মেঘবদল পর্ব -২৩+২৪

#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ২৩

হাতের দিকে তাক করে ঈশা তাকাল। মানুষটার চেহারা দেখেই সে চমকে উঠল। ইভানের অগ্নি দৃষ্টি সাকিবের হাতের দিকে। আর সাকিবের চেহারায় আকাশসম বিস্ময়। চোখ ফিরিয়ে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান তার দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত আর স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–তোমাকে ঐদিকে ডাকছে। যাও।

সাকিব সৌজন্য হাসল। ইশার দিকে তাকিয়ে বলল
–তোমার গিফট টা।

ইভান সাথে সাথেই সেটা আরেক হাতে নিয়ে নিলো। সাকিব আর কথা না বলে চলে গেলো। ঈশা একবার গিফট টার দিকে তাকিয়ে আবার ইভানের মুখের দিকে তাকাল। সে সাকিবের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সাকিব সম্পূর্ণ অদৃশ্য হতেই ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে খুব ঠাণ্ডা সরে বলল
–অনেক হয়েছে তোর শপিং। বাসায় ফেরার পালা এবার।

ঈশা ভয়ে ভয়ে বলল
–চাচি…।

কথা শেষ না হতেই ইভান খুব কঠিন ভাবে বলল
–রাইট নাও। আমি অপেক্ষা করছি বাইরে। ১০ মিনিট যদি ১১ মিনিট হয়েছে তাহলে সেটার শাস্তি আলাদা।

ঈশা আর কোন কথা বলল না। ইভান চলে গেলো। ঈশা কি করবে ভেবেই পাচ্ছে না। এখন সবাইকে যদি বলে সে বাসায় যেতে চায় তাহলে কি তাকে যেতে দেবে? যদি না বলে। আর এইদিকে সে যদি সত্যি সত্যি ১০ মিনিটের বেশী সময় নেয় তাহলে ইভান তাকে মেরেই ফেলবে। ভাবতে ভাবতেই ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল। ইতিমধ্যে ৩ মিনিট পার হয়ে গেছে। আর মাত্র ৭ মিনিট। এর মধ্যে খুজে বের করে অনুমতি নেয়া সম্ভব না। তাই ঈশা আর অপেক্ষা করলো না। বাইরের দিকে চলে গেলো। ইভান বাইকে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার হাতের ফোনে স্থির। ঈশাকে আসতে দেখে অবাক হল। ১০ মিনিট সময় দিয়েছিল আর সে ৫ মিনিটে চলে এলো। কিভাবে সম্ভব? কারন ইভান জানত ঈশা ১০ মিনিটে আসতে পারবে না। তাই কি শাস্তি দিবে সেটাও ভেবে রেখেছিল। ঈশা সামনে দাড়াতেই ইভান বলল
–এখনও ৫ মিনিট সময় আছে। সেই সময় টুকু এখানেই দাড়িয়ে থাক।

ঈশা দাঁত বের করে হেসে বলল
–এই ৫ মিনিটে তোমার কাজ আছে।

ইভানের ভ্রু কুচকে এলো। সরু চোখে তাকিয়ে বলল
–কি কাজ?

ঈশা আবারো হেসে বলল
–তুমি এখন ফোন করে সবাইকে বলবে যে আমাদের আরও কাজ আছে তাই এখান থেকে যেতে হবে।

ইভান শান্ত চোখে তাকাল। বলল
–তার মানে তুই বলে আসিস নি।

ঈশা মাথা নাড়াল। ইভান বিরক্ত হলেও তার কাছে উপায় নাই। তাই ফোন করে বলল যে তাদের কাজ আছে যেতে হবে। কাজের কথা শুনে কেউ আর কোন কথা বলল না। খুব সহজেই মেনে নিলো। ইভান ঈশাকে নিয়ে বাসায় চলে এলো। বাসার সামনে নামিয়ে দিলো। ঈশা নেমে দাড়িয়ে আছে। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে খুব সহজ ভাবে বলল
–আজ যা হয়েছে দ্বিতীয়বার যেন এমন কিছু না হয়। খেয়াল রাখিস।

ইভানের কথা শেষ হতেই ঈশা বলল
–কি এমন হয়েছে? আমার জন্য ভাবি গিফট কিনতে বলেছিল সাকিব ভাইয়া কে। তাই সে কিনে আমাকে দিয়েছিল। এটা খারাপ কি?

