মায়ায় জড়ানো সেই তুমি পর্ব -০৮

#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_৮
জাওয়াদ জামী

সারারাত দু’জন দুচোখের পাতা এক করতে পারেনা। রাত যেন আজ দীর্ঘ। দু’টি ভগ্ন হৃদয়ের গোপন কান্নার সাক্ষী রয় আজকের রাত।

প্রতিদিনের ন্যায় আজও রান্নাঘরে সবার পছন্দের খাবার তৈরীতে ব্যস্ত তানিশা। নিজের কষ্টকে প্রাধান্য না দিয়ে সবার চাহিদাকেই উপরে ঠাঁই দিয়েছে।

যথাসময়ে সবাই খাবার টেবিলে উপস্থিত হলেও জামিল চৌধুরী জানিয়েছেন, আজ থেকে তিনি রুমেই খাবেন। তাই তানিশা রুমে ওর শ্বশুরকে খাবার দিয়ে যতক্ষণ না খাওয়া হয় ততক্ষণ অপেক্ষা করেছে।

সবাই যে যার মত খাচ্ছে। সাদিফ তানিশার দিকে একটিবারও না তাকিয়ে শুধু এক টুকরো আপেল মুখে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। শায়লা চৌধুরী অনেকবার খাওয়ার কথা বললেও খায়নি । তানিশাও নিজের মত কাজ করছে।
” খালামনি আজকের পরোটায় তেল বেশি হয়েছে। এত তৈলাক্ত খাবার খেলে আমার স্কিন খারাপ হয়ে যাবে তো। আর তোমরা প্রতিদিন সকালে এসব কি খাও! পরোটা, ডিম ভাজা, আলু ভাজি, ভুনা মাংস, সেমাই। সকালে এসব খাওয়া যায়! বাসায় মাম্মা আমাকে কর্নফ্লেক্স, সিরিয়াল, ওটস্ বানিয়ে দেয়। ” আবদারের সুরে বলে সোহা।
” আচ্ছা আম্মু, কাল থেকে তোকে তোর পছন্দমত খাবারই দিব। আজকে কষ্ট করে খেয়ে নে। ”
” খালামনি ঐ মেয়েকে বলোনা কর্নফ্লেক্স করে দিতে। আচ্ছা ও কি ওসব বানাতে পারে? না কি শুধু গাঁইয়াদের মত পিঠা-পুলি, পায়েস এসবই জানে? যতসব গাঁইয়া। আঙ্কেল যে কি দেখে একে পছন্দ করেছিল! ”
সোহার কথা শুনে সাইফ, সাইরা হেসে উঠে।
” তোর আঙ্কেলের পছন্দের কথা বাদ দে। আমার পছন্দ কেমন তাই বল? সে নাহয় ছেলেকে ভাগাড়ে ফেলেছে। কিন্তু আমি সে ভুল করছিনা।আমি আমার ছেলেকে ভাগাড় থেকে তুলে প্রেমের সাগরে ছেড়ে দিব, বুঝলি? সাদিফের জীবনে দূর্গন্ধময় ভাগাড়ের অস্তিত্ব থাকবেনা। ”
” ঠিক বলেছেন মা, আমি ভাগাড় বলেই সারাদিন নোংরা, আবর্জনা আঁকড়ে ধরে থাকি। এসব আবজর্না ঠিক যেন কাঁঠালের আটা, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত লেগেই থাকে। আর ভাগাড় থেকে ছেলেকে তুলবেন কেমন করে? এই দুর্গন্ধময় ভাগাড় যদি দাবি না ছাড়ে? ভাগাড় নিজে যেমন দুর্গন্ধময় তেমনি আশেপাশেও দুর্গন্ধ ছড়াতে সময় নিবেনা। শুনুন আমি যতক্ষণ না ছাড়ছি ততক্ষণ আপনাদের মুক্তি নেই। কথাটা মনে রাখলে আপনাদেরই মঙ্গল। ”
শায়লা চৌধুরী স্তব্ধ হয়ে গেছে। এ কি শুনছেন তিনি! ঐ মেয়ে ইন্ডাইরেক্টলি থ্রে*ট দিল!
সাইরা, সাইফেরও গলায় খাবার আটকে গেছে।

