মায়াবতী পর্ব ৩২+৩৩+৩৪+৩৫

#মায়াবতী
#পর্ব_৩২
#সুলতানা_পারভীন
বেশ স্পিডেই গাড়ি ছুটিয়ে সিলেট পৌঁছেছে রাহাত। নেভিগেশনে চন্দ্র গ্রাম নামে প্রত্যন্ত এই গ্রামটা খুঁজে পেতে বেশ ভালোই বেগ পেতে হয়েছে রাহাতকে। আর একেবারে আদিম যুগের গ্রাম বলা চলে। একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে যেখানে প্রায় সবটাতেই নগরায়নের ছোঁয়া লেগেছে, সেখানে কেমন করে যেন এই ছোট্ট গ্রামটা বাদ পড়ে গেছে। সিলেটের যত ভিতরের দিকে যাচ্ছে ততই নেটওয়ার্ক খারাপ হচ্ছে। তাই সিলেট পর্যন্ত ঠিকঠাকভাবে পৌঁছলেও চন্দ্রগ্রাম খুঁজে বের করতে রাহাতকে বেশ খানিকটা নাকানি চুবানি খেতে হলো। গ্রামের সীমানায় পৌঁছে তো আরো যাচ্ছে তাই অবস্থা। সময়টা সম্ভবত রাত ১০ টার একটু বেশিই হবে৷ কিন্তু গ্রামের কোন ঘর থেকে আলোর ছিটেফোঁটাও দেখতে পাচ্ছে না রাহাত। তার উপরে এতো সরু রাস্তা!! গাড়ি সামনে নিতে প্রায় গাছ গাছালির উপরে তুলে দিচ্ছে টাইপের অনুভূতি হচ্ছে রাহাতের। তবে কেন যেন এই শহর থেকে এতো দূরের প্রত্যন্ত এলাকার অচেনা গ্রামটাতে এসেও রাহাতের বেশ লাগছে। এতো খুশির কারণটা রাহাত নিজেও ধরতে পারছে না।
মাথায় একটন পরিমাণের কনফিউশান নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল রাহাত। বেশ অনেকটা রাস্তা আগেই এক মুদি দোকানির কাছে মায়াদের বাড়ির হালকার উপরে ঝাপসা একটা নকশা পেয়েছিল। সেটা মাথায় রেখেই সামনে এগুচ্ছিল রাহাত। চারদিক শূন্যতায় খা খা করছে অথচ ছোট খাটো দোকানপাট গুলো ঠিকই এতো রাতেও খোলা!! ভাবা যায়!! রাহাত যে ঠিক কতোটা অবাক হয়েছে তা বলার মতো না। তার চাইতেও বেশি অবাক হয়েছিল যখন মায়া আর মিহানের নাম বলতেই দোকানি বলেছিলঃ- “হেডমাস্টার সাহেবের বাইত যাবেন!?” মায়ার বাবা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত এলাকার এক মাত্র স্কুলটার প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এই তথ্যটাও রাহাতের জানা ছিল না। আচ্ছা? মায়ার সম্পর্কে আর কি কি জানা নেই তার?? মায়াদের হোম টাউন সিলেট!! এটা দিহানের পাঠানো এ্যাড্রেসটা দেখার আগে ভুলেও কল্পনা করতে পারে নি রাহাত। নিজের ভালোবাসাতেই এখন খানিকটা সন্দেহ হচ্ছে রাহাতের। আবার এটাও মনে হচ্ছে ওর কাছ থেকে চলে গিয়ে আসলেই হয়তো মায়া ভালোই করেছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনের দিকে তাকাতেই দোকানির ডিরেকশন দেয়া মসজিদটা দেখতে পেল রাহাত। এটাও এই গ্রামের একমাত্র মসজিদ কিনা কে জানে! তবে মসজিদ পার করে বাম পাশে ঘুরিয়ে কিছুটা যেতেই একটা ছোটখাটো গেইট মতো দেখতে পেল রাহাত। গাড়িটা সেখানে পার্কিং করেই বাড়ির ভিতরে ঢুকে জাস্ট হা হয়ে গেল রাহাত। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটের আলোয় বেশ পুরানো একটা টিনের ঘর। কখনো হয়তো যত্ন করেই বানানো হয়েছিল ঘরটা। তবে অনেকদিনের অযত্নে অব্যবহারে টিনে মরিচা পড়েই হয়তো রাতের আঁধারিতে কালচে দেখাচ্ছে বাড়িটাকে। কি কারণে কে জানে রাহাতের গা টা একটু শিউরে উঠলো৷ কোনমতে কাঁপা কাঁপা পায়ে দরজায় গিয়ে কড়া নাড়লো রাহাত। মুদি দোকানি আরো একটা কাজের খবর দিয়েছে রাহাতকে। আর সেটা হলো মায়ারা পুরো পরিবার নতুন বৌ সহ আজ দুপুরেই বাড়ি এসেছে। ভাবতে ভাবতেই খুঁট করে দরজাটা শব্দ করে একটু ফাঁক হলো। দরজাটা খুলে দিতেই রাহাত দেখলো মিহান প্রায় হা করে রাহাতের দিকে তাকিয়ে আছে।
-আরে?? রাহাত ভাই? আপনি?? এতো রাতে?
-আসলেই ভাই দেরি হয়ে গেছে অনেকটাই—।
-আসুন আসুন–। ভেতরে আসুন–।
-জি—-।।
মায়া ছাড়া বাকি সবাই ছোট জায়গাটায় জড়ো হয়েছে। ডাইনিং কাম ড্রইং রুমের মতো করে সাজানো জায়গাটা। সবার সাথে চেয়ারে বসে পড়লো রাহাত।
-রাহাত? বাবা?? তোমার নাকি অফিসে জরুরি কাজ আছে তাই আসো নি??
