মম চিত্তে পর্ব -১৪+১৫

#মম_চিত্তে
#পর্ব_১৪
#সাহেদা_আক্তার

ফেরদৌসী শর্তের কথা জানতে চাইলেন। মম বলল, আমার দুটো শর্ত। প্রথম শর্ত হচ্ছে ঘরোয়াভাবে বিয়ে হতে হবে। বাইরের কাউকে বিয়ের ব্যাপারে জানানো যাবে না। আমি চাই না সবাই এটা বলুক যে অফিসে জয়েন করেই অফিসের বসকে হাত করেছে। কথার অনেক হাত পা গজায়। আর দ্বিতীয় শর্ত হলো আব্বু সুস্থ হওয়া পর্যন্ত আমি আব্বুর সাথে থাকবো। তিনি কিছুক্ষণ ভেবে হেসে বললেন, বেশ। তবে সারাজীবন তো এই দুই শর্ত মানা যাবে না। এক সময় তো সবাই জানবে।

– অন্তত তিন মাস।

– আচ্ছা। আমি সবাইকে বলে দেবো। এখন বলো শাড়ি গয়না কেমন লেগেছে। এগুলোয় হবে?

– জ্বি। ঘরোয়া বিয়েতে এত বেশি সাজের তো প্রয়োজন হবে না।

– ওমা! আমার ছেলে দেখবে না ওর বউকে কেমন লাগে বিয়ের সাজে!

মম লজ্জা পেল। তিনি মমকে নিয়ে এসে বসলেন কেবিনের ভেতর। রায়হান সাহেব তাঁদের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝতে পারলেন না৷ ভয়ে ভয়ে আছেন বিয়েটা হবে কি না। রাকিব হাসান বললেন, বিয়ের ডেটটা ঠিক করবেন কবে? কথাটা শুনে রায়হান সাহেবের বুক থেকে একটা বড় পাথর নামল। তাহলে বিয়েটা হচ্ছে। তিনি বললেন, ভালো কাজ যত তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা যায়৷

– তাহলে আগামী শুক্রবার?

– আমার কোনো আপত্তি নেই।

মম চুপ করে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু বলতে পারল না রায়হান সাহেবের কথা ভেবে। সবাই সবার মতো গল্প করছে। ও একটু পর বেরিয়ে এল বাইরে। বসল কেবিনের বাইরের চেয়ারগুলোয়। যদিও শর্তে রাজি হয়েছেন তবুও ভেতরে অস্বস্তি লাগছে। বিয়ের কথা বলছে মানে রিয়ান রাজি বিয়েতে। ও কি সব জেনে পছন্দ করেছে!? নাকি রনকের মতো সবার চাপে পড়ে বিয়েটা করতে চাইছে? তাছাড়া ফারিজা যে বলল ও রিয়ানের হবু বউ এটা কতটুকু সত্যি!? সবাই রায়হান সাহেবের কাছে আছে দেখে মম বেরিয়ে গেল অফিসের উদ্দেশ্যে।

রিয়ান ওর রুমে বসে আছে। মম ব্যাগ রেখে সোজা ওর রুমে রওনা দিল। কথা বলা দরকার। রুমের কাছে আসতেই ফারিজা বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। ওকে বলল, কোথায় যাচ্ছো? মম প্রতিউত্তরে বলল, দেখতেই তো পাচ্ছেন স্যারের রুমের দিকে যাচ্ছি। মম এগিয়ে যেতে লাগলে ফারিজা আবার বাঁধা দিয়ে বলল, যাওয়া যাবে না।

– কেন?

