মেঘবদল পর্ব -০১৯+২০

#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১৯

মাথার উপরে খটখট শব্দে ফ্যান চলছে বেশ দাপটে। কিন্তু ঠিক তার নিচে বসেই নিয়াজ সাহেব ঘামছেন অনবরত। মুখ রক্তিম বর্ণ ধারন করেছে। দুই একবার জোরে শ্বাস টেনে নিতেই বুকের ঠিক বাম পাশে চিনচিন করে উঠলো। শক্ত হয়ে বসে থাকলেন। চোখটাও বন্ধ করে রাখলেন কিছুক্ষন। কিন্তু ব্যাথা কমছে না বাড়ছে ধীরে ধীরে। আলতো করে ব্যাথার জায়গাটায় হাত রাখলেন তিনি। পিছনে মাথাটা এলিয়ে দিলেন। আর সম্ভভ হচ্ছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিছু বলতে চেয়েও পারলেন না। মুখে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। চোখটা বন্ধ করে মৃদু সরে আওড়ালেন
–পানি। পানি।

ঈশা তখনও চায়ের কাপ হাতে দাড়িয়ে আছে। কিন্তু দৃষ্টি তার নিচে স্থির। রাহেলা উঠে রান্না ঘরে গেছেন। বাবার মৃদু আওয়াজ কানে যেতেই সে তাকাল। চায়ের কাপ ফেলে দিয়ে বাবার কাছে গিয়ে অস্থির কণ্ঠে বলল
–তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে বাবা? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?

নিয়াজ সাহেব ঘোলাটে চোখে তাকালেন। তিনি অনেক কথা বলার চেষ্টা করছেন কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। ঠোঁট দুটো কেঁপে কেঁপে উঠছে তার। কিছুটা সময় নিয়ে বুকের বাঁ পাশে ইশারা করে দেখিয়ে অস্পষ্ট সরে বললেন
–ব্যাথা।

চোখ বন্ধ হয়ে গেল তার। বাবার কথায় ঈশা বিপদের আভাষ পেলো। কিছু একটা আন্দাজ করেই সময় নষ্ট করল না। চিৎকার করে ডাকতেই রাহেলা আর ইলু ছুটে এলো। হতবিহবল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুজন। কি হয়েছে বুঝতে চেষ্টা করছে। ঈশা বুঝতে পারছেনা এই মুহূর্তে তার কি করা উচিৎ। প্রথমেই তার ইভানের কথা মাথায় এলো। ফোন বের করে ইভানের নাম্বারে ফোন করলো। ইভান বাইরে থেকে মাত্র বাসায় এসেছে। ঈশার ফোন দেখে কপালে ভাজ পড়ে গেলো তার। ফোনটা ধরতেই ঈশা অপাশ থেকে কেদে উঠলো। ঈশার কান্না শুনে ইভানের বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো। বিচলিত হয়ে বলল
–কি হয়েছে? তুই কাদছিস কেন?

ঈশা কথা বলতে পারছে না। থেমে থেমে বলল
–বাবা…বাবা।

ইভান শান্ত সরে বলল
–কি হয়েছে ছোট বাবার?

ঈশা আবারো কাপা কাপা কণ্ঠে বলল
–বাবা কেমন যেন করছে।

ইভান আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত চলে গেলো ঈশাদের বাসায়। তাদের চেচামেচিতে পাশের ফ্ল্যাট থেকে জারিফরা সবাই চলে এসেছে। ইভান ভেতরে ঢুকেই দেখে সবাই অস্থির হয়ে কাঁদছে। ইভান নিয়াজ সাহেবের কাছে গিয়ে দুই হাত আলতো করে গালে রেখে বলল
–কি হয়েছে তোমার ছোট বাবা? কষ্ট হচ্ছে?