ইভান তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। মৃদু হেসে বলল
–খুব সখ গিফট পাওয়ার তাই না? তোমার ওই সাকিব ভাইয়া কে এরপর যদি কোনদিন তোমার আশেপাশে দেখি তাহলে তোমার পরবর্তী স্পেশাল গিফটটা আমিই দেব। মনে রেখ কেমন?

ঈশা গোল গোল চোখে তাকাল। বলল
–মানে কি?

ইভান অমায়িক হাসল। বলল
–মানেটা বুঝতে পারবে যদি আবার কখন এরকম পরিস্থিতি আসে। আর না আসলে ভাগ্য ভালো। তখন বোঝার প্রয়োজন নেই।

ইভানের কথা ঈশার ভালো লাগলো না। সে বিরক্ত হয়ে চলে যেতে নিলেই ইভান হাত টেনে ধরল। এক টানে নিজের কাছে এনে বলল
–যেটা আমার সেটার উপরে শুধু আমার অধিকার। আমি এসব একদম মেনে নেব না। আর যদি কখনও এরকম কোন ভাইয়াকে তোর আশেপাশে দেখেছি তাহলে তোকে নদীতে ডুবিয়ে মারব।

ঈশা ভয় পেয়ে গেলো কিছুটা। ইভান বুঝতে পারল। মনে মনে হাসল। কিন্তু মুখে গাম্ভীর্য ভাবটা রেখে দিলো। ঈশা ইভানের কাছ থেকে সরে দাঁড়ালো। ইভান ঈশাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–এখন সোজা বাসায় গিয়ে রেস্ট নিবি। আর আমার কথাগুল মাথায় রাখিস। মাথা থেকে বের হয়ে গেলে কিন্তু বিপদ আসন্ন।

ঈশা মাথা নাড়ল। যার অর্থ সে সব ভালভাবে বুঝতে পেরেছে। ইভান চলে গেলো। ঈশা কিছুক্ষন দাড়িয়ে থেকে ভাবল। তারপর বাসায় চলে এলো।

————-
মেঘবদল আজ সেজেছে নতুন রঙ্গে। লাল নীল আলোয় ঝলমল করছে চারিদিকে। সবার হইহুল্লড়ে মুখরিত হয়ে উঠেছে। নাহিদের হলুদ সন্ধ্যা। সকাল থেকে সব কাজ শেষ করে মেয়েরা এখন সাজগোজে ব্যস্ত। ফারিয়া এক ঘণ্টা সময় নিয়ে সাজছে। জারিফ বাইরে বসে আছে। সে খুব বিরক্ত। এতক্ষন ধরে ঘরে ঢুকে কি করছে সেটাই তার মাথায় আসছে না। আর এতো সাজার দরকারটাই কি সেটাও বুঝতে পারছে না। শুধু যে ফারিয়ার সাজ নিয়ে তার বিরক্তি সেটাও না। বিরক্তির আরেকটা কারন হল কয়েকদিন থেকেই জারিফ খেয়াল করছে ফারিয়া তাকে রীতিমতো এভয়েড করছে। সে প্রায় সময় অফিস থেকে এসে দেখে ফারিয়া ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু আসলেও সে ঘুমিয়ে থাকে না। আর জারিফ বাসায় থাকলে পুরো সময়টা সে রান্না ঘরেই কাটিয়ে দেয়। রাতে শোয়ার সময় খুব প্রয়োজনীয় কয়েকটা কথা বলেই ঘুমিয়ে পড়ে। জারিফ কে কথা বলার তেমন সুজগ দেয় না। জারিফ খেয়াল করেছে ফারিয়া সেদিনের সেই অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটার পর থেকেই কেমন বদলে যায়। তার মাঝে কেমন একটা বউ বউ ভাব চলে আসে। যা আগে কখনও দেখা যায় নি। মা আর শাশুড়িকে তেমন একটা কাজ করতে দেয় না। উলটা তাদের কাজ নিজেই করে দেয়। এটা নিয়ে অবশ্য বাড়ির সবাই খুশি হলেও জারিফ বেশ অবাক হয়। তার কাছে কেমন অদ্ভুত লাগছে ফারিয়ার এসব আচরন। চোখের সামনে কাল অবয়ব বুঝতে পেরেই জারিফ চোখ খুলে ফেলে। সামনে তাকাতেই তার মুখ হা হয়ে যায়। হলুদ শাড়িতে ফারিয়া কে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। খোপায় তাজা বেলি ফুলের মালা। হাতে সবুজ চুরি। জারিফের দৃষ্টিতে আকাশসম বিস্ময়। সে ভাবতেই পারছে না সামনে দাড়িয়ে থাকা এতো সুন্দরি মেয়েটা ফারিয়া। জারিফের এমন অদ্ভুত দৃষ্টি দেখে ফারিয়া লজ্জা পেল। চোখ নামিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে বলল
–তোমার পাঞ্জাবি বের করে রেখেছি। পরে নাও।

