#মিতুর_গল্প
#৫ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
ইরম চলে যাওয়ার পেছনের রহস্যের গন্ধটা কী ঠাহর করে ফেললো ধ্রুব? হ্যা আহনাফ ধ্রুবর কথা বলছি।ধ্রুব কিন্তু চতুর মানুষ।ওর কাজ কারবার সব ঠান্ডা মেজাজের। ওকে পুরোপুরি কেউ চিনতে পারে না। ধ্রুব নিজেও একটি আবছা অন্ধকারে ঢাকা রহস্যের নাম!
‘
ইরম যেদিন চলে গেল সেদিন রাতেই ধ্রুব এসে মিতুর কাছে বড় অনুতপ্তের গলায় বললো,’মিতু,আই অ্যাম সরি! এক্সট্রিমলি সরি ! আমি তোমার সাথে যা যা করেছি তা খুব অন্যায় ছিল।আমায় তুমি মাফ করে দাও!’
মিতু সত্যিই খটমট খেয়ে বসলো। ধাক্কা খেল একটা বুকের ভেতর। সারাদিন যা প্লান করে রেখেছে সব ওর এক কথাতেই বাতিল হয়ে গেছে।মিতু কী আর জানতো ধ্রুব এসে এভাবে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে বসবে?
ওমা শুধু কী মুখে মুখে বলে ক্ষমা চেয়েছে নাকি?কান পর্যন্ত ধরেছে।কানে ধরে মিতুর সামনে দাঁড়িয়ে বড় অনুতপ্ত গলায় বলেছে,’মিতু, আমি কিছুই জানতাম না এসবের! ভাইয়া অতটা নোংরা আমি ভাবতেও পারছি না। ছিঃ!’
মিতু অবাক হয়ে বললো,’এসব তুমি কী করে জানো?’
ধ্রুব তো এবার সব বুঝেই ফেললো।মিতুই তবে ওকে কায়দা করে বাড়ি থেকে বের করেছে। এবার তার পালা। তবে তার কাছে ভিড়তে পারবে না! এরকম মিতু হাজারটাকেও সে নাচাতে পারে!
ধ্রুব সামান্য হাসলো। হেসে বললো,’আমি তোমার আর ভাইয়ার কথাগুলো শুনে ফেলেছিলাম।দরজার এক সাইডে দাঁড়িয়ে!’
মিতু আরো অবাক হলো। অবাক হয়ে বললো,’তুমি না বাইরে ছিলে তখন?’
ধ্রুব বললো,’একটা প্রয়োজনে বাসায় এসেছিলাম। তখন শুনেছি।’
মিতু কিছু বলতে যাবে কিন্তু এর আগেই ধ্রুব বললো,’মিতু,আমি আরো তোমার সাথে কতো খারাপ ব্যবহার করেছি। তোমাকে শাস্তি দিয়েছি।সব ভাইয়ার জন্য।আমি কী আর জানতাম ভাইয়া
এমন নোংরা একটা মানুষ। ছিঃ! আমাকে এর বদলে শাস্তি দাও তুমি! তুমি যে শাস্তিই দিবে আমি তাই মাথা পেতে নিবো মিতু!’
মিতু খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলো।আহা ধ্রুবটা কতো ভালো! এমন লক্ষ্মী ছেলে আর হয় না!
মনে মনে এসব ভাবলেও মিতু খানিক ঢং করে বললো,’এখন তো একেবারে গলে যাচ্ছো। এমন ভং করছো যেন তুমি কিছুই জানতে না আগে থেকে তাই না? কিন্তু তোমার ভাই তো বলেছে তুমি সব জানতে!’
ছেলেরা কী কখনও কাঁদে?তাও তার স্ত্রীর সামনে! বোধহয় না। কিন্তু ধ্রুব কেঁদে ফেললো।ওর চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে নামলো দু’ গালের জমিনে। তারপর সেই জল চিবুক বেয়ে গলা ধরে ছুটে গেল আরো নিচে।
মিতুর কী যে মায়া হলো তখন!সে তো এ বাড়ির নতুন বউ। তবুও সে দ্রুত উঠে গেল ধ্রুবর কাছে। গিয়ে ধ্রুবর দু’ গাল মুছে দিয়ে বললো,’কেঁদো না।আমি জানি তুমি তোমার ভাইয়ার মতো না!’
ধ্রুব তার চোখ মুছে মায়াভরা চোখে তাকালো মিতুর দিকে। এই চাহনি যে মন কেড়ে নেয়ার চাহনি! মিতু জানে না কখন কীভাবে ধ্রুবর প্রতি সে কোমল হয়ে পড়লো!
