মেঘবদল পর্ব -১৭+১৮

#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১৭

–ঈশা।

ভরা রাস্তায় নিজের নামটা পুরুষালী কণ্ঠে কানে আসতেই পিছন ফিরে তাকাল ঈশা। সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্নি সরাসরি চোখে এসে লাগায় চোখ মুখ কুচকে নিলো। কপালের উপরে হাত রেখে রোদ আটকাতে চেষ্টা করলো। চোখ পিটপিট করে তাকাল। রাতুলের রক্তিম চেহারা চোখে পড়তেই ঈশার ভ্রু কুচকে এলো। রোদে মুখ প্রায় রক্তিম বর্ণ ধারন করেছে। ঈশা দ্রুত পাশেই একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়ালো। সে এগিয়ে এসে ঈশার সামনে দাঁড়ালো। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল
–তোমার কি খবর ঈশা?

ঈশা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–আমার আবার কি খবর হবে রাতুল ভাইয়া? আমি ভালই আছি।

রাতুল শান্ত দৃষ্টিতে ঈশাকে দেখে নিয়ে বলল
–আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি ভালো আছো। তোমাকে আমি কয়েকদিন ধরে ফোন করেই যাচ্ছি। কিন্তু তোমার কোন খবর নেই। আমার ফোন ধরছ না কেন?

ঈশা থেমে গেলো। সেদিন ইভানের কথা শোনার পর সে রাতুলকে ইগনোর করছে। রাতুল অনেকবার ফোন করলেও সে ফোন ধরেনি। এমন কি মেসেজের জবাবও দেয়নি। এভাবে যে বাইরে রাতুলের সাথে দেখা হয়ে যাবে সে ভাবতেই পারেনি। এখন তার মনে হচ্ছে কেন দাঁড়ালো সে। যদি কোন ভাবে বুঝতে পারতো যে রাতুল তাকে ডেকেছে তাহলে কোনভাবেই দাঁড়াত না। একটা শ্বাস টেনে বলল
–আসলে আমি কয়দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। তাই ফোন ধরতে পারিনি।

ঈশার কথা শেষ হতেই রাতুল তাচ্ছিল্য করে হাসল। বলল
–এতো ব্যস্ততার মাঝেও রাত জেগে ফেসবুক চালাতে ভুল হয়না তোমার। শুধু আমার মেসেজ সিন করার সময় তুমি ব্যস্ত হয়ে পড়। সবার সাথেই কথা হয় তোমার আর আমি ফোন দিলেই কেটে দিয়ে বন্ধ করে রাখো। তুমি কি কোন কারনে আমাকে ইগনোর করছ? কারণটা ঠিক কি?

ঈশা চোখ নামিয়ে নিলো। সে কি কারনে ইগনোর করছে সেটা বলা ঠিক হবে না। তবে সে যে আর রাতুলের সাথে কোন যোগাযোগ রাখতে চায় না সেটা স্পষ্ট করে বলতে হবে। নাহলে এভাবে সে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনবে। তাই চোখ তুলে তাকাতেই কিছু বলার আগে থমকে গেলো সে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। রাতুল ঈশার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাল। ঈশার দৃষ্টি তাক করে পিছনে তাকাতেই ইভান কে দেখে বেশ অবাক হল সে। হেসে বলল
–আরে ইভান ভাইয়া? কেমন আছো?

ইভান মৃদু হেসে বলল
–ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?

রাতুল হেসে বলল
–এই তো। এখানে কি করছ তুমি? কোন কাজে এসেছিলে নাকি?

ইভান খুব শান্ত ভাবে বলল
–একটা কাজ ছিল। এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। তোমাদেরকে দেখতে পেলাম। তুমি কি করছ এখানে?

