মায়ায় জড়ানো সেই তুমি পর্ব -১৩

#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_১২
জাওয়াদ জামী

হসপিটালের করিডোরে মাথা নিচু করে বসে আছে জামিল চৌধুরীর পরিবার। শায়লা চৌধুরী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সাদিফ একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে আইসিইউর দিকে। জামিল চৌধুরীর মস্তিষ্কে র*ক্ত*ক্ষ*র*ণসহ শরীরের ডানপাশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে। মস্তিষ্কে র*ক্ত জমাট বেঁধে আছে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় আইসিইউ তে সিফট করা হয়েছে।
জামিল চৌধুরীর ভাই-বোনেরা সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। কতদিন পর সব ভাই-বোন মিলে একসাথে হয়েছে। কত খুশি ছিল তাদের বড় ভাই। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল!

বিয়ে বাড়িতে গতরাতে হঠাৎই শোকের ছায়া নেমেছে। রাতে সবাই যখন দেখল সাদিফ বাবাকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে গাড়িতে উঠছে তখনই তোলপাড় শুরু হয়েছে। শায়লা চৌধুরী পাগলপ্রায়। সাইরা অতিশোকে কথা বলার ভাষা হারিয়েছে। বাবা যতই খোঁচা দিয়ে কথা বলুক না কেন ও বাবাকে খুব ভালোবাসে।
রাত পেরিয়ে সকাল হয়েছে কিন্তু জামিল চৌধুরীর কোন উন্নতি হয়নি। এদিকে বিয়ের সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। অতিথিরা সবাই উপস্থিত হয়েছে। এমতাবস্থায় বিয়ে পেছানোর কোন পথ দেখতে পাচ্ছেনা সাদিফ। সে সকালে ফোন করে রাতুলের বাবাকে জানিয়েছে জামিল চৌধুরীর বিষয়ে। তিনি কালবিলম্ব না করে হসপিটালে চলে আসে। সাথে তার ছেলেরাও আছে। সবকিছু জানার পর তিনি বিয়ের সব অনুষ্ঠান বন্ধ করতে চান। কিন্তু সাদিফ রাজি হয়না। যেহেতু দুইপক্ষেরই সব আয়োজন করা হয়েছে এবং অতিথিরাও উপস্থিত তাই সাদিফ রাতুলের বাবাকে জানিয়ে দেয় প্ল্যান অনুযায়ী সব হবে। এখানে ওর বাবার কাছে ওর চাচা, মা, আরও দুই-একজন থাকবে।
দুপুরের দিকে সাদিফের কাছে ফোন দিয়ে ওর চাচা জানায়, জামিল চৌধুরীর অবস্থা আগের থেকে কিছুটা উন্নতির দিকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সাদিফ অতিথি আপ্যায়নে মনযোগ দেয়।