‘
পরদিন সকাল বেলা ধ্রুব বললো,’এই নেও তোমার মোবাইল। এখন থেকে এ বাড়ির সবকিছুই তোমার।এ বাড়ির গেট তোমার জন্য উন্মুক্ত। তুমি এ বাড়ির মালকিন।আর আমি এই মালকিনের অধম ভৃত্য! তুমি আমাকে যখন যা হুকুম করবে আমি তাই করতে প্রস্তুত!’
মিতু মিষ্টি করে হাসলো। হেসে বললো,’এই না না, এমন কথা কেউ বলে? আমরা দুজন কেবলই স্বামী স্ত্রী। আমাদের কেউই কারোর প্রভু কিংবা ভৃত্য নয়!’
ধ্রুব খুশি হলো। খুশিতে তার চোখ চকচক করে উঠলো।সে মিতুকে বললো,’মিতু বাসায় ফোন করো।বাবাক বলো আমাদের বাড়িতে বেড়াতে।তোমায় নিয়ে যেতে এসে।’
মিতু ফোন করলো সত্যি সত্যি। বাবাকে বললো,’বাবা তোমাদের জামাই বলছে আমাদের বাড়িতে তুমি যেন আসো। আমাকে এসে নিয়ে যাও!’
আজমল মাস্টার জানালেন তিনি আসবেন। মিতুকে এসে নিয়ে যাবেন। সঙ্গে মেয়ের জামাইকেও। কিন্তু কী দূর্ভাগ্য! সেদিন বিকেলেই তার গা কেঁপে জ্বর উঠলো। বিছানা থেকে তিনি উঠতেই পারছেন না। গায়ে সামান্য খিঁচুনিও আছে তার।তাই মেয়ের বাড়িতে মেয়েকে আর মেয়ের জামাইকে নিয়ে যেতে তিনি আর আসতে পারলেন না। তিনি অবশ্য শুভকে বলেছিলেন মিতুকে এসে নিয়ে যেতে। কিন্তু সে মামাকে এমন অসুস্থ অবস্থায় একা ঘরে রেখে যেতে নারাজ।
শেষমেশ বাবার এমন অসুখের কথা শুনে ধ্রুবই মিতুকে নিয়ে এলো। যাত্রাপথে গাড়িতে বসে মিতু কাঁদে।তার সাথে ধ্রুবও যেন কাঁদে।নাক আর চোখের জল সাদা টিস্যু পেপার দিয়ে মুছে। মিতু ওর দিকে তাকায়।ধ্রুব দ্রুত ওকে বুকে টেনে নেয়। তারপর সান্তনা দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,’কিচ্ছু হবে না। আমরা গিয়ে দেখবো বাবা সুস্থ । ইনশাআল্লাহ!’
কিন্তু ধ্রুব মনে মনে আরেকটি কথাও বলে। এবার আর তোমার বাবা মনে হয় বিছানা থেকেই উঠতে পারবে না।
‘
ধ্রুবকে পেয়ে মিতুদের বাড়ির সবাই খুশি।তার আচার আচরণ খুবই সুন্দর! শরীরে বিন্দু পরিমাণ অহংকারের রেশ পর্যন্ত নাই!
শশুরের শিউরের কাছে গিয়ে সে বসে থাকে সারাক্ষণ। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। উৎসাহ দেয় শশুরকে।বলে, ‘আপনাকে আমি এ দেশের সবচেয়ে বড় ডাক্তার দেখাবো বাবা।যদি আপনার বাইরে যেতে মন চায়।আমি আপনাকে ইউরোপ আমেরিকার ডাক্তার দেখিয়ে আনবো!’
আজমল মাস্টারের চোখ বেয়ে গরম জল বেরিয়ে আসে কলকল করে।তার ভেতরটা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে। আল্লাহর কাছে তিনি শুকরিয়া আদায় করেন। শুকরিয়া আদায় করে বলেন, আল্লাহ তুমি আমার মেয়েটাকে যোগ্য ঘরে,যোগ্য পাত্রের কাছে পাঠিয়েছো। তোমার দরবারে লাখো কুটি শুকরিয়া!
তারপর তিনি ধ্রুবর হাতটা চেপে ধরেন। এই হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতে ভালো লাগে তার।মনে কেমন বল আসে। ভরসা পান তিনি!
