মৃত কাঠগোলাপ পর্ব -১৯+২০

#মৃত_কাঠগোলাপ – ১৯
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

কামরুল হাসানকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। আপাতত তিনি ঘুমাচ্ছেন। বাবা ঘুমিয়ে পড়লে, আয়েশী ধীর পায়ে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে যায়। সিঁড়ি বেয়ে হাসপাতালের নিচে এসে থামে। একটু দূরেই বড় বট গাছ দেখা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে অনেক পুরনো গাছ। আয়েশী সে গাছের নিচে এসে দাঁড়াল। বড্ড মাথা যন্ত্রণা করছে। পিপাসায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আয়েশী ক্লান্ত গা নিয়ে গাছের নিচে বসল। কাপড় ময়লা হচ্ছে, হোক। একটুখানি শান্তি যদি মেলে? আয়েশী নিজের পার্স থেকে ফোন বের করে। ফোনের লক খুলে গ্যালারিতে প্রবেশ করে চোখে পড়ে মৃদুল এবং আয়েশীর হাস্যোজ্জ্বল ছবি। আয়েশী মৃদুলের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে, মৃদুল হাত বাড়িয়ে সেলফি তুলছে। দুজনের মুখেই লেপ্টে আছে তৃপ্তির হাসি। আর থাকবেই না কেন? সেদিন যে মৃদুল এবং আয়েশীর জন্য এক বিশেষ দিন ছিল। সেদিন ছিল তাদের বাগদান! এই তো সেদিনের কথা। অথচ আজ? আজ সব স্মৃতি। মৃদুল তো চলে গেছে, কিন্তু সে আয়েশীকে দিয়ে গেছে কিছু সুন্দর, অতুলনীয় স্মৃতি। মৃদুল নেই, আয়েশী মৃদুলের সেই স্মৃতি আকড়ে সারাজীবন পাড় করে দিতে পারে। সারাটাজীবন!

‘ হরে কৃষ্ণ… ‘
হঠাৎ আয়েশীর সামনে লাফিয়ে এসে দাঁড়ায় এক বড্ড পাগল লোক। আয়েশী কেঁপে উঠে। মোবাইল একহাতে চেপে ধরে দু কদম পেছায়। ভ্রু কুঁচকে চায় পাগলটার দিকে। পাগল লাফাচ্ছে, গায়ে একটা ময়লা প্যান্ট ব্যতীত আর কিছুই নেই। চুলে বহু বছরের জট। গা থেকে মারাত্মক দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। আয়েশী ভয় পেয়ে পাগলটাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চায়। তবে পাগল লোকটি হাত দিয়ে আটকে দেয় আয়েশীকে। চোখ উপর-নিচ ঘুরিয়ে বলে,
‘ নাম কি রে তোর? ‘
আয়েশী নাক কুঁচকে ফেলে। লোকটার কাছাকাছি থাকায় গন্ধে বমি চলে আসার জোগাড়। আয়েশী কথা বলে না। মাথা নিচু করে পুনরায় পাশ কাটায়। তবে পাগল লোকটা আবার আয়েশীর কাছে লাফিয়ে আসে। আয়েশী ভয়ে আবার দু কদম পেছায়। রাগ দেখিয়ে বলে,
‘ দেখুন, আমার রাস্তা ছাড়ুন বলছি। নাহলে আমি লোক জড়ো করব। ‘
পাগল হাসে। হু হা করে হাসতে হাসতে যেন আয়েশীর গায়ে লুটিয়েই পড়ে। আয়েশী ভয়ে নিজের জামা খামচে ধরে। পাগল লোকটা হাসি থেমে বলে,
‘ লোক ডাকবি। হ্যাঁ? ডাক তোদের ভদ্র সমাজের অভদ্র লোকদের। ডাক না, ডাক। ‘
লোকটা চিৎকার করতে করতে হঠাৎ আয়েশীর হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে পিচ ঢালা রাস্তায় আ’ছাড় দেয়।
শক্ত আ’ঘাতে আয়েশীর মোবাইলে ভে’ঙে কয়েক টুকরো হয়ে যায়। মুহূর্তেই কি হয়ে গেছে বুঝতে আয়েশীর বেশ কষ্ট হল। পরক্ষণেই রাস্তার মধ্যে আয়েশীর এতদিনের মোবাইলে ভে’ঙে পড়ে থাকতে দেখে, আয়েশীর চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। ছুটে যায় রাস্তায় পড়ে থাকা ভাঙ্গা মোবাইলের দিকে।
ধাম করে বসে যায় রাস্তায়। মোবাইলের ভাঙ্গা টুকরোগুলো জোড়া লাগানোর চেষ্টা করে। এ মোবাইল নষ্ট হয়ে গেলে, মৃদুলের সাথে আয়েশীর সব স্মৃতি হারিয়ে যাবে। আয়েশী- মৃদুলের সকল সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী এই মোবাইল। তাদের সকল ছবি, ক্ষুদে বার্তা সব এই মোবাইলে সংরক্ষণ করা। আয়েশী কেঁদে ফেলে। মোবাইল সমস্ত পার্ট টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এই মোবাইল আর ফিরে পাওয়া সম্ভব না। মৃদুলের শেষ স্মৃতিগুলোও আয়েশী হারিয়ে ফেলল। এত অলক্ষ্মী কেন সে? আয়েশী কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না। কারো না।

