মেঘবিলাসী পর্ব ৩৫+৩৬+অন্তিম

#মেঘবিলাসী
#israt_jahan_arina
#part_35

আকাশে আজ কালো মেঘ জমেছে। কিছুক্ষণ পর হয়তোবা সেই মেঘ কান্নার রূপ নিয়ে এই শহরের মাঝে ঝরে পড়বে।বাহিরে এলোমেলো বাতাস বইছে।বাতাসে শিউলী ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে।তিন্নির বারান্দায় সে একটা শিউলী ফুল গাছ দেখেছে।ফুলের সুবাস যেনো তার রুমটাকে স্নিগ্ধতায় ছেয়ে রাখে।তাইতো সেও তিন্নির জন্য শিউলী ফুল গাছ এনেছে।বিছানায় এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে জিসান।জিসানের দুই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।

যেই মেয়েটাকে সারা জীবন আগলে রাখতে চেয়েছিলো,আজ নিজেই তার সাথেই এতটা রুঢ় বিহেভ করেছে।তার চোখে অশ্রু ঝরিয়েছে।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।এই মেয়েটার চোখের পানি সে খুব বেশি ঝরতে দেখেনি।মনটা বোধয় পাথরের তৈরি।তবে যত বার এই পাথরের বুক থেকে অশ্রু ঝরেছে,ততবার জিসানের মন ক্ষত বিক্ষত হয়েছে।একজন মেচিউর ছেলে হয়েও কতোবার টিনেজারদের মতো কাজ করেছে।এই মেয়েটার একটা মিষ্টি হাসি তার দিনটাকে উচ্ছ্বাসিত করে তুলতো।

নিজের ভিতরে গিলটি ফিল হচ্ছে। তবে এতো কিছুর মাঝে জিসান একটা জিনিষ খেয়াল করেছে। বিয়ের দিন তার দেওয়া লকেট টা আজ তিন্নির গলায় দেখেছে।আগে কখনো পড়তে দেখেনি।এমনকি তিন্নি সেই টেবিলের ড্রয়ারেই তার দেওয়া লকেট আর দেনমোহরের টাকার খামটা বের করেনি।আজ তার মাথা এতো বেশি গরম হয়েছিলো যে বিষয়টা তখন খেয়াল করেনি।তবে তিন্নি কেনো আজ তা পড়লো?আর এই রূপেই বা কেনো জিসানের কাছে আসলো?

হঠাৎ জিসান সোয়া থেকে উঠে বসলো।তিন্নি তাকে কিছু বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু কি?তিন্নি কি বলতে চায় তা শোনা দরকার ছিলো।
তার পর তার চোখ পড়লো খাটের পাশের টেবিলে।তিন্নির রেখে যাওয়া খামটা সেখানেই আছে।কিছু একটা ভেবে জিসান দ্রুত খামটা হাতে নিলো।খাম খুলে সে একটা চিঠি খুজে পেলো।বেশ কয়েক পাতার।তিন্নি কি তার মনের কথা এই চিঠির মাধ্যমে জিসানকে জানতে চেয়েছে?জিসানের গলা শুকাতে লাগলো।কয়েক বার ঢোক গিলে সে চিঠিটা পড়তে শুরু করলো।

ACP সাহেব,
প্রিয় শব্দটি দিয়ে লেখা শুরু করলাম না।কারণ আদো এই শব্দটা ইউজ করা উচিৎ হবে কিনা জানি না।আমার চিঠি পড়ে সেটা আপনিই নাহয় ডিসাইড করবেন?অনেক সাহস নিয়ে এই চিঠিটা লিখতে বসেছি আজ।
আপনি জানেন আমরা সবসময় যে ভাবে জীবনটাকে ভাবি,ঠিক সেই ভাবে সাজাতে পারিনা।অনেক কিছুই আমাদের হাতে থাকে না।যেমন কোনোদিন আমার আপনাকে এমন চিঠি দিতে হবে তা আমিও ভাবিনি।
আমি জানি বিয়ের পর থেকে আমাকে নিয়ে আপনার মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছে।আমি কেনো আপনাকে মেনে নিতে পারিনি? কেনো আমি সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারিনি?কেনো আমার দিক থেকে আমি কোনো এফোর্ড দেইনি?আপনার সব প্রশ্নের জবাব আমি দিবো।অনেক কথা আমি হয়তো মুখে বলতে পারবো না।তাই লিখে জানাচ্ছি।

বাবা মায়ের ভীষণ আদরের মেয়ে আমি।তবে এই পৃথিবীতে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হলো আমার পাপা।জীবনে কোনো কিছুর অভাব আমি কোনোদিন পায়নি।ছোট বেলা থেকে সব সময় আত্মীয়দের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি।তবে আমি অনেক বেশি চুপচাপ ছোট বেলা থেকে।নতুন মানুষদের সাথে আমি মিশতে পারিনা।তবে ছোট বেলা থেকেই আমি প্রচন্ড জেদি।হয়তো পাপার অধিক ভালোবাসা পেয়ে এমন হয়েছে।

একটু বড় হওয়ার পর থেকেই আমি আমার এলাকাতে অনেক পরিচিত মুখ হয়ে যাই।তার এক মাত্র কারণ হয়তো আমার বাহ্যিক সৌন্দর্য।আমাকে নিয়ে মামনি অনেক বেশি চিন্তিত থাকতো।আমার স্কুলের সকল টিচারের প্রিয় ছাত্রী ছিলাম আমি। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি আমার সুন্দর্য দায়ী না।ক্লাসে অলওয়েস টপ করতাম হয়তো তাই।তবে আমি কোনো দিন বাহ্যিক রূপকে প্রাধান্য দেই না।কারণ যার মন সুন্দর নয় তার সকল রূপও ফিকে হয়ে যায়।

আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি।আমি কৈশোর বয়স শেষে যৌবনে পদার্পণ করেছি।এই সময়টা অনেক মেয়ের জন্য আবেগপ্রবণ হলেও আমার ক্ষেত্রে তা ছিল না। পাপা বরাবর আমাকে রিয়েলিস্টিক হতে শিখিয়েছে।আবেগে ভেসে যাওয়া মেয়ে আমি কখনো ছিলাম না।

প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় একটা ছেলে আমাকে প্রতিদিন ফলো করতো।প্রথম প্রথম না বুঁজলেও পড়ে ঠিক বিষয়টা খেয়াল করতে পেরেছি।ছেলেটার সাথে তার দুইজন ফ্রেন্ডও থাকতো।
একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে ছেলেটা আমার রাস্তা আটকায়।আমি মোটেও ভীতু মেয়ে নই।তাই আমি রেগে বলি

-“কি সমস্যা? রাস্তা আটকে রেখেছেন কেনো?”

ছেলেটা মুচকি হেসে বললো

-“তুমি তিন্নি তাইনা?”

আমি মোটেও অবাক হইনি।এই মর্ডান যুগে কারো নাম বের করা খুব সহজ।যেমন আমি জানি তার নাম রাকিব আজমীর।আমাদের এখানকার কোনো এক বড়ো নেতার ছেলে।নিজেও রাজনীতির সাথে জড়িত।ভার্সিটিতে লেখাপড়া না করে ক্ষমতা দেখিয়ে বেড়ায়।সে এবং তার বন্ধুরা তার বাবার ক্ষমতার জোরে এলাকাতে যা খুশি করে বেড়ায়।আমি বিরক্ত হয়ে বললাম

-“হে,তো?”

-“তো কিছু না।আমি রাকিব আজমীর।তোমরা সাথে আমার কথা আছে।”

-“সরি আমি অপরিচিত কারো সাথে কথা বলিনা।”

-“সমস্যা নেই কথা বললেই পরিচিত হয়ে যাবে।”

-“মানে?”