– তোমার এক্সেস নেই।

– কে বলেছে আমার এক্সেস নেই? ক’দিন আগেও তো…

– ক’দিন আগের কথা চলে গেছে। এখন তোমার প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

– তাই? লেট মি সি।

মম তার কার্ড দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল আসলেই মেশিনে নট এলাউড দেখাচ্ছে। ওর ব্যাপারটা বেশ বিরক্ত লাগল। ফোন বের করে রিয়ানের নাম্বার খুঁজে নিল। হুট করেই একদিন ওর নাম্বারে ফোন দিয়ে কথা বলেছিল ওর সাথে। রায়হান সাহেবের খবর নিয়ে বলেছিল সাহায্য লাগলে এই নাম্বারে ফোন করে জানাতে। তখনই সেভ করেছিল।

ফোন দিয়ে রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল মম৷ কাচের দেয়াল দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভেতরে রিয়ান একটা ফাইলের দিকে ঝুঁকে আছে। ফোন বাজতেই না দেখে ফোনটা রিসিভ করে কানে দিয়ে বলল, হ্যালো, মি. রিয়ান বলছি।

– ফোন রিসিভ করার আগে যে কে ফোন দিয়েছে তা দেখতে হয় জানা নেই?

– ওহ, সরি সরি। হ্যাঁ বলুন মিস মম।

মম চাপা গলায় বলল, মিস থেকে যখন মিসেস করছেন তো দরজায় এক্সেস বন্ধ করেছেন কেন? রিয়ান বলল, আপনার তো এক্সেস আছে। মম বাইরে থেকে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, যদি থাকে আমি কি সাধে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি? রিয়ান বাইরে তাকিয়ে দেখল মম ফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ও দ্রুত কম্পিউটারে এক্সেস প্রোগ্রামে ওর নাম ইন্ট্রি করে বলল, আসুন ভেতরে। মম আবার মেশিনে কার্ড দিতে লাগলে ফারিজা বলল, যাকেই ফোন দাও না কেন ভেতরে এক্সেস করতে পারবে না। ও কার্ড দিতে যখন দরজা খুলে গেল তখন ফারিজার দিকে ফিরে বলল, যেখানে মালিক এক্সেস দিয়েছে সেখানে অন্য কাউকে ফোন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বলে মম ভেতরে চলে গেল।

চেয়ারের কাছে আসতে রিয়ান বলল, বসুন। মম চেয়ারে বসে বলল, বিয়ের আগেই রুমে ঢোকার অনুমতি বন্ধ করে দিয়েছেন!? বিয়ের পর কি করবেন? রিয়ান হাতের ফাইল টেবিলে রেখে বলল, আমি এক্সেস বন্ধ করিনি।

– তাহলে বলতে চাইছেন আপনার কম্পিউটার নিজে নিজে কাজ করে?

– তা নয়। মনে হচ্ছে কেউ আমার কম্পিউটারে হাত দিয়েছে। আচ্ছা, আমি দেখছি। বাই দ্যা ওয়ে, ফোনে যে বললেন মিস থেকে মিসেস করছি বলতে কি বোঝালেন?

– আপনার বাবা মা আমাদের বিয়ের ডেট ফাইনাল করেছেন।

– আপনি তো বিয়েতে রাজি নয়। বলেননি কেন? আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি এখুনি ফোন দিয়ে বলছি।

রিয়ান ফোনে হাত দিতেই মম বাঁধা দিয়ে বলল, অনেক কিছু ইচ্ছের বিরুদ্ধে করতে হয়। তা আপনি বলুন তো একজন ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি কেন হলেন? ও চুপ করে রইল। মম যে ডিভোর্সি এটা ওর জানা ছিল না। ওকে চুপ থাকতে দেখে বলল, জানতেন না তো আমি ডিভোর্সি? একমাস অন্যের ঘরে ছিলাম। তার পরকিয়া সম্পর্কটা শেষ করে দিয়েছে। এবার আপনি সিদ্ধান্তে নিন। মম উঠে যাচ্ছিল ; রিয়ান বলে উঠল, আমি আপনাকে যেতে বলিনি মিস মম। মম ওর দিকে তাকাল। মুখ কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। মমও চুপ করে বসে রইল ওর দিকে তাকিয়ে।

– আপনি কি বিয়েটা ভাঙার জন্য ডিভোর্সের ব্যাপারটা সামনে আনলেন?