‘ তুই কাঁদছিস ক্যান? ‘
পাগলটা আয়েশীর কানের কাছে চিৎকার করে বলে। আয়েশী কান্না থামায়। আগুন চোখে তাকায় পাগল লোকটার দিকে। চিৎকার করে বলে,
‘ তোকে আমি খু’ন করে ফেলব। আমার মোবাইল ভাঙার সাহস কোথায় পেলি? ‘
পাগল লোকটা কিছুক্ষণ শীতল চোখে তাকায়। হয়তো আয়েশীর কথার অর্থ ধরতে চাইছে। কিন্তু একটু পরই হু হা করে হেসে বলে,
‘ খু’ন? পাগলদের আবার খু’ন করা যায় নাকি? তারা খু’ন হয়ে যায় বলেই তো তারা পাগল। এই দেখ, আমি মৃ’ত। দেখ দেখ। আমার দিল ছিঁ’ড়ে দেখ। তাজা র’ক্ত পাবি না। সব পানি হয়ে গেছে। দেখ, দেখবি? ‘
পাগল লোকটা আয়েশীর হাত ধরে ফেলে। আয়েশী ভয়ে পেয়ে ধস্তাধস্তি করে। পাগল লোকটা গর্জন করে হাসে। আয়েশীর হাত ছেড়ে বলে,
‘ তোরা ভদ্র সমাজ, আমাদের নোংড়া গায়ে হাত দিবি ক্যান? তোরা হাত তো’ নোংরা টাকা ছুঁয়ে অভ্যাস।টাকা, টাকার মায়া বড় মায়া। টাকাই এই পৃথিবীর’ সব। হায়রে টাকা, হায়রে পৃথ্বী। ‘

