মেঘবিলাসী পর্ব ২৬+২৭+২৮

#মেঘবিলাসী
#israt_jahan_arina
#part_26

তিন্নি তার নিজের লাইফে অনেক বেশি ডুবে আছে। কলেজে তার রেগুলার ভাইবা আইটেম এমনকি রিটেন আইটেম হচ্ছে। দু মিনিট দম নেওয়ার সময় নেই তার। অবনী রহমানের আজকাল ভীষণ আফসোস হয়। ইসস!! মেয়েটা মেডিকেলে পড়তে যেয়ে একদম শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। তিন্নির লেখাপড়ায় যাতে খুব একটা ক্ষতি না হয় তাই জিসান এবাসায় খুব কম আসে। কিন্তু আজ তার তিন্নি কে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছিলো। তাইতো এত রাতে বাসা থেকে ছুটে এসেছে। কিছুদিন যাবত তার একদমই ঘুম হচ্ছে না। তিন্নিকে একটা বার দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছে সে। দিনের বেলাতে সে নিজেও ভীষণ ব্যস্ত থাকে। তিন্নিকে দেখে মনের অস্থিরতা অনেকটা কমে আসলো।

তিন্নি এখনও বারান্দায় আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ মনে হয় আমাবস্য চলছে। চারপাশ কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার জীবনটা তো ঠিক এমনই অন্ধকার। তার এই অন্ধকার জীবনে জিসান নামক মানুষটি ভোরের আলো হয়ে চারপাশ আলোকিত করে তুলছে। কিন্তু তিন্নির ভীষণ ভয় হয়। সেকি পারবে এই আলো সহ্য করতে। অজান্তেই তার চোখ বেয়ে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।

হঠাৎ এমন সময় কেউ তার কাঁধে হাত রাখলো। তিন্নি চোখ ফিরিয়ে দেখলো তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে।আনিসুর রহমান মেয়ের চোখে পানি দেখে অস্থির হয়ে গেলেন আর বললেন

-“জিসানের সাথে কিছু হয়েছে?এতো রাতে ও এসে আবার চলে গেলো কেনো?”

তিন্নির আনমনা হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো
-“জানিনা পাপা।”

-“তোমার চোখে পানি কেনো মা?”

-“তেমন কিছুই না।তুমি ভুল দেখেছো?

তিনি বুঝতে পারলেন তিন্নি এখন কিছুই বলবে না।মেয়েটা নিজের মনের অবস্থা কাউকে বুঝতে দেয়না।তিনি আবার বললেন

-“এতো রাত জেগে থেকোনা।আমার বিশ্বাস তুমি এক্সাম গুলিতে অনেক ভালো করবে।এতো স্ট্রেস না নিয়ে রেস্ট করো।”

-“পাপা মামনি কিন্তু তোমার আর আমার চাইতেও বেশি ভালো অভিনয় করে।”

-“তোমার মামনি তোমাকে অনেক ভালোবসে।সে তোমাকে সব সময় হ্যাপী দেখতে চায়।”

-“পাপা আমার মাথা ব্যাথা করছে।একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।”

আনিসুর রহমান মলিন হেসে বললো
-“রুমে চল।আমি হাত বুলিয়ে দিবো।”

অনেক্ষন যাবত তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।ঘুম ঘুম চোখে তিন্নি বললো

-“মামনিকে প্রতিদিন এতো রাতে আমার রুমে আসতে মানা করে দিও।আমি ঠিক আছি।

আনিসুর রহমান কিছু বললো না।তিন্নি আবার বললো
-“আর তুমিও আসা বন্ধ করো।রাতে তোমার প্রপার ঘুম প্রয়োজন।”

তিনি এবারও কিছু বললেন না।পরম আদরে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।কিছু সময় পর তিন্নি ঘুমিয়ে পড়লো।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে জিসান রেডি হয়ে নিলো।গত রাতে তার বেশ ভালো ঘুম হয়েছে।ডাইনিং এ আসতেই রোজিনা খালা জিসানের নাস্তা দিলো।
জিসান নাস্তা করা প্রায় শেষ।রোজিনা খালা জিসানের কফি এগিয়ে দিতে দিতে বললো

-“বাবা কেমন বিয়া করলা,বউ বাইত আহেনা?বউ থাকতো আমার হাতো খাওন লাগে?