– আপনার তাই মনে হচ্ছে? আমার তো তা মনে হচ্ছে না। এখানে কেবল আমি বিয়ে করছি না। আপনিও করছেন। আপনার জানাটাও জরুরি। সমাজে ডিভোর্স শব্দটা মেয়ের জীবনে একটা কালো ক্ষতের মতো। যা সারাজীবনেও ভালো করা যায় না। ডিভোর্সি জানলে ছেলেরা একশ কদম পিছিয়ে যায় বিয়ে থেকে। তাই জানতে এসেছিলাম আপনি কেন রাজি হলেন।

– আমার দাদি কখনো কারো জন্য খারাপ কিছু পছন্দ করেনি। তাই আমার বিশ্বাস আপনিও তেমন হবেন।

– তাই বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলেন!?

– আমার আপনাকে পছন্দ হয়েছে মিস মম।

হঠাৎ রিয়ানের এমন কথা মম আশা করেনি। কি আশা করেছিল তাও বেমালুম ভুলে গেল এই কথাটার পর। কি বলবে কিছু বুঝতে না পেরে বোকার মতো তাকিয়ে রইল ওর দিকে। রিয়ান হেসে বলল, এর থেকে বড় কারণ আর কি হতে পারে বিয়েতে রাজি হওয়ার? মম প্রতিউত্তরে কিছু খুঁজে পেল না। বাইরে ফারিজা উঁকিঝুঁকি মারছে এবং সেটা মমর চোখে পড়তে রিয়ানকে জিজ্ঞেস করল, মিস ফারিজার ব্যাপারে কি ভাবেন?

– ওর ব্যাপারে কি ভাববো? ওর এককালে আমার ভার্সিটিতে ক্লাসমেট ছিল। ভার্সিটি লাইফ শেষ হওয়ার পর এই অফিসে এপ্লাই করল আমার পিএ পোস্টের জন্য। হয়েও গেল। ভালোই কাজ করে মেয়েটা।

– এর বাইরে আর কিছু নেই?

রিয়ান ওর দিকে তাকিয়ে বলল, আর কি থাকবে? মম বলল, কিছু না। মনে মনে বলল, মিথ্যা কথা ভালোই রটাতে পারো মিস ফারিজা। একটা ছোট শাস্তি তো তোমার প্রাপ্য মিথ্যার জন্য। ফারিজা তখনো বাইরে থেকে দেখছে ওদের। মম হঠাৎ উঠে গিয়ে রিয়ানের চেয়ারটা ঘুরিয়ে চেয়ারের দুই হাতলে হাত রেখে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ল। কিছু বুঝে ওঠার আগে রিয়ানের ডান গালে একটা কিস করে বসল। ওর এমন আচরণে কিছুটা অবাক হয়ে গেল রিয়ান। মম উঠে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে ফিরে বলল, সবকিছুর একটা কারণ থাকে। বলে লজ্জায় বেরিয়ে গেল।

বাইরে এসে ফারিজার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল। তখনো ওর লজ্জায় কান লাল হয়ে আছে। মম কিছু না বলে নিজের টেবিলের দিকে রওনা দিল। ফারিজা যে রাগে কাঁপছিল সেটা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারল। কিন্তু পাত্তা দিল না। এটা একটা ছোট শাস্তি মাত্র। কাউকে ভালোবাসলে তাঁকে নিজের কাছে রাখার জন্য মিথ্যা রটনা করা কতটা যুক্তিযুক্ত? ভাগ্যে না থাকলে কি সত্যিই জোর করে ভালাোবাসার মানুষকে পাওয়া যায়?

মম টেবিলে বসতে তৌসিফা জিজ্ঞেস করল, কেমন আছিস? মম কম্পিউটার ওপেন করতে করতে বলল, ভালো। আচ্ছা কালকে যে রিপোর্টটা করতে বলেছিল মিটিংয়ে করেছো? আমার লাগবে কাগজগুলো। তৌসিফা ওকে রিপোর্ট বুঝিয়ে দিতে লাগল। মম মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনছিল। তাই খেয়াল করেনি ফারিজা প্রায় বিশটার মতো ফাইল এনে ওর টেবিলে সজোরে রাখল। দুইজনে শব্দ শুনে ওর দিকে তাকাল। ফারিজা নকল হাসি দিয়ে বলল, এই ফাইলগুলো শেষ করো আর আমাকে রিপোর্ট জমা দাও আজকের মধ্যে। আর যে স্বপ্ন দেখছো সেই স্বপ্ন ভুলে যাও। তোমাকে যাতে স্যারের আশেপাশে না দেখি। না হলে এই চাকরি তোমার আর করা হবে না। বলে ফারিজা চলে গেল। তৌসিফা কিছু না বুঝে মমকে জিজ্ঞেস করল, কি হলো বলো তো!? মম ফাইলগুলো দেখতে দেখতে বলল, হিংসেতে জ্বলছে। পোড়া গন্ধ পাওনি? তৌসিফা ওর কথায় মুখ চেপে হাসতে লাগল। মম ফাইল গুলো দেখা শেষ করে বলল, এগুলো কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফাইল না। অযথা দিয়ে গেল। এইগুলোর কোনো কাজই নেই এখন। শুধু শুধু আমার টেবিলটা জ্যাম করলো। মম একটা চেয়ার এনে তাতে ফাইলগুলো রেখে নিজের কাজ করতে লাগল।