-“মনে খুব সোজা।আমি তোমাকে পছন্দ করি।”

বিষয়টা আমি আগেই আঁচ করতে পেরেছিলাম।তাই খুব বেশি অবাক হইনি।আমি বললাম

-“কিন্তু আমি আপনাকে পছন্দ করি না।”

-“সমস্যা নেই,পছন্দ হয়ে যাবে।”

-“কখনোই এমন হবে না।”

-“তা দেখা যাবে।”

এর পর থেকে সে আমাকে রাস্তা ঘাটে বিভিন্নভাবে উত্যক্ত করতে শুরু করে।আমি বাসায় কাউকে কিছুই জানায় নি।পাপা চিন্তা করবে তাই।অন্যায় সহ্য করা আমার ধাঁচে নেই।মেয়ে বলে চুপ করে থাকবো তেমন আমি নই।কাউকে পছন্দ করার অধিকার যেমন আমার আছে,তেমনি কাউকে না বলার অধিকার ও আছে।

প্রতিদিনের মতো রাকিব আমার পিছু নিয়েছিলো।আমাকে নানা ভাবে উত্যক্ত করতে শুরু করে।একসময় রাস্তার মধ্যে আমার হাত ধরে ফেলে। রাস্তার আশেপাশে হাজারো মানুষ ছিল কিন্তু কেউ আমাকে হেল্প করতে আসেনি।আমি প্রচন্ড রেগে যাই।এবং রাস্তার মধ্যেই তাকে থাপ্পড় মারি।সেদিন রাগে আমার সারা শরীর কাপছিল।কাউকে পছন্দ করলে এইভাবে উত্যক্ত করা যায়?

আমার সেই থাপ্পড়ের পর বেশ কয়েকদিন আর আমাকে ডিস্টার্ব করেনি। আমি অনেকটা রিলাক্স হয়ে যাই। বিষয়টা মিটমাট হয়ে গেছে ভেবে আমি আর পাপাকে কিছু জানায়নি।
একদিন আমি বিকেলে শপিংয়ে বের হয়েছিলাম। শপিং শেষ করে বাইরে এসে দেখি সন্ধ্যা হয়ে গেছে।সেদিন আমি গাড়ি নিয়ে যাইনি।তাই রিকশা করে বাড়ি ফিরছিলাম।কিছুদুর আসার পর হঠাৎ একটা গাড়ী সামনে এসে দাড়ালো।কিছু বুজে উঠার আগে গাড়ী থেকে তিনজন বের হয়ে আমাকে টেনে হিচড়ে তাদের গাড়িতে উঠালো।ততক্ষণে আমি বুজে গেছিলাম তারা কারা,আর আমার সাথে কি হতে চলছে।
তারা আমাকে একটা বাড়িতে নিয়ে যায়।ততক্ষণে আমার হাত পা তারা বেধে দিয়েছিলো।ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে আসছে।কি করবো কিছু বুজে উঠতে পারিনি।রাকিব সামনে এসে আমাকে অনেক গুলো থাপ্পড় দিতে লাগলো।হয়তো সেই দিনের থাপ্পড়ের প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করছে।”

এতো টুকু পরেই জিসানের শরীর কাঁপতে লাগলো।চোখের সামনে চিঠিটা ঝাপসা দেখতে লাগলো।চিঠিটা আগে পড়ার শক্তি সে কিছুতেই পাচ্ছেনা।তবুও সাহস যোগাড় করে চিঠিটা পড়তে শুরু করলো।

“আজও সেই বিভিৎস রাতের কথা মনে হলে আমার শরীর এখনো কাপে।গলা শুকিয়ে আসে।আমার পুরো পৃথিবীটা ঘুরতে থাকে।
আপনি এখন যা ভাবছেন তাই! হে সেদিন ধর্ষনের শিকার হয়েছিলাম।গণধর্ষণ!রাকিব আর তার দুই বন্ধু।একটা মেয়ের সবচাইতে মূলবান জিনিস সতীত্ব আমি হারিয়েছি সেইদিন।আমি কখনো আপনাকে সেই রাতের বর্ণনা দিতে পারবনা।আমার বুকটা জ্বলে যায় সেই রাতের কথা মনে পড়লে।
সৌন্দর্য মেয়েদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হলেও আমার জন্য ছিল অভিশাপ।সৌন্দর্য্য আমার জীবনটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।সেদিন শুধু আমার সতীত্ব যায়নি,আমার আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা সব হারিয়েছি।সমাজের চোখে আমি হয়ে উঠেছি সবচাইতে ঘৃণার পাত্র।

মাঝরাতের দিকে তারা আমাকে রাস্তায় ড্রেনের পাশে ফেলে যায়।তখনও আমি পুরোপুরি জ্ঞান হারাই নি। আমি আশেপাশের সব কিছু ঝাপসা দেখছিলাম। কোথায় আছি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। পুরো শরীর জুড়ে আমার যত না ব্যথা ছিল তার চেয়ে বেশি ব্যথা হচ্ছিল আমার মনে। আমি চিৎকার করে কাউকে ঢাকতে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু টু শব্দ টা পর্যন্ত মুখ দিয়ে বের করতে পারছিলাম না। আমার দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। এঅবস্থায় কতক্ষণ সেখানে পড়েছিলাম আমি জানিনা।

একজন মধ্যবয়স্ক লোক তার ওয়াইফ কে নিয়ে হয়তো সকালে হাঁটতে বের হয়েছে। রাস্তার পাশে আমাকে দেখে।আমার গায়ের জামা অনেক জায়গাতেই ছেড়া ছিলো।মহিলাটি তার নিজের গায়ের ওড়না দিয়ে আমাকে ঢেকে দিয়েছিল।তারা দ্রুত আমাকে হসপিটালে নিয়ে যায়। তারপর ঠিক কত সময় পর আমার জ্ঞান ফেরে আমি জানিনা। তবে আমি চোখ খুলে আমার সামনে পাপাকে দেখতে পেয়েছি।ফ্যালফ্যাল চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। দুচোখ বেয়ে তার অশ্রু ঝরছিল।কারণ সারা জীবন তিনি যে মেয়েকে ফুলের মতো আগলে রেখেছে সেই মেয়েরি কষ্ট বেদনা সহ্য করতে পারছিল না। অধিক শোকে হয়তোবা পাথর হয়ে গেছেন। আর আমার মামনি আমার পায়ের কাছে বসে মুখ গুঁজে কাঁদছেন। বিশ্বাস করুন, সেদিন আমার কাছে নিজের শারীরিক যন্ত্রণার চাইতে এই দুজন মানুষের চোখের জল বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছিলো।

আমাকে তিন দিন পর বাসায় আনা হয়।তখন জেনেছি সেই বয়স্ক দম্পতি আমার কাছথেকে নাকি পাপার নম্বর নিয়েছিলো।তবে এমন কিছুই আমার মনে নেই।তখন আমার বাসার পরিবেশ ছিলো অন্যরকম।পাপা মামনি আমাকে সব সময় খুশি রাখার চেষ্টা করেছে ।কিন্তু আমি আমার মধ্যে ছিলামনা।।আমিতো তখন সজ্ঞানে ছিলাম না,তাই কিছুই মনে পড়ছেনা।নিজেকে ঘর বন্ধ করে নিয়েছিলাম।আমার রুমে সূর্যের আলো টুকু সহ্য করতে পারছিলাম।নিজের প্রতি কেমন ঘৃণা হতে লাগলো। আমি অনেক মর্ডান ফ্যামিলিতে বড়ো হলেও ওই সময় গুলিতে আমি অনেক চিপ চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করি।