ভার্সিটিতে এসে দুইটা ক্লাস করার পর আর ভালো লাগছেনা তানিশার। মস্তিষ্কে হাজার ভাবনা ঘুরাঘুরি করছে। কি করবে ভেবে কুল পাচ্ছেনা। লাইব্রেরীতে এসে বই খুলে সামনে ধরে রেখেছে ঠিকই কিন্তু পড়ায় মনযোগ দিতে পারছেনা। হুট করেই কেউ একজন ওকে টানতে টানতে বাইরে বাগানে এনে দাঁড় করায়।
” রিশা, কি হয়েছে তোর? আমাকে এভাবে টেনে আনলি কেন? ”
” তোর কি হয়েছে? এত আপসেট কেন তুই? কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। ”
” আমার কিছুই হয়নি রিশু। তুই শুধু শুধু চিন্তা করছিস। ”
” তানিশা আজ চার বছর যাবৎ আমাদের বন্ধুত্ব। তোর মুখ দেখেই আমি বুঝতে পারি কিছু হয়েছে কি না। এর আগেও অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু তুই এড়িয়ে গেছিস। আমি ভাবতাম তুই হয়তো আমাকে অন্তর থেকে বন্ধু বলে মনে করিসনা। কিন্তু অন্যদিনের থেকে আজকে তোকে অস্থির লাগছে। এমন মনে হচ্ছে তুই খুব চিন্তায় আছিস। তাই তোকে এভাবে এনেছি। আমি কি এতই পর যে কিছু খুলে বলা যায়না! ”
তানিশা কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে থাকে। আসলে সে কি বলবে! তার সাথে যা ঘটছে এগুলো কি আদৌ বলার মত! একবার ভাবছে রিশার সাথে শেয়ার করুক আবার পরক্ষণেই ভাবছে কি লাভ।
” তানু, তুই বলবিনা? ঠিক আছে বলিসনা। তবে শুনে রাখ তুই আমাকে পর ভাবলেও আমি তোকে নিজের বোনের মতই দেখি। তোর সকল সুখ-দুঃখে, বিপদ-আপদে আমি তোর পাশে থাকব। আচ্ছা এখন লাইব্রেরীতে যা। আমিও বাসায় যাবো। অযথাই তোর সময় নষ্ট করলাম। ” রিশা চলে আসতেই তানিশা ওকে ডাকে।
” রিশু একটু দাঁড়াবি? চল কোন নির্জন জায়গায় বসি। ” রিশা মাথা ঝাঁকিয়ে বাগানের একপাশে বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে যেয়ে বসে।

তানিশা বেশ কিছুক্ষণ থেকেই মাথা নিচু করে বসে আছে। আসলে কিভাবে শুরু করবে তাই ভাবছে। রিশাও ওকে সময় দিচ্ছে।
” রিশু আমার একটা চাকরি প্রয়োজন। যে কোন একটা চাকরি। কিন্তু সমস্যা হলো ঢাকায় আমার পরিচিত বলতে তেমন কেউই নেই। ”
” তুই চাকরি করবি! তোর হাসবেন্ড মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সিইও! তোর শ্বশুরও বড় পদে আছে ! আর তুই পড়াশোনা শেষ না করেই চাকরি করবি! ”
” রিশু আমি আমার পরিচয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই। তাছাড়া একটা চাকরি পেলেই ঐ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসব। ”
রিশার বুঝতে বাকি থাকেনা ঘটনা গুরুতর।
” তানু, তুই যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিস, ভেবেচিন্তে নিয়েছিস? ঝোঁকের বশে কিছু করে পরে পস্তাবিনা তো? ”
” আমি অনেক ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার পিছু হটার আর কোন পথ নেই। ”
” তাহলে আগামীকাল তুই আমাকে তোর বায়োডাটা দিস। দেখি কিছু করতে পারি কি না। ”
” তোর পরিচিত কেউ আছে রিশু? ”
” আমার বড় মামার কোম্পানি আছে। ছোট মামারও আছে। তুই বায়োডাটা দিলেই তাদের সাথে কথা বলব। ”
তানিশার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। রিশা নানানভাবে ওকে শান্তনা দেয়। আর ক্লাস করেনা কেউই। বিকেল পর্যন্ত তানিশাকে নিয়ে আড্ডা দেয়। তানিশার মন ভালো করার জন্য রিশা ব্যস্ত হয়ে গেছে।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় বিকেল গড়িয়ে গেছে। তানিশার বুক ধুকপুক করছে না জানি কি হয়। কিন্তু ওর ভাগ্য ভালো বলতে হবে। শায়লা চৌধুরী সোহা,সাইরাকে নিয়ে শপিংয়ে গেছে। বাসা পুরো ফাঁকা।
আজ রিশার সাথে বাইরে খেয়েছে তাই বাসায় এসে না খেয়েই শুয়ে পরে। শরীর ক্লান্ত থাকায় শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পরে।