নিয়াজ সাহেব চোখ মেলে তাকালেন। ইভানের আওয়াজ শুনে তিনি মৃদু সরে বলার চেষ্টা করলেন
–বুকে…ব্যাথা।

ইভান তার কথা শুনেই আর দেরি করল না। বলল
–এখনই হাসপাতালে নিতে হবে। দেরি করা ঠিক হবে না।

হাসপাতালের কথা শুনে সবার মুখের বর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। বুঝে গেলো যে নিয়াজ সাহেবের কোন সাধারন অসুখ হয়নি। ইভান দেরি না করে এম্বুলেন্স আসতে বলল। কিছুক্ষনের মধ্যেই এম্বুলেন্স চলে এলো। নিয়াজ সাহেব কে এম্বুলেন্সে উঠান হল। রাহেলা সাথে যাওয়ার জন্য জেদ করলো। ইভান খুব শান্ত সরে রাহেলার হাত ধরে বলল
–ছোট বাবা সুস্থ হয়ে আসবে ছোট মা। তুমি একদম ভেব না। তুমি দোয়া করো। আর আমি আছি তো। তোমার ছেলের উপরে ভরসা করেই দেখো।

নিয়াজ সাহেবের এখনও জ্ঞান আছে। ইভানের শেষের কথাটা কানে আসতেই তিনি চোখ খুলে তাকালেন পিটপিট করে। ইভান পাশেই দাড়িয়ে ছিল। কথা না বলতে পারলেও তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। ইভান এম্বুলেন্সে উঠে নিয়াজ সাহেবের দিকে তাকাল। খুব যত্ন করে তার চোখের পানি মুছে দিয়ে শান্ত সরে বলল
–একদম ভয় পাবে না। দেখো তুমি ঠিক হয়ে যাবে।

————
সারিবদ্ধ করে রাখা চেয়ার গুলোতে বসে আছে ইভান। নিচের দিকে তাকিয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে। নিয়াজ সাহেবের অবস্থা খুব একটা ভাল না। আই সি ইউ তে রাখা হয়েছে। সবে সকালের আলো ফুটেছে। সারা রাত অস্থির ভাবে কেটেছে সবার। এখনও ভালো খারাপ কিছুই বলা যাচ্ছে না। ডাক্তার দেখবেন তারপর জানাবেন তার অবস্থা। নুরুল রহমান একবার চেয়ারে বসছেন তো আরেকবার আই সি ইউর সামনে গিয়ে দাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছেন। ইভান বেশ অনেক্ষন ধরেই বাবার এসব কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছে। হতাশ শ্বাস ছেড়ে উঠে গিয়ে বাবার পিছনে দাঁড়ালো। হাত ধরে টেনে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। নুরুল রহমান অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন। ইভান ধমক দিয়ে বলল
–তুমি এভাবে বারবার ওখানে গিয়ে দাড়িয়ে থাকলে কি ছোট বাবা সুস্থ হয়ে যাবে? আর তুমি সারা রাত ঘুমাওনি। না খেয়ে আছো। এভাবে যদি অসুস্থ হয়ে যাও তাহলে আমার বিপদ হয়ে যাবে। কয়দিকে সামলাবো আমি বল।

নুরুল সাহেব শান্ত চোখে তাকিয়েই আছেন। ইভান কঠিন ভাবে বলল
–এখানে বসে থাকো। আমি খাবার আনতে যাচ্ছি। আর এসে যেন তোমাকে বসে থাকতেই দেখি।

বলেই চলে গেলো। নুরুল সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়েই থাকলেন। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাসটা বেরিয়ে এলো ঠিক কি কারনে তিনি নিজেও জানেন না। ইভান খাবার নিয়ে এলো। বাবার পাশে বসে খাবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
–খেয়ে নাও বাবা।

ইভানের ভীষণ আদুরে কণ্ঠ শুনে চোখের পানি আটকাতে পারলেন না নুরুল সাহেব। কেদে ফেললেন। ইভান বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল
–কেঁদো না বাবা। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে তো এভাবে।

ছেলের প্রতি সমস্ত অভিমান যেন গলে গেলো তার। ছোট বাচ্চার মতো বুকে মুখ লুকিয়ে কাদতে লাগলেন। ইভান বাবাকে সামলে নিলো কৌশলে। বাবা ছেলের এমন আলিঙ্গনের মুহূর্ত দূর থেকে দেখছিল ঈশা রাহেলা আর মাহমুদা। তারা কখন এসেছে দুজনের কেউ খেয়াল করেনি। ইভান চোখ ফেরাতেই তাদের দেখে ফেলল। মাহমুদা খুশির কান্নাটা লুকিয়ে ফেললো আচলে। ইভান উঠে দাঁড়ালো। তাদের কাছে যেতেই রাহেলা হুহু করে কেদে ফেললো। ইভান মাহমুদার দিকে তাকিয়ে বিরক্তিকর সরে বলল
–ছোট মাকে কেন এনেছ মা? দেখছই তো এমনিতেই পরিস্থিতি কি। এবার ছোট মা যদি অসুস্থ হয়ে যায়।