জিসান হেসে বললো
-“খালা আমার বউ ভবিষ্যৎ ডাক্তার।তার অনেক লেখাপড়া থাকে।আর তাছাড়া আমি আমার বউকে দিয়ে রান্না বান্না করবো না।আমি নিজে তাকে রেধে খাওয়াবো।”

-“তোমার বউয়ের কফাল ভালা।তোমার মতন সোয়ামি ফাইছে।”

জিসান মুচকি হেসে বললো

-“আমার কপালটাও কিন্তু ভালো।
________________
তিন্নি আর তার সব ফ্রেন্ডরা মিলে আজ রেস্টুরেন্টে এসেছে।কয়েক দিন তারা এক্সাম নিয়ে ব্যাস্ত ছিলো।আজ তাই একটু রিফ্রেশমেন্ট এর জন্য এসেছে।
চেয়ারে বসে সীমা বললো

-“আজ জম্পেশ খাওয়া দাওয়া হবে।কয়দিন টেনশন এ ঠিক মত খেতে পারিনি।”

সুমাইয়া মুখটা মলিন করে বললো

-“আরে এই কয়দিন আদনান আমাকে রান্না করে খাইয়েছে।বেচারা একদিকে অফিসে সামলেছে আর একদিক দিয়ে আমাকে।”

রত্না বিরক্ত মুখ নিয়ে বললো
-“আমার অবস্থা বেশি খারাপ।বাবা বলে দিয়েছে রেজাল্ট ভালো না করলে ধরে আমার কাজিন ইনাদের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে। ওকে আমার একটুও পছন্দ না।”

তিন্নি এবার বললো
-“আংকেল কে বল যে তুই ওকে পছন্দ করিস না।”

-“বাবা আমার কথা জীবনেও শুনবে না।”

-“এক কাজ কর আমাদের কলেজের কোনো সিনিয়র ভাইয়াকে পটিয়ে ফেল।ডক্টর ছেলে দেখলে তোর বাবা মানা করবে না।”

-“আইডিয়া ভালো।কিন্তু কোন ছেলেকে পটাবো?তোর জামাইর মতো কোনো হিরো টাইপ ছেলে খোঁজে দে।”

তিন্নি বিরক্ত হয়ে বললো
-“ওই রাব্বিকে পটিয়ে ফেল।”

-“আমার খেয়ে দেয় আর কাজ নাই।তাছাড়া ওই ছেলে তোর পিছনে লাট্টু।”

-“আরে ট্রাই করে দেখ।সে কিন্তু ভালো স্টুডেন্ট।ভবিষ্যতে ভালো ডক্টর হবে।”

রত্না কিছু বলার আগেই সীমা বললো
-“তিন্নি ওইটা জিসান ভাই না?”

জিসান নামটা শুনে একটু চমকে উঠলো।সাথে সাথে পিছনে ফিরে দেখলো সত্যি জিসান।
জিসান দিকে তাকিয়ে তিন্নির মেজাজ খারাপ হলো।জিসানের পাশের মেয়েটা কে? যেই হোক তাতে আমার কি?
সীমা বললো

-“তুই প্ল্যান করে এই রেস্টুরেন্টে এসেছিস? ওও!! চুপি চুপি প্রেম চলে তোমাদের।এটা আর হচ্ছেনা।আমি এক্ষুনি ডাকছি ভাইয়াকে।”

তিন্নি তাকে কিছু বলার আগেই সীমা দাড়িয়ে জিসান কে ডাকতে লাগলো।
জিসান আর তার কলিকরা মিলে lunch করতে এসেছে। হঠাৎ নিজের নাম শুনে ঘুরে তাকালো।
কিছুটা দূরের টেবিলে সীমা দাড়িয়ে ওকে ডাকছে।তার চোখ পড়লো তিন্নির দিকে।সে সাথে সাথে উঠে দাড়ালো। দ্রুত তিন্নির দিকে এগিয়ে আসলো।সীমাকে উদ্দেশ্য করে বললো
-“কি ব্যাপার শালীকা?তোমরা এখানে কি করছো?