শায়লা চৌধুরী সবাইকে নিয়ে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে। তানিশা জামিল চৌধুরীর খাবার রুমে দিয়ে আসে। সব কাজ সেরে অভ্যাসবশত অপেক্ষায় থাকে সাদিফের। সাদিফ সাড়ে এগারোটার দিকে বাসায় আসে। কলিংবেল বাজালে দরজা খুলে দেয় তানিশা। সাদিফ কোনকিছু না বলে সোজা রুমে চলে যায়। তানিশা খাবার গরম করতে শুরু করে।
টেবিলে খাবার দিতেই সোহা আসে।
” তুমি এখন যেতে পারো। সাদিফকে আমিই খেতে দিব। ” তানিশা কিছু না বলে রুমে চলে আসে।
সাদিফ নিচে এসে সোহাকে দেখেই ভুরু কোঁচকায়।
আশেপাশে তাকিয়ে তানিশাকে খোঁজে। কিন্তু তানিশার ছায়াও চোখে পরেনা। সোহা খাবার বেড়ে দিলে খেতে শুরু করে।

পরদিন সকালে রেডি হবার সময় প্রয়োজনীয় সব কিছু হাতের কাছেই পায়। কিন্তু খাবার টেবিলের পাশে তানিশাকে দেখেনা। তানিশার জায়গায় সোহা দাঁড়িয়ে আছে। সাদিফের হঠাৎই ভিষণ রাগ হয়। কিন্তু ও তো জানেনা, সোহা তানিশার থেকে সব দ্বায়িত্ব কেড়ে নিচ্ছে।