পাপা তার এক বন্ধুর সাথে কথা বলে।তিনি ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা।আমার সম্মানের কথা ভেবে পাপা গোপনে রাকিব এবং তার দুই বন্ধুর নামে কেস করে।তাদের গ্রেফতার করা হয়।পাপার বন্ধু পাপকে জানায় রাকিবের বাবা রফিকুল আজমীর বিশাল বড় নেতা।তার ক্ষমতার কাছে আমরা পারবোনা।হলো তাই।রাকিবের বাবা নিজের ক্ষমতার জোড়ে ছেলেকে জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন।সেই থানার ওসিকে টাকা দিয়ে কেসটা দামা চাপা দিতে বলেছেন।পাপা অনেক চেষ্টা করেও তার মেয়ের অন্যায়কারীদের শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি।সে দিন আমি প্রথম পাপকে অসহায় হতে দেখেছি।ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়তে দেখেছি।তবুও চেষ্টা করতে দেখেছি।তারা হসপিটালে যেয়ে পাপকে কেসটা তুলে নিতে হুমকি দিতে শুরু করে।মামনিকে রাস্তা ঘাটে ভয় দেখায়।তখন আমাদের জীবনে দুর্বিসহ নেমে আসে।আমার সম্মান যেনো ক্ষুণ্ণ না হয় তাই কোনো রেলিটিভ এর সাহায্য নিতে পারছিলো না।

এই সব স্ট্রেস নিতে না পেরে আমি একটা খারাপ কাজ করে বসলাম।সুইসাইড আটেম্প নিলাম।অনেক গুলো স্লিপিং পিল নিলাম।কিন্তু মরতে পারিনি মামনি আমাকে সঠিক টাইম হসপিটালে নিয়ে আসে।সে দিন আমি পাপাকে হাউমাউ করে কাদতে দেখেছি।আমার এই কাজে পাপা ভেঙে পড়েছে।নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছিল।আমার জন্য আমার পুরো পরিবার সাফার করেছে।

আমাদের সমাজের নিয়ম আলাদা।ধর্ষিতাকে সমাজের মানুষের লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়,আর ধর্ষকরা সমাজে বুক ফুলিয়ে বাঁচে।পাপা কখনো চাইতোনা আমি সমাজে নিচু হয়ে বাচি।
পাপা তখন ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েছিল।তখন আমার পুরো পরিবারের সাপোর্ট সিস্টেম হয়ে উঠলো আমার মামনি।সবাইকে স্বাভাবিক লাইফ ফিরিয়ে আনতে নিজেকে শক্ত করে নিলো।আমি তত দিন স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম।করো সাথে কথা বলতাম না।নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম।

পাপা আমার সাথে কথা বলতে পারতনা।আমাকে দেখেই তার চোখ ভিজে উঠতো।ভয়ে আমি বাসার বাহিরে বের হতে পারতাম না।তামিম তখন অনেক ছোট।তামিমকেও আমি সহ্য করতে পারতাম না।পুরো পৃথিবীটা আমার কাছে বিষাক্ত মনে হতো।আমার সাথে এমন কেনো হলো বলতে পারেন? আমার অপরাধ কি ছিলো?এক নিমিষেই আমার সব স্বপ্নকে কেনো ভেঙে দিয়েছিলো তারা?

অনেকটা দিন কেটে যায়। আমার স্কুলের টিচাররা আমার সাথে দেখা করে আবার স্কুলে যাওয়ার কথা বলে।তারা এই বিষয়টা জানেনা।পাপা হয়তো কিছু একটা বুঝিয়েছে।আমি ক্লাস করতে রাজি হয়নি।তবে এক্সাম দিবো বলেছিলাম।আসলে সেই মুহূর্তে আমার জীবনের কোনো লক্ষ্য খুজে পাচ্ছিলাম না।

পাপকে ভীষণ অস্থির দেখাতো তখন।হয়তো আমার পরিস্থিতি তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না।আর রাকিবরাও তখন বাহিরে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।যা আমি বা আমার পরিবার মেনে নিতে পারছিলাম না।।মামণি সবার সামনে স্বাভাবিক থাকলেও ভিতরে ভিতরে মরে যাচ্ছে।

একদিন সকালে বসে নাস্তা করছিলাম।হঠাৎ টিভিতে একটা সংবাদ শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই।আমার দু চোখ ভিজে উঠে।এটা কি করে হতে পারে?#মেঘবিলাসী
#israt_jahan_arina
#part_36

বাহিরে ঝড়ো হাওয়া বইছে।শীতল ঠান্ডা আবহাওয়ার মাঝে জিসান দর দর করে ঘামছে।তার গায়ের টি শার্ট ঘামে ভিজে একাকার।বুকের বাপাসে তীব্র ব্যাথা হচ্ছে।মনে হয় কেউ খামচে ধরে আছে।তার হাতের চিঠিটা আর পড়তে পারছেনা।কারণ সে সব ঝাপসা দেখছে।গলাটাও প্রচন্ড শুকিয়ে গেছে।পানি দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নেয়া প্রয়োজন।

জিসান একগ্লাস পানি পান করে ওয়াস রুমে যেয়ে মুখ ধুয়ে নিলো।মিররে নিজের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো।তার কি আসলেই তিন্নির হাসবেন্ড হওয়ার কোনো যোগ্যতা আছে?এতো দিন পাশে থেকেও সে মেয়েটার মনের দুয়ার খোলা তো দূরে থাক,দরজার তালাটা অবধি খুলতে পারেনি।সে মনে কতটা যন্ত্রণা নিয়ে হাসি মুখে তার সামনে ঘুরে বেরিয়েছে।অথচ সে তার মনের যন্ত্রণার কোনো আভাস পায়নি।হঠাৎ জিসান হাউমাউ করে কাদতে শুরু করে।সে জীবনে কবে এই ভাবে কেঁদেছে তা ঠিক মনে করতে পারছেনা।ছেলেদের মন নাকি শক্ত হয়।কই সে তো তিন্নির চাইতে বেশি শক্ত হতে পারছেনা।তার সব কিছু ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সে আবার চিঠিটা হতে নিলো।চিঠিটার অনেক জায়গাতে কালি লেপ্টে গেছে।জিসানের আর বুঝতে বাকি নেই যে তিন্নি চোখের জল পড়ে কালি ছড়িয়ে পড়েছে। সেই বিভৎস দিনটা মনে করতে নিশ্চয়ই তার প্রিয়তমার মনটা বার বার ভেঙে পড়েছে।জিসান আবার চিঠিটা পড়তে শুরু করলো।

‘ টিভিতে নিউজ চলছে, বিশিষ্ট নেতা রফিকুল আজমীর ছেলে রাকিব আজমীরের গত রাতে আকর্ষিক মৃত্যু ঘটে।তার নিজ ফ্ল্যাটে সে এবং তার দুই বন্ধুর মৃত দেহ পাওয়া যায়।পুলিশ ধারণা করছে ড্রাগ এর ওভার ডোজের কারণে তাদের মৃত্যু হতে পারে।তারা নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের ড্রাগ নিতো বলে জানা গেছে।’

এই খবরটা শুনে আমি প্রচন্ড ভাবে অবাক হই।পাশে মামনি ও অবাক চোখে দাড়িয়ে আছে।তার চোখ অশ্রু।সেটা ছিল আনন্দ অশ্রু।আমি দৌড়ে পাপার রুমে যাই।পাপা হসপিটাল থেকে ভোর রাতের দিকে বাসায় ফিরে ঘুমাচ্ছে।পাপাকে দেখে আমি অবাক হই।আজ অনেক দিন পর পাপকে ভীষণ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেখেছি।

জানেন আমরা মেয়েরা প্রত্যেকে জীবনে একজন হিরোর অপেক্ষায় থাকি।হয়তো আমিও করতাম।যে আমাদের জীবনটাকে বদলে দিবে।যে আমাদের পদতলে পৃথিবীর সব সুখ এনে দিবে।তবে সেই সময়টায় আমার জীবনেও আমার সেই হিরোর দেখা পাই।সেটা আর কেউ না আমার পাপা। হে আমার পাপা।আমি ঘুমন্ত পাপকে ঝাপটে ধরি।আজ অনেকদিন পর পাপার বুকে মাথা গুঁজে দিয়েছি।মনে আমার প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেছে।পাপার ঘুম ভেঙে যায়।আমাকে তার বুকে দেখে নিজেও আরো শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে।আমি ফুপিয়ে কেঁদে উঠি।আর পাপা কে বলি

-“এই সব তুমি করেছো তাইনা পাপা?”