-না মা–। কাজ ছিল–। আসলে কাজটা দুপুরের মধ্যে শেষ হবে আমি জানতাম না–। আর আমি আসবো মায়া বলে নি আপনাদের??
-কই নাহ—-। এই মেয়েটা কাজের কথাগুলোই বলে না—। বসো বাবা-। খেতে দিই–। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে—-। মিহান রাহাতের সাথে একটু যা বাবা—। ছেলেটা একটু ফ্রেশ হয়ে নিক—-।।
হাত মুখ ধুতে গিয়ে আরেকবার অবাক হতে হলো রাহাতকে। বাড়ির ভিতরে ওয়াশরুমের কোন ব্যবস্থা নেই। হাত মুখ ধুতে হলো পুকুরঘাটে গিয়ে। শান বাঁধানো ঘাট যদিও পুকুর পারে। আর বেশ খানিকটা দূরেই একটা টিনের ছাউনি নিয়ে টয়লেট। ফ্রেশ হয়ে এসে এতোক্ষণে রাহাতের খেয়াল হলো সকাল থেকেই সে যে না খেয়ে আছে ব্যাপারটা টেরই পায় নি। রাস্তায় এক কাপ চা খেয়েছে শুধু। টেবিলে ভাত আর মাছ তরকারি দেখে এতোক্ষণে খিদেটা যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তাড়াতাড়ি খাওয়া শুরু করলো রাহাত।
-বাবা কিছু মনে করো না–। তুমি আসবে জানলে ভালো মন্দ কিছু রাঁধতাম—।।
-আরে নাহ নাহ মা–। সমস্যা নেই–। আপনার হাতের সব রান্নাই আমার জন্য অনেক স্পেশাল–।
-মেয়েটা যদি একবারও বলতো—?
-মায়া কোথায় মা??
এতোক্ষণে দিয়া মুখ খুললো। বেশ অনেকক্ষণ ধরেই রাহাতকে দেখে জাস্ট অবাক হয়ে চুপ করে ছিল দিয়া। এতো রাতে উনি আসবেন সেটা দিয়ারও কল্পনার বাইরে ছিল।
-হি হি—। ভাইয়া মায়া আপু তো ঘুমিয়ে গেছে সেই কখন–। আমি তো আপনি এসেছেন দেখে ডেকে এলাম–। আপু টেরও পায় নি—।
রাহাত হালকা হেসে খাওয়ায় মন দিল। মনে হলো এই মাত্র যেন ওর বুকের উপর থেকে কেউ এক টন ওজনের একটা পাথর নামিয়ে নিয়েছে। খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে মুছে একটু গল্প করলো রাহাত সবার সাথে। এতোটা জার্নি করে এসেছে তাই বেশিক্ষণ বসে থাকলো না। মিহান মায়ার রুমটা দেখিয়ে দিলে সেদিকেই গিয়ে রুমে ঢুকলো রাহাত। কাঠের ডবল পার্টের একটা দরজা আছে৷ সেটা ভালো করে বন্ধ করে মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে মায়াকে দেখতে পেল রাহাত। খাটের একপাশে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। গায়ে পাতলা একটা কাঁথা জড়ানো।
গায়ের টিশার্টটা খুলে মায়ার পাশের খালি বালিশটায় শুয়ে পড়লো রাহাত। মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট বন্ধ করে মায়ার দিকে এগিয়ে এসে কাঁথার মধ্যেই ঢুকে বুকে জড়িয়ে নিলো। সারা দিনের এতো থকল পার করে এখন রাহাতের শান্তি লাগছে মায়াকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পেরে। অন্ধকার হাতিয়ে মায়ার কপালে আলতো করে একটা চুমো খেয়ে শক্ত করে বুকে চেপে ধরলো মায়াকে। মায়াও ঘুমের ঘোরে রাহাতের বুকের ভিতরে ঢুকে এলো। রাহাত হেসে মায়ার চুলে হাত বুলালো।
” ঘুম ভাঙলে মায়াবতীটার আমাকে দেখে কি রিএ্যাকশন হবে ভিষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এতো টায়ার্ড লাগছে চোখও খুলে রাখতে পারছি না। উফফ—। এই মিষ্টি মায়াপরীটাকে বুকে নিলেই শান্তিতে চোখ জুড়িয়ে আসে কেন এতো? এই মায়াবতী? কাল থেকে একটা নতুন সূচনা করতে চাই তোমাকে নিয়ে–। পারমিশন দিবে আমার মায়াবতীটা?”
