মিতুর গল্প পর্ব ৪

#মিতুর_গল্প
#৪র্থ_পর্ব
#অনন্য_শফিক



ইরম ওকে কাঁপতে দেখে বললো,’কী ব্যপার মিতু বন পাতার মতো এভাবে কাঁপছো কেন? খাবার নিয়ে এসেছো তো টেবিলে দেও। দাঁড়িয়ে থাকলে তো আর আমার খাওয়া হবে না!আসো। খাবার নিয়ে আমার কাছে আসো।’
মিতু এসে খাবারের প্লেট টেবিলের উপর রেখে চলে যেতে চাইতেই ইরম বললো,’আরে দাঁড়াও। দাঁড়িয়ে থাকো এখানে। আমার আবার কখন কী প্রয়োজন হয় তোমার তো তা এনে দিতে হবে তাই না!’
মিতুর ভীষণ রাগ লাগছে।দুঃখও হচ্ছে তার নিজের ভাগ্যের কথা ভেবে। আবার জেদ হচ্ছে অনেক শুভ ভাইয়ার প্রতি।কে বলেছিল তাকে অত দরদ দেখাতে তার প্রতি।যে বিয়ে ভেঙে যেতে চলছিলো তা জোর করে রামদা দেখিয়ে নতুন করে জোড় দেয়ার কী প্রয়োজন ছিল!
ইরম খেতে খেতে বললো,’তুমি রান্না করেছো তাই না?জোস্ হয়েছে।আর হবেই না বা কেন জোস্?যার হাত এতো সুন্দর তার হাতের রান্নাটাও তো সুন্দরই হবে তাই না?’
কথাগুলো বলতে বলতে মিটিমিটি হাসছিলো ইরম।
মিতু রাগে এ ঘর থেকে চলেই যেতে পা বাড়ালো। কিন্তু ইরম পেছন থেকে আবার ওকে ডাকলো।বললো,’এখান থেকে চলে গেলেই কী বেঁচে যেতে পারবে তুমি মিতু?আমি বার বার তোমায় ডাকবো। এখন যদি বেরিয়ে যাও তবে এক্ষুনিই ডাকবো।বলবো একটু লবণ দিয়ে যাও।এক ফালি লেবু।একটু জেলি।একটু সবজি!হা হা হা!’
মিতু এবার লাল লাল চোখ নিয়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর চুপিচুপি অথচ ধারালো গলায় বললো,’কী চান আপনি আমার কাছে? আপনার সমস্যা টা কী?’
ইরম হাসলো। হেসে বললো,’আমি তোমাকে চাই। অনেক আগে থেকেই চাই।মনে করে দেখো জয়ের বিয়ের কথা।ওর বিয়ের সময় থেকেই তোমাকে চেয়ে আসছি। ওখানে তুমি আমায় অপমান করেছিলে।আমি ওসব একদম ভুলে গেছি। কিন্তু তোমাকে পাওয়ার কথা একটুও ভুলিনি।আমি যা চাই তা যেভাবেই হোক আদায় করে ছাড়ি। তোমাকে যেন সহজ ভাবে পাই এই জন্য দেখো কী করেছি। আপন ছোট ভাইকে উৎস্বর্গ করেছি তোমার জন্য। তোমাকে পেতে!’
মিতু ভয় পাচ্ছে। কেমন যে ভেতরটা কাঁপছে ওর!
সে শুধু রাগ আর ভয় মাখা গলায় বললো,’আপনি যদি আমার সাথে এরকম কিছু করতে চান তবে আমি ধ্রুবর কাছে সব বলে দিবো।’
ইরম হাসলো। হেসে বললো,’কার কাছে বলে দিবে তুমি?ধ্রুবর কাছে?হা হা হা। এই তুমি কী জানো ধ্রুব আমার চেয়েও চরিত্রহীন?জানো না তো তাই না? তবে শুনো, সে সব জানতো।’
মিতু যেন ভয়ংকর একটা চক্রের ভেতর আটকে গেছে।সে কী করবে না করবে কিছুই বুঝতে পারছে না এই মুহূর্তে। তাকে যে করেই হোক এই ইবলিশ বাড়িটা থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কীভাবে যাবে সে?
