মেঘদিঘির পাড়ে পর্ব -০৮

মেঘদিঘির পাড়ে – ৮
মালিহা খান

১৬.
মিনিট না গড়াতেই তাজা রক্তে ভিজে গেলো কাঁটাবিদ্ধ তালু। রক্তের ফোঁটা টপটপ করে চুঁইয়ে পড়লো মেঝেতে। ইউসুফ ঘাবড়ে গেলো। চোখের শাসনে কাজ হলোনা। উল্টো সরাসরি সেই শাসনভরা রক্তিম চোখে তাকিয়েই হাতের মুঠোয় আরো চাপ দিলো বিভা। তার চোখদুটো শুকনো, মনটা ভীষণ ভেজা। সূঁচালো মাথার গোলাপকাঁটাগুলো ঘচঘচ করে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত বিঁধে গেলো। বিভা চোখ নামিয়ে নিলো। ঘাড় সোজা করে তার হাতের উপর ধরে রাখা ইউসুফের হাতের দিকে তাকাল। ইউসুফ বুঝলো। ধীরগতিতে নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে নিচুস্বরে বলল,

-“আচ্ছা আমি ধরছিনা। এবার তো ছাড়বে?’

বিভা শুনলোনা, আরো কিছুক্ষণ ঠেসে ধরে রাখলো কাটাভর্তি ডাঁট। ইউসুফ নিরবে চেয়ে রইলো। দিরুক্তি করলোনা। মেয়েটা প্রচন্ড জেদি। কিছু বললে শুনবে তো না-ই, বরং দ্বিগুন জেদ করবে।
শেষমেষ গা কাঁপানো ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে ছেড়েই দিলো বিভা। আলগা করে দিলো শক্ত মুঠো। সাথেসাথেই তীব্র ব্যাথায় টনটন করে জ্বলে উঠলো জায়গাটা। ইউসুফ এবার হাত বাড়ালো। আলতো করে ধরলো। হাতের উঠালে গাছটাও উঠে আসবে এমনভাবে গেঁথেছে। কাঁটাগুলো থেকে হাত ছাড়ানোর জন্য ডাঁটটা সামান্য টান দিতেই সিক্ত অস্ফুট আতর্নাদ করলো বিভা। চোখ বুজে ফেললো। চোখে নিরবে জল এলো।
ইউসুফ কাঁটা থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলেও নিজে ছাড়লোনা। ধরে রাখলো। অত:পর জোরবিহীন অত্যন্ত নির্ভার গলায় বললো,”এসো, রক্ত পড়ছে। আর জেদ করোনা বিভা। কথা শোনো।”

বিভার দু’চোখ দিয়ে অঝরবেগে জল ঝরলো হঠাৎই। ক্ষতবিক্ষত হাতের দৃশ্যমান সহ্যহীন যন্ত্রনায় নয়, বরং অক্ষত হৃদয়ের অদৃশ্য ছটফটে যন্ত্রনায় বারণ- নিষেধ ছিন্নভিন্ন করে কেঁদে উঠলো সে। বিধস্ত কাঙালিনীর মতোন আছরে পড়লো প্রিয় বুকে। রক্তাত্ব হাতটায় গাল ছুঁয়ে নি:স্বর মতোন আওড়ালো সেই এক আক্ষেপ,

-“আপনি আমাকে ভালোবাসেন না কেনো?”

ইউসুফ উওর দিলোনা। দিতে পারলোনা। বিভার কপালটা তার গলায় ঠেকানো। শব্দহীন কান্না। এই কান্না শোনা যায় না, অনুভব করতে হয় মাত্র। এই কান্নায় জল গড়ায়, বুক হাল্কা হয়না। অনুভুতিরা ঝাপসা হয়ে যায়, অবহেলার করাঘাতে ঝাঁঝড়া হয়ে যায়।
বিভা তার বুকের শার্টের মুচরে ধরেছে। মাটি দিয়ে ধবধবে শার্ট মেখে গিয়েছে, ভাঁজ পরে টানটান আয়রন নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
অল্পকাল মৌন থেকে বিভাকে সরানোর চেষ্টা করলো ইউসুফ। বাহুতে হাত রেখে বললো,

-“এটা ছাদ, ছাড়ো।”

বিভা গলা থেকে মুখ তুললো। ইউসুফের গালভর্তি তার হাতের রক্ত মেখে আছে। সে গাল থেকে হাত নামিয়ে নিলো। চোখে চোখ রাখলো। টলমলে ঘোলাটে চোখ। নির্জীব চাহনী। ক্লান্ত গলা,

-“আপনি আমাকে কখনোই ভালোবাসবেন না? কখনোই না? কোনোদিন…”

বিভা বলতে পারলোনা পুরোটা। অসমাপ্ত বাক্যেই কন্ঠ থেমে গেলো। চোখ বুজে ফেলতেই তড়িঘড়ি করে মাথার তালুতে হাত রাখলো ইউসুফ। রোদে গরম হয়ে পুড়ে যাচ্ছে যেনো।