কথাটা বলে নিজেই হেসে ফেললো রাহাত। পাগলীটা তো ঘুমে কাদা হয়ে গেছে একেবারে। সকালে কি করবে কে জানে? রাহাত আলতো করে মায়ার কপালে আরেকবার ঠোঁট ছুঁইয়ে চোখ বুজলো। আর তার চোখ জুড়ে নেমে এলো রাজ্যের ঘুম।।
চলবে
(একটু খুশি হইয়া যান)#মায়াবতী
#পর্ব_৩৩
#সুলতানা_পারভীন
ভোরের দিকে মায়ার ঘুম ভাঙলো নাকে চুলের সুড়সুড়ি লাগায়। হাত দিয়ে নাক ঘষে দেয়ার চেষ্টা করায় গরম একটা শরীরে হাত ঠেকলো। মায়া আঁতকে উঠে চোখ মেলে তাকাতেই রাহাতকে দেখে আরেকবার থতমত খেয়ে গেল। রাহাত মায়ার সাথে একই কাঁথা গায়ে পেঁচিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তাও আবার খালি গায়ে! এক মূহুর্ত মায়ার মনে হল আসলে ব্যাপারটা সত্যি না। ও নিজেই হ্যালুসিনেশন করছে। যার উপরে রাগ করে এতোদূরে পালিয়ে এলো সেই মানুষটা কি করে এক রাতের মধ্যে ওকে খুঁজে পাবে!! একই শহরে থাকতেও খুঁজে পেতে দশটা দিন সময় লেগেছিল তার। আর ঢাকা থেকে এতো দূরে এই পাড়াগাঁয়ে মাত্র কয়েকটা ঘন্টায় খুঁজে বের করে ফেলবে!! অসম্ভব।
মায়া ধরেই নিয়েছে রাহাত আসে নি। যাকে পাশে বেঘোরে পড়ে পড়ে ঘুমাতে দেখছে সেটা ওর কল্পনা। একটু আলতো করে ছুঁয়ে দিলেই ভ্যানিশ হয়ে যাবে মানুষটা। মায়া রাহাতের দিকে মুখ করে বালিশে মাথা রেখে রাহাতকে দেখছে এক মনে। ওর খুব করে ইচ্ছে করছে একবার মানুষটাকে ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু ধরলেই আর মানুষটাকে দেখতে পাবে না ভেবে আর সাহস করে এগুচ্ছে না মায়া।
-কেন এসে এসে জ্বালাচ্ছ? সব কিছু ছেড়ে ছুঁড়ে তো চলে আসতেই চাইছি একেবারে৷ তবু কেন বার বার পথ আটকাচ্ছো? তোমাকে সত্যি আর কারো সাথে নিতে পারবো না আমি। —- সেদিন যখন বলেছিলে আমার জন্য আগের সব ভুল শোধরাতে চাও–সেদিনও বিশ্বাস করেছিলাম জানো?? কিন্তু তুমি কি করলে? আরেকবার আমার বিশ্বাসটা ভাঙলে। কেন বলো তো? —–আমি তো ভুলেই গেছিলাম। যে মেয়েটাকে অফিসে পি.এ রাখতে তোমার প্রেসটিজে বাঁধে-যাকে গেঁয়ো দাদিআম্মা মনে হয়- তাকে কেনই বা নিজের জীবনসঙ্গী করে রাখবে??
কথাগুলো বলতে বলতে মায়া একটু অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিলো। হঠাৎ কারো হাতের টানে একেবারে বুকের ভিতরে জাপটে ধরা অনুভব করলো মায়া। আরেকবার অবাক হয়ে মায়া রাহাতের দিকে তাকালো। না তো। মানুষটা তো ঠিকই পাশে আছে৷ ভ্যানিশ হয়ে যায় নি। ব্যাপারটা খেয়াল হতেই মায়ার বুকের ভিতরে ধ্বক করে উঠলো। রাহাত সত্যি সত্যি এসেছে!!? কি করে!! শরীর মোচড়ামুচড়ি করে রাহাতের হাতের বাঁধন থেকে ছোটার বহু চেষ্টা করেও ছুটতে পারছে না মায়া। হাত দুটো যেন ইচ্ছে করে আরো বুকের ভেতরে চেপে ধরছে মায়াকে। মায়া খুব বিরক্ত হয়ে চুপ করে গেল। এই লোকটা এমন কেন? একটু হারিয়ে গিয়েও শান্তি নেই এর জন্য। কোথাও একটু হাওয়া হয়ে যেতে দিবে না নাকি!?
-উহু—। দিবো না হাওয়া হতে–। এতো অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকো না তো। ঘুমুতে দাও–। এভাবে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলে ঘুম ঘুম ক্লান্ত শরীর নিয়েও তোমার মাঝে ডুব দিবো কিন্তু—–।।
মায়া তাড়াতাড়ি রাহাতের বুকে মুখ লুকিয়ে নিল। এই লোকের আসলেই বিশ্বাস নেই। আর কখন কি বলে তার হুঁশটুকুও নেই। রাহাত আরো নিবিড় করে মায়াকে বুকে চেপে ধরলো।
-কি আছে কি নেই সেটা সকালে ঘুম ভাঙলে বুঝাবো দাঁড়াও—।
মায়া একবার শিউরে উঠে রাহাতের বুকে আরেকটু আড়ষ্ট হয়ে চুপ করে রইলো। রাহাত চোখ বুজেই আলতো করে মায়ার চুলে চুমো খেল। এক সময় দুজনেই গভীর ঘুমে হারিয়ে গেল। ঘুমের ঘোরেও মায়ার বারবার মনে হচ্ছে রাহাত আসলেই আসে নি। স্বপ্নই দেখছে সে। ঘুম ভাঙলেই দেখবে মানুষটা নেই। অথচ তবুও মানুষটার স্পর্শ, উষ্ণ শরীর, নিঃশ্বাস, বুকের ঢিপঢিপ সবই বেশ ভালো করেই অনুভব করতে পারছে।
সকালে মায়ার ঘুম ভাঙলো ঠোঁটে কারো ঠোঁটের স্পর্শে। চমকে আথালিপাথালি সরে যাওয়ার আগেই রাহাত ওকে টেনে বুকে শুইয়ে দিলো।
-আরে আরে?? গুড মর্নিং মায়াবতী? আমি তো?
-তুমি!!? মানে!! তুমি কখন এলে?