তানিশা ভার্সিটি যাবার পথে বায়োডাটা তৈরী করায়। ভার্সিটিতে পৌঁছে প্রথমেই রিশাকে বায়োডাটা দেয়। তারপর একে একে সব ক্লাস করে। ক্লাস শেষে দুইজনে মিলে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়। দুপুর গড়ালে যে যার পথে রওনা দেয়। দুজনের গন্তব্য শহরের দুই দিক। রিশা বাড়ির গাড়িতে করে রওনা দেয়। আর তানিশা রিক্সার খোঁজ করে।
বরাবরের মতো হুট করেই ইশানের বাইক এসে থামে তানিশার সামনে।
আজকাল তানিশা অভ্যস্ত হয়ে গেছে ইশানের এরুপ অদ্ভুত আচরণের।
” ম্যাডাম জলদি চলুন। আমাকে মিষ্টি খাওয়াবেন।”
” আপনাকে মিষ্টি খাওয়ানোর কোন চুক্তি ছিল নাকি! কই আমারতো মনে পরছেনা! ”
” গুণীজনরা ঠিকই বলত, মেয়েরা কিপ্টে হয়। আফসোস ইশান আফসোস। শেষমেশ এ কাকে বাঁচালি যে কিনা উচ্চ লেবেলের কিপ্টে। ”
” আপনি বারবার আমাকে কিপ্টে বলছেন কেন? কোন কারন ছাড়াই হুটহাট আপনাকে মিষ্টি খাওয়াতে যাব কেন? ”
” কারন ছাড়া কে মিষ্টি খেতে চেয়েছে ম্যাডাম? কারন আছে বলেই খেতে চেয়েছি। ”
” এখন কারনটা জানিয়ে আমাকে উদ্ধার করুন। ”
” আমার একটা চাকরি হয়েছে ম্যাডাম। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ম্যানেজার হিসেবে আমাকে পছন্দ করেছে এমডির বউ। আর পছন্দ করবেইনা কেন, আমার মত অ্যাট্রাক্টিভ ছেলে সেখানে একটাও নেই ” লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলে ইশান।
তানিশা বিষম খায়। মানুষ যে নিজের প্রসংশা নিজেই করে তা এই বান্দাকে না দেখলে আগে বিশ্বাস করতনা।
” বলছি কি মিষ্টি খাওয়াবেন তো? ”
তানিশা মহা মুসিবতে পরেছে। কি করবে ভেবে পায়না।
” বুঝেছি আপনার কাছে টাকা নেই। অবশ্য আমার কাছ থেকে ধার নিতেই পারেন। আমি আপত্তি করবনা। বেতন পেয়েই শোধ করে দিব। ”
তানিশা হতভম্ব হয়ে বলে, ” আপনার থেকে ধার নিব আবার মাস শেষে আপনিই ধার শোধ করবেন! কি আজব! ”
” ঐ যে দ্বায়িত্ব বলে একটা কথা আছে সেটাই পালন করছি। ” বিগলিত বদনে ইশান কথা বলছে।
” এই নিন টাকা, আর দয়া করে নিজেই পছন্দমত মিষ্টি কিনে খান। তবুও আমাকে নিয়ে টানাটানি বন্ধ করেন। ” তানিশা ইশানের দিকে কিছু টাকা বাড়িয়ে দেয়।
” একি করছেন ম্যাডাম! আমি ঢাকার মেয়েদের উপকার করতে আপনাকে মিষ্টি দায়ভার নিতে বলেছি। আর আপনি আমাকে টাকা দিচ্ছেন! দুনিয়ায় ভালোবাসা মানুষের কত অভাব! ” ইশান এমনভাবে বলছে যেন কেঁদে দিবে।
তানিশা লোকটার অভিনয় দেখে মনে মনে হাসে। তবে সেই হাসি ঠোঁটের কোনে ফুটতে দেয়না। কারন তানিশার প্রশ্রয় পেলেই এই লোক মাথায় চড়ে নাচবে।
” আপনি টাকা নিয়ে বিদেয় হন। আমার অলরেডি দেরি হয়েছে। এরপর আরো দেরি হলে বাসায় ঢুকতে পারবনা। ”
” বলেন কি! আপনার মা এত দজ্জাল! ব্যাড ভেরি ব্যাড। এই নিন ফোন, তার নম্বর দিন। আমি কথা বলছি উনার সাথে। ”
” জি না মা নয়। ওটা শ্বাশুড়িমা হবে। আর আপনি ফোন করলে বাসায় ঢুকার যে আশাটুকু আছে তাও শেষ হয়ে যাবে। ”
ইশান বড়সড় ধাক্কা খায়। বুকের মধ্যে হার্টবিটেরা ড্রাম পেটানো শুরু করে দিয়েছে। একটা চিনচিনে ব্যথা বুকের বাঁ পাশ থেকে শুরু করে সমস্ত দেহে ছড়িয়ে পড়ছে। হাত-পা অসার হয়ে গেছে।
” যাহ, কি বলছেন আপনি বিবাহিত হতে যাবেন কেন। আপনি আমার সাথে মজা করছেন। ” নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলে ইশান।
” আমি সত্যি বলেছি। এখানে বিন্দুমাত্রও মজার কিছুই নেই। ”
তানিশার মুখাবয়ব দেখে ইশান বুঝে নেয় তানিশা সত্যি বলছে। আর কথা বাড়ায়না। খপ করে তানিশার হাত থেকে টাকা নেয়।
” আপনি গেলেন নাতো কি হয়েছে! আপনার টাকা নিলাম। এখন মিষ্টির দোকানে যেয়ে ইচ্ছেমত মিষ্টি খাব। তবে আফসোস কোন মেয়ে জেলাস হবেনা। শুধু গায়ে পরে কথা বলতে আসবে। ” কথা বলতে বলতে ইশান ইশারায় একটা রিক্সা ডেকেছে। রিক্সা সামনে আসলে তানিশাকে ইশারা করে উঠার জন্য।
তানিশা একটু হেসে রিক্সায় উঠে বসে।