জারিফ আরেকদফা অবাক হল। ফারিয়ার মুখে এমন কথা হজম করতে পারল না। টিপিক্যাল বউদের মতো আচরনের কারণ জারিফের মাথায় আসছে না। সে উঠে দাঁড়ালো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত আরও একবার ভালো করে দেখে নিলো। এই মুহূর্তে তার মনে ভীষণ আফসোস হচ্ছে এতদিন তার বউয়ের এই রুপ সে কেন দেখেনি? দেখলে হয়তো আরও আগেই প্রেমে পড়ে যেত। ফারিয়া আবারো বলল
–রেডি হয়ে নাও। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

জারিফ তার কথা যেন শুনলই না। নেশাভরা কণ্ঠে বলল
–তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। অদ্ভুত সুন্দর।

ফারিয়া হতভম্ভ চোখে তাকাল। আগে কখনও জারিফের মুখে এমন কথা সে শোনেনি। প্রথম এমন কথা শুনে ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। তাই চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল
–তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।

জারিফ এবার শুনতে পেল। মাথা নাড়িয়ে ঘরে গেলো। ফারিয়া হতবিহবল দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। জারিফের কথাটা মাথায় আসতেই হাসল সে।

————-
হলুদের স্টেজের সব কিছু তদারকি করছে ইভান। কিছুক্ষনের মধ্যেই নাহিদকে স্টেজে বসানো হবে। ঈশা তার কাজ শেষ করে নাহিদ কে আনতে যাচ্ছিলো। ঠিক সেই মুহূর্তে পাশের আয়নায় খেয়াল করলো তার খোপার ফুল খুলে গেছে। সেই আয়নায় তাকিয়ে নিজে নিজে সেটা ঠিক করার চেষ্টা করছে। কিছুতেই পারছে না। বেশ বিরক্ত হল সে। আশে পাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। এমন কেউ নেই যাকে একটু ঠিক করে দিতে বলবে। একটা শ্বাস ছেড়ে নিজেই চেষ্টা করতে লাগলো ঠিক করতে। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হচ্ছে সে।
–কোন হেল্প লাগবে?

আওয়াজটা বেশ পরিচিত। ঈশার কানে লাগতেই ভ্রু কুচকে এলো। পিছন ঘুরে তাকাল। সাকিব কে দেখে হকচকিয়ে গেলো সে। নাহিদ কে হলুদ লাগানর জন্য মৃন্ময়ীর বাড়ির লকজন এসেছে। কিন্তু সাকিবও যে এসেছে সেটা ঈশা জানত না। আর সেদিনের ইভানের হুমকির পর ঈশা আজ ভালভাবে দেখে নিয়েছে সাকিব এসেছে কিনা। কিন্তু দেখতে পায়নি। তাই সে মোটামুটি নিশ্চিন্ত ছিল যে আজ কোন ঝামেলা হবে না। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে কোন অঘটন ঘটতে যাচ্ছে। মনটা কেমন খচখচ করছে। ঈশাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাকিব আবার বলল
–তোমার হেল্প লাগলে আমাকে বলতে পারো। কোন সমস্যা নেই।

ঈশা মনে মনে ভাবল এই ছেলের কাছ থেকে হেল্প নেয়া তো দুরের কথা এভাবে কথা বলা দেখলেই আজ তাকে সত্যি সত্যি নদীতে ফেলে দেবে ইভান। আশে পাশে দ্রুত চোখ চালিয়ে নিলো। ইভান কে দেখতে না পেয়ে সস্তির নিশ্বাস ফেললেও তার ভয়টা কেটে গেলো না। শুকনো ঢোক গিলে বলল
–ধন্যবাদ। আমার কোন হেল্প লাগবে না।

সাকিব হাত বাড়াল। সেদিকে তাকিয়েই বলল
–ফুলটা ঠিক করে দেই?