-সেই কখন এলাম!! রাতে এলাম। আর তুমি তো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছ—-।
-কেন এসেছ??
-মিহান ভাইয়া আর দিয়া ভাবি হানিমুনে এখানে এসেছে—। তোমার আমার হানিমুনটাও তো বাকি ছিল না? তাই আর কি?? মাকে বলো নি আমি আসবো??
-তুমি!!? অসহ্য লোক একটা!! এক্ষুণি ঢাকা ফিরে যাবা অসভ্য লোক—।
-আরে আরে–?? আচ্ছা?? তুমি বললেই চলে যাবো নাকি? উহু– মোটেও না—-। তোমার সাথে বহু হিসাব বাকি আমার—। সেগুলোর ফয়সালা না করে এক পা ও নড়ছি না আমি—-।
-কিসের হিসাব শুনি??
-তোমার সব রাগ, অভিমান, অভিযোগ মেনে নিয়েছি আমি৷ কিন্তু তোমার আমার সম্পর্কটা শুধু শরীরের চাহিদা মেটানোর জন্য ছিল এটা কেন বললে?
-বলবো না কেন?? আর এসেছই বা কেন? যাও না তোমার পি.এ র কাছে? আমার কাছে কি?
-আরে?? পি.এ র বিয়েতে তোমাকে সহ দাওয়াত দিয়েছে তো–। তোমাকে নিতে এসেছি–।
-মানে??
-সেদিন দিহানের সাথে কথা বললে না? ওর আর লিজার বিয়ে—।
-তো আমি কি করবো??
-আরে?? কি মুশকিল?? ওরা দুজন না থাকলে তোমাকে খুঁজে পেতাম কিনা কখনো জানিও না—। তাই ওদের বিয়েতে তোমাকে নিয়ে যাবো–। ওরা আমার পাগলামি দেখে তোমাকে দেখতে চায় জানো??
-বাহ!! ওই মেয়েকে তুমি পার নাইট ৫০০০০ করে টাকা দিচ্ছ আবার বিয়েতে বউ নিয়ে যেতেও চাচ্ছো!! কি ব্যাপার কি বলো তো?
-আরে শোনো না—? তোমাকে যে অডিওটা পাঠিয়েছে সেটা আরো আগেই–। ওই যে তুমি বাড়ি থেকে চলে এসেছিলে?! সেদিনের—। জুলি ইচ্ছে করেই—–।।
-আবার জুলি!!
-না রে বাবা—। শোনো না? ওই বদমাইশ মেয়েটা তোমাকে ইচ্ছে করে ভুল বুঝাচ্ছে মায়াবতী–। আমি সত্যি—–।।
-এসব করো নি বলছো? এটা তোমার গলা নয় সেটা বলতে চাইছ তুমি আমাকে!?
-না তো—-। করেছিলাম তবে এখন সব ছেড়ে দিয়েছি—। সরি তো মায়াপরী–। ওটা আগে করে ফেলেছিলাম–। আমি সত্যি সব শুধরে নিয়েছি বিশ্বাস করো??
-আবার??!
-উ—হ–। তুমি দিহানকেই জিজ্ঞেস করো না হয়?? ও সবটা জানে—। সরি তো? এই? মায়াবতী? তাকাও না প্লিজ??
-ছাড়ো—। এটা তোমার শহর নয় যে ১০ টা ১১ টা পর্যন্ত বিছানায় পড়ে থাকবে–। এখানে একটা ২ বছরের বাচ্চাও ৬ টার সময় উঠে যায় বিছানা থেকে—।
-তাই? আমাদের পিচ্চিগুলোকে তাহলে এখানে নিয়ে আসবো কেমন? ওরা ভোর ভোর উঠে সারা উঠানময় খেলা করবে। আর আমি তোমাকে বিছানায় ফেলে তোমার মাঝে ডুব দিবো—।।
-অসভ্য লোক একটা!! সরো—। আজেবাজে কথা সব সময়—।।
রাহাতকে ধাক্কা দিয়ে নিজে বিছানা থেকে উঠে গেল মায়া। ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে ব্রাশ করতে করতে বাইরে বেরিয়ে গেল। আর রাহাত ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে মায়ার কাজ দেখছে। মায়া হাত মুখ ধুয়ে রুমে এসে ব্রাশটা রাখতে যাবে এমন সময় রাহাত মায়ার হাত থেকে ব্রাশটা নিয়ে একটু পেস্ট লাগিয়ে ব্রাশ করতে শুরু করলো।
-এই?? কি করছ কি? এটা আমার ব্রাশ—-।।
-যা তোমার তাই আমার—। তাই না মায়াবতী??