পাপা আমাকে কপালে চুমু খেয়ে বলে

-“আজ প্রায় আট মাস পর আমার মেয়েটা আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।আমার কিযে ভালো লাগছে বলে বুঝাতে পারবো না।”

-“কেনো করতে গেলে এইসব?যদি তোমার কিছু হয়ে যেত?”

-“আমার মায়ের জন্য আমি সব করতে পারি।আমার মেয়েকে কষ্টে রেখে তারা স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়াবে তা হয়না।তুমি কোনো অপরাধ করনি,তবে কেনো তুমি ঘরের কোন পরে থাকবে?আমার মেয়ে এই সমাজে মাথা উচু করে বাঁচবে।কেউ তোমার দিকে আঙুল তুলতে পারবে না।তারা তাদের অপরাধের সাজা পেয়েছে।আমাকে কথা দাও মা তুমি সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে জীবন টাকে উপভোগ করবে?কোনো অন্ধকারকে তুমি তোমার জীবনের বাধা হয়ে দাঁড়াতে দিবে না?”

সেদিন পাপার বুকে মাথা রেখে আমি শেষ বারের মতো কেঁদেছিলাম।আমি ভয়ে যখন স্কুলে যেতে পারতাম না।তখন পাপা আমাকে নিজে নিয়ে যেতো।আমি ভয়ে রাস্তা পর্যন্ত পার হতে পারতাম না।মনে হতো এই বুঝি তারা আবার আসবে।আমার এই বিপর্যস্ত অবস্থা পাপা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না।পাপা অনেকবার থানায় যায় রাকিবকে পুনরায় যাতে গ্রেফতার করে।কিন্তু পুলিশ ক্ষমতার আর টাকার কাছে বীকে গেছিলো।দিনের পর দিন থানার চক্কর কাটিয়েও আমরা কোনো বিচার পাইনি।তখন আমার চাইতে পাপাই বেশি ডিপ্রেসন চলে যায়।অনেক ভেবে চিন্তে পাপা ঠিক করে নিজেই তাদের শাস্তি দিবে।

পাপা রকিবদের বেশ কিছুদিন ফলো করে।তারা নিয়মিত ড্রাগ নিতো।সেইদিন তারা ড্রাগ নিয়ে বাসায় ফিরছিল।রাস্তায় পাপা তাদের গাড়ি দার করায়।রাকিব পাপা কে দেখে বিভিন্ন খারাপ কথা শুরু করে।আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলতে থাকে।আসলে সে ততটা সেন্সে ছিল না।যেই সুযোগে পাপা তাদের এক ধরনের ড্রাগ তাদের শরীরে পুষ করে দেয়।তারা কেউ কিছুই করতে পারেনি।তারা প্রচন্ড ড্রাংক ছিলো।পাপা সেখান থেকে চলে আসে।তারাও ড্রাংক অবস্থায় তাদের ফ্ল্যাটে চলে আসে।প্রায় ঘন্টা খানেক পর সেই ড্রাগ রিয়াকশন শুরু হয়।তারা তিনজনই ওভার ডোজের জন্য মারা যায়।একজন ডক্টর হওয়ার সুবাদে এই ধরনের ড্রাগ সম্পর্কে সব কিছুই জানতো।পাপা কে সন্দেহ করার কোনো উপায় ছিল না।

সেই দিনের পর থেকে আমার জীবনটা পুরো পুরো বদলাতে শুরু করে।রাকিবদের মৃত্যু আমার ভিতরে এক অদৃশ্য শক্তির সঞ্চার করে।আমি ভীষণ কনফিডেন্ট হতে শুরু করি। এর পরের যুদ্ধটা শুরু হয় আমার নিজের সাথে।জীবনে আমার তখন একটাই লক্ষ্য একজন ডক্টর হয়ে মানুষের সেবা করা।সে দিনের পর থেকে আমি আরো জেদি হয়ে উঠি।নিজের মনটাকে শক্ত করতে শুরু করি।সব সিচুয়েশনে নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করি।কারণ আমাকে সুন্দর ভাবে বাঁচতে হবে।পাপা আর মামনির জন্য।আমি লেখাপড়ার মাঝে ডুবে যেতে থাকি।তবে আমার জীবনের ওই অন্ধকার রাতকে আমি কিছুতেই ভুলতে পারিনা।

এই সব কিছু থেকে বেরিয়ে আসতে আমার তিনটা বছর সময় লেগে যায়।এই তিন বছর পর নিজেকে আয়নায় দেখলে অনেক তফাৎ খুঁজে পাই।কোনো কষ্টই আমাকে ছুঁয়ে যেতে পারে না।আসলে অনুভূতি জিনিসটাকে নিজের মনের মাঝে মেরে ফেলেছিলাম।আজ আমি অন্য তিন্নি।তার ছোট খাটো কষ্টে চোখে জল চলে আসে না।নিজেকে সব দিকথেকে পারফেক্ট করতে যেয়ে কেমন অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছি।

একদিন হঠাৎ পাপা আমার বিয়ের বিষয় বললো।আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম আমার এই অন্ধকার জীবনের সাথে কাউকে জড়াব না।জীবনের বাকিটা সময় একাই কাটাতে চেয়েছি। ঐযে বললামনা আমি প্রচন্ড জেদি হয়ে গেছিলাম।পাপা আর মামনি আমাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারছিলো না।তবে তারা এতো জলদি আমার বিয়ে নিয়ে ভাববে আমি চিন্তা করিনি।মূলত ফুপা আপনার কথা পাপা কে বলার পর থেকে পাপা আমাকে বিয়ের জন্য প্রেসার দিতে থাকে।নিজের মেয়ের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছে পাপা।আমি সবার সাথে যুদ্ধ করতে পারলেও পাপার সাথে পারিনা।

যেই দিন প্রথম আপনি আমাদের বাসায় আসেন,সেই দিন আমি আপনাকে সব সত্যি বলে দিবো বলে ঠিক করি।কিন্তু আপনাকে প্রথম দেখে আমি দ্বিতীয় বার চোখ তুলে দেখার সাহস পাইনি।কারণ কাউকে ভালোবাসার যোগ্যতা আমার নেই।করো স্ত্রী হবার যোগ্যতা নেই।আমি কিছুতেই দুর্বল হতে চাইনি।

যে দিন আমাদের একা কথা বলতে পাঠানো হয় সেই দিন পাপা আমাকে কোনো কিছু জানতে মানা করে।যদি আমি আপনাকে কিছু বলি তবে সে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করে রাকিব ও তার বন্ধুদের মৃত্যুর কারণ বলে দিবে।পাপার এই হুমকি শুনে আমি অনেক অবাক হয়েছিলাম ।বিশ্বাস করুন সেই দিন প্রথম আমার পাপা কে ভীষণ স্বার্থপর মানুষ মনে হয়।যে নিজের মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে অন্য কাউকে ঠকাতে পারছে।আমি আমার নিজের পাপাকেই চিনতে পারছিলামনা।