ধ্রুব তখন শশুরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। হেসে বলে,’আপনি একদম টেনশন করবেন না বাবা!একদম না!মিতু আর আমি আছি। আপনার কোন টেনশন নাই!’
কিন্তু মনে মনে সে বলে অন্য কথা।বলে, আপনার জন্য ভয়ংকর রকমের বিপদ অপেক্ষা করছে। এই বিপদে শুধু আপনি একাই পড়বেন না। পড়বে আপনার আদরের মেয়েও।আর এই ভয়ংকর বিপদটা তৈরি করবো আমি।আমি নিজে!
‘
এখানে আসার দু’দিন পর সন্ধ্যা বেলায় শুভর সাথে রান্না ঘরে তরকারি খুঁটতে খুঁটতে গল্প করছিলো মিতু।শুভর অভ্যেসটাই এমন। বাড়ির মহিলারা যখন তরকারি খুঁটতে বসে তখন সেও মাঝেমধ্যে তাদের সাথে বসে পড়ে।ডাটা কিংবা কচুর লতিকা হলে তো কথাই নেই। মহিলাদের সাথে বসে গল্প করে সে।সেও গল্প বলে।তার কাছে গল্পের কোন অভাব নাই। মিতুর বিয়ের আগে মিতুকে সে কত ভুরি ভুরি ভূত প্রেতের গল্প শুনিয়েছে! একেক দিন গল্প শুনে মিতুর এমন অবস্থা হতো যে ভয়ে সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বড় ঘরে পর্যন্ত আসতে পারতো না।শুভর শার্টে খামচি দিয়ে ধরেই তবে আসতো।শুভ তখন হাসতো। অবশ্য ওদের ভেতর প্রেম ভালোবাসা বলতে কিছুই ছিলো না।ওরা কেউ কাউকে কখনো বলেনি এসব। কিন্তু মনে মনে ওদের কেউ কাউকে ভালোবাসতো কি না কে জানে!ওরা না বললে তো আর আমরা জানতে পারি না!
সেদিন সন্ধ্যা বেলায়ও মিতু তরকারি খুঁটছিলো।আর শুভ তার পাশে বসে গল্প করছিলো। প্রথমে সে জিজ্ঞেস করলো ওর শশুর বাড়ির বিষয়ে।বললো,’ওই বেয়াদবটার কী খবর রে?ওর সাথে কী তুই কথাবার্তা বলিস নাকি?’
মিতু বললো,’কোন বেয়াদবটা?’
‘আরে ইরম না কী যেন ওই ছাগলটার নাম!ধ্রুবর ডাক্তার ভাই। যে তোরে ওইসব নোংরা নোংরা কথা বলেছিল?’
মিতু মুখটা কুঁচকে বললো,’উনাকে বেয়াদব ডাকবা না। আমার ভাসুর উনি!’
মেয়েরা এমন-ই। ওদের এই একটা বদ অভ্যাস আছে। বিয়ের পর এরা যদিও জানে ওর দেবর ভাসুর কিংবা ননদের বরটা চরিত্রহীন তবুও তারা কেন জানি বাবার দেশের মানুষদের সাথে গর্ব করে ওদের নিয়ে কথা বলে। ওদের নিয়ে মিথ্যে প্রশংসা করে। যদিও এইসব প্রশংসা তাদের মনে আনন্দ দিতে পারে না। তবুও তারা এটা কেন জানি করে!
মিতুও এর ব্যতিক্রম নয়।সেও এটা করলো। এবং এটা করার কারণেই শুভর কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল।সে জ্ঞানী।জ্ঞানী মানুষেরা একটুতেই সব বুঝতে পারে।শুভও বুঝে ফেললো সবকিছু।মিতু যে ওখানে সুখে নেই তা সে ইতিমধ্যেই টের পেয়ে গেছে।
তারপর সে ইচ্ছে করেই আরো অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলো।বললো,’ধ্রুব কেমন রে? খুব ভালো তাই না?’
মিতু এবার মিথ্যে বললো না।কারণ তারও বিশ্বাস ধ্রুব খুব ভালো ছেলে।তাই সে স্ফূর্তি নিয়ে বললো,’সে কী আর বলতে হয়।ওর মতো ছেলেই হয় না!’
শুভ হেসে বললো,’আমার চেয়েও ভালো?’
মিতু জোর গলায়ই বললো,’হ্যা তোমার চেয়েও ভালো। ‘
মিতু কথার এক পর্যায়ে এসে বললো,’দুদিন পর তো চলেই যাবো আমরা। আবার কখন আসি তার নেই ঠিক ঠিকানা! আজ একটা ভূতের গল্প বলো তুমি। কতদিন তোমার মুখ থেকে ভূতের গল্প শুনি না!’