কথাটা বলে রাহাত হেলেদুলে ব্রাশ করতে করতে পুকুরের দিকে রওনা দিল। আর পিছনে মায়া হা করে রাহাতকে দেখতে লাগলো। কি হলো তার কিছুই বুঝলো না বেচারি।
চলবে#মায়াবতী
#পর্ব_৩৪
#সুলতানা_পারভীন
রাহাত ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো মায়া মা আর দিয়ার সাথে বসে পিঠা বানাচ্ছে। মিহানও ফ্রেশ হয়ে আসায় দুজনে মিলে আড্ডা দিতে দিতে রান্নাঘরের কাজ দেখতে লাগলো রাহাত। রান্নাঘরটা বাড়ির ভিতরে না দিয়ে উঠানের অপর পাশে বানানো। প্রত্যন্ত এই গ্রামে না আছে কারেন্ট, আর না আছে গ্যাসের সুবিধা। তাই রান্না হচ্ছে মাটির চুলোয়। চুলোর ধোঁয়ায় সমস্যা না হওয়ার জন্যই সম্ভবত এই আলাদা ব্যবস্থা। রান্নাঘরে মায়ার ব্যস্ততা দেখতে দেখতেই রাহাত মিহানকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। অফিস কোথায়, কাজ কেমন হয়, বস কেমন -এসব নিয়েই মিহানকে প্রশ্ন করছে রাহাত।
নাস্তা করতে বসে রাহাত দেখলো পুলি, ভাঁপা, চিতুই-এরকম কয়েকটা পিঠে করা হয়েছে। আর শীত শীত সকালে পিঠাগুলো খেতেও বেশ লাগছে রাহাতের। খাওয়া শেষ করে গাড়ি থেকে শপিং ব্যাগগুলো আনলো রাহাত৷ মিহানও হেল্প করলো অবশ্য। অনেকগুলো শপিং করেছিল রাহাত। শাশুড়ীকে, মিহানকে আর দিয়াকে কয়েকটা করে শপিং ব্যাগ দিয়ে বাকিগুলো মায়াকে ধরিয়ে দিলো। মায়াও ভ্রু কুঁচকে রাহাতকে দেখছে।
-আরে?? এসবের কি দরকার ছিল বাবা??
-মা?? আমি কি দিতে পারি না? মাকেই তো দিয়েছি—।।
-রাহাত ভাই–। আর আমাদের গুলো? এতো কাপড় চোপড়ের কি দরকার ছিল??
-আরে মিহান ভাই—। নতুন বিয়ে করেছেন–। একটু ঘুরবেন ফিরবেন ভাবিকে নিয়ে—। তাই আর কি–। হা হা–। তা আজকে কোথায় যাওয়া হচ্ছে??
-সবাই মিলে খালার বাড়ি যাই আজকে??
রাহাত কিছু বলার আগেই মায়া নিজের হাতের শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
-ভাইয়া–। আমি যাচ্ছি না–। এমনিতেই খারাপ লাগছে একটু–। জার্নি করলে শরীর খারাপ করবে আরো—।। তোমরা যাও–।
-তাহলে কাল পরশু যাই??
-আরে না না—। আপনারা যান–। মায়া আর আমি বাড়িতে থাকি–। আমিও কাল ড্রাইভ করে এসে টায়ার্ড অনেক—-।।
মায়া রাহাতের দিকে রাগী লুক দিয়ে রুমে চলে এলো। এই লোকটা না গেলে সারাদিন জ্বালিয়ে মারবে। মায়া ভেবেছিল রাহাতও মিহানদের সাথে যাবে। আর মায়া একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। তা আর হলো কই?! মিহানও বুঝতে পেরেছে মায়া কোন কারণে রাহাতের উপরে রেগে আছে। তাই ওদের দুজনকে একা ছাড়ার ব্যবস্থা করে দিল।। যাওয়ার আগে রাহাতকে ইশারায় ডাকলো।
-জি ভাইয়া?
-মায়া বোধ হয় আপনার উপরে অনেক খেপেছে–। আমরা তো আজ রাতে ফিরবো না–। দেখুন রাগ ভাঙাতে পারেন কিনা–। এই মেয়ের রাগ কিন্তু সাংঘাতিক–।
-থ্যাংক ইউ ভাইয়া—-।।
রাহাত লাজুক হেসে মাথা চুলকাতে চুলকাতে রুমে এলো। এসেই হা হয়ে গেল। মায়া শপিংব্যাগগুলো বিছানায় ছড়িয়ে রেখে জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে৷ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা কতোটা রেগে আছে রাহাতের উপরে। রাহাত হেসে মায়াকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে চুলে নাক ডুবালো। মায়া চমকে উঠে রাহাতের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো।
-ছাড়ো—।
-উহু—-।।
-বলছি না ছাড়ো? সরো??
-একটা গান শুনবে মায়াবতী??
-না——।
-শুনো না?? একটু—-।।
-না না না—। না বলছি না??
-আরে বাবা একটু শুনো?? জাস্ট কয়েকটা লাইন??
এবার মায়া চুপ করে যাওয়ার রাহাত মায়ার কানে ঠোঁট বুলিয়ে দিতে দিতে গান ধরলো৷
-“আমার পরান যাহা চায়,
তুমি তাই, তুমি তাই গো!
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই কিছু নাই গো !
তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখের সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে,
আর কিছু নাহি চাই গো ।
আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিব বাস,
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ মাস ।
যদি আর কারে ভালোবাস,
যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও,
আমি যত দুখ পাই গো ।”
রাহাতের কণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীতটা শুনেই মায়া চুপ হয়ে গেছে। রাহাতও তাই সুযোগ বুঝে মায়ার ঘাড়ে, গলায় আলতো করে ঠোঁট ডুবিয়ে দিচ্ছে একবার। আবার কখনো মায়ার কানে ছোট্ট করে কামড় বসাচ্ছে। মায়া কেঁপে উঠে রাহাতের সামনে থেকে আচমকা উঠে বিছানা থেকে নেমে গেল। রাহাত খাটের সাথে হেলান দিয়ে মায়ার কাজ দেখছে।
-এই? কই যাও?
-খবরদার ছোঁবে না একদম–। একবার একটা করে আমাকে জব্দ করা না? তোমাকে আমি আর কক্খনো মাফ করব না–। সে তুমি যত কিছুই করো না কেন—।
-আচ্ছা– মায়াবতী–। মাফ করো না–। এখন কাছে আসো??