রাতুল ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–এখানেই একটু কাজে এসেছিলাম। ঈশার সাথে দেখা হয়ে গেলো তাই কথা বলছিলাম।

ইভান গম্ভির ভাবে বলল
–ওহ। ঠিক আছে। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। পরে কথা হবে। আজ আসি।

রাতুল মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল
–আমি যতদূর জানি তোর কাজ শেষ। রাস্তায় এভাবে দাড়িয়ে সময় নষ্ট করার কোন দরকার নেই। আমার সাথে চল।

ঈশা শুকনো ঢোক গিলে ফেললো। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে খুব ভয় পেয়েছে। রাতুল ঈশার দিকে তাকাল। সে তার উত্তর এখনও পায়নি। তাই সে চায় না ঈশা ইভানের সাথে চলে যাক। আরও কিছুক্ষন কথা বলার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ঈশা জানে ইভান কি পরিমান রেগে আছে। তার নমুনা আগের দিনেই কিছুটা দেখেছে। তাই আর না করার সাহস করে উঠলো না। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। ইভান বাইক স্টার্ট দিতেই ঈশা উঠে বসলো। খুব ধির গতিতে বাইক চলছিল। উচু নিচু রাস্তায় ঈশা হেলেদুলে যাচ্ছে। ইভান সামনে তাকিয়েই বলল
–আমাকে ধর না হলে কিন্তু পড়ে যাবি।

ঈশা বাইকের আয়নায় তাকাল। ইভান সামনের দিকে তাকিয়ে বাইক চালাচ্ছে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না ইভান তাকে এরকম কথা বলল কি না। তাই ভাবতে লাগলো। তার ভাবনার মাঝে ইভান আবার ধমক দিয়ে বলল
–শুনতে পাস নি কি বললাম? তুই পড়ে গেলে দোষটা আমার ঘাড়ে এসে পড়বে। আমি কেন তোর জন্য দোষ ঘাড়ে নিবো? তাই আমাকে ধরে ঠিক করে বস।

ঈশা কথা বুঝতে পেরেই ইভানের ঘাড়ে হাত রাখল। ইভান সামনে তাকিয়েই মুচকি হাসল। কিছুক্ষন বাদে বাইক একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়ালো। ইভান বাইক থামিয়ে ঈশাকে নামতে বলল। ঈশা নেমেই বলল
–এখানে কেন থামালে? আমরা বাসায় যাব না?

ইভান শান্ত ভাবে বলল
–আমি যদি না চাই তাহলে কি তুই বাসায় যেতে পারবি?

ঈশা গোল গোল চোখে তাকাল। মাথা নাড়িয়ে না বলল। ইভান কঠিন সরে বলল
–তাহলে কোন কথা না বলে চুপচাপ আমার সাথে আয়।

ঈশা বুঝতে পারল এখন হাজার প্রশ্ন করলেও ইভান কোন উত্তর দেবে না। তাই অজথা প্রশ্ন না করে তার সাথে চুপচাপ যাওয়াই ভালো। ইভানের পিছে পিছে চুপচাপ ভেতরে গেলো। ফাঁকা একটা টেবিল দেখে ইভান ঈশাকে ইশারা করলো বসতে। ঈশা বসে পড়লেও তার কৌতূহলটা কিছুতেই দমিয়ে রাখতে পারছে না। ইভান সামনের চেয়ারে বসে শান্ত ভাবে বলল
–কি খাবি?

ঈশা পিটপিট করে তাকাল। বলল
–কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।

ইভান কোন কথা বলল না। ওয়েটারকে ডেকে হালকা কিছু খাবার অর্ডার করলো। ঈশা এখনও নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে। ইভান খুব শান্ত ভাবে বলল
–রাতুল কি বলছিল?

ঈশা চমকে তাকাল। ভিত কণ্ঠে বলল
–তেমন কিছু না।

ইভান তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই ঈশা চোখ নামিয়ে নিলো। ইভানের অমন দৃষ্টির অর্থ সে বুঝতে পারল। বলল
–আমি কেন ফোন ধরছিলাম না তাই জিজ্ঞেস করছিলো।

ইভান খুব ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলল
–আমার কাছ থেকে কোন কথা লুকানোর চেষ্টা করে থাকলে সেটা তোর সব থেকে বড় ভুল হবে। কারন আমি কোন না কোন ভাবে সব কিছুই জানতে পারি। আমার…।

ইভানের কথা শেষ হওয়ার আগেই ঈশা অসহায়ের মতো বলল
–আমি মিথ্যা বলিনি বিশ্বাস করো।

ইভান মৃদু হাসল। বলল
–আমি জানি তুই মিথ্যা বলিস নি। আর আমি তোকে বিশ্বাস করি।

ঈশা শান্ত চোখে তাকাল। ইভানের ঠোটে অমায়িক হাসি। ইভানের এমন আচরন দেখে ঈশা বেশ অবাক হল। সে কিছুই বুঝতে পারছে না এমন আচরনের কারন কি। ঈশা ভীত কণ্ঠে বলল
–আচ্ছা আমরা এখানে কেন এলাম?