পাগলটা আকাশের দিকে দুহাত তুলে বিলাপ করে। কাউকে কি অভিযোগ জানাচ্ছে? কাকে? ওই উপরে যিনি বসে আছেন, তাকে? কি অভিযোগ জানাচ্ছে? এই পৃথিবীর ভদ্রতার মুখোশ পড়ে থাকা অভদ্র লোকদের বিরুদ্ধে? আয়েশী গভীর ভাবে পাগলটার দিকে তাকায়। পাগলটার চোখে কিসের যেন কাতরতা। লোকটা কি ভীষন দুঃখী? তার কি অনেক, অনেক অভিযোগ আমাদের নিয়ে? আয়েশী ভীষন অবাক হয়। বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রয় পাগল লোকটার দিকে। পরক্ষণে নিজের ভা’ঙ্গা মোবাইলের দিকে তাকায়। মৃদুল কি তবে চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল?
_________________________
‘ ওসমান, পাগল দেখেছ কখনো? ‘
ধ্রুব তার পোষা বাঘদের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করছিল। হঠাৎ করে এ কথা শুনে ওসমান ভ্যাবাচেকা খায়। বলে,
‘ দেখেছি, স্যার। ‘
‘ কখনো কি কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের পাগল দেখেছ? ‘
ওসমান অবাক হয়। সুস্থ মস্তিষ্কের পাগল আবার হয় নাকি? তাদের মস্তিষ্ক অসুস্থ বলেই তো তারা পাগল। ওসমান কথা বলে না। চুপ করে থাকে। ধ্রুব হাসে। বাঘদের সামনে খাবার হিসেবে তাজা মাংস ফেলে। বাঘরা মাংস পেয়ে হা’মলে পড়ে তার উপর। ধ্রুব বাঘদের সেখানে রেখে হেঁটে আসে বাগানের মধ্যে। ওসমান পেছন পেছনে আসে। ধ্রুব টিস্যু দিয়ে হাত পরিষ্কার করে বলে,
‘ উত্তর দিলে না কেন ওসমান? ‘
ওসমান মাথা নত করে বলে,
‘ আপনি’ই আমার থেকে বেশি জানেন, স্যার। ‘
‘ হ্যাঁ, ঠিক। আমি যা জানি, তার অর্ধেক যদি তুমি জানতে তাহলে আজ তুমি আমার এই কালো সম্রাজ্যের একচ্ছত্র রাজা হতে।’
ধ্রুব হাঁটতে হাঁটতে একটি কাঠের তৈরি কক্ষের সামনে দাঁড়ায়। কক্ষটার দরজায় বিশাল এক তালা ঝুলানো। ধ্রুব নিজ হাতে সে তালা খুলে। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলে, কক্ষের ভেতর ওসমানের চোখে পড়ে এক লোক। যার চারপাশে অসংখ্য টাকার নোট ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। ওসমান বুঝতে পারে না, এই লোক কে? আর এই লোককে ধ্রুব টাকা দিয়েই বা কেন মুড়িয়ে রেখেছে? ওসমান ধ্রুবর দিকে চায়। ধ্রুব নিজে থেকেই হয়তো সব বলবে।
ধ্রুব লোকটার পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসে। লোকটার ময়লা চুলে হাত বুলিয়ে বলে,
‘ টাকার গন্ধ ভালো লাগছে? ‘
লোকটা একটা এক হাজার টাকার নোট নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ শুঁকে। লম্বা করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘ টাকার ঘ্রাণ এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ঘ্রাণ। মানুষ এই ঘ্রাণের কারণেই টাকার নোটের পেছনে ছুটে। ‘
ধ্রুব লোকটার হাত থেকে সেই এক হাজার টাকার নোট ছি’নিয়ে নেয়। এতে লোকটা উত্তেজিত হয়ে যায়। লোকটা ধ্রুবর থেকে নোটটা ছিনিয়ে নিতে চায়। তবে ধ্রুব ধরা দেয় না। ধ্রুব টাকা ধরা হাত লোকটার নাগালের বাইরে উচুঁ করে বলে,
‘ যদি কেউ তোমার থেকে টাকা ছিনিয়ে নেয়, কেমন লাগবে? ‘
লোকটা দাত খিঁচে ধরে। হুংকার ছেড়ে বলে,
‘ খু’ন করে ফেলব। ‘
ধ্রুব পুনরায় হাসে। সে এতদিন যে সোনার খনির খোঁজ করেছিল, আজ সে তাই পেয়ে গেছে। এখন শুধু এই সোনার খনিকে ভালো করে ঘষে মেজে পরিপূর্ন সোনায় পরিণত করতে হবে।
ধ্রুব টাকার নোট আবার লোকটার হাতে ধরিয়ে দেয়। লোকটা পুনরায় ব্যস্ত হয়ে যায় টাকার ঘ্রাণ শুঁকতে। ধ্রুব উঠে দাঁড়ায়। কক্ষের দরজা তালা দিয়ে বেরিয়ে আসে সেখান থেকে।
ধ্রুব ভেজা টিস্যু দিয়ে হাত পরিষ্কার করে। চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে বুক টানটান করে দাড়ায়। ভ্রুরু কুচকে, ঠোঁটে রহস্যময় হাস নিয়ে চেয়ে রয় দূরে। ওসমান বেকুব হয়ে এতক্ষণ ধ্রুবর কার্যকলাপ দেখছিল। ধ্রুব কি করতে চাইছে কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। আসলে এত বছর ধ্রুবর সাথে কাজ করেও সে ধ্রুবকে এখনো ভালো করে চিনে উঠতে পারেনি। ধ্রুব, সে তো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে এক আস্তরণ ঘেরা রহস্যময় মানবের নাম।
#মৃত_কাঠগোলাপ – ২০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