-আসবো না কাছে–। থাকবোও না তোমার সাথে—-।
-ও? তাই? কই যাবা?? আমি তো তোমার পিছে পিছে এসে হাজির হবো—-।
-তুমি ঘুমাও—। আমি মা আর ভাইয়াদের সাথেই খালার বাড়ি চলে যাবো—। থাকো তুমি একা একা–।
-আরে??
মায়া রুম থেকে বেরুনোর আগেই রাহাত মায়ার হাত টেনে টিনের দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। মায়া রাগী চোখে রাহাতের দিকে তাকিয়ে হাত ছোটানোর জন্য লাফালাফি করছে৷ কিন্তু কিছুতেই রাহাতের শক্তির সাথে পেরে উঠছে না বেচারি।শেষে বিরক্ত হয়ে মায়া রাহাতের হাতেই কামড় বসালো। প্রথমে একটু আস্তে কামড় বসালেও পরে রাগ করে রাহাতের হাতে বেশ জোরেই কামড় বসালো মায়া। রাহাত হেসে মেয়েটার পাগলামিগুলো সহ্য করছে। মায়া হয়রান হয়ে রাহাতের হাত ছেড়ে দিতেই রাহাত মায়ার মুখটা এক হাতে তুলে ধরে চোখের দিকে তাকালো। মায়াও রাহাতের দিকে তাকিয়ে আছে ভ্রু কুঁচকে।
-মা, ভাইয়া, ভাবি এখনো বাড়িতেই আছে মায়াবতী–। এখনই এতো কাছে ডাকছ কেন?? উনারা যাক তারপর কত কামড়াতে পারো আমিও দেখবো—–।।
-অসভ্য লোক—। ছাড়ো—। নইলে এখান থেকেই মা কে ডাকবো বলে দিলাম—-।।
-হুম হুম–। অবশ্যই ম্যাডাম–। ডাকুন–। দেখুন চেষ্টা করে —।।
মায়া মাকে ডাকার জন্য মুখ খোলার আগেই রাহাত মায়ার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। নিচের ঠোঁটটা আলতো করে কামড়ে ধরে বেশ খানিকটা সময় চুপ করে মায়ার ভারি নিঃশ্বাসগুলো অনুভব করলো রাহাত। একটু পরে মায়ার মুখটা তুলে ধরে দেখলো মায়া চোখ বুজে আছে। রাহাত মায়ার কান আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।
-আবার ডাকবে মাকে?? চেষ্টা করে দেখতে পারো–। তবে এবার কিন্তু ডিউরেশনটা আরেকটু বেশি হবে–।সেটা মাথায় রেখো–কেমন মায়াবতী??
-সরো——।।
-উহু—। কথা ছিল তুমি রাগ করলে আমার উষ্ণ স্পর্শে তোমার রাগ ভাঙাবো–। অভিমান করলে তোমার নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে—-।। ছাড়াছাড়ি হচ্ছে না মিসেস মায়াবতী—।
-তোমার দোহাই লাগে প্লিজ চুপ করো?
-কেন গো?? শুনলে বুকের ভিতরে ধুকপুক করে ওঠে? আরো আদর খেতে মন চায়? তুমি চাইলে করতেই পারি–তবে মা আর ভাইয়া ভাবি যাওয়ার পর—-।।
-আমার বয়েই গেছে—-। সরো তো??
-আচ্ছা যাও—। সবাই রেডি হলো কিনা দেখো গিয়ে—। তোমাকে বশে আনার জন্য সারাটা দিন তো পড়েই আছে—? কি বলো?
মায়া রাগী চোখে রাহাতের দিকে তাকাতেই রাহাতও মায়ার দিকে ইশারায় একটু চুমো দেখালো। তারপর হাতের বাঁধনটা ছেড়ে দিতেই মায়া রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রাহাতও হেসে মায়ার পিছন পিছন ড্রইংরুমের দিকে পা বাড়ালো। মেয়েটা সোজা পথে মাফও করবে না। আর ওর কোন কথাও শুনবে না৷ তাই এভাবে বিরক্ত করে, আরো রাগিয়ে দিয়েই মায়াবতীর মান- অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করছে রাহাত৷ কতটুকু কি করতে পারবে কে জানে! তবে সে হাল ছাড়বে না। রাহাতও যেন পণ করেছে।। তার মায়াবতীর রাগ সে যেমন করেই হোক ভাঙাবেই ভাঙাবে।
চলবে#মায়াবতী
#পর্ব_৩৫
#সুলতানা_পারভীন
রাহাত ড্রইংরুমে এসেই দেখলো মিহান, দিয়া আর মা একেবারে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিয়েছে। রাহাত মিহানকে নিজের গাড়ির চাবিটা ধরিয়ে দিলো।
-গাড়িটা নিয়ে যান ভাইয়া–। কতদূর যেতে হবে—।
-আরে??
-না ভাইয়া–। প্লিজ না করবেন না।
মা আর ভাইয়া ভাবি বেরিয়ে যেতে রাহাত গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল। মায়া বিরক্ত হয়ে রান্না ঘরে গিয়ে কাজ করতে লাগলো। এই লোকটা পুরোটা দিন চোখের সামনে ঘুরঘুর করবে-ভাবতেই রাগ লাগছে মায়ার। কেন যে মরতে মায়ের সাথে গেল না সেটা ভেবে নিজের উপরও রাগ লাগছে প্রচন্ড। কিন্তু একবার যাব না বলে পরে যেতে চাইলে মা নিশ্চয়ই সন্দেহ করতো! হয়তো জানতেও চাইতো কি হয়েছে। কিন্তু রাহাতের এই কথাগুলো কি করে মাকে বলতো মায়া?? আর বলার পরই বা কি হতো!! মা বা ভাইয়া কেউ কি রাহাতকে ছেড়ে কথা বলতো!! কত অপমান করতো মানুষটাকে!! সেটা মায়া কি করে সহ্য করবে! যতই রাগ করে চলে আসুক না কেন মানুষটাকে তো সে আজও ভালোবাসে! সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। ইভেন নিজের জীবনের চেয়েও বেশি হয়তো—।।
-এই? মায়াবতী? আঙুলে কি হয়েছে?