ঈশা এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না। সে একটু ঝাঝাল গলাতেই বলল
–আমি কি আপনার কাছে কোন হেল্প চেয়েছি? চাইনি তো। তাহলে কেন হেল্প করতে এসেছেন আগ বাড়িয়ে। এসব আমার একদম পছন্দ নয়। একটু মনে রাখবেন প্লিজ।

বলেই সেখান থেকে চলে গেলো। কিন্তু সামনে এগুতেই দেখল ইভান টেবিলে বসে আপেল নিয়ে সেটাকে একবার উপরে ফিকে দিচ্ছে আবার ক্যাচ ধরছে। ঈশার ভয়ে জান বের হয়ে জাওয়ার মতো অবস্থা। ইভান আপেলটাতে কামড় দিয়ে এগিয়ে আসল ঈশার কাছে। ঈশার সামনে দাড়িয়ে আপেলটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে হাত ভাজ করে দাঁড়ালো। বলল
–খা।

ঈশা কেঁপে উঠল। মৃদু সরে বলল
–আমি খাব না।

ইভান শান্ত চোখে ঈশার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। তারপর হাত শক্ত করে চেপে ধরল। টেনে নিয়ে গেলো।
#মেঘবদল
লেখক – এ রহমান
পর্ব ২৪

ছাদের এক কোণায় ঈশা দাড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। অস্থির ভাবে দৃষ্টি এদিক সেদিক ফেলছে। মনে মনে ভয়ে সিটিয়ে যাচ্ছে। মস্তিষ্কে একটা বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে আশেপাশে কোথাও নদী নেই তাই বুঝি ছাদে এনেছে। ছাদ থেকে ফেলে দিতে। শুকনো ঢোক গিলে চোখ তুলে ইভান এর দিকে তাকাল। ইভান খুব শান্ত ভাবে রেলিংয়ে ভর দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল তার মুখের দিকে। বোঝার চেষ্টা করলো রাগের মাত্রা কতোটুকু। কিন্তু বুঝতে পারলো না। মনেও হচ্ছে না যে ইভান রাগ করে আছে। তাহলে কেনো এখানে নিয়ে এলো। ঈশার এখন অসহ্য লাগছে। তাই সাহস সঞ্চয় করে বলল
— নিচে সবাই আছে। আর আমরা এখানে।

ইভান উত্তর দিলো না। আগের মতই স্থির দাড়িয়ে থাকলো। ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল। এসব কারণেই ইভান কে তার বিরক্ত লাগে। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারেনা। ঈশা আবারও বলল
— অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে।

ইভান ঘুরে তাকাল। গম্ভীর সরে বলল
— তাতে কি? বিয়ে কি তোর নাকি?

ঈশা কোন কথা বলল না। আবার মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকাল। বিরক্ত লাগছে খুব তার। নিচে পুরো মনটাই পড়ে আছে তার। কিন্তু ইভান তাকে আটকে রেখেছে এখানে। চোখ বন্ধ করে ফেললো। খানিকবাদে হালকা স্পর্শে চোখ খুলে ফেললো সে। চোখ খুলতেই ঈশা কেপে উঠলো। ইভান কাছাকাছি এসেছে তার। একটু পিছিয়ে গেলো। ইভান এগিয়ে গেলো তার দিকে। দৃষ্টি ঈশার উপরে স্থির। তার অসস্তি লাগছে। বুঝতে পারছে না ইভান কি করতে চাচ্ছে। ইভান আরো কাছাকছি আসতেই ঈশা পিছিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু ইভান কোমর ধরে ফেললো তার। ঈশা কেপে উঠলো। ইভান তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল
— খুব সুন্দর লাগছে জান।

ঈশা চোখ খুলে ফেললো। ইভান এর চোখের দিকে তাকাল। কিন্তু মুহূর্তেই ভেতরে এলোমেলো অনুভূতি শুরু হয়ে গেলো। ইভান মৃদু হেসে বলল
— ভালবাসিস আমাকে?

ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেললো। ইভান আবারও বলল
— যখন থেকে ভালোবাসা বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই এই মেয়েটা আমার সবটা দখল করে নিয়েছে। এই মেয়েটাকে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না।

পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল ঈশা। ইভান এর কথা বুঝতে পারলেও মাথায় ঢুকছে না এই মুহূর্তে। ইভান আলতো করে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতেই ঈশা দূরে সরে গেলো। তার চোখ ছলছল করছে। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল চোখের পানি। ঈশা কাপা কাপা কণ্ঠে বলল
— এতদিন আমি প্রতি মুহূর্তে কষ্ট পেয়েছি। দম বন্ধ হয়ে আসতো আমার। মাঝে মাঝে মনে হতো তোমাকে ভালোবাসাটাই আমার জীবনের শাস্তি হয়ে গেছে। তুমি আমাকে এতদিন ইচ্ছা করে কষ্ট দিয়েছ। তোমার কাছে ভালোবাসার কথা শোনার জন্য আমি দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছি। কিন্তু তুমি আমাকে এড়িয়ে গেছো। তুমি জানতে আমি তোমাকে ভালোবাসি তবুও কিছুই বল নি।

ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
— তোর বাবা আমাদের এই সমপর্কটা ভালো ভাবে নেয়নি। মা যখন আমাদের বিয়ের কথা বলেছিল তখন সবাই সম্মতি জানালেও তোর বাবা কোন কথা বলেনি। আর সেদিন আমি রেস্টুরেন্টে তোকে ডেকেছিলাম সেটা বলতেই। কিন্তু তার আগেই তুই বলে দিয়েছিলি যে বিয়ে করতে পারবি না। সেদিন কারণটা না জানলেও পরে জানতে পারি যে তনুর কারণেই তুই বিয়েটা করতে চাস নি। আমি সে বিষয়টাকে গুরুত্ব দেইনি ঠিকই কিন্তু তোর বাবার কারণেই দূরে থাকার চেষ্টা করেছি।

ঈশা কৌতূহলী চোখে প্রশ্ন করলো
— কেনো বাবার তোমার উপরে এতো রাগ?

ইভান অপরাধীর মতো বলল
— রাগ না। তার আমার উপরে অভিমান ছিল। বাবার সাথে আমার মতের বিরোধ নিয়েই তোর বাবা আমার উপরে অসন্তুষ্ট। আমি নিজের মত ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলাম সেটাই কারো ভালো লাগেনি। কারণ কেউ চায় না আমি দেশের বাইরে যাই। আর তোর বাবার বড় চিন্তার কারণ ছিল সে মেয়েকে এতো দূরে যেতে দেবে না। তাই বিয়েতে আপত্তি ছিল তার। কিন্তু যখন..।

ইভান থেমে গেলো। ঈশা বেশ মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছিল। থেমে যাওয়ায় ভ্রু কুঁচকে এলো তার। বলল
— যখন কি?

ইভান অমায়িক হাসলো। ঈশার চোখে চোখ রেখে বলল
— তোর বাবাকে যখন কথা দিয়েছি যে আমি সব দায়িত্ব নেবো। আর কোথাও যাবো না। তখন সব দায়িত্বের সাথে নিজের মেয়ের দায়িত্বটাও আমার হাতে তুলে দিয়েছে।

ঈশা গোল গোল চোখে তাকাল। এতো কিছু হয়ে গেলো আর সে কিছুই জানতে পারলো না। কেউ তাকে বলে নি। ইভান উল্টা দিকে ঘুরে দাড়ালো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল
— এতদিন আমি সার্থপরের মত শুধু নিজের কথা ভেবেছি। কখনো ভাবিনি বাবা অসুস্থ। এক মাত্র ছেলে হিসেবে বাবা মায়ের দেখাশোনা আমাকে করতে হবে। বাবা আমার জন্য জীবনে অনেক কিছু ত্যাগ করেছেন। তোর বাবা আমাকে সবটা না বললে হয়তো আমি কোনদিন উপলব্ধি করতে পারতাম না। নিজের কথা ভেবেই এগিয়ে যেতাম। তোর বাবা আমাকে খুব ভালোভাবে বুঝে দিয়েছে আমি ভুল ছিলাম। তবে জানিস আমি ভেবে নিয়েছি বাবা এতদিন অনেক কষ্ট করেছে এখন আর বাবাকে কষ্ট করতে দেবো না। সব দায়িত্ব আমি নেবো।

ঈশা ইভান পাশে এসে দাড়ালো। ইভান পাশ ফিরে ঈশার দিকে তাকিয়ে হাসলো। হাসির কারণ বুঝতে না পেরে ঈশা সরু চোখে তাকাল। ইভান বলল
— এতো তাড়াতাড়ি ভাইয়ার বিয়েটা কেনো ঠিক করলো তুই জানিস?