ইভান খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–তেমন কিছু না। গল্প করতে।

ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–গল্প করতে মানে?

–বাসায় তো গল্প করা সম্ভব হয় না। তাই এখানে নিয়ে আসলাম। যাতে একটু সময় নিয়ে কথা বলতে পারি। তোর কোন সমস্যা আছে?

ইভানের কথা ঈশার মাথার উপর দিয়ে গেলো। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। ওয়েটার খাবার দিয়ে গেলো। ইভান খাবারের প্লেট ঈশার সামনে দিল। কিন্তু ঈশার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। সে ইভানের দিকেই তাকিয়ে আছে। ইভান তাকে এভাবে বোকার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল
–আমি এমন কোন কঠিন কথা বলিনি যা বুঝতে তোর এতো সময় লেগে যাচ্ছে। খুব সহজ ভাবে বাংলা ভাষায় বলেছি। খাবারটা খেয়ে নে।

ঈশা আজ ইভানের আচরনে ক্ষনে ক্ষনে চমকে যাচ্ছে। এতো শান্ত ভাবে ইভান কোনদিন ঈশার সাথে কথা বলেনি। যতটুকু কথা হয়েছে শুধু ঝগড়া। ঈশা চুপচাপ খেয়েই যাচ্ছে আর ভাবছে। কোন ভাবেই কোন উত্তর মেলাতে পারছে না। পরিবেশ কেমন অস্থির হয়ে উঠছে। খাওয়া শেষ করে ইভান ঈশাকে বলল
–তুই বাইরে গিয়ে দাড়া আমি আসছি।

ঈশা নির্বাক মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। বাইকের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। তার মাথায় সব কিছু কেমন গোলমেলে লাগছে। কিছুক্ষন পরেই ইভান আসলো। ঈশাকে বাইকে নিয়ে সে বাড়ির দিকে চলে এলো। বাড়ির সামনে এসে বাইক থামিয়ে ঈশাকে নামিয়ে দিয়েই সামনে তাকাতেই দেখল ঈশার বাবা নিয়াজ রহমান তীক্ষ্ণ চোখে তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছেন। ঈশা বাইক থেকে নেমে বাবাকে দেখেই দাড়িয়ে গেলো। ইভান বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। ঈশার সেদিন ইভান কে বিয়ে করার কথা বলার পর থেকেই ইভান নিয়াজ রহমানের মুখমুখি হয় নি। কারন সে বুঝতে পারে কোন এক বিচিত্র কারনে তিনি ইভান কে পছন্দ করেন না। সেটা মুখে প্রকাশ না করলেও তার চাহুনি আর কথা বলার ধরন দেখেই ইভান সেটা বুঝতে পারে। অন্য কারও চোখে হয়ত সেটা পড়েনি। কারণটা ইভান জানে না। আর জানার চেষ্টাও করেনি কখনও। ইভানের ধারনা ঈশা সেদিন সবার সামনে ইভান কে বিয়ে করার কথা না বলে যদি অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা বলত তাহলে হয়ত তিনি এতটা রিয়াক্ট করতেন না। নিয়াজ রহমান এগিয়ে এসে ঈশার সামনে দাঁড়ালেন। ইভান অত্যন্ত নম্র সরে সালাম দিলো। তিনি সালামের জবাব দিয়ে ঈশাকে কিছু বলার আগেই ইভান বলল
–আমি বাসার দিকে আসছিলাম তো ঈশাকে চোখে পড়লো রাস্তায়। রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছিলো। তাই বাইকে নিয়ে এলাম।

