মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি পর্ব ১৪

#মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি
#পর্বঃ১৪
#Ipshita_Shikdar
৪২।
সাগরের পাড়ে একাকিই হাঁটছে প্রিয়া, কোনো এক অজানা কারণে এখানে মানুষজন খুব কম। হাতের ফোনটার দিকে বার কয়েক তাকিয়ে পুনরায় কল করে আরিজের নাম্বারে।

“প্রেম-ভালোবাসা মানুষকে সবসময় অশ্লীল না বানালেও বেহায়া বানায়। আত্মসম্মানবোধটাই যেন তখন শূণ্য হয়ে পড়ে।”

এ দুটো বাক্য শুনেছিল সে আগে। আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

আপন ভাবনাতেই কল রিংটোন একবার বাজতে বাজতে কেটে গেলেও তার ঘোর ভাঙে না। পুনরায় কল আসলে পক্ষীই অতি বিরক্তির সাথে জোরেই বলে উঠে,

“কানে কালা হলেন নাকি! ফোনটা একবার বেজে কেটে কেটে গেল, আবার বাজছে; ধরছেন না কেন?”

হঠাৎ সে জোরে বলায় চমকে উঠে আরিজ।

“হুম…? হ্যাঁ, ধরছি। ”

ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে স্ক্রিনে মোটা মোটা অক্ষরে ভাসছে প্রিয়ার নাম। গোপণে ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে কলটা রিসিভ করে সে।

প্রিয়া তখন নোনাজলে সিক্ত বালুময় পাড়ে বসে। খাণিক দ্বিধা নিয়ে প্রথমেই বলে,

“হ্যালো, কেমন আছো?”

আরিজও বেশ নিচু ও শান্ত গলাতেই কথোপকথন শুরু করে।

“হুম, ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? আর তোমার ট্যুর কেমন যাচ্ছো?”

যুবকের মুখে কথাটা শুনেই শ্বেতাঙ্গ নারী মৃদু গোলাপি ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি ফুটে উঠে, এ হাসির আবরণে লুকায়িত আছে হাজার খাণেক তাচ্ছিল্য। অত্যন্ত শীতল তবে আবেগি গলায় সে উত্তর দেয়,

“আদৌ তোমার কি কিছু যায় আসে আমার সম্পর্কিত কোনো কিছুতে? দু’টো দিন পর মনে হলো এই মেয়েটা কেমন আছে? তাও আমার মনে করিয়ে দেওয়ার পর… কতোটা অগ্রাহ্য হয়ে উঠেছি আমি তোমার কাছে, বুঝতে পারছো!”

আরিজ কী উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না, তাই সে নীরবতাই পালন করে। প্রিয়া ঠোঁট কামড়ে নীরবে নিজের চোখজোড়া থেকে অতি বেদনার নোনাজল বিসর্জন দিচ্ছে। ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু নামক নোনাজল মিশে যাচ্ছে অসীম নোনাজলে।

অপরদিকে পক্ষী কিছুটা হলেও অনুমান করতে পারে কলটা কোন ব্যক্তিটির। মৃদু অস্বস্তি ও অনেকটা খারাপ লাগা নিষ্পিষ্ট হতে শুরু করে তার ক্ষুদ্র দেহমন, হৃদয়ে অদ্ভুত এক পোড়ন অনুভব করে সে। এই জ্বলন সহ্য করার মতো নয়, খুব দ্রুতোই হেঁটে শয্যাগার থেকে বের হয়ে যায় সে।

বেশ কয়েক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা বিরাজমান থাকে প্রিয়া ও আরিজের মাঝে। এই নিস্তব্ধতা কাটিয়ে উঠে প্রিয়ার বচনেই। সে এবার ভেজা গলায় বলতে শুরু করে,

“আমাদের সম্পর্কটা এতোটাই ঠুনকো কবে হলো বুঝতেও পারলাম না। জানো তোমার পরিবর্তন আমায় কত কষ্ট দেয়! আমার হৃদয়ে মধ্যখানটায় আস্ত এক তীরের মতো তোমার অবহেলা। এতোটা হতাশ, অশ্রুসিক্ত, বেদনায় জর্জরিত আমার এই দেহমন নিজের জন্য, ভালোবাসার জন্য পরিবারের কাছে অযোগ্য সন্তান হয়েও পাইনি। ভাইয়ার থেকেও দূরে যেয়ে পাইনি, বিশ্বাস করো! বড্ড ভালোবাসি তোমায়, বড্ড বেশি…!”