ঈশা মাথা নাড়লো। সে জানে না। ইভান বলল
— তোর বাবা আর বেশিদিন তোর দায়িত্ব নিতে চায় না। তাই।

ঈশা হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাল। বলল
— মানে?

ইভান হেসে ফেললো। বলল
— তোকে খুব তাড়াতাড়ি আমার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ভাইয়ার বিয়ে শেষ হলেই আমাদের বিয়েটা হবে।

ঈশা তৎক্ষণাৎ চোখ নামিয়ে ফেললো। বিয়ের কথা শুনে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেছে। তীব্র ভালোলাগা কাজ করছে।

ইভান ঈশার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল
— ভালোবাসি পাখি। খুব বেশি ভালোবাসি। বউ হবি আমার?

ঈশা ইভান কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এতদিনের সমস্ত অভিমান কষ্ট সব কিছু নিশেষ হয়ে গেলো। সব কিছুর উর্ধ্বে আজ ভালোবাসা পূর্ণতা পেল।

————-
হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলো বেশ রাতে। অনেক মজা করেছে সবাই মিলে। এখন খুব টায়ার্ড। ফারিয়ার মাথা ধরেছে খুব। এক কাপ চা খেলে ভালো হতো। ভাবলো চেঞ্জ করে তারপর চা বানাবে। জারিফ ওয়াশ রুমে। ফারিয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খোঁপা থেকে ফুল খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু চুলে আটকে গেছে। কিছুতেই খুলতে পারছে না। টানাটানি করছে। জারিফ ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে দেখে ফারিয়া চুল ধরে টানাটানি করছে। সে এগিয়ে এসে ফারিয়ার পিছনে দাড়ালো। হাতের উপরে হাত রাখতেই ফারিয়া চমকে তাকাল আয়নায়। জারিফ ফুলগুলো খুলছে সেদিকে তাকিয়ে। ফারিয়া হাত নামিয়ে নিলো। জারিফ ফুল গুলো খুলে গলা থেকে মালাটা খুলে দিতে গেলেই তার শীতল হাতের স্পর্শ ফারিয়ার গলায় লাগতেই কেপে উঠলো। নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো। জারিফ মালাটা খুলে পুরো খোপাটা খুলে দিলো। ফারিয়া চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। জারিফ সেদিকে খেয়াল না করেই কানের দুল খুলতে হাত বাড়াতেই ফারিয়া চোখ মেলে তাকাল। কাপা কাপা গলায় বলল
— আমার একটা কাজ আছে। আমি আসছি।

বলে যেতে নিলেই জারিফ আটকে দিলো। হাত ধরে টেনে আবার আগের জায়গাতেই দাড় করিয়ে দিয়ে কানের দুল গুলো খুলতে খুলতে বলল
— তোমার এখন কোন কাজ নেই। শুধু শুধু মিথ্যা বলছো।

ফারিয়া কোন কথা বলতে পারলো না। এলোমেলো অনুভূতির আঘাতে সে অতিষ্ট হয়ে গেছে। জারিফ কানের দুল খুলে রেখে দিল। তারপর শাড়ির আচলের পিন খুলতে গেলে ফারিয়া হাত দিয়ে আটকে দিয়ে বলল
— আমি পারবো।

জারিফ ছেড়ে দিল। আয়নায় ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল
— আমি জানি।

ফারিয়া একবার জারিফের দিকে তাকিয়ে পা বাড়াতেই জারিফ গম্ভীর গলায় বলল
— তুমি কি কোন কারণে আমাকে ইগনোর করছো?

ফারিয়া দাড়িয়ে গেলো। ঘুরে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
— না না। ইগনোর করবো কেনো?