-হুম?? তুমি—-??
-তোমার আঙুল কেটে রক্ত পড়ছে–।
-হুম?? আরে?? খেয়াল করি নি—। তুমি এখানে কি করো?? যাও জার্নি করে এসেছ না এতোটা রাস্তা–?? ঘুমাও।
-মাঝে মাঝে তুমি প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলো–। বুঝসো?
-যাও তো। ঘুমাও–। আর এই একটু কাটায়, এইটুকু রক্ত ঝড়লেই বা কি হবে?? এর চেয়ে কতো বেশি রক্তপাত হচ্ছে বুকের ভেতরে–। সেটা তো কেউ দেখতেও পায় না–।
-মায়া???
-যাও তো এখন–। হাত ছাড়ো–। রান্না বাকি আমার—।।
রাহাত এক ছুটে বড় ঘরটার দিকে চলে গেল। মায়া পাশে রাখা জগ থেকে একটু পানি ঢেলে হাতটা ধুয়ে নিল। এতটা অন্যমনস্ক ছিল যে আঙুলটা এতোটা কেটেছে টেরই পায় নি ও। এখন পানি লাগায় জ্বালা করছে প্রচন্ড। শাড়ির আঁচলে আঙুলটা ধরে রক্ত পড়া বন্ধ করার চেষ্টা করছে এমন সময় রাহাতের হাতের স্পর্শ পেল মায়া। মায়া মুখ তুলে দেখলো রাহাত তুলোয় সেভলন লাগিয়ে মায়ার আঙুলে লাগানোর জন্য বাড়াচ্ছে। মায়া আঁতকে উঠে হাতটা টেনে নেয়ার চেষ্টা করলো। রাহাত বিরক্ত হয়ে মায়ার মুখের দিকে তাকালো।
-মায়া?? এতো লাফালাফি করছো কেন?
-এমনিতেই বড্ড জ্বালা করছে–। আবার সেভলন?? না না না–। জ্বালা করবে আরো–।
-মায়া?? নড়ো না বলছি না?? ব্যান্ডেজ করে দিবো–। আর সেভলন না দিলে ইনফেকশন হতে পারে—-।।
-না নাআআআ–। আমি সেভলন লাগবো না—।
-বেশি কথা বলবা সেভলন খাওয়াই দিবো বলে দিলাম মায়াবতী—। চুপ করে বসে থাকো—-।।
মায়া চুপ হয়ে গেল। মনে মনে ইচ্ছে মতো গালি দিচ্ছে রাহাতকে। ফাজিল লোকটা একটুও শান্তি দেয় না। এমনিতে তার কথা চিন্তা করতে করতে হাত কেটেছে আর সে এখন সেভলন দিয়ে আরো বেশি জ্বালা দিচ্ছে। খারাপ লোক একটা। রাহাত মায়ার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা মানে কাটা আঙুল সেভলন দিয়ে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। তারপর আলতো করে ব্যান্ডেজে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।
-বেশি কষ্ট হচ্ছে মায়াবতী??
-এ আর কি কষ্ট?? এর চাইতেও বেশি কষ্ট নিয়ে ঘুরতে হবে আজীবন আমাকে–। সরো—। রান্না করি—।
-কাটা হাত নিয়ে রান্না করতে হবে না–। এসো?
-হুহ—। রান্না করতে হবে না–। বললেই হলো আর কি–। না খেয়ে থাকবে দুপুরে?
-তোমার কষ্ট কম করতে না খেয়ে সারাদিনটাও থাকতে পারবো—।
-ইশ–। পরে খোঁটা দিতা যে না খাইয়ে রেখেছি–। হুহ—। সরো তো?
-মায়াবতী?? আচ্ছা যাও—। তুমি বলে দাও–। আমি রান্না করছি—।
-আহারে!! ভালোবাসা দেখাইতে আসছো!! জীবনে মাটির চুলা দেখেছ তুমি? যে এখন রান্না করবা বলতেছ??
-তোমার জন্য আমি সব করতে পারি মায়াবতী–। জাস্ট আরেকটা সুযোগ দিয়ে দেখো–। প্লিজ??