নিয়াজ রহমান স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন। ইভানের কথা তিনি বিশ্বাস করলেন কিনা বা কিভাবে নিলেন সেটা দুজনের কেউই বুঝতে পারল না। শুধু গম্ভির গলায় বলল
–ভেতরে যাও। আর ইভান তোমার ঈশাকে বাইকে আনার কোন দরকার ছিল না। রিক্সায় উঠিয়ে দিলেই পারতে। আমাদের পরিবারের একটা সম্মান আছে। পরের বার বিষয়টা খেয়াল রাখবে।

ইভান মৃদু সরে বলল
–জি।

নিয়াজ সাহেব চলে গেলেন। ঈশা হাফ ছেড়ে বাঁচল। ইভানের দিকে তাকাতেই সে দাতে দাত চেপে বলল
–তোর বাবার কি ধারনা যে আমি তোকে বাইকের পিছনে নিয়ে প্রেম করে বেড়াচ্ছি? তাই আমাকে এভাবে কথা শুনিয়ে গেলো। আর তার মেয়ে আমার বাইকে উঠলে মান সম্মান চলে যায় তাই না?

ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল। তার বাবা কি বলেছে সেটা নিয়ে তো তার কোন দোষ নেই। তাহলে তাকে এভাবে কথা শোনানোর মানে কি? সে মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে থাকলো। ইভান আবার রাগি সরে বলল
–তোর বাবা কি আমাকে একটুও ভয় পায় না?

ঈশা বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাল। তার বাবার ইভান কে ভয় পাওয়ার কোন কারন নেই। বরং তার বাবাকে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারন আছে ইভানের কাছে। ঈশা বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল
–আমার বাবা কেন তোমাকে ভয় পাবে? তুমি ভয় পাবে আমার বাবাকে।

–আমার ভয় পাওয়ার কোন কারন নেই। তোর বাবার ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারন আছে। যার হাতে নিজের আদরের মেয়েকে তুলে দিবে তার সাথে এরকম ব্যাবহার করলে সে যদি মেয়ের উপরে এসবের প্রতিশোধ নেয়। তখন কি তার মেয়ে সহ্য করতে পারবে?

ঈশা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। ইভান কি বলল কানে আসলেও মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না। ইভান আবারো বলল
–তোর বাবার মাথায় বিষয়টা ভালো করে ঢুকিয়ে দিস। তাকে বলে দিস আমার সাথে যেন ভালো ব্যাবহার করে। নাহলে ভবিষ্যতে তোর বাবার এই ব্যবহারের মাশুল তোকে দিতে হবে। সুদে আসলে সব আমার মতো করে শোধ নেবো। ইভান কাউকেই ছেড়ে দেয় না। মনে রাখিস।

বলেই সে চলে গেলো। ঈশা হতভম্ভ চোখে চেয়ে রইল তার যাওয়ার দিকে। #মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১৮

এক বালিশের দুই মাথা ধরে একে অপরের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে ফারিয়া আর জারিফ। জারিফ ধমকের সুরে বলল
–কালকেই তো ওই বালিশে ঘুমিয়েছিলে। আজ কি এমন হল যে আমার বালিশ ধরে টানাটানি করছ।

ফারিয়া মুখ ভার করে বলল
–ওই বালিশে শুয়ে আরাম পাচ্ছিলাম না। তাই আমি এই বালিশে ঘুমাব।

–আর আমি?

জারিফ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করতেই ফারিয়া এক গাল হেসে বলল
–কেন ওই বালিশে ঘুমাবে।

জারিফ বালিশটা ফারিয়ার হাত থেকে টেনে নিয়ে বলল
–আমার বালিশ ছাড়া ঘুম আসে না। তাই আমি আমার বালিশ কাউকে দেই না। তুমি নিজের ব্যবস্থা করে নাও।

বলেই বালিশ ঠিক করে রেখে শুয়ে পড়লো। ফারিয়া মুখ ফুলিয়ে বলল
–আমার সাথে এমন করবে? আমি না তোমার বউ।

জারিফ বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাল। উঠে বসে অবাক সরে বলল
–বউ?

ফারিয়া মাথা নাড়ল। জারিফ একটু ভেবে বলল
–বউয়ের দায়িত্ব কি জানো?