দুপুরে রিয়ানের রুম থেকে ডাক পড়ল। মম কি করবে বুঝতে পারল না। ওর সামনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। লজ্জায় ডুবে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কি ভেবে যে কাজটা করল! মাথায় যা এসেছিল তা করে এখন পস্তাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে কাজ করতে লাগল আর নিজে নিজে বিড়বিড় করতে লাগল। সবাই খেতে চলে গেছে আরো দশ পনের মিনিট আগে। ও একলা বসে কাজ করতে লাগল। কাঁধে কারো অস্বস্তিকর স্পর্শ পেয়ে চেয়ার সরিয়ে তাকিয়ে দেখল রাসেল ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। মমর ভেতরে ভেতরে মেজাজ খারাপ হলেও বাইরে বলল, কিছু বলবেন?

– খেতে যাবে না?

– জ্বি কাজ শেষ করে।

– তাহলে তো দেরি হয়ে যাবে। চলো আজকে আমার পক্ষ থেকে তোমার ট্রিট।

মম একটা ফাইল হাতে নিয়ে বলল, সরি, স্যার আমাকে ডেকেছিল। ভুলে গিয়েছিলাম। আসি। ও সরে চলে এল রিয়ানের রুমে সামনে। রাসেলের কথা বলবে কি না ভাবতে ভাবতে রিয়ানের রুমে প্রবেশ করল। ঢুকে রিয়ানের দিকে তাকাতে আবার তখনের কথা মনে পড়ল। রিয়ান ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, এতক্ষণে আসার সময় হলো? কখন লাঞ্চ নিয়ে বসে আছি! এসো, বসো। মম নিচের দিকে তাকিয়ে চেয়ারে বসল। রিয়ানের টোল পড়া হাসিতে ও লজ্জায় আগা গোড়া লাল হয়ে গেল। ওর কোনো রেসপন্স না দেখে রিয়ান বলল, আমি কি খাবার বেড়ে দেবো?

– না না না। আ…আমি দিচ্ছি।

মম প্লেট টেনে নিয়ে খাবার বেড়ে রিয়ানকে দিল। রিয়ান আবার হেসে বলল, আমি তো আপনার কথা বলেছিলাম আর আপনি আমাকে খাবার বেড়ে দিলেন? এখন থেকে প্র্যাকটিস করছেন? গুড গুড। মমর কান দিয়ে ধোঁয়া বের হতে লাগল। রিয়ান আবার বলল, চামুচগুলো দিন তো। মম অন্যদিকে তাকিয়ে এগিয়ে দিল। ও চামুচ নিয়ে খাওয়া শুরু করে বলল, আপনাকে লজ্জা পেলে ভালোই লাগে দেখতে। মম খাবারটা বেড়ে মাত্র খাওয়া শুরু করছিল। ওর কথা শুনে বাম হাত দিয়ে জামা খামচে ধরে বলল, আপনি কি আমাকে খেতে দেবেন না আমি উঠে যাবো?
#মম_চিত্তে
#পর্ব_১৫
#সাহেদা_আক্তার

– সরি সরি। খেয়ে নিন। আপনার সাথে কিছু কথা আছে মিস মম।

– কি নিয়ে?