তালিব শেখ অতি সংকোচের সাথে চৌধুরী বাড়ির গেইটে পা রাখে। তানিশার বিয়ের পর শুধু একবার এ বাড়িতে এসেছিলেন তিনি। সেদিন শায়লা চৌধুরীর আচরণ দেখে খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। তাই আর এদিকে পা মাড়াননি। কিন্তু আজ আসতেই হল সাদিফ আর জামিল চৌধুরীর জেদের কাছে হার মেনে। তারা দুজনেই কদম তলী যেয়ে দাওয়াত করে এসেছে। এবং বারবার ফোন করেছে আসার জন্য। তাই তিনি আসতে বাধ্য হয়েছেন। অবশ্য তানিশা চায়নি ওর বাবা এ বাড়িতে পা দিক। এ নিয়ে অনেক রাগারাগিও করেছে বাবার সাথে। কিন্তু তালিব শেখ জামিল চৌধুরীর কথা ভেবে না এসে থাকতে পারলেননা।
গেইটের ভিতরে ঢুকেই তালিব শেখ বুঝতে পারে বাড়ির পরিবেশ খুব গম্ভীর। এখানের কাউকেই তিনি চিনেননা যে জিজ্ঞেস করে জেনে নিবেন। আশেপাশে তাকিয়ে খোঁজ করতে থাকেন সাদিফ অথবা তার বাবার। কিন্তু নজরে আসলনা কেউই। বাড়ির ভেতরে ঢুকবেন কিনা তা নিয়ে দ্বিধা হতে থাকে। সাদিফ বাগানের এককোনায় কাজে ব্যস্ত ছিল শ্বশুরকে দেখে দ্রুতই চলে আসে।
” আসসালামু আলাইকুম বাবা। আপনি কখন এসেছেন? একা এসেছেন? আর কেউ আসেনি! ”
” ওয়ালাইকুমুসসালাম। এইতো মাত্রই আসলাম। এতদূর পথ তাই কেউ আসতে সাহস করলনা বাবা। তা তোমার বাবা কোথায়? তাকে দেখছিনা যে? ”
শ্বশুরের প্রশ্নে সাদিফের চোখে পানি এসে গেছে। সে শ্বশুরকে নিয়ে ভেতরে আসল। ড্রয়িংরুমে বসিয়ে সব খুলে বলে তাকে।
তালিব শেখ অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কি হতে কি হয়ে গেল! তিনি তৎক্ষনাৎ হসপিটাল যেতে চাইলে সাদিফ না করলেও শোনেননা। তাই চাচাতো ভাইয়ের সাথে পাঠিয়ে দেয় তালিব শেখকে।
তালিব শেখ গিফ্ট সহ নানানরকম জিনিসপত্র এনেছেন সবগুলোই সাদিফের কাছে দিলে সাদিফ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ” এগুলো কেন? ”
তালিব শেখ মনমরা হয়ে উত্তর দেয়, ” মেয়ে না থাকলেও এটা ঠিকই আমার মেয়ের শ্বশুর বাড়ি। মেয়ের শ্বশুর বাড়ি কখনো খালি হাতে আসতে নেই। ”
সাদিফ গতরাত থেকে বাবার চিন্তায় তানিশার কথা মনে করার সুযোগই পায়নি। কিন্তু এখন তালিব শেখ মনে করিয়ে দিলেন। সাদিফ বুকের বাঁ পাশে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করতে। আজ তার এই কঠিন সময়ে অতিপ্রিয় দুজন পাশে নেই। একফোঁটা অশ্রু টুপ করে ঝরে পরে।

তালিব শেখ রাস্তায়ই তানিশাকে ফোন দিয়ে জামিল চৌধুরীর কথা জানায়। তানিশা সেই থেকে কেঁদেই চলেছে। ঐ একটা মানুষই ওকে সাহস জুগিয়েছে, ভরসা দিয়েছে, মনোবল জুগিয়েছে এমনকি নিঃস্বার্থভাবে ভালোও বেসেছে। যে বাড়িতে একটা সময় সবার উপেক্ষার পাত্রী হিসেবে বাস করতে হত সেখানে তিনি পিতৃস্নেহ দিয়েছেন। সকল বিপদে-আপদে বটগাছের ন্যায় ছায়া দিয়েছেন আগলে পরম আদরে। সেই মানুষটা আজ অসুস্থ ভাবতেই বুক খাঁখাঁ করছে। মেয়েকে কাজের খালার কাছে রেখে অজু করে এসে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। সৃষ্টিকর্তার নিকট আকুল নিবেদন জানায় জামিল চৌধুরীর সুস্থতার জন্য।