রাহেলা মুখে আচল চেপে কাঁদছে। মাহমুদা বলল
–কারও কথা কি শুনছে নাকি? হাসপাতালে আসতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

রাহেলা কাপা কাপা কণ্ঠে বলল
–তোর ছোট বাবা এখন কেমন আছে?

ইভান কোন উত্তর খুজে পেলো না। কারন এখনও সে নিজেই জানে না। তাই শান্তনা দেবার একটা উত্তর দিতে প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু কিছু বলার আগেই নুরুল রহমান গম্ভির সরে বললেন
–যেমন দেখেছ তেমনই আছে। ডাক্তার এখনও কিছু বলেনি। না বলা পর্যন্ত তাঁর অবস্থা অপরিবর্তিত।

রাহেলার মনের ভয় বেড়ে গেল। ইভান সবাইকে চেয়ারে বসাল। পিছন ফিরে দেখে ঈশা নেই। একটু এগিয়ে গিয়ে এপাশ অপাশ চোখ ফেরাতেই দেখল আই সি ইউ এর দরজার সামনে দাড়িয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছে। কিছুক্ষন সেখানে দাড়িয়ে থেকে সিঁড়ির উপরে গিয়ে বসলো। দুই হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে কাদতে লাগলো। ইভান গিয়ে দাঁড়ালো সামনে। মাথায় আলতো করে হাত রাখতেই ঈশা চোখ তুলে তাকাল। ইভান কে দেখে নিজের ভেতরের কষ্টটাকে চাপিয়ে রাখল। চোখের পানি মুছে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইভান হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। নিজের হাতের মুঠোয় ঈশার হাত দুটো নিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল
–সবার আগে সব কিছুর জন্য নিজেকে ব্লেইম করা বন্ধ কর। কোন কিছুই তোর জন্য হয়নি। এটা একটা এক্সিডেন্ট। ঠিক হয়ে যাবে সব কিছু।

ঈশা ছলছল চোখে তাকাল। সে তার বাবার এই অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী করছিলো এতক্ষন। সেটা যে ইভান বুঝে যাবে ঈশা ভাবেনি। বেশ অবাক হলেও নিজের কষ্টের কাছে সেটা প্রাধান্য পেল না। কেদে ফেললো সে। ইভান হাত ছেড়ে ঈশার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল আলতো করে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
–নিজের কষ্টটাকে মনের মাঝে চেপে রেখে কোন লাভ নেই। যতটা কাদতে ইচ্ছা করে কেঁদে নে।

ঈশা বুঝতে পেরে মাথা তুলে একবার ইভানের দিকে তাকাল। কাপা কাপা কণ্ঠে বলল
–বাবা কি ঠিক হবে না?

ইভান শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো। ঈশার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে অনবরত। ইভান পরিস্থিতি সামলাতে দুষ্টুমি মাখা কণ্ঠে বলল
–তোর বাবা এতদিন ধরে আমাকে এতো জালাল আর এসবের প্রতিশোধ না নিয়েই আমি ছেড়ে দেবো? বাবার সব অত্যাচারের দায়ভার তার মেয়ের উপরে পড়বে। আর এই সব কিছু তাকে নিজে চোখে দেখেই সহ্য করতে হবে।

সরু চোখে তাকাল ঈশা। ঝাঁঝাল গলায় বলল
–তুমি তার মেয়েকে অত্যাচার করবে আর সেটা বাবা চুপচাপ দেখবে সেটা কিভাবে ভাবলে?

ইভান মৃদু হেসে বলল
–এতদিন নিজের বাড়িতে রেখে মেয়ের উপরে খবরদারী করেছে। আমি কিছুই বলিনি। কিন্তু জামাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে সেখানে খবরদারী করলে আমি মেনে নেবো?