— তাহলে কি করছো একটু বুঝিয়ে বলবে? আমি বুঝতে পারছি না। কিন্তু বুঝতে চাই।

ফারিয়া চোখ নামিয়ে নিলো। মৃদু সরে বলল
— কিছু না।

জারিফ বিছানায় বসে পড়লো। মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল
— আজকে একটা মেয়ে দেখেছি অনেক সুন্দরী। এখনো তার চেহারাটা চোখে ভাসছে।

ফারিয়া সরু চোখে তাকাল। বলল
— মানে?

জারিফ খুব সহজ ভাবে বলল
— বাংলায় বলেছি। একটা সুন্দরী মেয়ে দেখেছি। এখনো মনে হচ্ছে সেই মেয়েটাকেই দেখছি। অদ্ভুত সুন্দর। তুমি দেখলে তোমারও চোখ আটকে যেতো।

ফারিয়া হুট করেই রেগে গেলো। এগিয়ে এসে কোমরে হাত দিয়ে বলল
— কোথায় দেখেছো? আর কোন মেয়ে?

জারিফ ক্ষীণ হেসে বলল
— বসো পুরোটা বলছি। শুধু মেয়ে কেনো আর কি কি দেখেছি সবটা বলবো ইন ডিটেইল।

ফারিয়া রেগে গেলো। ঝাঁঝালো গলায় বলল
— তোমার লজ্জা করছে না আমাকে এসব বলতে?

জারিফ এমন ভাব করলো যেন ফারিয়ার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো। অবাক ভঙ্গিতে বলল
— তোমাকে বলতে কেনো লজ্জা করবে? তুমি তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তোমাকে বলবো না তো কাকে বলবো।

ফারিয়া বসে পড়লো। রাগী সরে বলল
— বেস্ট ফ্রেন্ড আগে ছিলাম এখন আমি তোমার বউ। আমাকে রেখে অন্য কাউকে দেখা টা তোমার জন্য পাপ।

জারিফ ঠোঁট চেপে হেসে বলল
— আমি কখন বললাম অন্য কাউকে দেখেছি। বলেছি মেয়ে দেখেছি। আর এমনিতেও আমার বউটাকেই জতো সুন্দর লাগছিলো। অন্য কারো দিকে দেখার সুযোগই হয়নি। পুরো প্রোগ্রামে আমার চোখ তো এক জায়গাতেই আটকে ছিলো। চোখ ফেরাতেই পারিনি।

ফারিয়া পিটপিট করে তাকালো। জারিফের কথা মাথায় ঢুকতেই সে উঠে দাড়ালো। যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই জারিফ হাত ধরে টেনে কোলে বসিয়ে নিল। ফারিয়া হতভম্ভ হয়ে গেলো। জারিফ কোমর ধরে আরো কাছে টেনে নিয়ে বলল
— এতক্ষণ দুর থেকে দেখছিলাম। এবার কাছ থেকে দেখতে চাই। মন ভরে।

ফারিয়া শুকনো ঢোক গিলে উঠে দাঁড়াতে চাইলে জারিফ আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অনেক টা কাছে এসে বলল
— আজ আফসোস হচ্ছে জানো নিজের জেদ বজায় রাখতে গিয়ে মনের অনুভূতি টা মনেই চেপে রেখেছিলাম। এতদিন জেদ না করলে তোমার কাছ থেকে দূরে থাকতে হতো না। আমি আর দূরে থাকতে চাই না ফারিয়া। আমার তোমাকে চাই। শুধু তোমাকে। ভালোবাসি ফারিয়া।

ফারিয়া পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। লজ্জা সংকোচ সব কিছু ছাপিয়ে আজ সুপ্ত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এ যেন এক সুখের মুহূর্ত। পরম পাওয়া।

————–
ওয়াশ রুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে বের হয়ে এলো মৃন্ময়ী। পরনের হলুদ শাড়িটা খুলে অন্য কাপড় পরবে সে। আলমারি থেকে কাপড় বের করতেই ফোন বেজে উঠলো। নাহিদের নাম্বার দেখে ঘাবড়ে গেল। কাল বিয়ে আর আজ কেনো নাহিদ ফোন করছে। কোন জরুরি কাজ আছে নাকি? কাপা কাপা হাতে ফোনটা তুলতেই নাহিদ বলল
— মৃন্ময়ী একবার নিচে আসবে?