ফারিয়া সরু চোখে তাকাল। সে ভালো করেই বুঝতে পারছে জারিফ তার এই কথার সুযোগ নেবে। জারিফ মৃদু হেসে বলল
–স্বামীর সেবা করা বউয়ের কর্তব্য। আমি ঘুমাব তুমি আমার মাথা টিপে দেবে।

ফারিয়ার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। চেচিয়ে বলল
–অসম্ভব। আমি এটা করতে পারব না।

জারিফ আবারো হাসল। বলল
–ঠিক আছে। তাহলে আজ রাতে আর তোমাকে ঘুমাতে হবে না। জেগেই থাকো। কারন তুমি যদি আমাকে খুশি করতে পারতে তাহলে হয়ত বা আমি তোমাকে বালিশটা দেয়ার ব্যাপারে ভেবে দেখতাম। কিন্তু এখন আর কোন সুযোগ নেই।

বলেই আবারো শুয়ে পড়লো জারিফ। ফারিয়া রেগে গেলো। যার ফলে ঘুম আসছে না তার। বসেই থাকলো অনেকটা সময়। এর মাঝেই জারিফ ঘুমিয়ে গেছে। সারাদিন অফিস করার পর বেশ ক্লান্ত সে। তাই চোখে ভরা ঘুম তার। আর ফারিয়ার মা আর শাশুড়ি আসায় তার কাজ একদম কমে গিয়েছে। নাই বললেই চলে। ফারিয়া উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। নিস্তব্ধ শহর। রাস্তায় দুই একটা কুকুর ডাকছে। সেখানে টুলে বসে গুনগুন করে গান ধরল। বেশ অনেকটা সময় কেটে গেছে সেখানে সে বুঝতেই পারেনি। জারিফের ঘুম হালকা হয়ে যাওয়ায় পাশ ফিরতে গিয়েই গুনগুন আওয়াজ কানে আসলো তার। চোখ মেলে তাকাল। ফারিয়া পাশে নেই। উঠে বসলো সে। বারান্দার দরজা খোলা। বাইরে থেকে ল্যামপোস্টের আলোর লম্বা রেখা মেঝেতে পড়েছে। উঠে সেদিকে গেলো জারিফ। বারান্দার দরজার কাছে যেতেই কানে আসলো এক পরিচিত গানের কথা। বেশ মিষ্টি সরে গুনগুন করে মৃদু আওয়াজে গান গাইছে ফারিয়া। ফারিয়া যে এতো সুন্দর গান গাইতে পারে সেটা জারিফের জানা ছিল না। মুগ্ধ হয়ে শুনছে সে। পিছনে কারও উপস্থিতি বুঝতে পেরে চমকে উঠলো। ভয়ে পিছনে তাকাতেই জারিফ কে দেখে সস্তির নিশ্বাস ফেললো। ঝাঁঝাল গলায় বলল
–এভাবে চুপ করে দাড়িয়ে থেকে আমাকে ভয় দেখানোর মানে কি?

আশ্চর্যজনক ভাবে জারিফ অমায়িক হাসল। বলল
–তুমি এতো সুন্দর গান গাইতে পারো আমাকে বলনি কেন?

ফারিয়া পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। জারিফ আবার বলল
–শুধু সুন্দর কেন তুমি যে গান গাইতে পারো সেটাই তো আমি জানি না। অথচ আমাকে বলা উচিৎ চিল ফারিয়া।

ফারিয়া মাথা বেকিয়ে পিটপিট করে তাকাল। বলল
–এটা আবার বলার কি আছে। আর সেরকম সিচুয়েশন আসেনি তাই বলা হয়ে উঠেনি। এমন অনেক কিছুই আছে যা তুমি জানো না।

জারিফ কোন উত্তর দিলো না। বারান্দায় গিয়ে টুলে বসে পড়লো। ফারিয়া বেশ অবাক হল। জারিফের কাছে গিয়ে বলল
–এখানে বসে পড়লে যে? ঘুমাবে না?

জারিফ ফারিয়ার হাত টেনে বসিয়ে দিলো। আব্দারের সুরে বলল
–একটা গান শোনাবে?