আমাদের বিয়ের দিন রাতে আপনি আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছেন কিন্তু আমি কিছুই বলিনি।আমি তখন আমার মাঝে ছিলামনা।নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছিলো।আমি কিছুতেই আপনার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলনা।তার পর বেশ কয়েক দিন আমি আপনার সামনে পর্যন্ত আসিনি।পালিয়ে বেড়াতে চেয়েছি।আমি আপনাকে ঠকাতে চাইনি।পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমি এমন করেছি।আমি সব সময় আপনার সাথে দূরত্ব বজায় রাখতে চেয়েছি।যাতে আমি আপনার প্রতি দূর্বল না হয়ে পড়ি।

আমি নিজেকে কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাইনি।তবুও জড়িয়ে গেছি।আর আপনাকে এতো ভালো হতে কে বলেছে?কেনো আমার এতো কেয়ার করেছেন?কেনো আমাকে এতো সম্মান দিয়েছেন?কেনো আমাকে কোনো কিছুতে জোর করেননি?কেনো আমার উপর কোনো অধিকার দেখাননি?এই সব না করাতে আমি আপনার উপর দুর্বল হয়ে পড়েছি।আপনার পাশে আমি কোনো মেয়েকে সহ্য করতে পারিনা।কেমন চিপ মেন্টালিটির হয়ে পড়েছি।আমি যতবার এই সম্পর্কটাকে ঠিক করতে এক ধাপ আগাতে চেয়েছি ততবার আমার অতীত আমাকে কয়েক ধাপ পিছিয়ে দিয়েছে।আমার ভীষণ ভয় হতে শুরু করে।আপনাকে হারাবার ভয়।আমার সাথেই কেনো এমন হয় বলতে পারেন?

সেদিন আমি খুব সুন্দর একটা সময় কাটিয়েছি।আপনার সেট কাটানো প্রতিটা সময়ই অমর জন্য সুন্দর।আমি সব যন্ত্রণা ভুলে যাই।কিন্তু সন্ধায় রেস্টুরেন্টে টিভিতে একটা নিউজ দেখে আমি আবার আমার অতীতে হারিয়ে যেতে থাকি।সেখানে রাকিবুল আজমীরের নির্বাচন প্রচারণা চলছিলো।এই মানুষটাকে দেখে রাকিব নামক জানোয়ারের মুখটা ভেসে উঠেছে।তাই আমি সেদিন চলে এসেছি।আপনার মুখোমুখি হতে চাইনি।আপনার সামনে নিজের দুর্বলতা দেখাতে চাইনি।তবে সেদিন আমার প্রচন্ড গিলটি ফিল হয়েছে।আমি স্বার্থপরের মত আপনাকে আমার মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছি।

আমি জানি আপনি আমাকে ভালোবাসেন।সেটা আমি আগেই বুঝেছি।আর সেটা বোঝার পর থেকে অপরাধবোধ আমাকে আরো ঘিরে ধরেছে।

তবে শত চেষ্টা করেও আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি।আমার অন্ধকার অতীত জেনেও স্বার্থপর হয়ে আজ আপনাকে বলতে ইচ্ছে করছে , ACP সাহেব , I fall in love with you. কবে,কখন তা জানিনা।আপনাকে প্রথম দেখে আমার হৃদয় স্পন্দন কয়েক মুহূর্তের জন্য থেমে গেছিলো।আর ধীরে ধীরে আমি না চাইতেও আপনাকে প্রচন্ড ভালোবসে ফেলেছি।আপনার স্ত্রী হতে পেরে আমার জীবন সার্থক।আমি সারা জীবন আপনার সাথে কাটাতে চাই।আপনার সাথে সংসার করতে চাই।

দেখেছেন আমি কেমন আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছি।আমি জানি আপনাকে ভালোবাসার কোনো যোগ্যতা আমার নেই ।আপনি ভালো কাউকে ডিজার্ভ করেন।তবে বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার শক্তি আমার আছে।আপনি আমার অতীত জেনে যে ডিসিশন নিবেন আমি তার সম্মান করবো।আমি আমার জীবনে দুজন শুদ্ধতম পুরুষের সন্ধান পেয়েছি। এক আমার পাপা আর অন্য জন আপনি।আপনি সারাজীবন আমার মনের বিশেষ স্থানে থাকবেন।
ইতি
আপনার স্ত্রী

চিঠিটা পড়ে জিসানের কেমন অনুভূতি হচ্ছে তা সে বলতে পারবে না।তিন্নির জীবনের দুর্ঘটনা তার মনকে ক্ষত বিক্ষত করছে।আর অন্য দিকে মনের কোন সুখ অনুভূতি হচ্ছে এটা জেনে তার সেই কাঙ্খিত মানুষটিও তাকে ভালোবাসে।#মেঘবিলাসী
#israt_jahan_arina
#last_part

বাহিরে তুমুল ঝড় বইছে।এই ঝড়ে বাহিরের সবকিছুকে দমিয়ে রাখতে পারলেও এই প্রেমিক পুরুষকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।কোনো বাধা তাকে আজ তার প্রিয়তমার কাছে যেতে আটকাতে পারবেনা।জিসান এই বৃষ্টির মধ্যে ড্রাইভ করছে আর ভাবছে তিন্নিকে আজ সে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।নিজের গালে কষিয়ে দুইটা থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে।তার পুতুলের মত বউটাকে কাদিয়েছে।আজ মা বেচে থাকলে এই অপরাধের জন্য খুন্তি দিয়ে পিটাত।আর বলতো

-“বলদের বাচ্চা বলদ।আমার পরীর মতো বৌমার চোখ দিয়ে পানি ঝরিয়েছে?তোর আজ থেকে পানি খাওয়া বন্ধ।পানি পিপাসা পেলে তিন্নির চোখের ঝরা পানি খাবি।একটু নোনতা লাগবে।কিন্তু কিছুই করার নেই।এটাই তোর শাস্তি।যা তিন্নির চোখের সামনে গ্লাস ধরে বসে থাক।”

এসব ভেবে জিসান মনে মনে হেসে দিলো।আজ তার বউ যেই সাজে এসেছিলো, সব ঠিক থাকলে আজ সে তিন্নির পারমিশন ছাড়াই একটা গভীর চুমু খেয়ে নিতো।এই মেয়ে আমাকে সারা জীবন এই ভাবেই অনুভূতির তাণ্ডবে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে ছাড়বে।তবে আমিও আর ছার দিচ্ছি না।আমার অনুভূতির জালে ফাঁসাবো তাকে।সারা জীবনেও এই জাল ভেদ করতে পারবেনা।

এতো সব ভাবনার মাঝে রিয়াজ তাকে কল করলো।
জিসান কল রিসিভ করতেই রিয়াজ বললো

-“জিসান আমাকে বাঁচা।”

রিয়াজের এমন কথায় জিসান কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো।সে বললো

-“কি হয়েছে রিয়াজ ভাই?”

-“তোর এই আধা পাগল ফ্রেন্ড প্রেগনেন্ট হওয়ার পর পুরা পাগল হয়ে গেছে।”

-“আবার কি করেছে?”

-“এই মেয়ে আমার মাথা পাগল করে দিয়েছে।রাত বিরাতে আমাকে জাগিয়ে বলে কিনা তার আইসক্রিম,চকলেট কেক খেতে মন চায়।আমি গভীর রাতে এই সব আনতে যাই।কিন্তু আজ বলে কিনা ফুচকা খাবে।তুই বল এই বারোটা বাজে আমি কোথা থেকে ফুচকা আনব? ওইসব নাহয় ডিপার্টমেন্ট স্টোরে পাওয়া যায়।কিন্তু ফুচকা?আমার কাল সকালে মিটিং।কিন্তু আমি ঘুমাবো কি করে।কিছু বললে বলে আমার না বাচ্চার খেতে মন চায়।তুই বল আমার মতো ACP কে কিনা ব্ল্যাকমেইল করে।ভীষণ প্যারায় আছি।”

জিসান হোহো করে হেসে দিল। এই দুইজন জীবনে শোধরাবে না। আচ্ছা তিন্নি যখন প্রেগনেন্ট হবে সেও কি এমন করবে?

