মায়ায় জড়ানো সেই তুমি পর্ব -০৪

#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_৪
জাওয়াদ জামী

সেদিনের পর থেকে জামিল চৌধুরীর সাথে সাদিফের দূরত্ব বেড়ে গেছে। জামিল চৌধুরী পারতপক্ষে ছেলেকে এড়িয়ে চলেন।
তানিশাও নিজের মত করে থাকে। একই বাড়িতে সবাই বাস করে অথচ কেউ তানিশার সাথে কথা বলেনা। এখন আর এসবে তানিশার মন কেমন করেনা।
এক ঘরে থাকলেও এখন তানিশার মন সাদিফের জন্য আকুপাকু করেনা।
পরিক্ষা শেষ হয়েছে দুইদিন হলো। অনেকদিন বাবার বাড়ি যায়নি। বাড়ির জন্য মন কেমন করছে।
সাদিফ ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছে। তানিশা কোন ভনিতা ছাড়াই সাদিফকে ডাকে।
” শুনুন, আমার পরিক্ষা শেষ। অনেকদিন গ্রামে যাইনা। বাবা-মা কে দেখতে ইচ্ছে করছে। ”
” তোমার মন চাইলে যাও। কেউ বাঁধা দিবেনা। অযথা আমাকে বিরক্ত করোনা। ”
তানিশা একটুও অবাক হয়না। ও জানতো এরকমই হবে। মুচকি হেসে শুয়ে পরে।

সকালে খাবার টেবিলে জামিল চৌধুরীর কাছে বাবার বাড়ি যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করে।
জামিল চৌধুরী রাজি হয়।
” তুমি কবে যেতে চাও মা? আমি ড্রাইভারকে বলে রাখব, তোমাকে পৌঁছে দিবে। ”
” কাল সকালেই যেতে চাই বাবা। কিছুদিন পর থেকে ক্লাস শুরু হবে। তার আগেই চলে আসতে হবে। ”
শায়লা চৌধুরীসহ সবাই ওদের কথপোকথন শুনে কিন্তু কেউ কিছুই বলেনা। শায়লা চৌধুরী মনে মনে ভিষণ খুশি হয়। যা তার মুখে প্রকাশ পাচ্ছে।

শাহানা সিদ্দিকা রাতের খাবার টেবিলে সাজিয়ে রাখছেন। তাকে সাহায্য করছে পুত্রবধূ মিশু। বড় ছেলের বিয়ে করিয়েছেন। একটা নাতিও আছে দুই বছরের।
একে একে সবাই আসে ডাইনিং রুমে। যে যার চেয়ারে বসে পরে। সুখি পরিবার বলতে যা বোঝায় তার সবই বিদ্যমান এই পরিবারে। তিনবেলা সবাই একসাথে খেতে না পারলেও চেষ্টা করে রাতে একসাথে খাবার।
বড় ছেলেটার দিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায় শাহানা সিদ্দিকার। যেমন ভদ্র তেমনি নীতিবান। ঠিক যেন বাবার কার্বন কপি। চোখের কোনে পানি জমা হয় শাহানা সিদ্দিকার। সবার চোখ এড়িয়ে অতি সন্তর্পনে আঁচলে চোখ মুছলেন। আজ মানুষটা বেঁচে থাকলে কতইনা খুশি হতেন!
” ইশান, আর কতদিন টইটই করে গুরে বেড়াবি? কিছু চিন্তা করলি, কি করবি? ” খাবার মুখে তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করে জিসান।
” কয়েকটা জায়গায় অ্যাপ্লিকেশন করেছি ভাইয়া। ইন্টারভিউ শুরু হবে কয়েকদিনের মধ্যেই। ”
” পড়াশোনা করতে দেখিনা। ইন্টারভিউ দিবি কিভাবে! খালি ঘুম আর রাস্তাঘাটে টহল দেয়াই তোর এখন মুল কাজ মনে হয়? ”
ভাইয়ের কথা শুনে কিছুক্ষণ তব্দা মেরে থাকে ইশান।
” এইরে ভাইয়া কিভাবে জানল আমি রাস্তাঘাটে টহল দিই! বাজের চোখ দেখছি বিগ ব্রাদারের! ”
” দেবরজি তুমি এই বয়সে ইন্টারভিউয়ের কথা চিন্তা করছো! কিন্তু তোমার ভাইয়া এই বয়সে শুভ কাজ সেরে নিয়েছিল। তুমি কিন্তু সবদিকেই লেইট। তোমার সদা গম্ভীর, মুডি ভাইয়া জায়গামতো দান মারতে জানে। ” স্ত্রী মিশুর এমন লাগামছাড়া কথায় জিসান বেশ বিরক্ত হয়। কটমট চোখে তাকায় মিশুর দিকে।
” চিন্তা করোনা ভাবি, তোমার দেবরও জায়গামতই দান মারবে। বিগ ব্রাদার বিয়ের তিন বছর পর আমার ভাতিজাকে আনছে। আর আমি বিয়ের দশ মাস পরই একটা বিচ্চু উপহার দিব তোমাদের। সেক্ষেত্রে আমিই কিন্তু এগিয়ে থাকব। ”
জিসানের খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বড়ভাই, মায়ের সামনে এ কেমন কথা! এই ছেলেটা আর বড় হলনা! মনে মনে নিজের কপাল চাপড়াতে থাকে জিসান।
আর শাহানা সিদ্দিকা ছোট ছেলের এরুপ ঠোঁট কাটা কথা শুনে মুখ টিপে হাসে।
” আগে একটা চাকরির ব্যবস্থা কর বাবা। চাকরি ছাড়া বিচ্চুর মা পাওয়া যায়না আজকালকার দুনিয়ায়। ”
এভাবে গল্প, আলোচনা, সমালোচনা করতে করতে এক সুখি পরিবারের রাত শুরু হয়।