ফারিয়া ভ্রু কুচকে বলল
–অনেক রাত হয়েছে। এখন গান…।

–আমি এই প্রথম তোমার কাছে কিছু চেয়েছি। তবুও না বলবে?

জারিফের কথাটা ফারিয়ার কোথাও আঘাত করলো। এই আবদার ফেরানোর ক্ষমতা তার নেই। মুচকি হেসে গাইতে শুরু করলো পরিচিত এক রবীন্দ্র সঙ্গিত। জারিফ মুগ্ধ হয়ে তার গান শুনছে। মধ্যরাতে ফারিয়ার মিষ্টি কণ্ঠ বেশ লাগছে শুনতে। ফারিয়া আকশের দিকে তাকিয়ে আছে। আর জারিফ ফারিয়ার দিকে। গানের শুরুতেই তার দিকে তাকাতেই জারিফের দৃষ্টি থমকে গিয়েছিল। রাতের আবছা আলোয় রবিন্দ্রনাথের গানের নায়িকার মতো লাগছে তাকে। মনে হচ্ছে নায়িকা যেন নিজেই তার প্রেমের না বলা কথা ব্যক্ত করছে প্রেমিকের কাছে। এভাবে কখনও ফারিয়ার সৌন্দর্য তার চোখে ধরা দেয় নি। সত্যিই ফারিয়াকে জানা তার এখনও বাকি। গান শেষ হতেই জারিফ উঠে দাঁড়ালো। ফারিয়ার হাত ধরে টেনে ঘরে এনে বলল
–অনেক রাত হয়েছে। চল ঘুমাই।

ফারিয়া তাকিয়ে থাকলো শান্ত দৃষ্টিতে। জারিফ বালিশের কথাটা ভুলে গিয়েছে ভেবেই অভিমান হল তার। অভিমানি কণ্ঠে বলল
–আমি ঘুমাব না।

জারিফ বারান্দার দরজা লাগিয়ে ফারিয়ার দিকে ফিরে হেসে বলল
–আমার বালিশটা আজ থেকে তোমার। তুমি ওটাতেই ঘুমাবে।

ফারিয়া যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। অভিমানটা নিমেষেই কেটে গেলো। কিছু না ভেবেই জারিফকে জড়িয়ে ধরল খুশিতে। জারিফ কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো। তার অনুভুতির পরিবর্তনটা সে উপলব্ধি করতে পারছে। কি ভেবে মুচকি হেসে নিজেও জড়িয়ে ধরল ফারিয়াকে।

————-
অফিসের জন্য রেডি হয়ে নাস্তার টেবিলে বসতেই সায়রা এসে দাঁড়ালো নাহিদের সামনে। নাহিদ চোখ তুলে একবার তাকাল। সায়রা বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
–তুই একদিন ছুটি নিতে পারবি?

নাহিদ খেতে খেতে অন্য মনস্ক হয়ে বলল
–এখন মাসের শেষে কাজের অনেক চাপ। কোনভাবেই ছুটি নেয়া সম্ভব না।

সায়রা চেয়ারে বসে পড়লো। হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল
–তাহলে তো অন্য উপায় বের করতে হবে।

কথাটা নাহিদের কানে আসতেই সে ভ্রু কুচকে তাকাল। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–কিসের জন্য উপায় বের করতে হবে? কি হয়েছে?

সায়রা চিন্তিত হয়ে বলল
–ওদের বাসা থেকে ফোন করেছিলো। ওরা খুব তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেরে ফেলতে চায়। তাই দুই একদিনের মধ্যে আমাদেরকে তাদের বাসায় যেতে বলেছে। আংটি পরিয়ে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে আসবো। ভেবেছিলাম তোকে সাথে নিয়ে যাব। কিন্তু তুই তো যেতে পারবি না। তাহলে এখন ভাবতে হবে কে কে সাথে যাবে।