” এই যে ছোট নবাব আজ এই সময় বাসায় এসেছেন? সূর্য কোন দিকে উঠেছে আজকে। ” শাহানা সিদ্দিকা ছোট ছেলের রুমে আসে।
ইশানকে কপালে হাত রেখে শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়। ছেলেটা এঅসময়ে শুয়ে আছে কেন? ধীরে ধীরে ইশানের মাথার কাছে বসে চুলে বিলি কাটে।
” বাবু, তুই এই অসময়ে শুয়ে আছিস কেন? কিছু হয়েছে? মা’কে বল। ”
ইশান কিছু না বলে মায়ের কোলে মাথা রাখে। চুপচাপ মায়ের আদর নিতে থাকে।
শাহানা সিদ্দিকার মনে কু ডাকছে। তার এই চঞ্চল ছেলে এমন চুপচাপ হয়ে আছে, নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে! তিনি ছেলের স্থীরতা ঠিক মেনে নিতে পারছেননা।
” ইশু, আমাকে বলবিনা? আমার খুব চিন্তা হচ্ছে বাবা। ”
” মা বিয়ের আগেই তোমার নিষ্পাপ ছেলে বিপত্নীক হয়েছে। এই দুঃখ কোথায় রাখি মা। ”
” কিসব বাজে বকছিস! সব সময় তোর মজা না করলে চলেনা? এদিকে আমি মরছি চিন্তায় আর তিনি আমার সাথে মজা করছেন। সত্যি করে বল কি হয়েছে? ”
” পোলাতো নয় একখান আগুনেরই গোলারে। ” বেশ জোরে গেয়ে উঠে ইশান।
” আমি একজনের কাছে আগুনের গোলা হতে চেয়েছিলাম মাদার বাংলাদেশ। কিন্তু তার যে অলরেডি একখান আগুনের গোলা আছে তা কি ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছি! এক্কেবারে টুরু ছ্যাঁ*কা যেটাকে বলে সেটা গলাধঃকরণ করেছি আজ দুপুরে। ইশ! কি কষ্ট। বুকের ভিতর গ্যাসট্রিক হয়েছে মাদার বাংলাদেশ। একটা অ্যান্টাসিড দাওতো খেয়ে দেখি। যদি ব্যথা কমে। ”
শাহানা সিদ্দিকা ছেলের আবোলতাবোল কথায় ঘটনা কিছুটা আঁচ করে।
” ইশুরে, বাবা জীবনে চড়াই-উৎরাই আসবে। ধোঁকা খাবি, পদে পদে ঠেকবি আরো অনেক কিছুই হবে কিন্তু এসব ভেবে কখনো নিজেকে কষ্ট দিতে নেই। কিছু ব্যর্থতা, কিছু কষ্ট যেটা একান্তই নিজের থাকে, সেটাকে যত্ন করে বুকের ভেতর গোপনে রাখতে হয়। অতি সংবেদনশীল হয় এসব গোপন ব্যর্থতা, গোপন কষ্ট। এই ব্যথাময় সুখগুলোতে মাঝেমাঝে হাত বুলিয়ে না পাওয়ার পরশ নিতে হয়। তবেইনা না পেয়েও অনেককিছু পাওয়া যায়। ”
ইশান মায়ের কোলে মাথা রেখে নিশ্চুপ থাকে। এখন কিছুটা শান্তি লাগছে। এতক্ষণ এই কথাগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল ও।

সাদিফ বাসায় আসলে আজ সোহা দরজা খুলে দেয়। সাদিফের দুচোখ তানিশাকে খোঁজে। খাবারও দেয় সোহা। সাদিফ চুপচাপ খেয়ে উঠে যায়। সোহার সাথে কোন কথা বলেনা। সাদিফকে গম্ভীর দেখে সোহাও ঘাঁটায়না।