-“আমরা lunch এ এসেছি।”

জিসান আড়চোখে তিন্নিকে দেখলো।তার পর সীমাকে উদ্দেশ্য করে বললো

-“তোমরা প্লিজ আমাদের সাথে জয়েন করো।আমরা কয়েকজন কলিক মিলে এসেছিলাম।”

তিন্নি বললো
-“আপনারা কন্টিনিউ করুন। আমরা ডিস্টার্ব করতে চাইছি না ”

-“মোটেও ডিস্টার্ব হবে না।চলো।”

এ কথা বলে সে তিন্নির হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগলো।জিসানের এই অধিকার বোধটুকু তিন্নির ভীষণ ভালো লাগলো।
জিসান তিন্নি আর তার ফ্রেন্ডের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।জিসানের পাঁচ জন কলিক আছে।তিন্নির চোখ পড়লো একজনের দিকে।এটাই সেই ছেলেটা যাকে তিন্নি শপিং মলে আহত অবস্থায় দেখেছে।কি নাম যেনো বলে ছিলো সূচনা আপু? হে মনে পড়েছে।ফয়সাল নাম তার।কিন্তু তিন্নির চোখ আটকে আছে ওই মেয়েটার উপর।মেয়েটার নাম অদৃতি।জিসানের সাথে এক টিমে আছে।এতো সুন্দর মেয়ে কিনা চোর বাটপার দের পিছনে দৌড়ায়।এই মেয়ে মিষ্টি করে কথা বললেই আসামিরা মনে হয় গর গর করে সব অপরাধ শিকার করে নেয়।মেয়েটার মডেল হওয়ার দরকার ছিলো।ভুল প্রফেশনে চলে এসেছে।
তিন্নিকে দেখে ফয়সাল বললো

-“কি খবর আপনার ভাবী?আমাকে চিনতে পেরেছেন?”

এতো বড়ো লোকের মুখে ভাবী ডাক শুনে তিন্নি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।মিষ্টি হেসে তিন্নি বললো

-“জী!!আপনাকে চিনতে পেরেছি।একজন আপনার শরীর কেমন আছে?”

-“জী ভাবী ভালো আছি।”

অদৃতা মেয়েটা বললো
-“কি ব্যাপার জিসান?এতো মিষ্টি বউকে এতোদিন লুকিয়ে কেনো রেখেছো?”

-“লুকিয়ে কোথায় রাখলাম?এইযে তোমাদের সামনে নিয়ে এসেছি।”

-“তোমাদের জুটি আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।দুই জনই মানব সেবায় নিয়োজিত।”

জিসান অন্য কলিক তাহসান অনেকক্ষণ যাবত সীমাকে দেখে চলছে।সে তিন্নিকে বললো

-“ভাবী আপনি আর আপনার ফ্রেন্ডরা ডক্টর পাস করার পর আমরা কিন্তু ফ্রী ট্রিটমেন্ট নিবো।”

তিন্নি বিষয়টা খেয়াল করে বললো
-“ট্রিটমেন্ট কি আমার কাছ থেকে নিতে চান নাকি আমার অন্য ফ্রেন্ড থেকে?”