১৭.
ঘুমন্ত বিভার গায়ের কাঁথাটা ঠি ক করে দিয়ে যেভাবে ঢুকেছিলো ঠি ক সেরকম নিশব্দেই বেরিয়ে এলো ইভা। মাত্র গোসল করে আসা লাল গামছায় মোড়ানো চুলগুলো খুলতে খুলতে গিয়ে দাড়ালো ফাঁকা অলিন্দের রেলিং ঘেঁষে। আকাশটায় গুচ্ছ গুচ্ছ উড়োমেঘ। নীল বাগানে উড়ন্ত সাদা জবার ঢল। এই চলন্ত আকাশে মেঘদিঘি কি যে সুন্দর দেখায়! ঘন্টার পর ঘন্টা দিঘির জলে চেয়ে থাকলেও আঁশ মেটেনা। ইভার মন খারাপ হয়ে গেলো। আজ অনেকদিন! অনেকদিন যায়না দিঘির পাড়ে। সপ্তাহ দু’য়েক গড়িয়ে গেছে খুব করে। এমন না তাকে কেও মানা করেছে। সে নিজেই যায়না। ভয় করে। যদি আবার কোনো বিপদ হয়?
ভেজা চুলগুলো একপাশে এনে গামছা দিয়ে ঝাঁড়া দিলো ইভা। বাহাদুর উঠোনে খেলছে। পায়ে বল নিয়ে একা একাই দৌড়োদৌড়ি করছে।
বিভা ঘুমাচ্ছে অনেকক্ষণ। সেই যে ইউসুফ ভাই অজ্ঞান অবস্থায় নিয়ে এলো। হাতে মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে কি একটা ওষুধ খাইয়ে দিয়ে গেলো। আর যাবার সময় বলে গেলো,”ও উঠলে বলবি, তুই বেঁধে দিয়েছিস। ঠি কাছে?”
ইভা হাসল। ইউসুফ ভাই প্রায়ই এমন করে। বিভা কোনোদিন রাতে না খেয়ে ঘুমিয়েছে জানলে, তাকে দিয়ে রান্নাঘর থেকে খাবার আনাবে। ঘুমের মধ্যই উঠিয়ে মুখে তুলে খাইয়ে দিবে। তারপর বলবে,”যদি জেগে বুঝে যায় পেট ভরা বা কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবি,’তুই খাইয়ে দিয়েছিস’।”
ইভা কথা রাখে।
তন্দ্রার ডাকে হুঁশ ফিরলো ইভার। পেছন থেকে হম্বিতম্বি গলায় ডাকছে সে,

-“এত বেলায় গোসল করেছিস! চুল মোছ ভালো করে। ঠান্ডা লাগবে! একদম ভাইয়ের মতো হয়েছে! পৃথিবী উল্টে গেলেও এদেরকে দিয়ে চুল মোছাতে পারলাম না আমি।”

ইভা হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই পেছন ফিরলো। তন্দ্রা কখন এসেছে বুঝেনি। বলল,

-“পৃথিবী উল্টাতে হবেনা, আমি মুচ্ছি ভাবি। তুমি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছো কেনো? ভাইজানকে বলে দিবো কিন্তু।”

-“বলে দিয়েন ভাইজানেন বিনা বেতনের প্রহরী।”

ইভা হাত থেকে গামছা নামিয়ে রেলিংয়ে রাখলো। এগোতে নিয়ে বললো,

-“চলো ঘরে দিয়ে আসি।”

-“না মার কাছে যাচ্ছি। একা ভাল্লাগছেনা।”

-“আচ্ছা আম্মার ঘরেই দিয়ে আসি। পড়ে যাবা।”

-“আরে না পাগল, পড়বো না। তুই চুল মোছ। আকাশ দেখছিলি দেখ। আমি পারবো। একা একা একটু হাঁটাচলাও তো দরকার আছে। তোর ভাই আমাকে পঙ্গু বানিয়ে ফেলছে।”

তন্দ্রা গুটিগুটি গতিতে পা বাড়ালো। মায়ের ঘরের কাছাকাছি যাওয়া পর্যন্ত চেয়ে রইলো ইভা। সে ঢুকে গেলে গামছা নিয়ে আবার মনোযোগ দিলো চুল ঝাড়তে। মেঘের রং পাল্টেছে। পশ্চিমাকাশের সাদাজবার দল রক্তজবায় ছেঁয়ে যাচ্ছে। সুর্যের রং ভীষণ কমলাটে। এক্ষুণি অস্ত যাবে। পৃথিবীতে সন্ধ্যাটা নামে খুব দ্রুত। রোদ নেমে যাচ্ছে। শেষ বিকেলের বেরঙে আলোয় একবার মেঘদিঘির দিকে তাকালো ইভা। এখান থেকে অবশ্য অমন সুন্দর রুপ দেখা যায়না। তবু।
ইভা চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। আবছা আলোতে কে যেনো দাড়িয়ে আছে মনে হলো। নাকি না? সেদিকে দেখতে গিয়ে হাতের গামছাটা পড়ে গেলো হাত ফসকে। বাহাদুর নিচ থেকে চেঁচিয়ে উঠলো,

-“বুবু তোমার গামছা পড়ে গেছে। নিয়ে আসব?”

ইভা আচমকাই চমকে তাকালো বাহাদুরের দিকে। কেনো চমকালো জানেনা। খাপছাড়াভাবে বললো,”আ…হ্যাঁ… হ্যাঁ, নিয়ে আয়। নিয়ে আয়।”

দিঘির পাড়ের নিস্তব্ধতা চিড়ে ধীরকন্ঠ শোনা গেলো,”অবশেষে দেখা মিললো আপনার, ‘দিঘিকন্যা’।”

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here