সকালে তানিশা রান্না করে নিজের রুমে এসেছে। আজ ওরা নিজেরাই খেয়ে নিক। ওর শরীরটা ভালো লাগছেনা। রহিমা খালাকে ডেকে জামিল চৌধুরীকে খাবার দিতে বলে। রহিমা খালাও তানিশার চোখমুখ দেখে বুঝতে পারে ওর শরীর ভালোনা।
শরীর খারাপ থাকায় ভার্সিটিতে যাওয়া হয়না। এদিকে রিশাও ফোন দিয়ে জেনেছে তানিশার শরীর খারাপ তাই ভার্সিটিতে আসতে জোড় করেনি।
পরপর দুইদিন ভার্সিটি মিস করে তানিশা। এই দুইদিন বাসার সব কাজ রহিমা খালাই করেছে। তানিশা শুধু রান্না করেছে।
এই কয়দিন তানিশা ভুল করেও সাদিফের সামনে যায়নি। ও আর নিজেকে সাদিফের মায়ায় জড়াবেনা বলে পণ করেছে।
এদিকে সাদিফ রেগে আছে তানিশাকে না দেখে।ও ভাবছে তানিশা জিদ করছে ওর সাথে। ভাবতেই রাগ আরো বেড়ে যায়। এখন তানিশা সাদিফের রুমে যায়না। রহিমা খালাকে দিয়ে সাদিফের কাপড়চোপড় নিয়ে এসে পরিস্কার করে দেয়। খালাকে বুঝিয়ে দেয় কাপড়চোপড় কিভাবে, কোথায় গুছিয়ে রাখতে হবে। সাদিফ অফিসের জন্য রেডি হতে গেলে হাতের কাছে কিছুই পায়না। রেগেমেগে সব এলোমেলো করে রেখে দেয়।
এভাবেই দুইজন দুই আ*গু*নে পু*ড়*তে থাকে। তানিশা পু*ড়ে অবহেলার আ*গু*নে। আর সাদিফ পু*ড়ে ভালোবাসা পেয়েও হারানোর আ*গু*নে।

তৃতীয় দিন তানিশা ভার্সিটি মিস দেয়না। ডিপার্টমেন্টে এসেই দেখা হয় রিশার সাথে। রিশা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে তানিশাকে। কিন্তু তানিশার চোখমুখের অবস্থা সুবিধার না দেখে ভয় পায়।
” তানু, তোর চেহারার এ কি হাল হয়েছে! কিছু খাওয়াদাওয়া করিসনা? ”
” কয়েকদিন থেকে খেতে পারছিনা। শরীর খুব ক্লান্ত থাকে। এসব বাদ দে। রিশা, তুই আমার কথা তোর মামাকে বলেছিলি? ”
রিশা হাসিমুখে ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে তানিশার সামনে ধরে।
” মামা গতকাল তার বাসায় ডেকেছিল। আমি যেতেই সারপ্রাইজ দেয়। তোর চাকরি হয়ে গেছে। তবে প্রথমে অবশ্য কম্পিউটার অপারেটরের পদে কাজ করতে হবে তোকে। অনার্স ফাইনাল দেয়ার পর তোর কাজ দেখে প্রমোশনের ব্যবস্থা করবে। ”
” রিশু তুই বায়োডাটা মামাকে দেখিয়েছিলি কখন! আর এত তারাতারি সব হয়ে গেল! ”
” গাধি, আমাকে যেদিন বায়োডাটা দিয়েছিলিনা? সেদিনই ভার্সিটি থেকে সোজা বড় মামার বাসায় গিয়েছিলাম। উনাকে বায়োডাটা দেখিয়েছি। তোর রেজাল্ট ভালো থাকায় মামা আপত্তি করেনি। ”
” ধন্যবাদ দোস্ত। তুই আমার বড় বোনের দ্বায়িত্ব পালন করলি। তোর এই উপকার আমি কোনদিন ভুলবনা। ” কেঁদে ফেলে তানিশা।
” এই বোকা তুই কাঁদছিস কেন! আমি তোকে সুখী দেখতে চাই। তোকে আমি নিজেরই অংশ মনে করি। তবে আরেকটা কথা বলা হয়নি। তোর পোস্টিং কিন্তু সিলেট। ” মুখ গোমড়া করে বলে রিশা।
” বাঁচালি দোস্ত। আমি এই শহর ছেড়ে দূরে কোথাও যেতে চেয়েছিলাম। এখানে থাকলে আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারতামনা। ”
” ওয়েট প্লিজ, আমার কথা শেষ হয়নি। তুইতো জানিস আমার নানাভাইয়ের বাড়ি সিলেট। নানাভাই মারা যাবার পর নানিমনি সেখানেই থাকে। নানাভাইয়ের স্মৃতি থেকে দুরে থাকতে চায়না সে। তাই হাজার বলেও তাকে আমরা ঢাকা আনতে পারিনি। তিনি নানাভাইয়ের বাড়ি আঁকড়ে ধরে পরে আছেন। আমি আম্মু,মামার সাথে কথা বলে ঠিক করেছি তুই আমার নানিমনির সাথে থাকবি। তোর কিছুই করতে হবেনা শুধু অবসরে নানিমনির সাথে গল্প করবি। এটাই ফাইনাল ডিসিশন তোর রাজি না হয়ে উপায় নেই। ”
” আমার জয়েনিং কবে? জানিস কিছু? ”
” আজ আটাশ তারিখ। ত্রিশ তারিখে জয়েন কর। এক তারিখ থেকে অফিস। আজ থেকেই গোছানো শুরু কর। ত্রিশ তারিখের টিকেট কাটবো দুজন একসাথে আজকেই। আমি তোকে সব চিনিয়ে দিয়ে তবেই ঢাকা ফিরব। ”
তানিশা সম্মতি জানায় রিশার কথার।
বাড়ি ফিরে নিজের টুকটাক জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করে।