-“রিয়াজ ভাই কিছু করার নাই। বউ আপনার সামলানোর দায়িত্ব আপনার। তবে আমি একটা হেল্প করতে পারি। অনলাইনে অর্ডার করেন। বৃষ্টির দিন তো একটু রিকুয়েস্ট করে দেখেন।”

-“আসলেই তো এটা তোমার মাথায় ছিল না?”

এমন সময় সূচনা রিয়াজের থেকে ফোন নিয়ে বলতে শুরু করলো

-“দেখলি জিসান আমাকে এই ব্যাটা খওয়ার খোটা দেয়। আমি যদি একবার বাবাকে জানাই তাহলে কালই আমাকে এখন থেকে নিয়ে যাবে।পড়ে কিন্তু এই বেটাই কেঁদে কেটে শেষ হয়ে যাবে।”

-“তোরা একটু কম ঝগড়া করতে পারিস না?”

-“ইসস নেকা!আর তোরা কি করিস?দুইজন তো দুই প্রান্তে থেকেও কোল্ড ওয়ার করিস।’

জিসান হেসে বললো

-“আজ থেকে কোনো ওয়ার হবে না।শুধু ভাব বিনিময় হবে।”

-“তাই নাকি?এই তুই কই?এই বৃষ্টির মধ্যে বাহিরে কি করিস?”

-“আমার পরীকে আনতে যাই।পরীটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তো,তাই রাগ ভাঙাতে যাই।”

-“আরে মজনু।তলে তলে এতো দূর? তা তোর জেদি পরী যদি না আসে?”

-“তুলে নিয়ে আসবো।”

-“বেস্ট অফ লাক।যা মজনু লাইলীর কাছে যা।”

-“নিজের খেয়াল রাখিস।আর রিয়াজ ভাইকে বেশি করে টাইট দিস।আমাকে কয়দিন অনেক খাটিয়েছে।”

-“কি এই বেটার এতো সাহস? দারা এই বেটার খবর নিতেছি।”

জিসান কল কেটে আবার ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিলো।আজ রাস্তাটা এতো লম্বা মনে হচ্ছে কেনো।ভীষণ অস্থির লাগছে। এক নজর তিন্নিকে না দেখা পর্যন্ত কিছুতেই এই অস্থিরতা কমবে না।

প্রায় সাড়ে বারোটার দিকে জিসান তিন্নির বাসায় পৌঁছলো।তিন্নির বাবা মাকে কি জবাব দিবে।অনেক দ্বিধা নিয়ে সে ডোরবেল চাপলো।কিছুক্ষণ পর দরজা খুললো তিন্নির বাবা।জিসান কি বলবে বুঝতে পারছেনা।একেতো তিন্নি তার বাসা থেকে চলে এসেছে,তার উপর এতো রাতে সে এখানে এসেছে।নিশ্চয়ই তার উপর অনেক রাগ করবেন।তিন্নি তার প্রাণ ।আর সে তার প্রাণটা কে কষ্ট দিয়েছ। বাবা যদি তাকে তিন্নির সাথে দেখা করতে না দেয়। তবে জিসানকে অবাক করে দিয়ে তিন্নির বাবা হাসিমুখে জিসানকে বাসার ভেতরে আসতে বললেন।

আনিসুর রহমান আর জিসান মুখোমুখি বসে আছে। দুজনের মধ্যে এই কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করল। আনিসুর রহমান বলতে শুরু করল

-“তিন্নিকে ঘিরে আমার পুরো পৃথিবী। মেয়েটাকে অনেক আদরে বড় করেছি আমি। সব সময় আগলে রাখতে চেয়েছি। কিন্তু শেষ অবধি পারিনি।”

কথাটা বলেই আনিসুর রহমান করে কেঁদে উঠলেন। জিসানের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আনিসুর রহমান আবার বলতে শুরু করলেন

-“একটা বাবার জন্য এটা কতটা কষ্টের সেটা আমি হয়তো তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। মেয়েটাকে যখন হসপিটালে বিভৎস অবস্থায় দেখেছিলাম সেদিন আমার বুকটা জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে গেছিল। যে মেয়েটাকে কোনদিন আমি ফুলের টোকাও লাগতে দেই নি, সে মেয়েকে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় আমি হসপিটালে পড়ে থাকতে দেখেছি। আমার মেয়েটা ভেতর থেকে সেদিনই মরে গেছিল।যে মেয়ে প্রতিদিন আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতো, সে আমার সাথে পুরো আট মাস কোন কথা অব্দি বলেনি। আমার মেয়েটার আরো ভেঙে পড়েছিল রাকিব এর কোন বিচার না পেয়ে। জানোয়ারটা অন্যায় করে বুক ফুলিয়ে আমার বাসার সামনে দিয়ে হেঁটে যেত। বাবা হয়ে কিভাবে সহ্য করি আমি সেটা? এই জানোয়ারগুলোকে নিজেই শাস্তি দিয়েছি।

তবে সবকিছুর মাঝে আমি তোমার সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি। তিন্নির ফুপা যখন তোমার বিষয়ে আমাকে বলেছিল। বিশ্বাস করো বাবা, আমার মনে হয়েছিল একমাত্র তুমি পারবে আমার মেয়েটাকে সুখে রাখতে। তাকে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে।আমি নিজেই সব বিষয় তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি তো বাবা, নিজের মেয়ের সুখের কথাটা আমার মাথায় আগে এসেছে। ভীষণ স্বার্থপর হয়ে গেছিলাম।তোমার মত ছেলেকে ঠকিয়ে আমি কোন মতে সস্তি পাচ্ছিলাম না।আর না আমার মেয়েটা।

তোমাদের বিয়ের পর থেকে তিন্নির মধ্যে আমি অনেক পরিবর্তন দেখতে পেয়েছি।মেয়েটা আমার আগের মতো হাসি খুশি থাকতে শুরু করেছে।আমি জানি আজ তিন্নি তোমাকে সব সত্যি জানতে গেছে।কিন্তু মেয়েটাকে যখন বাসায় ফিরে আসতে দেখলাম অনেকটা ভয় পেয়ে গেছিলাম।আর তিন্নির মুখ দেখে ভয়টা আরো প্রকট আকারে ধারণ করেছে।

আমাকে মাফ করে দিও।তোমার জীবনটা নষ্ট করার কোনো অধিকার আমার নেই।তুমি যা চাও,আমরা তাই মেনে নিবো।
এবার জিসান তিন্নির বাবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার হাতে হাত রাখলো,আর বললো

-“বাবা আপনি কোনো ভুল করেননি।বরং আপনি আমাকে আপনার সবচাইতে দামী জিনিসটা গিফট করেছেন। এর মূল্যায়ন আমি সারা জীবন করবো।আর তিন্নির সাথে যা হয়েছে তাতে তিন্নির কোনো দোষ নেই।আর ওই জানোয়ারদের সাথে যা হয়েছে ভালো হয়েছে।সব বাবারা যদি আপনার মত তার মেয়েদের সাপোর্ট করতো,তবে কোনো মেয়ের জীবন ঝরে পড়তো না।
তিন্নিকে আমি সারা জীবন আগলে রাখতে চাই।হয়তো আপনার মতো তাকে ভালবাসতে পারবো না,তবে আমার সর্বস্ব দিয়ে তিন্নিকে ভালোবাসবো।”