কথাটা মাথায় আসতেই ঈশা বড় বড় চোখে তাকাল। ইভান মৃদু হেসে বলল
–বিয়ের পর মেয়েদের উপরে অধিকার শুধু স্বামীর থাকে। বাবার নয়।

ঈশা চোখের পানি মুছে নিলো। ইভান ছেড়ে দিয়ে পাশে বসে পড়ল। নীরবতায় কেটে গেলো কয়েক মুহূর্ত। ভেবেই পাচ্ছে না ঈশা কি বলবে এই কথার উত্তরে। তার মনের অবস্থা ভালো না। ইভান নিজে থেকেই বলল
–তোর বাবার আসলেই আমাকে ভয় পাওয়া উচিৎ। সুস্থ হয়ে উঠলেই আমি বিষয়টা ভালো করে বুঝিয়ে দেবো।

ভ্রু কুচকে তাকাল ঈশা। বলল
–কি করবে?

ইভান চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল
–তার মেয়েকে কিডন্যাপ করব।

ঈশা বড় বড় চোখে তাকাল। ইভান মৃদু হাসতেই একজন নার্স এসে বলল
–পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।

মুহূর্তেই দুজনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ইভান উঠে দাড়িয়ে বলল
–উনি এখন কেমন আছেন?

–এখন আর কোন ভয় নেই। খুব তাড়াতাড়ি ওনাকে কেবিনে শিফট করা হবে।

ইভান সবাইকে খবরটা দিলো। সবাই এখন খুব খুশি। অপেক্ষা করছে নিয়াজ সাহেবকে কেবিনে দিলে সবাই দেখা করতে পারবে। শ্বাস রুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসান হল অবশেষে। সবাই নিজেদের মতো কথা বলছে এখন। কি করবে সব গুছিয়ে নিচ্ছে। ইভানের মাথাটা বেশ ধরেছে। সারা রাত ঘুমায়নি। কেমন যেন অস্থির লাগছে। তাই এক পাশে দাড়িয়ে চোখ বন্ধ করতেই ঘাড়ে কারও স্পর্শ পেয়ে ঘুরে তাকাল। নাহিদকে দেখে বলল
–তুমি কখন এলে?

–এখনই এসেছি। বাসায় অস্থির লাগছিল। এদিকে আবার ছুটি নেয়ারও কোন উপায় নেই। তাই চলেই এলাম। এখান থেকেই অফিসে যাবো।

নাহিদের কথা শেষ হতেই কেউ একজন পিছন থেকে বলল
–আপনি এখানে কি করছেন?

দুজনেই গভীর দৃষ্টিতে তাকাল।
#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ২০

–আপনি এখানে কি করছেন?

দুজনেই গভির দৃষ্টিতে তাকাল। মানুষটাকে দেখেই নাহিদের চোখ জোড়া স্থির হয়ে গেলো। বিড়বিড় করে বলল
–মৃন্ময়ী?

ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। এই নামটা সে আগেও একবার শুনেছে। কিন্তু কোথায় এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তাই নাহিদকে থামিয়ে দিয়ে মৃদু সরে জিজ্ঞেস করল
–এটা কে?

নাহিদ জেনো তার কথা শুনলই না। এগিয়ে গিয়ে বলল
–তুমি এখানে কেন? এত সকালে এখানে কি করছ? সব ঠিক আছে তো মৃন্ময়ী? সত্যি কথা বলবে একদম।

হঠাৎ করেই নাহিদের এমন তুমি সম্বোধন মৃন্ময়ীর নিশ্বাস ভারি করে তুলল। বুকের ভেতর কেমন অসাড় অনুভুতি হল। পিটপিট করে একবার নাহিদের দিকে তাকাল। পাশ ফিরে ইভানের দিকে তাকাতেই অপরস্তুত হয়ে গেলো। চোখ নামিয়ে ম্রিদু কণ্ঠে বলল
–শান্ত হন। তেমন কিছুই হয়নি। আমার এক আত্মীয় অসুস্থ। তাই দেখতে এসেছিলাম।

নাহিদ সস্তির নিশ্বাস ফেলল। বলল
–ওহ! তাই বল। আমি তো ভেবেছিলাম তোমার কোন বিপদ হল না তো।

ইভান ভ্রু কুচকে তখনও তাকিয়ে আছে। নিয়াজ সাহেবকে কেবিনে শিফট করছে সেটা বলতে এসেই ঈশা দাড়িয়ে গেলো তাদেরকে দেখে। ইভানের পাশে এসে দাড়াতেই সে ঈশাকে দেখে গম্ভীর সরে বলল
–মেয়েটা কে রে?