পরদিন ভার্সিটিতে এসে ডিপার্টমেন্টের হেডের সাথে কথা বলে। স্যারকে চাকরির ব্যাপারে জানিয়ে শুধু পরিক্ষা দেয়ার অনুমতি নেয়। সব ক্লাস শেষ করে সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে। তানিশার মন ভিষণ খারাপ। সব বাঁধন ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে উঠতে গেলেই মাথা ঘুরে পরে যায় তানিশা। দিশা না পেয়ে কয়েকজন ফ্রেন্ডের সহযোগিতায় রিশা ওকে ভার্সিটির কাছের ক্লিনিকে নিয়ে যায়।

দুর্বল শরীর নিয়ে বাসায় ফিরে। ওর মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। নানান চিন্তা মাথায় ভিড় করেছে। কি করে একা একটা মেয়ে লড়াই করবে!

রাতে সাদিফ বাসায় আসলে রহিমা খালা দরজা খুলে দেয়। তানিশা লুকিয়ে লুকিয়ে কিছুক্ষণ তাকে দেখে। এই মানুষটাকে হয়তো আর কখনোই দেখতে পাবেনা। কিশোরী বয়সে এই মানুষটার প্রেমে এমন বিশ্রিভাবে পরেছিল তার থেকে আজও বেরোতে পারেনি। হয়তো কোনদিন পারবেওনা।
তানিশা লক্ষ্য করে সাদিফ এদিকওদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজছে। হয়তো সোহাকে খুঁজছে।

পরদিন সকালে রান্না শেষ করে তানিশা রুমে আসে। দুপুর বারোটার গাড়িতে টিকেট করা হয়েছে। জামিল চৌধুরী আজকাল আলাদা রুমে থাকে। তানিশা উনার জন্য খাবার নিয়ে আসে। যতক্ষন না খাওয়া হয় ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।
খাওয়া শেষ হলে জামিল চৌধুরীর পাশে বসে।
” বাবা আজ আমি চলে যাচ্ছি। দোয়া করবেন আমাদের জন্য। ”
” জামিল চৌধুরীর কোন কথা বলার ভাষা আজ নেই। তবুও অনেক কষ্টে জিজ্ঞেস করে কোন ব্যবস্থা হয়েছে মা? ”
” জ্বি বাবা। একটা কোম্পানিতে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে জয়েন করব কাল। ”
” কতদূর যাচ্ছো মা? এই অসহায় বাবাকে ভুলে যাবেনাতো? ”
” আমি নিজেকে ভুলতে পারি কিন্তু আপনাকে কখনোই ভুলবনা। সিলেট যাচ্ছি। আমি ফোন নম্বর বদলে ফেলেছি বাবা। কাল নতুন নম্বর থেকে আপনাকে ফোন দিব। তবে একটা অনুরোধ কাউকে বলবেননা আমি কোথায় আছি, ফোন নম্বর কোন কিছুই না। ”
” ঠিক আছে মা। তুমি যেখানেই থাকো ভালো থাকো। এই দোয়াই করি। ”
তানিশা রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ওর বুকটা ভারি হয়ে আছে। শায়লা চৌধুরীর কোথাও দাওয়াত আছে। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কিছুক্ষণ আগে বেরিয়েছে। সাদিফও অফিসে। তানিশা তৈরী হয়ে জামিল চৌধুরীর কাছে আসে। তিনি আজ অফিসে যাননি। তানিশার যাওয়ার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ কেঁদেছেন। কিছুই করতে পারেননি মেয়েটার জন্য তাই মেয়েটা যাওয়ার সময় একটু পাশে থাকতে চেয়েছেন।

তানিশা একে একে জামিল চৌধুরী, রহিমা খালার কাছ থেকে বিদায় নিল। রহিমা খালা স্তব্ধ! বউ কেন এমন করল! শেষবারের মত বাড়িটার ঘুরে তাকায় তানিশা। আর কখনোই এখানে ওর পা পরবেনা!

