মায়ায় জড়ানো সেই তুমি পর্ব -২৩

#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_২৩
জাওয়াদ জামী

রাতের খাবারের আয়োজন চলছে চৌধুরী বাড়িতে। তানিশা ব্যস্ত হয়ে টেবিল সাজাচ্ছে। তিয়াসাও ওকে সাহায্য করছে। সাইরা বাচ্চাদের সাথে সোফায় বসে খুনসুটিতে ব্যস্ত । শায়লা চৌধুরী স্বামীকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে ড্রয়িংরুমে এনেছেন। আজকাল জামিল চৌধুরী বেশ সুস্থ বোধ করছেন। অবশ হওয়া হাত-পা কিছুটা নাড়াচ্ছেন। ডক্টর আশা করছেন এভাবে চলতে থাকলে উনি এক সময় হাঁটতে পারবেন। শ্বশুরকে ড্রয়িংরুমে দেখেই তানিশা আবদার করল আজ তাকে ডাইনিং টেবিলে বসে সবার সাথে খেতে হবে। যদিও শায়লা চৌধুরী তাকে খাইয়ে দিবেন। জামিল চৌধুরীও ভিষণ আনন্দিত, আজ তিনি সবার সাথে খাবেন। তার মনে খুশির জোয়ার বইছে অথচ সেই খুশি মুখে প্রকাশ করার জন্য ভাষা হারিয়েছেন তিনি। জামিল চৌধুরীকে তার নাতি-নাতনীদের কাছে বসানো হয়েছে। তিনি হাসিমুখে ওদের খেলা দেখছেন। কিন্তু যতবারই মেয়ের দিকে তাকান ততবারই কেঁদে উঠে তার অন্তর। তার সেই সদা চঞ্চল মেয়েটা কেমন চুপসে গেছে। এই কয় বছরে কত পরিনত হয়েছে সে!
কলিং বেলের আওয়াজে শায়লা চৌধুরী ভুরু কোঁচকায়। এই সময় কে আসল!
তানিশা ব্যস্ত থাকায় সাইরা দরজা খুলতে যায়।
দরজার ওপাশে থাকা ব্যক্তিকে দেখে হৃৎস্পন্দন থমকে যায়। পারিপার্শ্বিকতা ভুলে তাকিয়ে থাকে সামনে।
” এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে ভেতরে যাব কেমন করে! না-কি আমাকে ঢুকতে দিবেনা? শ্বশুর বাড়ি এসেছি অথচ ভেতরে ঢুকতে পারিনি ব্যাপারটা সামনে বিরিয়ানি কিন্তু খেতে পারছিনা এমন দাঁড়ায়না? ” মুখভর্তি হাসিতে রাতুলের উচ্ছ্বসিত গলা।
” এসো। ” ছোট্ট করে জবাব দিয়ে পথ ছেড়ে দাঁড়ায়।
হাতে অনেকগুলি প্যাকেট নিয়ে বেশ অসুবিধা বোধ করছিল। তারাহুরো করে প্যাকেটগুলো সোফায় রেখে শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে সালাম দিয়ে দুইহাতে দুই বাচ্চাকে কোলে নেয়। বাচ্চারাও বাবাকে দেখে খুশি হয়ে আধোআধো গলায় এটাসেটা বলতে থাকে। শায়লা চৌধুরী তানিশার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসে।
রাতুল ওর পাশে বসা পুতুলকে দেখেই বুঝেছে ও সাদিফ ভাইয়ার মেয়ে। ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে তূর্ণাকে কোলে নেয় সে। তূর্ণাও বাধ্য মেয়ের মত রাতুলের কোলে উঠে।
সাইরা তখনও ঘোরের মধ্যে আছে। ওর বিশ্বাসই হচ্ছেনা রাতুল এসেছে। তানিশা এসে রাতুলকে সালাম দেয়। রাতুলও হেসে উত্তর দেয়।
” ভাবি সম্পর্কের দিক বিবেচনা করলে সালাম আপনার পাওনা। ”
” সালাম দিয়ে জামাইকে বরন করলাম। তা জামাইয়ের এতদিনে মনে হল আমাদের কথা! ”
রাতুল শুধু হাসে।
তানিশার বেশ ভালো লাগছে রাতুলকে দেখে। এখন শুধু একটাই চাওয়া, ওদের সম্পর্কের শিথিলতা দূর হোক।
” সাইরা রাতুল ভাইকে নিয়ে ভেতরে যাও। উনি ফ্রেশ হোক। তারপর একসাথে সবাই খাবে। ” তানিশা চাচ্ছে ওরা একান্তে কথা বলুক, বোঝাপড়া করে নিক নিজেদের মধ্যে।
” তিয়াসা, তুই বাচ্চাদের একটু সামলা। রাতুল ভাই আপনি ভেতরে যান। ” তানিশার কথা অমান্য না করে রাতুল সাইরার রুমের দিকে এগোতে থাকে। সাইরাও যায় তার পিছুপিছু।

