একটা প্রশ্ন করে বসলো,

– ভাই, মা’ল-টাল পাওয়া যাবে?

– কি যে কন না, ভাই! আপনে হইলেন কাস্টমার, যা চাইবেন তাই পাইবেন। দেশি-বিদেশি দুইটাই আছে.. দেশিটা এইখানেই বানায় আর বিদেশি টা বাইরে থেইকা আনাই… চলবে না?

– চলবে মানে? দৌড়াবে!.. চলেন ঘর দেখে আসি!..

– ঠিক আছে, চলেন!

দুজনই সানন্দে বস্তির ভেতরে ঢুকে যায়। ধ্রুব জানতে পারে ছেলেটার নাম মালেক। বস্তির তত্ত্বাবধায়ক সে। কাউকে নতুন ঘর ভাড়া দেয়া, ভাড়া তোলা, বস্তিবাসীর সব সমস্যা সমাধানের হরফন-মৌলা সে! মানে সকল কাজের কাজি!

______________________________

ক্যাম্পাসের গেটে দাঁড়িয়ে আছে অনন্যা। অপেক্ষা করছে কানিজের জন্য। সেদিনের পর আজই ভার্সিটির দিকে আসলো ও। তাই কোনোভাবেই চাচ্ছে না ইফতিদের সামনে পরতে! অনন্যা হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল। ক্লাস শুরু হওয়ার এখন সাত-আট মিনিট বাকি আছে। অথচ এখনও কানিজ লাপাত্তা!

ওর জন্য উৎসুক হয়ে রাস্তার দিকে তাকালো অনন্যা। ওই তো ওকে দেখা যাচ্ছে! আজ ও মেরুন রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে। কাঁধ থেকে ঝুলতে থাকা সাইড ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে দৌড়ের ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে। অনন্যা ডাক দিল,

– এ্যাই! এ্যাই কানিজ!

ডাক শুনে কানিজ এদিক ওদিক তাকিয়ে ওকে খুঁজলো। সেটা দেখে বিরক্ত হলো ও। যেদিক থেকে ডাকছে সেদিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে তাকাচ্ছে কেন মেয়েটা? উফ্! আবারও ডাকলো,

– কানিজ!

এবার ওকে দেখতে পেলো কানিজ। ছুটে এসে ওর সামনে দাড়ালো। হাঁফাতে হাঁফাতে বললো,

– সরি সরি, অনেক দেরি করে ফেলেছি!.. বিশ্বাস কর, আমি আগেই আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু এই ঘুমটার জন্য সব হয়েছে!.. আচ্ছা, ক্লাসের কি সময় আছে?

– রিলাক্স, কানিজ! এখনও ছয়-সাত মিনিটের মতো আছে।.. ধীরে ধীরে হেঁটেই যেতে পারবো। হাইপার হোস্ না!…

– পানি আছে? দিতে পারবি?

অনন্যা কিছু না বলে নিজের হ্যান্ড ব্যাগটা থেকে পানির ছোট্ট বোতলটা বের করলো। ও সেটা হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে বললো,

– thanks…. দৌড়িয়ে গলা শুকিয়ে গেছে!

পানি খেতে খেতেই হাঁটা শুরু করলো কানিজ। অনন্যাকে একবার বললোও না এগোতে। ভাবটা এমন যে দেরিটা ও না অনুই করেছে! অনন্যা পিছন থেকে ডাক দিলো,

– এ্যাই, আমায় রেখে কোথায় যাচ্ছিস?

– ওহ্, সরি সরি!.. আয় আয়, তাড়াতাড়ি আয়। ক্লাসের দেরি হয়ে যাবে তো!

– নিজে দেরি করে এসে ঢং! হুহ!

বিড়বিড় করতে করতেই ছুটে যায় অনন্যা।

কাল ধ্রুবের সাথে দেখা হয়েছিল কথাটা বলতে চায় না অনু। তবুও বলে ফেলতেই হয়। আসলে ব্যাপারটা নিয়ে কানিজ যতোই হাসি-ঠাট্টা করুক, তবুও ওকে সবটা জানাতে না পারলে অনুর ভালো লাগে না। জানে-জিগার দোস্ত বলতে বুঝি এমনই বুঝায়!

– উফফ, অনু!… তুই যে কি আমি না বুঝতে পারি না।… এই সামান্য ব্যাপারটা নিয়ে তবুও তোর হিমুর সাথে কথা বলতে হলো? যেখানে ছেলেটা কিছুই করলো না… তারপরও এতো আদিক্ষেতা দেখানোর কোনো দরকার ছিল? really, you are too much!

– তুই এমন করিস কেন, কানিজ? তুই কেন বুঝতে চাচ্ছিস না ছেলেটাকে আমি ভালোবাসি? ওকে আমার অসম্ভব রকমের ভালো লাগে!.. try to understand..i love him!

– অনু, তুই যত সহজে ‘ভালোবাসি’ কথাটা বললি… জীবনটা আসলেও তত সোজা নয়!… যাকে তুই চিনিস না, যার সম্পর্কে কোন এক্সজেক্টইনফরমেশন তোর কাছে নেই, তাকে তুই এতো তাড়াতাড়ি ভালোবেসে ফেললি কি করে?…

– একটা কথা কি জানিস? ভালোবাসতে কারণ লাগে না। সম্পর্ক, উঁচু-নিচু, জাত-পাত জানার প্রয়োজন হয় না। প্রকৃতিগত ব্যাপার, আপনা-আপনিই হয়ে যায়।… ধ্রুবকে আমি ভালোবাসি। সে আমায় নিয়ে ভাবে কী না ভালোবাসে কিনা তা আমি জানি না। জানতেও চাই না। আমি শুধু তাকে ভালোবাসতে চাই!….

অনন্যার কাব্যিক ধরণের কথা গুলো শুনে চরম বিরক্ত হয় কানিজ। ও বুঝতে পারে এগুলো নিয়ে ওর সাথে কথা বলাই বেকার। এই মেয়ে প্রেমে অন্ধ হয়ে গেছে! ভালো মন্দ কিচ্ছু বুঝছে না!

#চলবে—-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here