ঈশা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল। বলল
–আমি কি জানি?

ইভান একটু বিরক্ত হল। সে এরকম উত্তর আশা করেনি। ভেবেছিল ঈশা বলবে সে জানে। তাই ধমক দিয়ে বলল
–তুই আর কি জানবি? যা জানার দরকার নেই তাই জানিস। আর যা জানার দরকার আছে সেটা জানিস না।

ঈশা ঘুরে তাকাল। হাত ভাঁজ করে বলল
–কি বলতে চাইছ তুমি? আমি কি সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার নিয়ে জন্ম গ্রহন করেছি যে সবার মনের খবর রাখব। আর সাথে কে কার সাথে কথা বলছে সেই ব্যক্তির পরিচয়টাও জেনে নেবো।

ইভান খুব বিরক্ত হল। সরু চোখে তাকিয়ে বলল
–তুই একটু বেশী কথা বলছিস না? বেশী কথা বলা কিন্তু আমার একদম পছন্দ না।

ঈশা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল
–সেটা তোমার প্রবলেম। আমি তো এমনই। এখন আর নিজেকে চেঞ্জ করা সম্ভব না।

ইভান দাতে দাঁত চেপে বলল
–এটা হসপিটাল জন্য আজকের মতো বেচে গেলি। কিন্তু আমি ভুলে যাব এটা ভাবিস না। সময় হলেই বুঝতে পারবি।

ঈশা সন্দিহান চোখে তাকাল। তাদের কথার মাঝেই ফারিয়া আর জারিফ এসে দাঁড়াল। অস্থির ভাবে জিজ্ঞেস করল
–আঙ্কেল এখন কেমন আছেন?

ঈশা মৃদু হেসে বলল
–এখন ভালো আছে। মাত্র কেবিনে শিফট করেছে।

সবাই সস্তির নিশ্বাস ফেলল। ফারিয়া বলল
–খুব ভয় পেয়েছিলাম। আঙ্কেল ভালো আছে জেনে ভালো লাগলো।

কিছু সময় নিজেদের মতো কথা বলে তাদের দৃষ্টি আবারো নাহিদের উপরে ঠেকল। এতক্ষন নিজেদের কথার মাঝে তারা নাহিদের কথা ভুলে গিয়েছিল। ইভান ইশার দিকে তাকিয়ে বলল
–ভাইয়াকে জিজ্ঞেস কর তো মেয়েটা কে। এই প্রথম কোন অপরিচিত মেয়ের সাথে ভাইয়াকে এতক্ষন কথা বলতে দেখলাম। তাও আবার এত হেসে হেসে।

ঈশা গভির দৃষ্টিতে সেদিকে তাকাল। সেও বিষয়টা খেয়াল করেছে। তাই আর দেরি না করে এগিয়ে গেলো। নাহিদ আর মৃন্ময়ী নিজেদের মাঝে এমন গভীর ভাবে ডুবে ছিল যে আশে পাশে কি হচ্ছে সেসব খেয়াল করেনি। ঈশা গলা পরিস্কার করে বলল
–নাহিদ ভাইয়া?

নাহিদ চমকে তাকাল। ঈশাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করল। বলল
–চাচা এখন কেমন আছে?

ঈশা ঠোট এলিয়ে হেসে বলল
–ভালো আছে। কেবিনে শিফট করেছে।

নাহিদ বিস্ময়ের সুরে বলল
–তাই নাকি? খুব ভালো খবর। কখন শিফট করাল? আমি তো এখানেই ছিলাম। কিছুই জানলাম না।

ঈশা দাঁত কেলিয়ে বলল
–তুমি তো বিজি ছিলে তাই বুঝতে পার নি।

নাহিদ সরু চোখে তাকাল। ঈশার দুষ্টুমি করে বলা কথাটা বুঝতে তার কষ্ট হল না। গম্ভীর সরে বলল
–আমি তোর বড় ভাই। সেটা ভুলে গেছিস?