রুমে এসেই রাতুল শক্ত করে দু’হাতের বাঁধন বেঁধে নেয় সাইরাকে।
” চেহারার এমন অবস্থা হয়েছে কেন! খাওয়াদাওয়া করনি ঠিকমত? ” সাইরা নিরুত্তর থাকে। ওর চোখে অশ্রুর ফোয়ারা ছুটেছে।
” কথা বলবেনা আমার সাথে? অনেক অভিমান জমে আছে? নিশ্চুপ থেকোনা। মনে যা আসে তাই বল। রা*গ কর , গালি দাও, ঝগড়া কর তবুও আমার সাথে একটু কথা বল সাইরা। খুব কষ্ট পেয়েছি এতদিন। ”
” কেন কষ্ট পেয়েছ! তোমার কষ্টের কারন তো এতদিন সামনে ছিলনা। তবুও কেন কষ্ট পেয়েছ। আমি হীনা তোমার ভালো থাকার কথা ছিল। ” কান্নার দমকে কথা বলতে পারছেনা সাইরা।
” কে বলেছে আমি ভালো ছিলাম! অস্বীকার করবনা প্রথমদিকে অবশ্য অতটা খারাপ লাগেনি। কিন্তু সাতদিন যেতেই তোমাকে প্রচন্ড অনুভব করেছি সবকিছুতেই। অন্য সময় এ বাড়িতে আসলে অন্তত তোমার সাথে কথা হত। তাই মিস করার সুযোগ হয়নি। কিন্তু এইবার না হয়েছে কথা, না জানতে পেরেছি তোমাদের কোন খবর। ঠিকমত ঘুমাতে পারিনি। ”
” কে নিষেধ করেছিল ফোন দিতে। আমি ভাইয়ার সিদ্ধান্তকে সম্মান দিয়ে নাহয় কথা বলিনি কিন্তু তুমি! তুমি কেন ফোন করনি। ”
” আমি নিজের সাথে বোঝাপড়া করেছি শুধুমাত্র। কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারিনি। কিন্তু কেউ একজন আমার চোখের পর্দা খুলে দিয়েছে। যার দরুন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিতীয় বার ভাবতে হয়নি। ” সাইরার বুক ধক করে উঠে। কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাতুল! ওর হাত-পা কাঁপছে অনবরত। মাথা চক্কর দিতে শুরু করেছে।
রাতুল লক্ষ্য করে সাইরাকে কেমন উদভ্রান্ত লাগছে।
” সাইরা তুমি ঠিক আছো? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন! সাইরা, কথা বল। ” রাতুলের অস্থিরতা দেখে সাইরা চিন্তায় পরে যায়। ওর জন্য রাতুলের কেন এত ভাবনা! ছেড়েই যাবে যখন, তবে কেন এত উতলা হচ্ছে সে!
” তুমি আমাদের সম্পর্ক শেষ করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছ? ” সাইরার গলায় জোর নেই। টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে।
” এক থা*প্প*ড় দিব বেয়াদব মেয়ে। আর যাই হোক আমি কখনোই ভাবতে পারিনা আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে। আমি তোমাদের নিতে এসেছি। আমাদের আলাদা একটা সংসার হবে, যেখানে থাকব তুমি, আমি আর বাচ্চারা আর থাকবে শুধু সুখ আর সুখ। আর তুমি কিসব উল্টাপাল্টা ভাবছ! এত বোকাও কেউ হয়! ”
সাইরা মুহূর্তেই অনুভব করল ওর সকল দুঃখ কোথায় উবে গেছে।
” আলাদা সংসার কেন! আমিতো আলাদা সংসার চাইনা। আমি সবাইকে নিয়েই সুখী হতে চাই। আমি আব্বু-আম্মুকে ছাড়া সংসার কল্পনা করতে পারিনা। ”
” জীবনে সব কিছুরই প্রয়োজন আছে সাইরা। আম্মুকে কিছু কিছু বিষয় বুঝতে দিতে হবে। সে যেমন সন্তানকে মুঠোয় নিয়ে বাঁচতে চায়, তেমনি আমিও চাই আমার সন্তানদের নিয়ে বাঁচতে। আমি তার কাছ থেকে দূরে থেকে তাকে বুঝিয়ে দিতে চাই সন্তানদের সাথে দূরত্ব আমাকেও কষ্ট দেয়। তবে চিরদিনের মত আমি আলাদা থাকবনা। শুধু তার বুঝ আসতে যতদিন লাগবে ততদিন থাকব। এবার চোখমুখ মুছে তৈরী হয়ে নাও দেখি। সারা বিকেল খুঁজে একটা ফ্ল্যাট পেয়েছি কিন্তু তেমন কিছুই নেই সেখানে। কয়েকটা ফার্নিচার অর্ডার দিয়েছি, সেগুলো রাতেই পোঁছে দিবে। তোমার অনেক কাজ আছে সেখানে । ”
” না খেয়েই যাবে? একটু খেয়ে নাও, না খেলে সবাই কষ্ট পাবে। ”
” হুম, খেয়েই তবে যাব। ” সাইরার গালে টুপ করে চুমু দেয় রাতুল।
” ভালোবাসি সাইরা। অনেক মিস করেছি তোমাকে। আর কখনোই এত দূরত্ব আসতে দিবনা আমাদের মাঝে। এবার ভালো স্বামী হয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিব। ”