ইরম বললো,’আমার কোন তাড়াহুড়ো নেই মিতু। তুমি এমনিতেও নষ্ট হয়ে গেছো মিতু।ধ্রুবর কাছ থেকেই তুমি বাঁচতে পারোনি। আমার কাছ থেকে তো পারবেই না!’
মিতু জানে না সে কী করছে এই মুহূর্তে।তার মাথার ঠিক নেই।রাগে টেবিলের উপর রাখা ডালের বাটিটা ইরমের উপর ছুঁড়ে মেরে সে বললো,’তোদের দুই ভাইকেই আমি জন্মের শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো।মেয়ে নিয়ে খেলিস তো। মেয়েদেরকে অবলা প্রাণী মনে হয় তাই না? গৃহপালিত পশুর মতো ওদের সাথে আচরণ করতে ইচ্ছে করে তাই না? কিন্তু এটা কী খেয়াল আছে যে যুগ পাল্টে গেছে? নারীরাও যে লম্পট পুরুষদের শিক্ষা দিতে পারে তা কী তুই ভুলে গেছিস কুত্তার বাচ্চা?মনে নাই স্যান্ডেল দিয়ে যে তোরে পিটাইছিলাম আমি?’
ইরমের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এমনিতেও সে আধ পাগল। উদ্ভট আচরণ করে সে। এবার নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে তেড়ে আসতে লাগলো মিতুর দিকে।যেন মিতুর সাথে এই মুহুর্তেই খারাপ কিছু করে ফেলবে সে! মিতুকে আস্তো গিলে খাবে এই কর্কশ দুপুরে।
কিন্তু মিতুও কম না।সে জানে সে এই মুহূর্তে বাঁচা মরার লড়াইয়ে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে।তাই তার আর কোন রকম ভীতি কাজ করছে না।সে বরং তেজদীপ্ত গলায় বললো,’আয় তুই এদিকে আয়।আয় দেখি তোর কতো সাহস কুত্তার বাচ্চা!’
ইরমের কী হলো কে জানে!এর আগে সে কম মেয়ের জীবন নষ্ট করেনি।কম মেয়েকে তার বিছানায় ডেকে নেয়নি! কিন্তু ওদের কারোরই এমন সাহস ছিল না!ওরা ভীতু ছিল।বিড়াল ছানার মতো! কিন্তু এই মেয়েটি এমন কেন?যেন আগুন! কাছে গেলেই পুড়িয়ে ছারখার করে দিবে!
ইরম আর এক পা ও এগিয়ে যাওয়ার সাহস করলো না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল।
এবার মিতুর সাহসটা আরো বেড়ে গেল।সে বুঝতে পারলো ইরম তাকে ভয় পেয়েছে।আর মিতু ভালো করেই জানে একবার কারোর মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে পারলেই নিজের বিজয়টা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়। এই ভয় সহজে দূর হয় না।তাই সে ইরমের ভয়টা আরো বাড়িয়ে দিতে বললো,’কি রে লুইচ্চা তোর মারে ডাকবো নাকি এবার?ডেকে বলবো বুইড়া হয়ছে আপনার ছেলে এখনও বিয়ে করান নাই কেন তারে? আপনার ছেলের তো চরিত্র ভয়াবহ রকমের খারাপ! ছোট ভাইয়ের স্ত্রীরেও সে মানে না। খারাপ আবদার ইঙ্গিত করে হারামজাদা। আমার তো ভয় লাগে যে কখন জানি আবার আপনার কাছেও ওইসব আবদার করে বসে।মানে যেমন ছেলে আপনি বানাইছেন সে তো মা বোন ভাইয়ের বউ এইসব কিছু বোঝে না।সে বোঝে খালি শরীর।’
ইরম যেন এবার তার নিজের পাতা ফাঁদেই নিজে আটকে গেছে।সে কোনদিনও ভাবেনি এই মেয়ের এরকম দুঃসাহস আছে! এই মুহূর্তে তার কিছুই বলার নাই করার নেই।কী বলবে সে? এরকম বিপদ এই জীবনে তার সামনে কখনোই আর আসেনি!