ধ্রুব এবং আয়েশীর বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আয়েশী চেয়েছিল বিয়েটা সাদামাটা হবে। কিন্তু ধ্রুব তা শুনে নি। তার ভাষ্যমতে, সমাজে তার নামডাক অনেক। সাদামাটা বিয়ে করলে তার ইজ্জত থাকবে না। সবাই ভাববে, সে টাকার জন্য তার বিয়ে ধুমধাম করে করেনি। যা ধ্রুবর আত্মসম্মানে আঘাত হানবে। আয়েশী প্রথমে এ নিয়ে চেঁচামেচি করলেও, বাবার মুখের দিকে চেয়ে দাতে দাত চেপে সহ্য করেছে।
আয়েশী জানালায় মাথা ঠেকিয়ে দাড়িয়ে আছে। চোখ উপসে জল গড়াচ্ছে। এ আর নতুন কি। সদা হয়। মৃদুল মারা যাবার পর আয়েশী ঠিকমত একবারও হেসেছে কিনা মনে পড়েনা।
‘ আয়েশী? ‘
মায়ের কণ্ঠে পেছন ফেরে আয়েশী। মনোয়ারার এক হাতে ভাঁজ করা জামদানি শাড়ি। ওপর হাতে গয়নার বাক্স। মনোয়ারা হাতের সব বিছানার উপর রাখলেন। গয়নার বাক্স খুলে তা ঠিক আছে কিনা পরখ করে বললেন,
‘ ধ্রুব এসেছে। তোকে বিয়ে একটু বেরুবে। ‘
আয়েশী রাগে ফেটে পড়ে। বলে,
‘ আমি যাব না। তার এত শখ জাগছে কেন? সে কি জানে না, আমার পরিস্থিতি কেমন? ‘
মনোয়ারা ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে ‘শুস’ শব্দ করে বলেন,
‘ আস্তে কথা বল। ধ্রুব শুনবে। ‘
আয়েশী আগের চেয়ে দ্বিগুণ শব্দ করে চেঁচায়,
‘ শুনলে শুনুক। আমি কি তাকে ভয় পাই? সে কি শুরু করেছে? যখন যা মন চাইছে তাই করছে। কারো ফিলিংসের কি কোনো দাম নেই তার কাছে? ‘
মনোয়ারা ব্যস্ত পায়ে আয়েশীর পাশে এসে দাঁড়ালেন। আয়েশীর বাহু ধরে সাবধানী কণ্ঠে জানালেন,
‘ দেখ, কোনো অশান্তি করিস না। এমনিতেই তোর বাবার হার্ট ভালো না। তার মধ্যে এত অশান্তি সে নিতে পারবে না। ধ্রুব এসেছে, চুপচাপ তার সঙ্গে যা। একটু ঘুরে আয়। ভালো লাগবে। ‘
আয়েশী মায়ের দিকে চায়। এ কোন জন্মদাত্রীকে দেখছে সে? যে আয়েশীর মনের মধ্যে বয়ে চলা সর্বগ্রাসী তুফান সম্পর্কে অবগত হয়েও, কেমন সুন্দর করে তাকে অন্য পুরুষের সঙ্গে ঘুরে আসতে বলছে। আয়েশী বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলে যায়। মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রয়। মনোয়ারা আয়েশীর হাত ধরে তাকে বাথরুমে প্রবেশ করান। ব্লাউজ ও পেটিকোট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন,
‘ যা, পড়ে আয়। ‘

আয়েশী যেন রোবট হয়ে যায়। গা ছেড়ে বাথরুমের খিল আটকায়। বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রয় ঠায়। কিছুক্ষণ নিজের দিকে তাকায়। ভাবে, মৃদুল চলে যাবার পর থেকে সব কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। উলোট-পালোট হয়ে যাচ্ছে। আয়েশীর চারপাশ আর আগের মত সুন্দর না। বদলে গেছে, দূষিত হয়ে গেছে। কেউ আয়েশীকে বুঝে না। কেউ আর আগের মত মুগ্ধ চোখে চেয়ে বলে না,
‘ তুই আমার জীবনের আয়েশ, আয়েশী। তুই আছিস বলেই আমার জীবনে এত সুখ। ‘
সবার চোখে একটাই বাসনা, ‘ আয়েশী যেন সুখে থাকে। ‘
অথচ, মৃদুল ছাড়া আয়েশীর সুখ সে কবেই মরে গেছে। তা কেউ বুঝতে চায়না। কেউ না।
আয়েশীর দিল ছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয়।
কোথাও কেউ ভালো নেই। সবার মনে দুঃখ। কেউ বলে তো কেউ বলে না। পৃথিবী যেমন সত্য তেমন সত্য এই পৃথিবীর সবার মনের মধ্যে পুষে রাখা দুঃখসমুদ্র!
_____________________________
আয়েশীর মা খুব সুন্দর করে আয়েশীকে নীল জামদানি শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছেন। গলায় সরু সোনার চেইন, কানে সাধারণ ঝুমকো। আয়েশীকে দেখতে আজ খুব সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে স্বর্গ থেকে কোনো পরী এ ধরায় নেমে এসেছে। মনোয়ারা আয়েশীর চোখে কাজল লাগানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না। আয়েশীর চোখের নিচে জমে থাকা জলে, কাজলের রেখা বারবার লেপ্টে যাচ্ছে। মনোয়ারা একসময় বিরক্ত হলেন। ধমকে বললেন,
‘ ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছিস কেন এত? তোকে কি আমরা মেরে ফেলছি? কান্না থামা। ‘