শুভও তাই চাচ্ছিলো। মিতুর বিয়ের পর আর কাউকে সে ভূতের গল্প শোনায়নি।ছেলে মানুষদের কাছে ভূতের গল্প বলার কোন আনন্দ নাই।ওরা মন দিয়ে শুনে না। কিংবা শুনলেও ভয় পায় না। ভূতের গল্প বলতে হয় মেয়ে আর ছোট বাচ্চাদের।ওরা এসব গল্প মন দিয়ে শুনে। বিশ্বাস করে এবং ভয় পায়।
শুভ গল্প বললো।একটা না। পরপর তিনটা। ভয়ংকর ভয়ংকর গল্প।শুনলেই শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠে। মিতুর এবার ভয় হচ্ছে।এতো ভয় যে মনে হচ্ছে এই বুঝি ভূতটা এসে তার ঘাড় মটকে দিবে এক্ষুনি! এবং কী অদ্ভুত কান্ড। তখনই ইলেক্ট্রিসিটিও চলে গেল। মিতুর সাথে মোবাইল ফোন নেই।শুভর মোবাইল ফোনও অন্য ঘরে চার্জে রেখে এসেছিল। ভূতের গল্প শুনে এমনিতেই ভীষণ রকম ভয় পাচ্ছিলো মিতু। এবার ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ায় তো তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। সে সঙ্গে সঙ্গে শুভর শার্টটা খামচি দিয়ে ধরলো।আর বললো,’শুভ ভাই চলো ও ঘরে চলে যাই আমরা।’
শুভ উঠতে উঠতে বললো,’হ্যা চল।’
কিন্তু ওরা চলতে পারলো না।এর আগেই একটা টর্চের আলো এসে পড়লো ওদের দুজনের চোখে মুখে। সাথে কিছু কটু বাক্য।
‘তবে কী ভাইয়া সত্যিই বলেছিল এসব।তুই আসলেই এবরোশন করতে গিয়েছিলি। তোর আগে থেকেই চরিত্র খারাপ।শুভর সাথে তোর খারাপ সম্পর্ক ছিল। এখনও আছে।না জানি আরো কতো জনের সাথে আছে!’
তারপর ধ্রুব চিৎকার করে বাড়ির সব মানুষকে এক করে ফেললো।সবাই দ্রুত এদিকে ছুটে এলো।ধ্রুব এদেরকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলো, দেখুন ওরা দুজন অন্ধকারে পৃথিবীর ভয়ংকর পাপ করেছে।
বাড়ির সবাই ওদের এভাবে দেখে ধ্রুবর কথাটা বিশ্বাস করে ফেললো। কিংবা বিশ্বাস করবেই বা না কেন? আমাদের সমাজের মানুষেরা কী আর ধৈর্য্য ধরে একটা বিষয় নিয়ে ভাবতে পারে?অত সময় কোথায় তাদের! কিংবা মাথা খাটাবার অত প্রয়োজনটাই বা কী? গল্পের আঁড়ালের গল্প কিংবা ঘটনার আঁড়ালে লুকিয়ে রাখা ফাঁদ এইসব বিষয় নিয়ে তারা ভাবতে চায় না অত শতো। স্বামী চিৎকার করে বলেছে তার স্ত্রী অপরাধী আর তারা এসে দেখেছে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসছে দুজন নর নারী।এতেই হয়ে গেল।হতে পারে এই দু’জন নর নারী পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র দুজন মানুষ।তারা পাপের ‘প’ টাও কোনদিন করেনি। তবুও সমাজের কাছে তারা পাপী।জঘন্যতমো পাপী।আমরা অন্ধকারের ভেতরে কিছুই দেখতে পাই না।কারণ আমাদের ভেতরের যে জ্ঞানের চোখটা তা নেই।তাই আমরা অন্ধকারের গল্পটা সন্দেহের বশে নিজেদের মতো করে তৈরি করে নেই। এই গল্পেও এমনটিই হয়েছে।নিষ্পাপ মিতু আর শুভকে সবাই ধরে নিয়েছে ওরা ভয়ংকর পাপ করেছে এই অন্ধকারে!পাপ না করলে তারা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসবে কেন?
আর আজমল মাস্টারের কানে যখন এই কথাটা গিয়ে পৌঁছালো তখন আজমল মাস্টার—-
‘
#চলবে