সাদিফ অফিসের কাজে মন বসাতে পারছেনা। অস্থিরতা ঘিরে ধরেছে ওকে। এক সময় দেখে অফিসিয়াল একটা ফাইল বাসায় রেখে এসেছে।শায়লা চৌধুরীকে ফোন দিলে জানতে তারা কেউ বাসায় নেই। বাধ্য হয়ে আবার বাসার দিকে রওনা দেয়।

কলিংবেলের আওয়াজে দরজা খুলে দেয় রহিমা খালা। সাদিফ কিছু না বলে জোড় কদমে সিঁড়িতে পা বাড়ায়।
” বাপজান, তানিশা বউমা বাড়ি ছাইড়া গেছে গা। ” দুইটা সিঁড়ি টপকাতেই থেমে যায় সাদিফের পা। ঘুরে তাকায় রহিমা খালার দিকে। তারপর কোন কথা না বলে গেষ্টরুমে ছুটে যায়। ছিমছাম গেষ্টরুমের কাপড়ের আলনা ফাঁকা। কাঁপা কাঁপা হাতে আলমারি খুলেই বুকের ভিতর তোলপাড় বুঝতে পারে সাদিফ। আলমারিতে কোন কাপড় নেই। এমনকি ড্রেসিং টেবিলেও তানিশার ব্যবহার্য কিছুই নেই। মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে সাদিফ। রহিমা খালা দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে।
” খালা ও কোথায় গেছে, কিছু বলে গেছে? ”
” না বাপজান। শুধু কইছে একটা চাকরি হইছে আর এহান থাইকা দুরে অফিস তাই যাইতাছে। ”
সাদিফ সমস্ত বিছানা, আলমারি এলোমেলো করে খুঁজতে থাকে তানিশার যদি কোন ঠিকানা পায়। খুঁজতে খুঁজতে আলমারির একটা তাকের উপরে মেলে রাখা সংবাদপত্রের নিচ থেকে প্রাইভেট ক্লিনিকের খাম নিচে পরে। খামের উপরে তানিশার নাম লিখা। কাঁপাকাঁপা হাতে খাম খুলে সাদিফ। কিছুক্ষণের জন্য হার্টবিট থেমে যায়। মেঝেতে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
রহিমা খালা ছুটে আসে সাদিফের কাছে।
” বাপজান, এম্নে কাইন্দেননা। ভাইজান ঘরে কানতে কানতে ঝিম মাইরা পইরা রইছে। আবার আপ্নে এম্নে কানতাছেন! আমি কি করি এহন। ”
” কি বললেন খালা! বাবা বাসায় আছে? ” রহিমা খালার কাছে হ্যাঁ সূচক উত্তর পেয়ে বাবার কাছে ছুটে সাদিফ।
জামিল চৌধুরী বিছানায় শুয়ে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন।
” বাবা! তানিশা কোথায় গেছে তুমি জানো? ”
” কেন তা শুনে তুমি কি করবে? তোমার গলার কাঁটা আজ নেমেছে। তোমার তো এখন ভালো থাকার কথা। ”
সাদিফ বাবার পায়ের উপর পরে কাঁদতে থাকে। জামিল চৌধুরী ছেলের এরুপ অবস্থা দেখে থমকে যায়।
” বাবা তানিশা আমাকে ভালো রাখতে ছেড়ে যায়নি। আমাকে চির অপরাধী করে রেখে গেছে। আমার পিতৃত্বের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আমি শেষ হয়ে গেছি বাবা। ”
” এ কি বলছো তুমি সাদিফ! পিতৃত্বের অধিকার মানে? আল্লাহ আমি এ কি ভুল করলাম! তানিশা যাওয়ার আগে বলেছিল, আমাদের জন্য দোয়া করবেন! তবে কি…. ”
সাদিফ ক্লিনিকের পেপারস জামিল চৌধুরীর সামনে ধরে। সেখানে জ্বলজ্বল করছে প্রেগেন্সি রিপোর্ট পজিটিভ!

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here