প্রতিদিনের ন্যায় সকালে সব কাজ শেষ করেছে তানিশা। সবাই নাস্তা করে বেরিয়ে গেলে সে নিজেও তৈরী হবে বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য।

সবাই ডাইনিং টেবিলে বসেছে। এখনো খাওয়া শুরু করেনি অপেক্ষা করছে জামিল চৌধুরীর। তিনি একসময় আসলেন হাতে শপিং ব্যাগ নিয়ে।
” ড্যাড শপিং ব্যাগে কি আছে? ” ন্যাকা স্বরে বলে সাইরা।
” ব্যাঙ্গের বাচ্চা আছে। ” এক কথায় উত্তর দেয় জামিল চৌধুরী। যা শুনে সাইরা মুখ কাঁচুমাচু করে।
জামিল চৌধুরী ব্যাগটি তানিশার হাতে দিয় বলে,
” মা এখানে তোমার বাড়ির সবার জন্য কিছু কাপড়চোপড় আছে। কাল রাতেই দিব কিন্তু ভুলে গেছিলাম। তুমি এগুলো নিজ হাতে প্রত্যেককে দিও। ”
” এসবের কোন দরকার ছিলনা বাবা। আপনি কেন কষ্ট করতে গেলেন! ”
” তোমার এতকিছু ভাবতে হবেনা। আমি ড্রাইভারকে বলে রেখেছি ঠিকঠাকমত যেও। পোঁছে আমাকে ফোন দিও। ”
” জি বাবা। ”
সাদিফ বাদে সবাই এসব শুনে ভেতর থেকে রাগে ফেটে পরছে। কিন্তু কেউ মুখে কিছু বলছেনা। অফিস যাওয়ার সময় জামিল চৌধুরী তানিশার কাছে কিছু টাকা দিলেন হাত খরচের জন্য।