-আচ্ছা আচ্ছা। তোমাকে রান্না করতে হবে না–। তুমি শুধু মাছে মসলাটা মেখে দাও–। আমি নিজে বাকিটা করে নিবো—।
রাহাত খুশি হয়ে মায়ার কাজে হেল্প করছে। আর মায়া কাজের ফাঁকে ফাঁকে রাহাতের হাসি মুখটা দেখছে। লোকটা এমন কেন বুঝে না মায়া। এক মূহুর্ত মনে হয় মানুষটাকে বিশ্বাস করে সারাটা জীবন হাত ধরে চলা যায়। আর পরক্ষণেই সব কিছু ধোঁয়াশা হয়ে মিলিয়ে যায় অনিশ্চয়তার অতলে। মানুষটা সত্যিই কি বদলে গেছে? নাকি আবার মায়াকে কাছে টানার জন্য মুখোশ পড়েছে? কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না মায়া। মায়ার সমস্ত সত্তা চাইছে রাহাতের কাছে ফিরে যেতে। কিন্তু কোথাও একটা বাঁধছে। আর সেই বাঁধাটাকে মায়া কিছুতেই উপেক্ষাও করতে পারছে না।
রান্না শেষ হতে হতে দুপুর হয়ে গেল। রাহাত বেচারা তো মাটির চুলোর তাপে গরমে ঘেমে নেয়ে একসার অবস্থা। মায়া সেটা দেখেই হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা।
-আমার বেহাল দেখে মজা পাচ্ছো সুন্দরী? দিন আমারও আসবে। মনে রেখো বধূ এক মাঘে শীত যায় না–।
-হুহ—।।
মায়া হাত মুখ ধুয়ে এলো পুকুর থেকে। আর রাহাত বাচ্চাদের মতো ঝাঁপাঝাপি করে পুকুরে নেমে গোসল করলো৷ লোকটার এমন ছেলেমানুষি দেখে মায়া হেসে ফেললো। এই লোকটা বাচ্চাদের মতো হয়ে যায় মাঝে মাঝে৷ যেমনটা এখন করছে৷ কখনো পানি ছিটাচ্ছে মায়ার গায়ে। আবার কখনো পানিতে ডুব দিয়ে কয়েক মিনিট পর মাথা তুলছে। শেষে প্রচন্ড খিদে পাওয়ায় রাহাত পুকুর থেকে উঠে এসেছে। নইলে তার পানিতে লাফালাফি কতক্ষণ চলতো কে জানে!!
খেতে বসেও আরেকটা ভেজাল বাঁধলো। মায়ার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা বেশ অনেকটাই কেটেছে। তার উপরে ব্যান্ডেজ করা। এই কাটা ব্যান্ডেজ করা আঙুল নিয়ে বেচারি খেতেও পারছে না৷ তার উপরে ডান হাতের এই বুড়ো আঙুল হলো এমন একটা আঙুল যেটা ছাড়া মাখিয়ে ভাত মুখে পোরা একেবারেই অসম্ভব একটা ব্যাপার। মায়ার চুপ করে থাকা দেখে রাহাত এক লোকমা মায়ার মুখের সামনে ধরলো। মায়া মুখ তুলে তাকাতেই রাহাত মিষ্টি করে একটা হাসি দিলো।
-ঝগড়া ঝাটি, রাগা রাগী ব্যাপারগুলো একটু সাইডে রাখো। খাওয়া শেষ হলেও আমাকে রাগ দেখানোর জন্যও পাশে পাবে মায়াবতী–। তাই আপাতত খেয়ে নাও।
মায়াকে খাইয়ে দিয়ে রাহাত নিজেও খেয়ে নিলো। তারপর দুজনে মিলে প্লেটগুলো ধুয়ে রান্নাঘর গুছিয়ে নিয়ে মায়াকে নিয়ে রুমে এলো রাহাত। ছুটির দিনগুলোতে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় নি ওদের দুজনের। তাই রাহাত চাইছে যতটা সময় পারে মায়াকে সময় দিতে। ঢাকায় ফিরার পর ব্যস্ত হয়ে গেলে হয়তো এভাবে এতোটা সময় মেয়েটাকে দিতেও পারবে না। তারচেয়েও বড় কথা হলো মেয়েটার রাগটা ভাঙাতে হলে কিছু একটা করা চাই। কি করা যায়??
-তোমার না টায়ার্ড লাগছে?? তুমি ঘুমাও—-।।
-তুমি কি করবা??
-আমি মায়ের রুমে গিয়ে——।।
মায়া কথাটা শেষ করার আগেই রাহাত মায়াকে বুকে টেনে নিয়ে শুয়ে গেল বিছানায়। তারপর গায়ে কাঁথা টেনে একেবারে জাপটে ধরে রইলো বুকের ভিতরে।
-কি করছ কি তুমি??
-মায়ের রুমে কেন যাবা?? আমার বউ আমার বুকে থাকবে–। কোথাও যাওয়া চলবে না—।।
——————————
-এই মায়াবতী?? ঠোঁটের কোণে হাসি নেই কেন তোমার? চোখের কোণাটা কেমন চিকচিক করছে! এই সুন্দর মুখখানাই বা এতো মলিন কেন? মনটা কি ভিষণ খারাপ?? এই পরী? তোমার কষ্টগুলো বেচবে আমার কাছে?? জগতের সমস্ত সুখের দামে কিনে নিবো–। প্রমিস। তোমার মনের প্রতি বিন্দু কান্নার বিনিময়ে আমার উচ্ছল হাসিটুকু নিয়ে নাও–। কখনো ফেরত চাইবো না কথা দিলাম–। শুধু একটা জিনিসই চাইবো–। তোমার ঠোঁটের সেই হাসিটা প্রতিবার দেখার জন্য তোমার পাশে থাকতে চাই। সুযোগটা দিবে?? প্লিজ??
মায়া রাহাতের বুকে ডুবিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো। আর রাহাত কিছু না বলেই মায়ার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মেয়েটাকে একটু কেঁদে হালকা হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে রাহাত। এর পর আর কখনো এমন কিছু করবে না যাতে মায়া কাঁদে। বা এমন কিছু করবে না যাতে মায়া ভুল বুঝে ওর থেকে দূরে কোথাও চলে যায়। আর নিজের অতীতের ভুলগুলোর দিকে ভুলেও পা বাড়াতে চায় না রাহাত৷ এসব ভাবতে ভাবতেই রাহাত মায়াকে আরেকটু নিবিড় করে বুকে টেনে নিলো।
চলবে
৩২+৩৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here