ঈশা কিছু বলার আগেই ইভান এসে দাঁড়াল। বলল
–আমিও ঠিক তাই বলছিলাম। বেয়াদব। বড়দেরকে একদম সম্মান করতে জানে না। ছোটো মেয়ে তো এখনও তেমন ভদ্রতা শিখেনি। ধিরে ধিরে সব শিখে যাবে।

ইভানের কথা শুনে ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। জারিফ আর ফারিয়া ঠোট চেপে হাসল। নাহিদ সরু চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে সবার মাথায় কি চলছে। ইভান হেসে বলল
–তোমার পাশের জনকে ঠিক চিনলাম না। নামটা…।

–মৃন্ময়ী।

ইভানের কথা শেষ হওয়ার আগেই নাহিদ উত্তর দিলো। নামটা কানে আসতেই ঈশা বুঝে গেলো। অবাক চোখে তাকাল মৃন্ময়ীর দিকে। পাশে গিয়ে দুই হাতে ধরে বলল
–তুমি মৃন্ময়ী? মানে মৃন্ময়ী আপু? মানে ভাবী?

ঈশার ভাবী সম্বোধনে মৃন্ময়ীর কান গরম হয়ে গেলো। গাল রক্তিম আভা ধারন করল। দৃষ্টি নামিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। ইভানের এবার মনে পড়লো সে নামটা কোথায় শুনেছে। সবটা বুঝে গেলো সবাই। মৃন্ময়ীর অবস্থা বুঝে ঈশা হেসে বলল
–তুমি তো নতুন বউয়ের মতো লজ্জা পাচ্ছ। এত লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই তো।

মৃন্ময়ী লজ্জায় আরও আড়ষ্ট হয়ে গেলো। তার হাত পা অসস্তিতে কাঁপছে। নাহিদ বিষয়টা খেয়াল করতেই ধমক দিয়ে বলল
–সবাই তোর মতো নির্লজ্জ হয় না।

ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল। ইভান হেসে ফেলল। ঈশা দৃষ্টি ফিরিয়ে ইভানের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। নাহিদের দিকে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলল
–আমি কি এমন করেছি যে নির্লজ্জ বললে?

নাহিদ ঠোট বাকিয়ে হাসল। বলল
–এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি সেই কথা? সবার সামনে যেদিন বলেছিলি…।

ঈশা নাহিদের কথা বুঝতে পারল। তাই সাথে সাথেই মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে বলল
–চল তোমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।

বলেই হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলো সবার কাছে।

———–
সকাল গড়িয়ে দুপুর। যে যার মতো কাজে চলে গেছে। ইভান চেয়ারে বসে আছে চোখ বন্ধ করে। ঈশা এসে পাশে বসল। ইভান চোখ মেলে তাকাল না। তাকাবেই বা কিভাবে টায়ার্ড হয়ে আছে। কাল রাত থেকে ঘুমায়নি সে। ঈশা আলতো করে মাথায় স্পর্শ করতেই চোখ মেলে তাকাল সে। চোখ জোড়া লাল হয়ে আছে। ক্লান্তির ছাপ চেহারায়। ঈশা নরম সরে বলল
–বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও। এখন তো সবাই আছে।

ইভান ক্লান্ত সরে বলল
–রাতে যাব একবারেই।

ঈশা আবারো বলল
–তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। রেস্ট নিলে ঠিক লাগতো।

ইভান কোন কথা বলল না। ঈশার ঘাড়ে মাথা রাখল। ক্লান্ত সরে বলল
–মাথাটা ব্যথা করছে এখন কথা বলিস না। একটু রেস্ট নিতে দে।