নাহিদ মুখের খাবারটা মুখেই ধরে থাকলো। গভীর ভাবে কিছুক্ষন ভাবল। কথাটা মাথায় ঢুকতেই ঠোটে হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু নিজের কাজে এখন নিজের রাগ লাগছে। আগে সব কিছু না শুনেই কেন বলতে গেলো ছুটি নিতে পারবে না। মৃন্ময়ীকে আংটি পরাতে যাবে অথচ সে থাকবে না। সায়রা সামনের দিকে তাকিয়েই বলল
–দেখি সবার সাথে কথা বলে কাল পরশু একটা দিনক্ষন জানিয়ে দেবো।

নাহিদ মুখের খাবার শেষ করে গলা পরিস্কার করে বলল
–এতো তাড়াহুড়োর কি আছে মা? বললাম তো কাজের অনেক চাপ। দেখা যাবে আমার বিয়ের দিন আমিই ছুটি পাচ্ছি না। তখন কি হবে বলত? ওদের বল নিজেদের মতো প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে। এর মাঝেই আমরা কোন ছুটির দিন গিয়ে আংটি পরিয়ে দিয়ে আসবো।

সায়রা শান্ত চোখে তাকালেন। নাহিদ খাওয়া শেষ করে উঠে দাড়িয়ে বলল
–আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে আমি গেলাম।

বলেই উঠে গেলো সে। সায়রা ছেলের কথা ভাবতে লাগলো। নাহিদ গাড়িতে বসে ফোন বের করে মৃন্ময়ীর নাম্বারে কল করলো। কয়েকবার রিং হয়েও কেটে গেলো। কেউ ফোনটা ধরল না। নাহিদ বেশ বিরক্ত হল। তাই ফোনটা পকেটে ঢুকে রেখে নিজের গন্তব্যে চলে গেলো। কিছু কাজে ব্যস্ত ছিল মৃন্ময়ী। কাজ শেষ করে নিজের ফোনটা হাতে নিতেই নাহিদের নাম্বারটা দেখে থমকে গেলো। সময়টা দেখল প্রায় আধা ঘণ্টা আগে ফোন করেছিলো। নাহিদের নাম্বারের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো ফোনটা করবে কিনা। আবার যদি কোন কারনে ব্যস্ত থাকে আর মৃন্ময়ীর ফোন পেয়ে যদি রেগে যায়। কল দিয়েও কেটে দিলো। তারপর আবার ভাবল কোন জরুরি দরকারে ফোন দিয়েছিল কিনা। সাহস করে আবারো ফোন দিলো। এবার নাহিদ ফোনটা ধরল। নাহিদের কণ্ঠস্বর শুনে মৃন্ময়ী মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–আপনি ফোন দিয়েছিলেন আমাকে?

নাহিদ একটু গম্ভির গলায় বলল
–কেন? আমি কি কোন অন্যায় করে ফেলেছি? ফোন দেয়া ঠিক হয়নি বুঝি?

মৃন্ময়ী ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
–না না সেরকম কিছু না। আমি আসলে জানতে চাচ্ছিলাম কি কারনে ফোন দিয়েছিলেন?

নাহিদ আবারো গম্ভির গলায় বলল
–কারন ছাড়া কি আমি ফোন দিতে পারি না? সব সময় আপনাকে ফোন দেয়ার জন্য কোন কারন কেন লাগবে মৃন্ময়ী?

মৃন্ময়ী বেশ ঘাবড়াল। অবাকও হল বেশ। নাহিদের এভাবে কথা বলার কারন তার মাথায় ঢুকল না। মৃদু কণ্ঠে বলল
–পারেন। আমি সে কথা বলিনি।

ফোনের অপাশ থেকেই মৃন্ময়ীর অবস্থা বুঝতে পেরে নাহিদ মুচকি হাসল। ফোনের এপাশ থেকে মৃন্ময়ী তার কিছুই বুঝতে পারল না। তবে সামনে থাকলে তার এই হাসি দেখে হয়ত রাগ করত। নাহিদ নরম কণ্ঠে বলল
–আপনি কিছু জানেন মৃন্ময়ী?

মৃন্ময়ীর কপালে ভাজ পড়ে গেলো। নাহিদ কি নিয়ে কথা বলছে সেটা মৃন্ময়ী বুঝতে পারছে না। কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো
–কি জানব ঠিক বুঝতে পারছি না?