তানিশা সাদিফকে ফোন করে দ্রুত বাসায় আসতে বলে। ও চায় সাইরা যাওয়ার আগে ভাইয়ার সাথে দেখা করুক। তানিশা কিছুতেই চায়না সাদিফ এই বিষয় নিয়ে পরবর্তীতে রা*গা*রা*গি করুক।
সাদিফ তানিশার ফোন পেয়েই বাসায় রওনা দেয়। ততক্ষণে সবার খাওয়া শেষ। সাইরাও ভাইয়ের অপেক্ষায় আছে। ভাইকে না বলে সে কিছুতেই যাবেনা।
সাদিফ আসলে শায়লা চৌধুরী সব জানায়। সাদিফও দ্বিমত করেনা। রাতুল তার পূর্বের ভুলের জন্য সবার কাছে ক্ষমা চায়।
” রাতুল, তুমি একজন হাইলি এডুকেটেড পারসন। তোমাকে সবকিছু ডিটেইলস বলার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করিনা। তোমাকে শুধু একটা কথাই বলব, সাইরা আমাদের খুব আদরের। ওর মূল্যায়ন কর, দেখ ও তোমাদের জন্য নিজের জীবন দিতে দ্বিধা করবেনা। ওকে ভালো রেখ, তোমাকে ভালো রাখার দ্বায়িত্ব ও পালন করবে। ” সাইরার আজ এ বাড়ি থেকে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। ও অঝোরে কেঁদে চলেছে। সাদিফ বোনকে জড়িয়ে রাখে।
” তোর কোন সমস্যা হলে আমাকে জানাবি। মনে রাখিস ভাইয়া সব সময়ই তোর সাথে আছে। তোর যখন মন চাইবে তখনই চলে আসবি। ”
সাইরা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।