ঈশা কোন কথা বলল না। চুপচাপ শক্ত হয়ে বসে আছে। ইভানের উষ্ণ নিশ্বাস তার ঘাড়ের আশে পাশে বাড়ি খাচ্ছে। বেশ অসস্তি হচ্ছে তার। গলা শুকিয়ে আসছে। ইভান চোখ বন্ধ করেই আছে। নুরুল সাহেবের গলা শুনে দুজনেই চমকে তাকাল। তাদের পাশেই তিনি দাড়িয়ে আছেন। তার চোখে মুখে অসস্তির ছটা। এমন একটা দৃশ্য দেখবেন হয়তো আশা করেন নি। ঈশা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান চোখ নামিয়ে বলল
–জি বাবা।

তিনি বেশ অসস্তি নিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল
–নিয়াজ তোমাকে বাসায় জেতে বলেছে। সে চায় না তুমি এখানে থাকো।

ঈশা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিচে। ইভান ছোট্ট করে ‘আচ্ছা’ বলেই উঠে দাঁড়াল। বাবার সামনে দাড়িয়ে বলল
–তুমি কখন বাসায় যাবে?

নুরুল সাহেব কোন কারনে ছেলের সাথে চোখ মেলাতে পারছে না। তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে বলল
–আমি সন্ধ্যায় যাব।

ইভান শান্ত ভাবে বলল
–নিজের খেয়াল রেখো বাবা। দুপুরে খেয়ে নিও।

ছেলের মুখে এমন কথা শুনে তাঁর মুখে হাসি ফুটল। কিন্তু তিনি সেটা গোপন করেই বললেন
–তুমি ঈশাকেও সাথে নিয়ে যাও। সে একা এখানে থেকে কি করবে।

কেউ কোন কথা বলল না। ইভান মাথা নাড়ল শুধু। নুরুল সাহেব চলে গেলেন। ঈশা আর ইভান হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সায় উঠল। রিক্সা চলছে নিজ গতিতে। দুজন চুপচাপ। কিন্তু মস্তিস্কে তাদের এলোমেলো চিন্তা ভাবনা। ঈশা নীরবতা ভেঙ্গে বলল
–এর কি কোন সমাধান নেই?

ইভান সামনে তাকিয়েই বলল
–কিসের?

ঈশা অভিমানি দৃষ্টিতে তাকাল। সে ভালো করেই জানে তাঁর কথা ইভান বুঝতে পারছে। তবুও এমন হেয়ালি করছে। ঈশার রাগ হল। ইভান উত্তর না পেয়েও কোন কথা বলল না। রিক্সা এসে থামল বাড়ির সামনে। ইভান ঈশাকে বলল
–তুই বাসায় যা আমি আসছি।

ঈশা ঘুরে প্রশ্ন করল
–কোথায় যাচ্ছ?

ইভান মৃদু হাসল। দুষ্টুমি করে বলল
–টিপিক্যাল বউদের মতো প্রশ্ন করছিস? এখন থেকেই শুরু?

ঈশার খুব রাগ হল। চোখে পানি চলে এলো। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে দ্রুত বাড়ির ভেতরে চলে গেলো। ইভান মুচকি হাসল।

————
ফারিয়ার চেহারায় বেশ ক্লান্তি। এলোমেলো পা ফেলে সোফায় এসে বসল। জারিফ একটু আগেই এসেছে অফিস থেকে। সে এখন ফ্রেশ হচ্ছে ওয়াশ রুমে। ফারিয়া তাঁর মাকে বলল
–মা একটু পানি দাও তো।

তাঁর মা পানি এনে হাত ধরিয়ে দিলো। একটু খেয়ে রেখে দিলো সে। সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তাঁর মা কপালে হাত দিয়ে বলল
–কি রে শরীর খারাপ নাকি? এমন দেখাচ্ছে কেন?

ফারিয়া চোখ বন্ধ করেই বলল
–মাথাটা কেমন জেনো করছে।

জারিফ তখন বাইরে বেরিয়ে এলো। তাকে দেখেই ফারিয়ার মা বলল
–ফারিয়ার শরীর খারাপ লাগছে।

জারিফ ভালো করে তাঁর দিকে তাকাল। কি হয়েছে বুঝতে চেষ্টা করল। ঠিক সেই সময় ফারিয়া মুখ চেপে ধরে বেসিনে গিয়ে বমি করে দিলো। জারিফ দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে ফেলল। কিন্তু ফারিয়া জ্ঞান হারিয়ে জারিফের বুকে ঢলে পড়লো।

চলবে……
চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here