মৃন্ময়ী হতবাক হয়ে গেলো। ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত ১১ টা। এতো রাতে নিচে কেনো। আর কাল তো বিয়ে। তাহলে কেনো এখন ডাকছে। মৃন্ময়ী কে চুপ করে থাকতে দেখে নাহিদ আবার বলল
— কি হলো আসবে?

মৃন্ময়ী চোখ পিটপিট করে বলল
— আসছি।

ঘর থেকে বের হয়ে দেখলো সবাই ব্যস্ত নিজের কাজে। সবার চোখ থেকে নিজেকে আড়াল করে বের হয়ে গেলো বাইরে। বাড়ি থেকে বের হতেই দেখে নাহিদ রাস্তায় দাড়িয়ে আছে। হলুদ পাঞ্জাবী তার পরনে। গালে হলুদ এখনো লেগেই আছে। হাত মুখটাও ঠিক মত ধোয়নি। মৃন্ময়ী এগিয়ে গিয়ে কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
— আপনি এখানে? সব ঠিক আছে তো?

নাহিদ ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। বলল
— সব ঠিক আছে।

মৃন্ময়ীর মস্তিষ্ক নাহিদের কথা ধরতে পারলো না। সব ঠিক আছে তাহলে এত রাতে কেনো। নাহিদ হাত বাড়িয়ে মৃন্ময়ীর গালে হলুদ ছুঁয়ে দিয়ে বলল
— তোমাকে হলুদ ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছা করছিলো খুব। তাই ভাবলাম এখনই চলে আসি। তুমি বিরক্ত হওনি তো?

মৃন্ময়ী হেসে ফেললো। বলল
— এতো রাতে আসার দরকার ছিলো না নাহিদ সাহেব। কাল তো..।

বলেই থেমে গেলো। নাহিদ বলল
— জানি কাল বিয়ে। কিন্তু হলুদ তো আজ। কাল তো আর হলুদ ছুঁয়ে দিতে পারতাম না।

মৃন্ময়ী এবার শব্দ করে হাসলো। রাতের বেলায় তার হাসির শব্দ যেনো ঝঙ্কার তুললো। নাহিদ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। মৃন্ময়ী হাসি থামিয়ে দিল। মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেলো। নিচের দিকে তাকাল। নাহিদ বুঝতে পেরে বলল
— কি হয়েছে মৃন্ময়ী? কি নিয়ে মন খারাপ করছো?

মৃন্ময়ী ছলছল চোখে তাকাল। বলল
— আচ্ছা সেদিন যদি আমার সাথে খুব খারাপ কিছু হয়ে যেত তাহলে কি আপনি আমাকে মেনে নিতেন?

নাহিদ প্রথমে অবাক হলেও পরে মৃদু হাসলো। বলল
— প্রতিটা সম্পর্কের শুরুটা বন্ধুত্ব থেকে হয় মৃন্ময়ী। তোমার বন্ধু সুলভ আচরণ আমার বেশ ভালো লেগেছে। আর সব থেকে যেটা মন কেড়েছে তোমার সততা। তুমি আমাকে যদি বলতে যে সেদিনের ঘটনায় তুমি তোমার সম্ভ্রম হারিয়েছ। তবুও আমি তোমাকেই বিয়ে করতাম। কারণ কতজন এমন নির্দ্বিধায় নিজের ক্ষতির কথা নিজ মুখে বলতে পারে। তাছাড়াও সেখানে তোমার তো কোন দোষ ছিলো না। তাহলে কেনো আমি তোমাকে অপরাধীর গড়ায় দাড় করাব।

মৃন্ময়ী কান্নায় ভেংগে পড়লো। নাহিদ তাকে বুকে আগলে নিয়ে বলল
— ভুলে যাও মৃন্ময়ী। পুরাতন সব কথা ভুলে যাও। কাল থেকে তোমার নতুন জীবনের সূচনা হতে যাচ্ছে। সেটার জন্য প্রস্তুত হও। বাকি জীবনটা তোমাকে এই নতুন পরিচয় বহন করতে হবে।

মৃন্ময়ী নাহিদের বুকে মাথা রেখেই বলল
— এই পরিচয় বহন করতে আমি প্রস্তুত। এই পরিচয় শুধু আমার অহংকার হবে না আমি এই পরিচয়ের অধিকারী হয়ে গর্বিত।

চলবে…….
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here