– আগে খেয়ে শেষ করুন তারপর বলছি।

দুইজনই চুপচাপ খাওয়া শেষ করলো দ্রুত। রিয়ান জিজ্ঞেস করল, চা কফি? মম না করে দিয়ে বলল, বলুন কি বলবেন। রিয়ান এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে বলল, মিস ফারিজা বলেছে আপনি নাকি কাজ ঠিকমতো করছেন না। ফারিজার কথা শুনে মমর মুখ অন্যরকম হয়ে গেল। ও বলল, হঠাৎ এই কথা কেন বলল?

– তার অভিযোগ আপনি তাকে দিয়ে মাঝে মধ্যে কাজ করান। তার দেওয়া ফাইলের কাজ না করে নাকি আপনি নিজের কাজ করছেন।

– প্রথমত আমি নিজের কাজ নিজে করতেই পছন্দ করি। তাই তাকে দিয়ে কাজ করানোর কোনো মানে হয় না। আর যে ফাইল গুরুত্বপূর্ণ সেটির কাজই তো আগে করব। তাই না? সে আমাকে কয়েকমাস আগের অসমাপ্ত ফাইল ধরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমার যতদূর মনে হয়েছে নতুন ডিলের কাজগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি ওগুলো রেখে আগে এই কাজগুলো শেষ করতে চেয়েছি।

রিয়ানের কফি এসে গেল। ফারিজার উপস্থিতি টের পেয়ে রিয়ান খাওয়ার আগেই মম কাপটা হাতে নিয়ে এক চুমুক দিয়ে দিল। সাথে সাথে গরম কফি ওর ঠোঁট পুড়ে গেল। কিন্তু রিয়ানকে বুঝতে না দিয়ে বলল, বেশি গরম৷ আস্তে খাবেন।

– তা না হয় বুঝলাম। আপনার গরম লাগেনি? আগে বলতেন, দুই কাপ আনাতাম।

– না…… ঠিক আছে। আমি কাজে যাই।

বের হতেই ফারিজার চোখ গরম করা দৃষ্টি ওকে গিলতে লাগল। ও একটু হাসি দিয়ে কড়াইয়ে তেল গরম করতে লাগল। তেলটা গরম হলেই তো মাছটা ভাজা যাবে।

রিয়ানদের বাড়িতে বিয়ের আমেজ। আর দুটো দিন পরই বিয়ে। হাতে অনেক কাজ। দুপুরে খাবার টেবিলে বিয়ের কথা বলতেই সবাই আলোচনায় বসে গেল কে কি পরবে, কে কি করবে, খাবারের মেনু কি হবে এসব নিয়ে। ঘরোয়া বিয়ে হবে শুনে প্রথমে আনন্দে ভাটা পড়েছিল। পরে সবাই নিজের মতো ব্যাপারটা গুছিয়ে মেনে নিল। এই ঘরোয়া অনুষ্ঠানে যতটুকু আনন্দ করা যায় তার সবটাই ওরা করবে। ভাইবোনগুলো বিকালেই শপিংয়ে বেরিয়ে গেল। ফিরল দশটার পর। খাওয়া দাওয়া সেরে আড্ডা দিতে লাগল। রিয়ান অফিস থেকে ফিরতেই ঘিরে ধরল সবাই। টিজ করতে লাগল এটা ওটা নিয়ে।

রাতের সাড়ে বারোটা বাজে। নিচে এখনো হাসাহাসির আওয়াজ কানে আসছে। ফেরদৌসী শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রাকিব হাসান বই পড়ছেন বিছানায় হেলান দিয়ে। ফেরদৌসী মাথার চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললেন, আমার কত স্বপ্ন ছিল ছেলের বিয়েটা ধুমধাম করে দেবো। কিন্তু মেয়েটা দিল না।

– তাহলে কি বিয়ে ক্যান্সেল করে দেবো!?

– আমি তা বলিনি। কিন্তু এতো মেয়ে থাকতে ঐ মেয়ে কেন? আরো তো কত ভালো ভালো মেয়ে আছে।

– তুমি আম্মাকে চেনো ফেরদৌসী। আম্মার উপর নিশ্চয়ই তোমার আস্থা আছে।

– তা আছে। আম্মা কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেননি জানি। মমকে আমারও ভালো লাগেনি যে তা নয়। মেয়েটা নম্র ভদ্র, রান্না, ঘর গোছানো সব পারে। দেখতেও ভালো। কিন্তু…

– তোমাকে কি ডিভোর্সি শব্দটা ভাবাচ্ছে?