ওরা বিদায় নেয়ার পর বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সবার কাছে। শায়লা চৌধুরী আনন্দে কেঁদেই চলেছে অবশেষে তার মেয়ের জীবনে সুখ উঁকি দিচ্ছে।
জামিল চৌধুরীর বুক এক বিরাট পাথর চেপে ছিল এতদিন। আজ বুঝি তার থেকে মুক্তি পেল। তার মেয়েটার জীবনে ভালো কিছু হতে চলেছে।

তানিশার আজ খুব খুশি খুশি লাগছে। রাতুল যে ওর কথা এভাবে মেনে নিবে ও ভাবতেই পারেনি। অবশেষে মেয়েটা সংসার ফিরে পেল। অনেক কষ্ট পেয়েছে এতদিন।
” আমার বউ কি এত ভাবছে শুনি! আবার মিটিমিটি হাসছে। ” তানিশাকে বুকের মাঝে মিশিয়ে নিয়েছে সাদিফ।
” সাইরার কথা ভাবছি। ওর হাসিমুখ দেখে খুব ভালো লাগছিল। এই শুনুননা, ছুটির দিনে কিন্তু ওর বাসায় আমাকে নিয়ে যাবেন। যাবেন তো? ”
তানিশার আবদারকে সায় জানিয়ে মাথা নাড়ায় সাদিফ।

সাইরা নতুন ফ্ল্যাট সাজাতে গিয়ে বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকছে। রান্নাবান্না, বাচ্চাদের সামলানো সব মিলিয়ে ওর অবস্থা নাযেহাল। বাবার বাড়িতে ফোন করার সময় হয়ে উঠছেনা। কিন্তু তানিশা প্রতিদিনই ফোন করে ওদের খোঁজ নেয়।
রাতুলের মায়ের মন খুব খারাপ তার ছেলে এভাবে বাসা ছেড়ে অন্য জায়গায় থাকায়। রাগে তিনি ছেলের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন। সাতদিন হয়েছে ওরা অন্য ফ্ল্যাটে উঠেছে। এই কয়দিনে একবারও ছেলের সাথে কথা বলেননি। এমনকি রাতুলও মায়ের সাথে কথা বলেনি। কিন্তু রাতুলের বাবা নিয়মিত তার ছেলে, বউমার সাথে যোগাযোগ রাখছে। এমনকি নতুন ফ্ল্যাটে এসে বেড়িয়েও গেছেন। তিনি খুব খুশি ছেলের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ায়।

দুপুরে খাবার পর তানিশা মেয়েকে নিয়ে শুয়ে রয়েছে। মেয়েকে ঘুমিয়ে দিতে গিয়ে সেও তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পরেছে। কিন্তু ফোনের শব্দে তন্দ্রাভাব কেটে যায়। ফোন হাতে নিয়ে দেখল রিশার নাম।
” তানুউউউ ” তানিশার কানে তালা লেগে যায়।
” রিশা, আস্তে। এভাবে চিৎকার দিচ্ছিস কেন! ”
” দোস্ত, তুই খালামনি হতে চলেছিস। আমার গুলুমুলু একটা ময়না পাখি হবে। ” এক নিঃশ্বাসে বলে দেয় রিশা।
” কনগ্র্যাচুলেশন, রিশু। অবশেষে তুইও আমার কাতারে এসে গেলি। সাবধানে থাকবি কিন্তু। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করবি। ” আরো নানান উপদেশ দেয় তানিশা। দুই বান্ধবী মিলে অনেকক্ষণ নানান গল্প করে কাটিয়ে দেয়।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here