তানিশার আজ খুব খুশি খুশি লাগছে। কতদিন পর গ্রামে যাবে। তারউপর শ্বশুর বাবা কতগুলো শপিং করে দিয়েছে সবার জন্য। ব্যাগ গোছানো হলে রেডি হয়ে রওনা দিবে।
” এইযে শ্বশুরের আদরের বউমা? এই কাপড়গুলো ধুয়ে দাও এক্ষুনি। কতদিন থাকবেনা আমরা কি নোংরা কাপড় পরে থাকব? ”
বলেই সাইরা এবং শায়লা চৌধুরী কাপড়ের বালতি সামনে রাখে। দুইজনের হাতে চারটা কাপড় ভর্তি বালতি দেখে তানিশার দুচোখ ভরে উঠে লোনাজলে।
” মা, এখন আমি বেরোতে চাচ্ছিলাম। আ…..
আর কিছু বলার সুযোগ পায়না তানিশা।
” তুমি সিদ্ধান্ত নিবে কি করবে না করবে? আমার বাড়িতে থাকতে হলে আমার কথামত চলতে হবে। তা নাহলে সাদিফকে বলে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব। তোমার শ্বশুরের চৌদ্দ গোষ্ঠীও কিছু করতে পারবেনা। ”
” মম, ড্যাড ওকে শপিং ব্যাগটা যে দিল তাতে কি আছে একটু দেখি? ” সাইরা সেই ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলে।
” দেখ কি আছে। তোর বাবাকে বশ করে নিয়েছে এই ছো*ট*লো*কে*র মেয়ে। একে ছাড়া কিছুই বুঝেনা। ”
” মম, দেখো কত সুন্দর শাড়ী, থ্রী পিস, টি শার্ট আরো কত কিছু!
আমি এই থ্রী পিস নিলাম মম। এই শাড়িটা তোমাকে ভিষণ মানাবে। টি শার্টও আমিই রাখলাম। এই লো ক্লাস মেয়ে এসব দিয়ে কি করবে? সেই তো যাবে অজপাড়াগাঁয়ে অশিক্ষিত বাবা-মার কাছে। ”
” আচ্ছা তুই রাখ ওগুলো। আর শাড়িটা আমাকে দে। ”
ওদের ইচ্ছেমত সব নিয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।
হুহু করে কেঁদে উঠে তানিশা। কাঁদতে কাঁদতেই কাপড়ের বালতি নিয়ে প্রবেশ করে ওয়াশরুমে।

কাপড় ধুতে ধুতে এগারোটা বেজে যায়। একবারে গোসল সেরে বেরিয়ে আসে তানিশা। ছাদে কাপড়গুলো শুকাতে দিয়ে রেডি হয়ে নিচে নামে।
শ্বাশুড়ির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দেয় বাড়ির পথে।

ধুলো উড়িয়ে শাঁ শাঁ শব্দে ছুটে চলছে গাড়ি। জানালার গ্লাস খুলে রেখেছে তানিশা। কতদিন পর এই পথে যাচ্ছে! এই রাস্তা, গাছগাছালি এমনকি রাস্তার ধুলি কনাগুলোকেও বড্ড আপন মনে হচ্ছে। একমনে বাইরের দৃশ্য দেখতে থাকে তানিশা। এই পথের যেন শেষ নেই। দীর্ঘ যাত্রার পর বিকেল পাঁচটার দিকে তানিশার গ্রামে প্রবেশ করে। তানিশা ছটফট করছে কখন বাড়ি যাবে। বাবা-মা ওকে দেখলে চমকে যাবে। তারা তানিশার আসার সংবাদ জানেনা।

গ্রামের মাঝ বরাবর দুইতলা মাটির বাড়ি। চারপাশে মাটির দেয়াল দিয়ে তৈরী পাঁচিল। উত্তর-দক্ষিণ বরাবর লম্বা তিনটা মাটির দোতলা ঘর আবার পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা দুইটা ঘর নিয়ে মাটির দোতলা। দক্ষিণ দিকে টিনের বড় দরজার প্রবেশ পথ। দরজার সামনে একপাশে বড় বকুল গাছ। আরেকপাশে হলুদ বাগান বিলাসের বড় গাছটা লাল, গোলাপী কুঞ্জলতার লিকলিকে গাছগুলোকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখে দেয়ালের উপর নিরন্তর ফুল দিয়ে চলেছে। সবমিলিয়ে বাড়িটা বেশ ছিমছাম।

তানিশা গাড়ি থেকে বের হয়ে দৌড়ে দরজার সামনে আসে। ভেতর থেকে লাগানো টিনের দরজায় জোরেসোরে টোকা দেয়। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে যায়। মেয়েকে হাসিমুখে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়েশা খাতুন স্তব্ধ হয়ে গেছে। তানিশা মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে চোখের পানি ফেলতে থাকে। আয়েশা খাতুনও মেয়েকে পরম মমতায় বুকে জরিয়ে রাখে আর চোখের পানি ঝড়ায়।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here