তিন্নির বাবা জিসানকে জড়িয়ে ধরলেন।
তিন্নির রুমের সামনে দাড়িয়ে আছে জিসান।ভিতরে যেতে তার ভীষণ ভয় হচ্ছে।মনে মনে সে নিজেকেই গালি দিচ্ছে।একজন ACP হয়ে পিচ্চি মেয়েটা কে ভয় পাচ্ছে।আজ এই পিচ্চির কোন কথাই শুনবে না। সোজা তুলে নিয়ে যাবে।
তিন্নির রুমের দরজা লক করা ছিলো।তিন্নির বাবা নিজেই তাকে তিন্নির রুমের চাবি দিয়েছে।তিন্নি নাকি জিসানের বাসা থেকে ফিরে দরজা লক করে বসে আছে।

ধীরে ধীরে দরজা খুলে জিসান বেশ অবাক হলো। পুরো রুম অন্ধকার। বারান্দার কাচ টা খোলা তাই বাইরে ঠান্ডা হাওয়া রুমটাকে শীতল করে রেখেছে। জিসান তিন্নির রুম এর লাইট অন করে পিছনে তাকাতেই চমকে উঠলো। তিন্নি ফ্লোরে বসে হাঁটুতে মুখ গুজে আছে।রুমে কারো উপস্থিতি যেনো তাকে মোটেও বিচলিত করলনা।সে সেভাবে বসে থেকেই গম্ভীর কণ্ঠে বললো

-“পাপা প্লিজ চলে যাও।আমি কিছুক্ষন একা থাকতে চাই।”

তিন্নির কন্ঠে কি ছিলো তা জিসান জানেনা।তবে তার ভিতরটা কেপে উঠলো।তিন্নিকে সে কখনো এই রূপে দেখে নি।তিন্নিকে তো তার পাথর মনে হতো।যাকে কিছুতেই দমিয়ে রাখা যায়না।যাকে শত চেষ্টা করেও ভাঙা যায়না।জিসান নীরবে তিন্নির পাশে ফ্লোরে বসে পড়লো।পাশে করো উপস্থিতি টের পেয়ে তিন্নি মুখ তুলে বলতে শুরু করলো

-“পাপা আমি ঠিক………”

আর বলতে পারলোনা।জিসানকে দেখে থেমে গেলো।আর জিসান এক দৃষ্টিতে তিন্নির দিকে তাকিয়ে আছে।তিন্নি এখনো সেই সাজে।শুধু তিন্নির চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে।অনেক কেঁদেছে মনে হয়।তিন্নির ফর্সা গাল দুটো লাল টমেটো হয়ে আছে।অতি সুন্দরী মেয়েরা বুজি কাদলে ভয়ংকর সুন্দর লাগে?এই মেয়েতো দেখা যায় কাদতে কাদতেও আমাকে ঘায়েল করতে পারে।তিন্নি সোজা হয়ে বসে কাপা কাপ কন্ঠে বললো

-“আ…আপনি এখানে?

জিসান গম্ভীর কণ্ঠে বললো
-“কেনো অন্য কাউকে আসা করছিলে?”

-“না তেমন কিছু না।”

তার পর কিছুক্ষণ নিরবতা ছেয়ে গেলো।জিসান গম্ভীর কণ্ঠে বললো

-“তোমাকে কি শাস্তি দেয়া যায় বলোতো?”

তিন্নি কিছুটা অস্থির হয়ে বলে
-“বিশ্বাস করুন,আমি আপনাকে ঠকাতে চাইনি।তবে আপনি যে শাস্তি দেবেন আমি তা মাথা পেতে নিবো।”

জিসান মনে মনে ভীষণ হাসি পাচ্ছে।এতো দিনে তিন্নিকে আজ্ঞাকারি বউ মনে হচ্ছে।তিন্নি আবার বলতে শুরু করলো

-“আমি আপনাকে অনেক বার সব বলতে চেয়েছিলাম।কিন্তু ভয়ে বলতে পারিনি।আমার অপরাধের যে শাস্তি মন চায় দিতে পারেন।তবে প্লিজ পাপাকে মাফ করে দিবেন।তিনি আমার সুখের কথা চিন্তা করে এমন করেছে।আমিও চাইনা আমার এই অন্ধকার জীবনের সাথে আপনাকে জড়াতে।আমার অপবিত্রতা আপনার পবিত্রতাকে কুলোসিত করুক আমি চাইনা।আপনাকে আমি খুব জলদি মুক্তি দিয়ে দিবো।ডিভোর্সের জন্য অ্যাপ……”
আর কিছুই বলতে পারলোনা তিন্নি।জিসান তাকে ততক্ষণে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে।দুই জনের চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে।জিসান কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে উঠলো

-“এই জীবনে কোনদিন তুমি আমার থেকে মুক্তি পাবেন।তোমার একটাই শাস্তি,আমার সাথে সারা জীবন থাকতে হবে।আর তুমি অপবিত্র কে বলেছে?আমার চোখে তুমি সবচাইতে পবিত্র আর শুভ্র নারী।যারা তোমার সাথে অন্যায় করেছে তারা অপবিত্র।তুমি কেনো নিজেকে ছোট করে দেখবে?”

-“আপনি প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন।এতেই সবার মঙ্গল।আমি চাইনা আমার মত একটা ধর্ষিতা মেয়ে আপনার সুন্দর জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়াক।”

জিসান এবার তিন্নির চিবুকে হাত রেখে বললো

-“তুমি আমার স্ত্রী।আমার ভালোবাসা।তুমি ছাড়া আমার জীবন মোটেও সুন্দর না।তোমাকে ছাড়া আমি জীবন কল্পনাও করতে পারিনা।আমার কেউ নেই।এই পুরো পৃথিবীতে একমাত্র তুমিই আমার আপন।তুমি ছাড়া আমি নিঃস্ব।”

তিন্নির চোখের পানিতে জিসানের হাত ভিজে যাচ্ছে।তিন্নি কাদতে কাদতে বললো

-“আপনি আবেগের বসে এই ডিসিশন নিচ্ছেন। পরে আফসোস হবে।”

-“আমি মোটেও আবেগের বয়সে নেই।তিন্নি তোমার সাথে যা ঘটেছে তা একটা দুর্ঘটনা।যাতে তোমার কোনো হাত নেই।আর আমি শুধু তোমার শরীর না,গোটা তিন্নিকে পাগলের মতো ভালোবাসি।”

জিসান তিন্নির চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো

-“তোমার চোখে অশ্রুধারা একটুও মানায় না।এই চোখে ভালোবাসা,অভিমান আর ক্রোধ মানায়।সেই রাগী চাহনি আমাকে ভৎস করে দেয়।”

এবার জিসান তিন্নির হাত ধরে বললো

-“এইযে হাত ধরেছি।আর কোনোদিন ছাড়বোনা।তুমি চাইলেই না।”

-“প্লিজ জিসান আপনি নিজের জীবনটাকে আবার সাজিয়ে নিন।”

জিসান এখন রাগ হচ্ছে।এই মেয়ে এতো জেদি কেনো।তাকে যে আমি পাগলের মত ভালোবাসি এটাকি বুঝে না।তবে জিসানের এই মুহূর্তে একটা কাজ করতে ইচ্ছা হচ্ছে।আজ সে তার ইচ্ছা পূরণ করবে।তার পর যা হবে দেখা যাবে।যা ভাবনা তাই কাজ।জিসান হঠাৎ করেই তিন্নির চুলে হাত গুজে গভীর চুমুতে লিপ্ত হলো।তিন্নি যেনো মুহূর্তেই কদতে ভুলে গেলো। হটাৎ এই আকর্ষিক হামলার ব্যাপারে সে মোটেও অবগত ছিলো না।তবে তার মনে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে।মনে হয় নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে।আর জিসান যেনো বহুদিনের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে।জিসান তিন্নিকে ছাড়তেই তিন্নি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো।