বলতে বলতে খাণিক শব্দ করেই কেঁদে ফেলে সে। অনেক ত্যাগ স্বীকার করার ফলে তার ভালোবাসা এবং এই সম্পর্ককে এত দূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। এত যতন করে আগলে রাখা বিষয়টা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে ভাবতেই তো মনের প্রতিটি কোণে পোড়ন ধরে যায়।

আরিজের দেহমন তীব্র অপরাধবোধের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়। পক্ষীর প্রতি কাজ করা অনুভূতিগুলোও যেন এখন বিষধর শাপ লাগছে যুবকের নিকট। মনে হচ্ছে কোনো এক গোলকধাঁধায় পড়েছে সে, যার থেকে বের হওয়ার দোয়ার খুঁজে পাচ্ছে না।

খোঁজার আগ্রহও তার বিন্দুমাত্র নেই, কারণ বর্তমানের পরিস্থিতি তার নিজেকে বদ্ধ উন্মাদ ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। প্রিয়ার কান্না থামাতে এবং পরিস্থিতি এড়াতে সে আমতা আমতা করে বলে উঠে,

“কেঁদো না প্লিজ। আমার শুধুমাত্রই এক্সিডেন্ট হয়েছিল, যেদিন তুমি শিক্ষা সফরের কথা জানিয়েছিল। আমি আসলে চাইনি তোমার ট্যুরটার মজা নষ্ট করতে চাইনি, কোনো দুশ্চিন্তাও দিতে চাইনি তোমায়। তাই বিষয়টা বলিনি আর কী…!”

প্রিয়ার মনের পোড়ন, বেদনা এবার যেন প্রশমিত হয়। শীতলতা বয়ে যায় তার সারা হৃদয় জুড়ে। একই সাথে প্রিয়জন দূরে না যায়নি বলে সুখকর অনুভূতি এবং তার কষ্ট জেনে বিষণ্ণতা দুটোই অনুভব করে সে। তবে কোথাও না কোথাও একটা কিন্তু রয়েই গিয়েছে। তবুও তা অগ্রাহ্য করে ফেলে সে, কারণ বিষয়টির সামনাসামনি হওয়াতে যে বড্ড ভয় তার। সে যে নিজের অনুভূতি, হৃদয়, মস্তিষ্কের সর্বস্ব লুটিয়েছে এই সম্পর্কের মাঝে, তাই তো তা মিথ্যে মানতে বড্ড নাকোচ তার।

অতঃপর অত্যন্ত প্রিয়জনের খবর জানতে উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করতে শুরু করে সে।

“তুমি ঠিক আছো এখন? কী অবস্থা? কোথায় লেগেছে? ঔষধ ঠিকমতো খাচ্ছো তো?”

মেয়েটার এমন কথায় পূর্বে আরিজ প্রশান্তির হাসি দিতো, ভাবতো প্রেমিকা কতো ভালোই না বাসে তাকে। কিন্তু আজ তার মাঝে সেই অনুভূতি মৃত। বরং, বেশ অস্বস্তিদায়ক যেন এই পরিস্থিতি তার নিকট।

সে শান্ত গলাতেই উত্তর দেয়,

“তুমি প্যারা নিয়ো না। আমি ঠিক আছি, এখানে সবাই আছে আমাকে দেখার জন্য। তুমি নির্দ্বিধায় নিজের ভ্রমণ উপভোগ করো। ”

“হুম, আর সরি এভাবে তোমার সাথে…”

পরিস্থিতির অস্বাভাবিকতা কাটাতে সে প্রিয়াকে থামিয়ে বলে উঠে,

“না, ঠিক আছে। বাদ দাও এসব, বলো তোমার ট্যুর কেমন কাটছে?”