তালিব শেখকে হসপিটালে দেখে শায়লা চৌধুরী বেশ অবাকই হয়। তালিব শেখ যে তার মেয়ের বিয়েতে আসবেন তিনি ভাবতেই পারেননি। শায়লা চৌধুরী কান্নায় ভেঙে পরলেন তালিব শেখের সামনে।
” বেয়াই আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনার মেয়েকে আমি আগলে রাখতে পারিনি। ওকে ওর যথাযোগ্য মর্যাদা কখনোই দিইনি। আপনাদেরও প্রাপ্য সম্মান দিইনি। এতকিছুর পরও আপনি যে আমার মেয়ের বিয়েতে এসেছেন আমি চিরকৃতজ্ঞ করইলাম আপনার কাছে। এসব আমার অন্যায়ের শাস্তি। আমার পাপের দায়ভার অন্য একজন ভোগ করছে৷ ”
” বেয়ান এভাবে বলবেননা। আল্লাহ যেটা করেন তাঁর বান্দার ভালোর জন্যই করেন। ধৈর্য্য ধরেন, নিজেকে শক্ত রাখেন। আপনি ভেঙে পরলে আপনার ছেলে-মেয়েদের সামলাবে কে। দেখবেন বেয়াই ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবেন। ”
” বেয়াই আমাকে একবার বউমার কাছে নিয়ে যাবেন? আমি ওর হাতে-পায়ে ধরে ক্ষমা চাইব। ওকে ফিরিয়ে আনব আমার ছেলের কাছে। আমার নাতনিকে একা একা বেড়ে উঠতে দিবনা।”
” বেয়ান এসব আপনি কি বলছেন! আপনি তানিশার কাছে ক্ষমা চাইবেন কেন! ওকে শাসন করার অধিকার যেমন আপনার আছে তেমনি আদরও আপনিই করবেন। কিন্তু ক্ষমা নয়। বাবা- মায়েরা কখনো সন্তানের কাছে ক্ষমা চায়না। আর আমি নিজেই তানিশার ঠিকানা জানিনা। জানলে ঠিক নিয়ে যেতাম।
তালিব শেখ বেশ কিছুক্ষণ হসপিটালে কাটিয়ে সাদিফের বাড়িতে আসে। বড়যাত্রী আসতে আর দেরি নেই। শায়লা চৌধুরী বড়পক্ষের সকল আপ্যায়নের দ্বায়িত্ব তালিব শেখের কাছে দিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন।
তালিব শেখ বাসায় যাওয়ার পর সাদিফ অল্পসময়ের জন্য হসপিটালে আসে বাবাকে দেখতে। কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করার পর আবার বাসায় ফিরে যায়।

সবার মন খারাপ থাকলেও ঠিকঠাকভাবে সাইরা-রাতুলের বিয়ে সম্পন্ন হয়। সাদিফ ওর বাবার অবর্তমানে সকল দ্বায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে। সাইরা বড়যাত্রী আসার পর থেকেই কেঁদেকেটে বুক ভাসাচ্ছে। এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে ভাবতেই বুকটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। তারউপর বাবা অসুস্থ মাও পাশে নেই। এমন অসহায়বোধ সাইরা কখনোই করেনি। বিদায় বেলা ঘনিয়ে আসছে অথচ সাইরার পাশে বাবা-মা কেউই নেই। বরপক্ষ তাড়া দিচ্ছে। সাদিফের নিজেকে আজ বড় একা মনে হচ্ছে। এমন সময় শায়লা চৌধুরী আসে। তার পাশে তালিব শেখ। মাকে দেখে সাইরা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। শায়লা চৌধুরীও মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
সাইরা আজ বাবাকে ভিষণভাবে মিস করছে। ওর বারবার মনে হচ্ছে বাবা যদি এখানে থাকত। কতবড় দুর্ভাগা সন্তান সে, বিদায়ের সময় বাবা পাশে নেই। এ বাড়িটাকে কত যে ভালবাসত তা এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছে সাইরা। এই বাড়ির প্রতিটি কোন যেন ওকে টানছে। এমনকি বাগানের ধুলি কনাগুলোও যে ওর ভিষণ প্রিয় তা বুঝতে মোটেও বেগ পেতে হচ্ছেনা। বারবার পিছু ফিরে দেখতে থাকে প্রিয় বাড়িটিকে। আজ থেকে সে এই বাড়ির অতিথি কথাটা ভাবতেই শ্বাস আটকে আসছে।
সাদিফকে ওর ছোট ফুফু নিয়ে আসে সাইরার কাছে। ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিরবে চোখ ঝরায় সাইরা। এই ভাইটার সাথে ওর কখনোই খুব একটা মেশা হয়নি। গম্ভীর ভাইকে ও একটু এড়িয়েই চলেছে। কিন্তু আজ এই ভাইও যেন হঠাৎ করেই খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে। আজ যেন এই বাড়ির প্রতিটি কোন ছুঁয়ে যাওয়া বাতাসকেও সাইরার বড্ড আপন মনে হচ্ছে। ধীর পায়ে সাদিফের কাছে এগিয়ে যায় সে। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সাদিফ আলতো করে হাত রাখে বোনের মাথায়। ভাইয়ের আদর মাখা আস্কারা পেয়ে ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে চির অহংকারী বোনটাও আজ কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে।
হায়রে নারীজীবন! অজস্র ভালোবাসা, অফুরান স্নেহ, হাজারো আহলাদ-আস্কারা পায়ে মাড়িয়ে একদিন ঠিকই অন্যের ঘর আলোকিত করতে পারি জমাতে নতুন ঠিকানায়। পেছনে ফেলে রেখে যায় হাজারো স্মৃতি। যা আমরন হৃদয়ের ক্যানভাসে আঁকা রয়।