ফেরদৌসী কিছু বললেন না। রাকিব হাসান বইটা রেখে চশমা খুলে বললেন, মেয়েটার কি দোষ এতে!? সে কি ইচ্ছে করে ডিভোর্স দিয়েছে? রায়হান সাহেবের কাছে সবটাই শুনেছি আমি। দোষ তো মেয়েটার ছিল না। ছিল ছেলেটার। কিন্তু আমাদের সমাজের ট্রেন্ড হয়ে গেছে সব সময় মেয়েদেরকে দোষী বানানো; দোষ ছেলের হোক বা তার নিজের৷ এটা নিয়ে ভেবো না। আর ঘরোয়া বিয়ের সিদ্ধান্তটা আমি মনে করি ভেবেই নিয়েছে মম। এখন যদি বিয়ের কথা সত্যিই সবাই জানে, ওকে গোল্ড ডিগার বলতে এক মুহুর্ত সময় নেবে না। ছেলের বউকে নিশ্চয়ই অসম্মানিত হতে দিতে চাইবে না তুমি। ফেরদৌসীর মাথার চুল বাঁধা শেষ। উনি এসে তাঁর পাশে বসে কাঁধে মাথা রেখে বললেন, আমার ছেলেটা ভালো থাকলেই হলো। আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।
.
.
.
.
রায়হান সাহেবকে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে। তাঁর অবস্থা ভালো। তাই বেশিদিন রাখতে হয়নি হাসপাতালে। এসেই কাজে লেগে পড়তে চাইলেন। মম বাঁধা দিয়ে বলল, সব কাজ করা হয়ে গেছে আব্বু। তুমি শান্ত থাকো। তোমাকে বিশ্রাম নিতে বলা হয়েছে। তুমি রুমে চুপচাপ বিশ্রাম করবে। ঠিক আছে?

– আমার মেয়ের বিয়ে আর আমি শুয়ে বসে থাকব?

– হুম থাকবে।

বর্ষার ডাক পড়ল রান্নাঘর থেকে। মম বেরিয়ে চলে গেল রান্নাঘরে। আজকে ওর বিয়ে। মমর ভেতরে কোনো উত্তেজনা কাজ করছে না। হবার কথাও নয়। দ্বিতীয় বিয়ে বলে নয়। প্রথম বিয়েতেও ভয় করেনি, হাত পা কাঁপেনি। না হয়েছে উত্তেজনা। ভালোবাসার মানুষ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর যখন অন্য কারো সাথে বিয়ে হয় তখন এসব হওয়ার কথা ভাবতেই পারেনি মম। মনটা ঘৃণায় পাথর হয়েছিল। আজও বিয়েটা বাবার কথা রাখতেই করা। ভালোবাসা শব্দটা কেমন যেন বিকৃত হয়ে গেছে ওর কাছে। ও রান্নাঘরে গিয়ে দেখল মাধুরী খালা আর বর্ষা মিলে অর্ধেক রান্না করে ফেলেছে। পঁচিশ ত্রিশ জনের রান্না। মম হাত লাগাতে যাচ্ছিল। বর্ষা মানা করে দিয়ে বলল, তুই না কনে? রান্নায় হাত দিচ্ছিস কেন? তোকে ডেকেছিলাম আর কি রান্না করা লাগবে সেজন্য। মম ওকে বলল, তাহলে তো তোমাকে আগে কাজ করতে দেওয়া উচিত না। তুমি না প্রেগনেন্ট?

– আরে, এখন তো কাজ করতেই পারব। সমস্যা হবে না আমার। এখন বল আর কি রান্না করা লাগবে।

– যা করছো তাও এনাফ।

– তাহলে সুন্দর করে গোসল সেরে নে। দুপুর তো হতে চলল। সবাই চলে আসবে।

মম নিজের রুমে চলে এল। আলমারি থেকে কাপড় নিতে গিয়ে কোটটার দিকে নজর পড়ল। প্রত্যেকবার কাপড় নেওয়ার সময় চোখ পড়ে। আজকেও পড়ল। কোটের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগল, রিয়ান জানতে চাইলে কি বলবে!?