মিতু ওকে বিড়ালের মতো মিইয়ে যেতে দেখে অট্টহাসি হেসে বললো,’কী গো ডাক্তার ইরম নাসের লুইচ্চা? এইবার চুপ হয়ে গেলেন কেন আপনি?বহুত তো কথা বলছেন আগে। এখন বিড়াল ছানা হয়ে গেলেন কেন?
আসেন। আমার কাছে আসেন। আপনার না আমারে পাওয়ার খুব শখ।আসেন আপনারে আদর কইরা আপনার তল পেটে একটা লাত্থি দেই! আমার ডান পা টা খুব লাফাচ্ছে আপনার তলপেটে একটা লাত্থি দিতে!’
ইরম এবারও চুপ। মিতুর সাহস আরো বেড়ে গেছে এবার।সে বুঝে ফেলেছে এই জগতে সাহসী মানুষদের কোন ভয় নেই। সাহসী মানুষেরা যদি শারীরিক ভাবে দূর্বলও হয় তবুও ওরা পরাজিত হয় না। শেষ পর্যন্ত লড়ে যায়। গলার সবটুকু শক্তি দিয়ে বলে,আমি পরাজয় মানি না। এমনকি তরবারি দিয়ে মাথাটা শরীর থেকে কেটে আলাদা করে ফেললেও তার কাঁটা মাথা ন্যায়ের কথা বলে।মুক্তির কথা বলে।সে এখন জানে,যদি এই পৃথিবীর সবগুলো মেয়েই তার মতো সাহসী হয়ে যায় তবে এই পৃথিবীর সবগুলো কাপুরুষ মেয়েদের পায়ের কাছে এসে নতজানু হবে। পা ধরে ক্ষমা চায়তে চায়তে এদের জীবন বেহাল হয়ে যাবে!
মিতু এবার ইরমের আরো কাছে এগিয়ে গেল। তারপর ওর সামনেই একটা চেয়ার টেনে বসে বললো,’সুন্দরী মেয়ে দেখলেই মাথা ঠিক থাকে না তাই না? একজন ডাক্তার এমন হয় কী করে আমি তা বুঝি না!নাকি তুই ভুয়া ডাক্তার!জ্বরের টেবলেট কী জানিস তো তুই?বল তো কী?নাপা না প্যারাসিটামল?’
ইরম নিরুপায়। এখানে যে কথা বলা যাবে না তা সে জানে।কথা বললেই মিতুর গলা বাড়বে।তার মাকে ডেকে আনবে এখানে। তখন সর্বনাশ হবে। তার মা এমনিতে হয়তোবা একটু বদমেজাজি।এক সময় তার বাবাকে কথায় কথায় কান ধরে উঠিয়েছে বসিয়েছে।তার দাদিকে দুই চোখে কোনদিন দেখতে পারেনি।মা বলেও ডাকেনি।ডাকতো মহিলা বলে। কিন্তু এমন বাজে স্বভাবের মহিলা হওয়া সত্ত্বেও ছেলের ওইসব কুকীর্তির কথা শুনলে তার মা একটুও ছাড় দিবে না।এটা সে খুব ভালো করেই জানে।তাই সে শুধুমাত্র আস্তে করে এই কথাটিই বললো,’মিতু, আমার ভুল হয়ে গেছে বোন। বুঝতে পারিনি আমি! তুমি এসব নিয়ে আর সমস্যা করো না। এখন এখান থেকে চলে যাও প্লিজ!মা এসে দেখে ফেললে ভয়াবহ কান্ড হবে!’