এভাব নানা ধারার কথাবার্তায় চলতে থাকে তাদের প্রায় কয়েক মিনিট। ফোন কাটার পর আরিজ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে গা এলিয়ে দেয় নরম বিছানায়। এই নরম বিছানায়ও আজ আরাম পাচ্ছে না সে, তার সম্পূর্ণটা জুড়ে যাচ্ছে বিষণ্ণতায়। তবুও সব ভাবনা পিছনে ফেলে সে স্বাভাবিক হয়।

৪৩।
একগুচ্ছ সূর্যালোকের প্রবেশে ঘুম ভাঙে আরিজের। ফজরের নামাজের পক্ষী সেই যে ধমক দিয়ে শুয়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল, তারপর ঘুম ভাঙলো এখন।

বলা বাহুল্য, এক সপ্তাহের বেশি কেটে গিয়েছে সেদিনের পর। আরিজ এখন মোটামোটি একা হাঁটতে পারলেও সম্পূর্ণ স্বাভাবিকর ভাবে হাঁটতে সক্ষম নয়।

ফজরের নামাজটা আজকাল সবার জোরজবরদস্তিতে বিশেষ করে পক্ষীর আদেশে ঘরেই পড়তে হয় তার। মেয়েটার জন্য তার রোজকার জীবনযাপনের তালিকায় যোজন-বিয়োজন মোট কথায় পরিবর্তিত হয়েছে অনেক কিছু। যেমনঃ আগের মতো কড়া ঝালঝাল খাবারের কমতি, আবার রোজ সকালে হাঁটাচলা বন্ধ, পূর্বের ন্যায় রাতদিন ল্যাপটপও কাজও করা বন্ধের প্রায় আরও কত কী! কিন্তু অবাককর বিষয় হলো, যে একরোখা ছেলেটা কারো কথাই গায়ে লাগায় না, সে আজকাল নব্য পরিচিত হওয়া মেয়ের কপাট রাগ বা জোরজবরদস্তি যুক্ত আদেশেও গা ভাসিয়ে দেয়।

পক্ষী খাবারের ট্রলি নিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখে জনাব ঘুম থেকে জেগে আরাম আড়মোড়া ভাঙছে। কিছু একটা ভাবতেই মাথায় দুষ্টুমি ভর করে তার যেন। কপাট বিরক্তির সুরে বলে উঠে,

“আহ! কী কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমান আপনি আরিজ! অবশ্য, আপনাকে কুম্ভকর্ণকে আপনার সাথে তুলনা করা তারও অপমান।”

শ্যামাঙ্গিনীর কথায় চোখজোড়া ছানাবড়া হয়ে উঠে তার। ততক্ষণে পক্ষী বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, যুবকের মুখভঙ্গি দেখে ললাটে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ে তার। সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করে,

“তোমার কী ঘুমের ঘোর এখনো ভাঙেনি বলে আমায় চিনতে পারছো না? মানে কী স্বভাবরে বাবা! পুরাই এলিয়েন!”

আরিজ নামক বইটির অনেকাংশই পক্ষীর পড়া হয়েছে, যার কারণের যুবকের অনেক বিষয় সম্পর্কেই জ্ঞাত সে।

শ্যামাঙ্গিনীর প্রথম উক্তিতে তো ভড়কে গিয়েছিলোই আরিজ, এবার যেন আরও ভড়কে গেল। নাক ফুলিয়ে বলল,

“তাই না! আমি এলিয়েন, কুম্ভকর্ণ…! তাহলে দেখো এই আরিজ জামান কী করে!”

বলেই নারীটির হাত টেনে ধরে বিছানায় ফেলে নরম বালিশের সাহায্য প্রাণঘাতক নয় হৃদয় ঘাতক আঘাত করতে শুরু করে। নারীও কী কম যায়! সেও প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আরেকটি বালিশ নিয়ে মারতে শুরু করে এক পর্যায়ে বড়সড় খাটের উপর দু’জনের লাফালাফির এক পর্যায়ে পক্ষীকে ধরতে যেয়ে পায়ের ব্যথায় আলতো আর্তনাদ করে বসে ধপ করে পড়ে আরিজ।

তা দেখে পক্ষীর হাসি আর আটকে…? সে খিলখিল করে হাসতে শুরু করে, এই হাসিতে যেন মুক্ত ঝরছে অবিরাম। যুবক সব বাদ দিয়ে শ্যামাঙ্গিনীর এই হাসি দেখছে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে।

“মেয়েটাকে প্রথম সাক্ষাতে মনেই হয়নি, তার ভিতরে এতোটা বাচ্চামি, রাগ, অভিমান, দুষ্টুমি, বাচালতা লুকিয়ে আছে। এতোটা স্নিগ্ধ ও মায়াময় এই নারীটি কি এসব কিছু আগলে রেখেছিল শুধুমাত্র এই প্রান্তে কাছে প্রকাশে? হয়তো হ্যা, নয়তো না। তবে শুধু চায় না এই মায়ামত নারীর আড়াল করে রাখা রূপ এথায় ছাড়া অন্যকোথাও প্রকাশ হোক।”