নাহিদ বিস্ময়মাখা কণ্ঠে বলল
–আপনি সত্যিই জানেন না? নাকি আমার সাথে নাটক করছেন।

মৃন্ময়ী শ্বাস ছাড়ল। বলল
–আমি সত্যিই জানি না।

নাহিদ উতফুল্য কণ্ঠে বলল
–আপনার বিয়ে মৃন্ময়ী। আর আপনি জানেন না? হাউ ইজ ইট পসিবল?

নাহিদের কথা শুনে মৃন্ময়ীর কান গরম হয়ে গেলো। অবিশ্বাসের সুরে মৃদু কণ্ঠে বলল
–মানে?

নাহিদ হেসে ফেললো। বলল
–বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা? আপনার পরিবারের কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে আমাদের বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

লজ্জায় মৃন্ময়ীর গলায় কথা আটকে যাচ্ছে। যেন নাহিদ সামনে দাড়িয়ে এমন কথা বললে সে লজ্জায় মরে জেত নিশ্চিত। ফোনটা কেটে দিলো সে। অজানা এক অনুভুতির সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে মৃন্ময়ী।

———–
মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হয়েছে কিছুক্ষন আগেই। নিয়াজ সাহেব আজ মসজিদে জান নি নামাজ পড়তে। বাসায় নামাজ পড়েছেন। নামাজ শেষ করে সোফায় বসে টিভির রিমোট হাতে নিয়ে অন করতেই তার স্ত্রী রাহেলা এসে বসলেন তার পাশে। ইলু পড়তে বসবে কিন্তু তার আগে প্রতিদিনের রুটিন তার এক কাপ চা খেতেই হবে। তাই আর অপেক্ষা করতে পারছে না। রান্না ঘরে গেলো ঈশার কাছে। সে চা বানাচ্ছে। ঈশার বাবা মেয়ের উপরে রাগ করে আছেন। খুব একটা কথা বলেন না। বাবাকে খুশি করতেই মেয়ের প্রচেষ্টা। বাবার জন্য নিজে হাতে আজ সব খাবার রান্না করবে। সন্ধ্যার নাস্তা থেকে শুরু করে রাতের খাবার পর্যন্ত। ইলু পিছনে দাড়িয়ে বলল
–আপু তোমার চা বানানো এখনও হয়নি? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। পড়তে বসবো।

অনেক্ষন রান্না ঘরে থাকার ফলে ঈশার মেজাজ তেলে বেগুনে জলে উঠলো। পিছনে ঘুরে ইলুকে কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলো। সে তাকে কিছু বলতে চায় না। কারন তার সাথে চেচামেচি করলে সে বাবাকে গিয়ে নালিশ করবে। আর বাবার রাগ কমার বদলে আরও বেড়ে যাবে। তাই নিজের রাগটাকে এখন সংযত করতে হবে। বাবাকে রাগালে বিপদ হয়ে যাবে। এক গাল হাসি দিয়ে বলল
–তুই পড়তে বস। আমি তোর ঘরে দিয়ে আসবো।

ইলু গোল গোল চোখে তাকাল। ঈশার এরকম ব্যাবহার মেনে নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। তার মতো বদ মেজাজি মেয়ে এতো নরম সরে কথা বলছে সেটা ইলু কিছুতেই হজম করতে পারছে না। তারপরেও কিছু না বলে চলে গেলো নিজের ঘরে। ঈশা দুই হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। মাথায় কাপড় দিয়েছে সে। বাবার সামনে একটা কাপ ধরে বলল
–বাবা তোমার চা।

নিয়াজ সাহেব টিভি থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকাল মেয়ের দিকে। তারপর হাতে ধরে থাকা কাপটার দিকে তাকাল গভীর ভাবে। ঈশা অপেক্ষা করছে বাবার কথা শোনার জন্য। ভয় হচ্ছে বাবার রাগ সাংঘাতিক। যদি কথা না বলে। কিভাবে সে বাবার রাগ ভাঙ্গাবে? আর কিভাবেই বা ইভানের প্রতি তার অনুভুতি বাবাকে বোঝাবে।

চলবে……

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here