জিসান মুচকি হেসে বললো

-“এইযে এখন তুমি পুরোটাই আমার।তিন্নি আমি তোমাকে আজ আমার সাথে নিয়ে যেতে চাই।আমি তোমাকে ছাড়া আর ওই বসাতে থাকতে পারছিনা।আমি চাই দিন শেষে বাসায় ফিরে যেনো আমার একা থাকতে না হয়।আমি আর একা টেবিলে বসে খেতে চাই না।আমার জীবনের প্রতিটা সকাল তোমার মুখ দেখে শুরু করতে চাই।তুমি কি আমার পাশে থাকবে?বিশ্বাস করো কোনোদিন তোমার অমর্যাদা করবো না।তুমি আমার জন্য ভীষণ মূল্যবান।”

তিন্নি আবারো কেঁদে দিলো আর জিসানকে ঝাপটে ধরলো।জিসান তিন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো

-“কেঁদে লাভ নেই।আজ আমি তোমাকে নিয়ে যাবই।দরকার হলে তুলে নিয়ে যাবো।”

কান্নার মাঝেও তিন্নি হালকা হেসে দিলো।জিসান তিন্নিকে কোলে তুলে নিলো।আর তিন্নি জিসানের বুকে মুখ গুজে রইলো।

আনিসুর রহমান অনেক্ষন যাবত ড্রয়িং রুমে বসে আছে।অবণী রহমান যখন আসে তখন জিসান তিন্নির রুমে প্রবেশ করছিলো।তিনি স্বামীকে বললেন

-“ব্যাপার কি বলোতো?জিসান এতো রাতে?ওদের মধ্যে কি আবার জামেলা হয়েছে।তুমি প্লিজ তিন্নিকে বুজাও।আর তিন্নি যেনো জিসানকে কিছু না বলে।আমি আমার মেয়েকে সুখী দেখতে চাই।”

-“জিসান সব জেনে গেছে অবনী।”

-“কি বলছো তুমি?তোমার জন্য আমার মেয়ের সংসার ভেঙে গেলে কোনোদিন ক্ষমা করবনা?”

কথাটা বলেই তিনি কেঁদে দিলেন।আনিসুর রহমান স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন

-“আমাদের মেয়েকে আর কোনো কষ্ট ছুঁতে পারবেনা। এখন তো আমার মেয়ের সুখের সময় শুরু।বলেছিলাম না জিসান কোনোদিন আমার মেয়েকে অসম্মান করবে না?”

-“তুমি সত্যি বলছো?”

-“হুম।”

জিসান তিন্নিকে কোলে নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই তিন্নির মা বাবাকে দেখতে পেলো।তার ভীষণ লজ্জা লাগছে।তিন্নি এখনো চোখ বন্ধ করে তার বুকে মুখ গুজে আছে।জিসান ভাবছে আজ লজ্জা পেলে আর বউ নিয়ে যেতে পারবে না।তাই আমতা আমতা করে বললো

-“বাবা আমি তিন্নিকে নিয়ে যাচ্ছি।”

তিন্নি এক হাতে জিসানের টিশার্ট খামচে ধরলো।আসলে সেও লজ্জায় মুখ তুলতে পড়ছে না।
আনিসুর রহমান হেসে বললো

-“তোমার বউ,যা খুশি করো।”

জিসান যেনো আরো লজ্জা পেলো।দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে তিন্নিকে গাড়িতে বসিয়ে দিলো।গাড়ি চলতে শুরু করল।এই নীরব রাতের শহরে একজোড়া দম্পতি নতুন জীবনকে আহ্বান জানাচ্ছে। সুখ তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
গভীর রাতে তারা জিসানের বাসায় পৌঁছালো।জিসান তিন্নিকে আবারো কোলে তুলে নিলো।তারা বাসায় পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে নিলো।তিন্নি ওয়াস রুম থেকে বের হতেই জিসান বললো

-“জানো তোমাকে শাড়িতে দেখার ভীষণ ইচ্ছা ছিলো।”

-“আমি জানি।”

-“তার মানে এতদিন জেনেও ইচ্ছা করে পড়তে না।”

তিন্নি ভাবলেশহীন ভাবে বললো

-“আপনি কন্ট্রোল লেস হয়ে পড়তেন তাই।”

-“আমি কন্ট্রোল লেস হতাম তাই,নাকি আমার মুগ্ধ চাহুনি দেখে তুমি কন্ট্রোল লেস হয়ে পড়তে?”

-“আপনি বেশি বুঝেন।আমার ক্ষিধা লেগেছে।”

-“একটু বসো।আমি আমি আসছি।”

অনেক ক্ষন পরও জিসানকে আসতে না দেখে তিন্নি কিচেনের দিকে গেলো।জিসান চুলায় কিছু একটা করছে।তিন্নি বললো

-“কি করছেন?”

-“ও! তোমার জন্য পিৎজা বানাচ্ছি।”

-“আপনি পিৎজাও বানাতে পারেন?”

_”তোমার জামাইর কোয়ালিটি আছে।সব পারে।”

তারা পিৎজা শেষ করতেই জিসান বললো
কফি খেতে মন চাইছে।তিন্নি হেসে বললো

-“আপনি রুমে জান,আমি আনছি।”

জিসান রুমে আসতেই সূচনা কল করলো।
জিসান হেলো বলতেই সূচনা বললো

-“কীরে মজনু,খুব খুশি মনে হচ্ছে।”

-“লাইলিকে তুলে নিয়ে আসছি।”

-“একদম ভালো কাজ করছিস।যা এবার নিজের ভার্জিনিটি লুস করে ফেল।আর কত ভার্জিন থাকবি? বুড়া হইলে এই ভার্জিনিটি দিয়ে কি করবি?”

-“তুই জীবনেও ঠিক হবিনা।এই অবস্থায় এতো রাত জেগে থাকা ঠিক না।”

-“জ্ঞান দিবি না তো। ওই বেটাও তাই করে।আমার ঘুম নাই কিন্তু ওই ব্যাটা ঠিক ঘুমাইতেছে।যায় হোক তুই তোর লাইলীর কাছে যা।”

-“আচ্ছা বায়।”

তিন্নি রুমে এসে দেখে জিসান বারান্দায় বসে আছে।তিন্নি কফি দিতেই জিসান তিন্নিকে নিজের কোলে বসিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।আর বললো

-“আজ আমরা সারা রাত এখানে মেঘবিলাস করবো”

তিন্নি কপাল কুঁচকে বললো

-“এইটা আবার কি জিনিস?”

জিসান হেসে বললো

-“রাতে বসে চন্দ্র উপভোগ করাকে চন্দ্রবিলাস বলে।তবে আজ আকাশে চাঁদ নেই।আছে শুধু রাশি রাশি মেঘ।তাই আমরা মেঘবিলাস করবো।জিসানের কথায় তিন্নি খিল খিল করে হেসে দেয়।আর জিসান মুগ্ধ নয়নে তার মেঘবিলাসী কে দেখতে থাকে।যে হাসি জুড়ে আছে শুধু মুগ্ধতা।

(আজ গল্পের সমাপ্তি হলো। যারা এতো দিন আমার পাশে ছিলেন তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।আমার প্রথম গল্পে আপনারা আমাকে এতটুকু সাপোর্ট দেবেন আমি ভাবতে পারিনি। ভবিষ্যতেও এভাবে আমার পাশে থাকবেন। আর প্লিজ কিউ রিভিউ দিতে ভুলবেন না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here