“এই যে জনাব, দশটা বাজে খেয়াল আছে? খাবার খেতে হবে, যান ফ্রেশ হয়ে আসেন।”

আরিজের সব অহেতুক কিংবা প্রয়োজনীয় ভাবনার ঘোর ভাঙে পক্ষীর কথাতেই। সে সায় জানিয়ে ধীরপায়ে বাথরুমের দিকে যায়। পক্ষীও কোমরে ওড়না বেধে বিছানা গুছানোর কাজে লেগে যায়।

যুবক ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে এসে দেখে তার স্ত্রীর শিলমোহর লাগানো রমণী ওড়না বেধে কাজে ব্যস্ত। সম্পূর্ণ অকৃত্রিমতা ছেয়ে আছে তার মুখশ্রীতে, কোনো ক্রিমের ছোঁয়াও নেই। তবে চোখজোড়ায় গাঢ় করে কাজলরেখা টানা। আর বাঁকা রেশমের ন্যায় চুলগুলোর থেকে কয়েকটা হাত খোপাতে বন্দী হতে না পেরে এদিক ওদিক ছুটছে। অত্যন্ত সাধারণ তার এই রূপ, তবুও অপরূপা রমণী লাগছে। তবে খোপাটা যেন এই নারীদেহে বেমানান।

আপনমনেই সে মিনমিনে গলায় উঠে,

“কন্যারে, কন্যারে, বাঁকা চুলেতে খোঁপা আর বাইধো না রে; ঐ চুলেতে জাদু আছে রে, আমার ঘুম আসে না রাতে একলা ঘরে। ”

“এসেছেন তো… নিন আজ স্যুপ আর স্যান্ডউইচ করেছি, খেয়ে নিন।”

বিছানার কাঁথা ভাঁজ করতে করতে কথাটা বলে পক্ষী। এই কথাটা যেন একটুও পছন্দ হয়নি আরিজের। মুখশ্রী বিকৃত করে ফেলে সে।

“আমি একা খাবো নাকি? কিন্তু আমার হাতের তো…”

যুবতী কিছু না বলে কাঁথাটা বিছানায় ফেলে চলে যায় বাথরুমে। হাত ধুতে ধুতে বলে,

“বুঝলাম না ডাক্তার চাচা বললেন, আপনার হাত দিন তিনেকে ঠিক হয়ে যাবে। আর দেখো, সপ্তাহ পেরিয়ে গেল হাত ঠিক হওয়ার নাম নেই।”

কথাটা শুনে মিটমিট করে হাসছে আরিজ। প্রকৃতপক্ষে, তার হাত স্বাভাবিক হয়েছে বহু আগেই। কিন্তু কেন যেন এই নারীটির হাতে খেয়ে সে অমৃতরস পান করার ন্যায় সুখ পায়।

৪৪।
আরিজ রাগে চোখমুখ শক্ত করে, রক্তিম চোখে নাক লাল করে বাড়ি ফিরছে। তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন রাগে টগবগ করছে। ড্রইংরুমে বিদ্যমান দুই মধ্যবয়স্ক বোন ছেলেকে এভাবে আসতে দেখে ভড়কে যায়। চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করে,

“কীরে তুই এভাবে…? আর পক্ষী কোথায়? তুই না ওকে নিতে গিয়েছিলি!”

কিন্তু যুবক এতোটাই রাগে তা কানেই যেন যায়নি তার। সে হনহন করে হেঁটে নিজের শয্যাগারে প্রবেশ করে। বলা বাহুল্য, সে পক্ষীকে ভার্সিটি থেকে নিয়ে আসতে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। কিন্তু ফিরত আসে এভাবে।

নয়ন্তিনী বেগম চিন্তিত গলায় বললেন,

“বুবু, আমাদের কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? পক্ষী আর আরিজকে এভাবে… আমরা ভালো করতে যেয়ে খারাপ করছি না তো ছেলেটার?”

নয়নার মাঝে গম্ভীরতা বিরাজমান। শীতল গলায় সে উত্তর দেয়,

“দেখ, আল্লাহ বান্দার ভালো ছাড়া খারাপ চায় না। তাছাড়া আমি সবদিক ভেবেচিন্তেই করছি… ”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here