বারোটার দিকে কলিংবেল বাজল। বৃষ্টি ভেবেছিল বরযাত্রী এসে গেছে। খুলে দেখল আদ্রিতা এসেছে প্রিয়ান্তুকে নিয়ে। বর্ষা ওকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল, তুমি একলা? বাকিরা কোথায়?

– বাকিরা আরো পরে আসবে। আমি আগে আগে চলে এসেছি। কনে কোথায়?

– রুমে, গোসল করছে। তুমি আসো।

– হুম গিয়ে বসি ওর রুমে।

বৃষ্টি প্রিয়ান্তুকে কোলে নিল। আদ্রিতা মমর রুমে গিয়ে বসল। মম বের হচ্ছে না দেখে বিছানায় বসে ফোন টিপতে লাগল। হঠাৎ ওর পাশে কিছু একটার উপস্থিতি টের পেয়ে পাশে তাকিয়ে চমকে উঠে ছোটখাটো একটা চিৎকার মারল। বর্ষা তাড়াতাড়ি এসে বলল, কি হয়েছে?

– বিড়াল।

– ও, নিনি? তোমাকে ভয় দেখিয়েছে?

– নিনি কে? বিড়ালটা?

– হ্যাঁ, মমর বিড়াল। আদর করে নিনি ডাকে।

– ঐদিন তো দেখিনি। সেরেছে; আজকের জন্য ওকে এই বাসা থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যান।

– কেন?

– আমার ভাইয়ের বিড়ালে এলার্জি। বিয়েতে হাঁচতে হাঁচতে বিয়ে না করেই চলে যাবে।

– আচ্ছা আমি দেখছি।

বর্ষা নিনিকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তখনই মম বের হলো ওয়াশরুম থেকে। ওকে দেখে মাথার চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বলল, কাউকে দেখছি না যে? শুধু তুই এলি!?

– এলাম আর কি। আমার বান্ধবীর বিয়ে বলে কথা। আগে আগে চলে এলাম তাই। বোস তো।

মমকে পাশে বসিয়ে বলল, হলুদ দিয়ে গোসল করলি নাকি? সুন্দর সুন্দর লাগছে। মম হালকা লজ্জা পাওয়া স্বরে বলল, তোকে বলেছে……

– দেখ, দেখ গাল লাল হয়ে গেছে। এখন আমার ভাইটা থাকলে কি যে ভালো হতো!

– ওই চুপ কর তো। খালি ফাইজলামি। প্রিয়ান্তু কোথায়?

– বৃষ্টির কাছে। বসার রুমে।

– ও।

মম চুল ছড়িয়ে দিয়ে ফ্যানের নিচে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এক মনে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর প্রাক্তনের বউ ওর পাশে বসে আছে। ভাবতেই হাসি পেল ওর। আদ্রিতা দেখে জিজ্ঞেস করল, হাসছিস যে? মম ওর দিকে না তাকিয়ে বলল, এমনি। একটা হাসির কথা মনে পড়েছিল তাই। আচ্ছা আদ্রি, তুই কি জন্য আমাকে তোর ভাইয়ের জন্য পছন্দ করলি?

– আমি কিছু করিনি। উপর থেকে কানেকশান দিয়ে দিয়েছে আমি শুধু সাহায্য করছি।

এবার মম ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কি কানেকশান? আদ্রিতা রহস্য করে বলল, সিক্রেট কানেকশান। পরে জানতে পারবি। এখন উঠ। সবাই চলে আসবে। তোকে তৈরী করে দেই। রেডি হতে হতে চুল শুকিয়ে যাবে।