তালিব শেখ বাড়ি ফিরে যেতে চাইলে সাদিফের জোড়াজুড়িতে থেকে যায়। রাতে সাদিফের সাথে হসপিটালেই থাকেন। শায়লা চৌধুরীকে তার ননদরা বাড়িতে নিয়ে এসেছে। নিজ হাতে ভাইয়ের খাইয়ে দিয়েছে বড় ননদ। তারা রাতে শায়লা চৌধুরীর সাথেই থেকেছে। স্লিপিং পিল দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়েছে তাকে।

পরদিন সকালে জামিল চৌধুরী রেসপন্স করে। তাঁর জ্ঞান ফিরে এসেছে। কিন্তু তিনি কথা বলতে পারছেননা। স্থির হয়ে রয়েছেন। তার চোখ দিয়ে অনর্গল পানি ঝরছে। কেউই বুঝতে পারছেনা তিনি কেন কাঁদছেন। সবাই ভাবছে হয়তো শারিরীক কষ্টে কাঁদছেন তিনি। কিন্তু তিনি কেন কাঁদছেন তা একমাত্র তিনিই জানেন। কিন্তু দূর্ভাগ্য তিনি তার কষ্টের কথা কাউকে জানাতে পারবেননা।

সাদিফ বারবার সাইফকে ফোনে ট্রাই করছে কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছে। নিজের ভাইয়ের এরুপ দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকান্ডে সাদিফের চরম রা*গ হয়। সাদিফের মন চাচ্ছে এখনই কানাডা যেয়ে সাইফের কানের নিচে ঠাঁটিয়ে দুইটা দিতে। কিন্তু সে নিরুপায়। বাবাকে এই অবস্থায় ফেলে সে কোথাও যেতে পারবেনা।

সাইরা দুপুরের দিকে রাতুলের সাথে বাবাকে দেখতে এসেছে। বাবার কাছে যাওয়া মাত্রই কিছুক্ষণ বাবার বুকে মাথা রেখে নিরবে শুয়ে থাকে। জামিল চৌধুরী মেয়েকে দেখে খুব খুশি হয়। সারাটা বিকেল বাবার পাশেই বসে থাকে। সাদিফও আছে সেখানে। শায়লা চৌধুরী এসব দেখে শুধু নিরবে চোখের পানি ফেলে। তার দীর্ঘশ্বাসের সাথে একটাই আফসোস উথলে ওঠে, তার ছোট ছেলেটা যদি এখানে থাকত।

বিঃদ্রঃ গল্প দিতে দেরি হওয়ায় আমি ক্ষমাপ্রার্থী। বাসায় বর্তমানে দশজন মেহমান অবস্থান করছে। আমি বাড়ির একমাত্র পুত্রবধূ এবং সবার বড়। তাই দ্বায়িত্বও অনেক। তাই ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও গল্প দিতে পারিনি। আমি আবারও ক্ষমা চাইছি।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here