মিতু হাসলো। হেসে বললো,’আমি কোথায় যাবো?তুই যাবি।আজকেই তুই এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবি।এক মাসের ভেতর এই বাড়িতে তুই আসবি না। কীভাবে কী বলে কোথায় যাবি তা আমি জানি না। তবে যদি যেতে না চাস তবে আমি তোর জীবনটা নরক করে ছাড়বো।এটাই আমার ফাইনাল কথা।ওয়ার্নিংও বলতে পারিস এটাকে!’
মিতু ভাবেনি ইরম এতোটা ভয় পাবে। সেদিন বিকেল বেলায়ই হুট করে ইরম তার মাকে বললো তার নাকি চট্টগ্রাম যেতে হবে। ওখানে এক মাসের ট্রেনিং আছে তার।যেতেই হবে।না গেলে হবে না। এবং সন্ধ্যা বেলায় বাসা থেকে বেরিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে চলেও গেল ইরম।
মিতু তো এবার মহা খুশি।একটা ইবলিশকে এক মাসের জন্য এ বাড়ি থেকে বের করা গেছে। এবার ছোট ইবলিশটাকে ধরবে সে। ওটাকে শিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করতে হবে। মানুষ না হলে ওর জন্য অন্য ব্যবস্থা আছে।মিতু এখন আর ভয় পায় না। মেয়েদের একবার ভয় ভেঙে গেলে,মেয়েরা শুধুমাত্র একবার তাদের নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে জেনে গেলে তখন সারা পৃথিবীও যদি তার বিপক্ষে চলে যায় তবুও তাকে আর দমিয়ে রাখতে পারে না!

(কিছু কথা-
রোমান্টিক দুটো কথা লিখে আপনাদের আমি সন্তুষ্ট করতে পারবো না কখনোই। সন্তুষ্ট করতে পারবো না সুন্দর সুন্দর বাক্য দিয়ে গল্পের লাইন লিখেও। আমার গল্পের থিমও সুন্দর না। তবে আমি যা পারবো তা হলো অন্ধকারে পিষ্ট হওয়া আমাদের মায়েদের বোনেদের জীবনের গল্প বলে যেতে।আমি পারবো তাদের লুকিয়ে থাকা শক্তির কথা বলতে। আমার মা বোনেরা ভীতু প্রকৃতির।ওরা অবলা প্রাণীর মতো দিনের পর দিন পুরুষের অত্যাচার সয়ে যায়। স্বামী পরনারীর সাথে পরকিয়ায় জড়াচ্ছে এতেও তার কিছুই করার থাকে না। ভয়ে চুপ থাকতে হয়।মারের ভয়। সমাজের ভয়।আমি এইসব ভয়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারি।আমি তাদের সাহস দিতে পারি যে তারা যেন ওইসব পাপিষ্ঠ পুরুষদের মুখের লাগাম টেনে ধরতে পারে। এদের জন্মের শিক্ষা দিতে পারে।যদি তারা এটি পারে তবেই আমি স্বার্থক।এর বেশি কোন কিছুই চাই না আমি। আমার লিখার উদ্দেশ্য লেখক নাম ডাক পাওয়া নয়। আমার লিখার উদ্দেশ্য আমার মা বোনের মুক্তি।আমি আশা রাখি একদিন সব নারী তার নিজের সাহস সম্পর্কে জানবে। এবং সে প্রতিবাদী হবে। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়। সেই দিনটি নারীর মহান বিজয়ের দিন হবে। সেই দিন নারী পুরুষের মধ্যে কোন প্রকার ভেদাভেদ থাকবে না। কোন নারী আর ধর্ষিতা হবে না। নির্যাতিত হবে না। অপমানিত হবে না। ইনশাআল্লাহ! ইনশাআল্লাহ! ইনশাআল্লাহ!)

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here