বলতে না বলতে দরজার কলিং বেলের আওয়াজ কানে এসেছে। বর যাত্রী এসে গেছে। বৃষ্টি এসে রুমের দরজা মেরে দিয়ে বলল, সবাই তোকে তৈরী করে নিতে বলেছে। নামায পড়ে আসলেই বিয়েটা হয়ে যাবে। মম উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আজকে আবার মুক্ত পাখি বন্দি হতে চলেছে। এবার কি করবে? সোনার খাঁচায় সোনার শিকল পরিয়ে গান গাইতে বলবে নাকি এখনের মতোই আকাশে উড়ে গান গাইতে দিবে? ভাবতে ভাবতে চুপচাপ বারান্দা থেকে গিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। বেসিনে মুখ ধুতে গিয়ে হুট করে কেমন কান্না পেল। বাবাকে ছেড়ে মোটেই যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু তিনিই তো ওকে রাখতে চাইছেন না। এত বড় মেয়ে বাড়িতে থাকলে নাকি নানা লোক নানা কথার মেলা বসাবে।

মম মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এল। বর্ষা সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দিল। শাড়িটা বেশ ভারি। গায়ে জড়াতেই ভার অনুভব হলো। এই ভার একটা সংসারের। অনেক বড়ো দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেওয়ার। আগেরবার এটা মাথায় আসেনি। এখন মম জানে খুব ভালো করে।

শাড়ি পরানো শেষে বৃষ্টি মেকআপ করাতে বসল। গাঢ় খয়রী শাড়িটার সাথে মিলিয়ে ওকে সাজিয়ে দিল সুন্দর করে। এর মাঝে শেম্পু করা চুলটাও শুকিয়ে গেছে। আদ্রিতা ওর মাথায় সুন্দর করে একটা খোঁপা বেঁধে দিল। সাজ কমপ্লিট হয়ে গেলে গয়না পরানো শুরু করল। এর মাঝেই বাইরে বেশ কথা শোনা যাচ্ছে। ছেলেরা জুম্মার নামায থেকে চলে এসেছে। শব্দ শুনে বর্ষা আর বৃষ্টি রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নাস্তার আয়োজন করতে হবে। মাধুরী খালাকে হেল্প করতে হবে হাতে হাতে। আদ্রিতা মমর কাছে বসে রইল।

কিছুক্ষণ পর নিক্কণ আর তুলি ভাবি এসে রুমে ঢুকল৷ ওকে দেখে তুলি ভাবি বলল, মা শা আল্লাহ, কত সুন্দর লাগছে তোমাকে! নাবিল তুলিভাবির কোলে ছিল। সেখান থেকে তাঁর কথা শুনে বলল, তুদর। আদ্রিতা জিজ্ঞেস করল, এনেছো? তুলি ভাবি ওর হাতে একটা থলে ধরিয়ে দিল। থলে থেকে বকুল ফুলের মোটা একটা গাজরা বের করল। মম অবাক হয়ে বলল, এটা কোথায় পেলি?

– বানিয়ে এনেছে।

– এত ফুল পেল কোথায়?

– আমাদের বকুল গাছ বেল করে। দাঁড়া তোকে এই গাজরাটা লাগিয়ে দেই।

নিক্কণ বলল, এই গাজরাটা আমার ভাই বানিয়েছে আজ সকাল থেকে বসে বসে। শুনে মমর মুখে লালিমা দেখা দিল। না চাইতেই লজ্জা পেয়ে গেল। নিক্কণ আর আদ্রিতা মুচকি হাসল। গতকাল রাতে সব ভাই বোন মিলে রিয়ানকে দিয়ে জোর করে রাজি করিয়েছে গাজরাটা বানানোর জন্য। আজ সকালে ফুলিকে দিয়ে সব ফুল পেড়ে রিয়ানের বিছানায় ঢেলে দিয়ে বলল, একা হাতে বউয়ের জন্য গাজরাটা বানিয়ে নাও। আমাদের মেলা কাজ। বানানো শেষ হলে আমাদের দিয়ে এসো। তোমার বউকে পরিয়ে দেবো। বলেই সবাই বেরিয়ে গেল। সবাই ভেবেছিল রিয়ান হয়ত বানানো শেষ করতে পারবে না বা বানাতে বিরক্তবোধ করবে। কিন্তু নামাযে যাওয়ার আগে নিক্বণের হাতে গাজরার থলেটা ধরিয়ে দিতে ভাই বোন সব অবাক। তারপর সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল।

চলবে…
চলবে…

বি.দ্র.: আমার ল্যাব পরীক্ষা চলছে তাই দিতে দেরি হচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here