আয়েশী ঠোঁট চেপে ধরে জল আটকাল। মনোয়ারা এবার খুব সুন্দর করে আয়েশীর চোখে কাজল দিয়ে দিলেন। আয়েশীকে আয়নার দিকে ঘুরিয়ে বললেন,
‘ দেখ, কি সুন্দর দেখাচ্ছে আমার মেয়েকে। ‘
আয়েশী তাকায় না আয়নায়। মাথা নত করে ঠোঁট কামড়ে ধরে। মনোয়ার বুঝেন, আয়েশীর মনের দুঃখ। তাই তিনি আর বেশি ঘাটান না মেয়েকে। মেয়ের শাড়ির আঁচল ঠিক করে দিয়ে বলেন,
‘ যা, ধ্রুব বসে আছে। ‘
আয়েশী গা ছেড়ে দিয়ে হেঁটে যায় বসার ঘরের দিকে। ধ্রুব সোফায় বাবু হয়ে বসে আছে। ধ্রুবর সামনে আয়েশীর বাবা
বসে হবু মেয়ের জামাইয়ের সাথে গল্প করছেন। আয়েশী বাবার পাশে এসে দাঁড়ায়। ধ্রুব আয়েশীর পানে চোখ তুলে তাকায়। সঙ্গেসঙ্গে তার চোখ আটকে যায়, ভষ্ম হয়ে যায়, ঝলসে যায়। আয়েশীকে আজ তার ভাবনার চেয়েও বেশী সুন্দর দেখাচ্ছে। ধ্রুবর বুক ‘ধুকপুক-ধুকপুক’ করে। ধ্রুব বা হাতে নিজের বুকে চাপ দিয়ে বিড়বিড় করে, ‘ ওল ইজ ওয়েল, ওল ইজ ওয়েল ‘

কিছুক্ষণ পর, নিজেকে সামলে নিয়ে ধ্রুব সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আয়েশীর পাশে দাঁড়িয়ে আয়েশীর হাত আকড়ে ধরে। আয়েশীর রাগ হয়। হাত ছাড়াতে চায়, পারে না। ধ্রুব কামরুল হাসানের থেকে বিদায় নেয়। সদর দরজার দিকে হেঁটে যেতে যেতে আয়েশীর কানের কাছে ফিসফিসায়,
‘ তোমায় আজ ভীষন মনমোহিনী লাগছে, রক্তজবা। তোমার থেকে আজ আমার চোখ সরানো যাচ্ছে না। এত সুন্দর কেন তুমি? ‘
আয়েশী দাত খিচে উঠে। এত বেহায়া ছেলে আয়েশী এ জন্মে দেখেনি। রাগ হচ্ছে ভীষন। মন চাচ্ছে, ধ্রুবকে এখনি এক কোপে খু’ন করে ফেলতে। ইশ, যদি করা যেত! তবে আয়েশী আজ ধ্রুবর এই বেহায়া ভালোবাসা থেকে মুক্ত হয়ে যেত।
_________________________________
ধ্রুব-আয়েশী শহরের একটি নামিদামি ক্যাফেতে আসে। ধ্রুবকে দেখে ক্যাফের মালিক ব্যস্ত পায়ে ধ্রুবর পাশে এসে দাঁড়ায়। ধ্রুবর পা ধরে সালাম করলে ধ্রুব বলে,
‘ কেমন আছ, শাহাদাত? ‘
শাহাদাত উঠে দাঁড়ায়। ধ্রুবর থেকে মাথা নিচু করে নম্র গলায় জানায়,
‘ আপনার দোয়ায় ভালো আছি, স্যার। ‘
ধ্রুব হাসে। শাহাদাতের কাধে হাত রাখতেই ভয়ে শাহাদাতের চেহারা নীল বর্ণ ধারণ করে। শাহাদাত কাধ সংকুচিত করে ফেলে। ধ্রুব শাহাদাতের কাধে চাপড় দিয়ে হেসে বলে,
‘ আরো দোয়া চাইলে, আজ আমার ও আমার মিসেসের ভালো করে খাতিরদারি করো। বুঝলে? ‘
শাহাদাত তাৎক্ষণিক মাথা নেড়ে বলে,
‘ অবশ্যই, স্যার। চলুন আমার সাথে। ‘
ধ্রুব আয়েশীকে নিয়ে আগে আগে হাঁটে। পেছন পেছনে ক্যাফের মালিক আসে। মালিকের মুখ শুকিয়ে আধখান হয়ে গেছে। আজ যেন কোনো অঘটন না ঘটে। নাহলে ধ্রুবর হাত থেকে আজ কারও নিস্তার নেই। কারো না!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here