-“আমার আপনার কাছ থেকে ট্রিটমেন্ট নিতে সমস্যা নেই।কিন্তু আপনি তো জিসান ভাইয়ের রোগ সারাতে ব্যাস্ত থাকবেন।তাই আপনার অন্য ফ্রেন্ডরা ফ্রী থাকলে তাদের দেখাতাম।”

-“সুমাইয়া বাদে বাকি সবাই ফ্রী আছে।ট্রাই করে দেখতে পারেন।”

তিন্নির কথা শুনে সীমা তিন্নিকে খোঁচাতে লাগলো।তিন্নিও তাকে চোখ টিপ দিয়ে দিলো।সীমার ভীষণ লজ্জা লাগছে।
জিসান তিন্নির কানে কানে বললো

-“তুমি একটু ওয়েট করো,আমি তোমাকে বাসায় ড্রপ করে দিবো।”

-“আপনাকে কষ্ট করা লাগবে না।আমি চলে যেতে পারবো।”

-“আমার মোটেও কষ্ট হবে না।তুমি দাড়াও আমি তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি।”

তিন্নি আর কিছুই বলতে পারলো না।জিসানের সাথে সময় কাটাতে তার খুব ভালো লাগে।মানুষটা সব সময় হাসি খুশি থাকে।আর অন্যকেও হাসাতে পারে।
কিছু সময় পর জিসান তিন্নিকে নিয়ে বাইকের কাছে আসলো।জিসান বলে উঠলো

-“বাইকে উঠতে সমস্যা হবে না তো?আসলে তোমার সাথে দেখা হবে জানলে গাড়ি নিয়ে আসতাম।”

তিন্নি মাঝে মাঝে অবাক হয়।এই মানুষটা এতো কেয়ারিং কেনো?তিন্নি বললো

-“কোনো সমস্যা নেই।আমি বসতে পারি।আগে রাতুল ভাইয়ের বাইকে বেশ কয়েকবার বসেছি।”

জিসান ব্রু কুচকে তিন্নির দিকে তাকালো।তিন্নি জিসানকে পাত্তা না দিয়ে আসে পাশে দেখতে লাগলো।আসলে সে জিসানকে জেলাস ফিল করতে চাইছে।
জিসান মুচকি হেসে বললো

-“রাতুলের বাইকে আমি উঠে ছিলাম।তার ড্রাইভিং খুব একটা ভালো না।নিজের জামাইর বাইকে উঠে দেখো।তোমার জামাই ভালো বাইক রাইডার।”

তিন্নি মনে মনে জিসানকে খারাপ একটা গালি দিলো।এই লোক না জানি কত মেয়েকে বাইক রাইড দিয়েছে।আচ্ছা অদ্রিতা মেয়েটাও কি এই মানুষটার পাশে বসেছে?এমন সময় তিন্নি দেখলো অদ্রিতা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হচ্ছে।তাকে দেখেই তিন্নি দ্রুত জিসানের বাইকে উঠে বসলো।অদ্রিতা কে দেখিয়ে জিসানের কাছাকাছি বসলো।
বাইকে কিছুদুর যাওয়ার পর তিন্নি এবার কিছুটা দূরে চলে আসলো।নিজের কাজের জন্য এখন লজ্জা লাগছে। সে কি আসলেই জেলাস ফিল করছিলো।জিসান বলে উঠলো

-“দূরে গেলে কেনো?ধরে বসো,নাহলে পরে যাবে।”

-“সমস্যা নেই পড়বো না।”

জিসান এবার নিজেই তিন্নির হাত ধরে নিজের কোমরে জরিয়ে দিলো।তিন্নি কিছুটা কেপে উঠলো।কেমন অনুভূতি হচ্চে সে বলে বুঝাতে পারব না।মনে হয় বুকের ভিতর কিছু একটা দ্রুত গতিতে ছুটে চলছে।ভীষণ ভালো লাগছে আজ তার।সামনের মানুষটাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে।দুই হাত দিয়ে সে জিসানকে ঝাপটে ধরে রাখলো।#মেঘবিলাসী
#israt_jahan_arina
#part_27

জিসান অফিসে ঢুকতেই তাহসানের সাথে দেখা হলো।সে জিসানকে সালাম দিয়ে বলতে শুরু করলো

-“জিসান ভাই,ভাবির ওই ফ্রেন্ড সীমার সাথে আমার একটা প্যাচ আপ করে দাও না?

-“আরে বেটা এখন আর প্রেম করে কি করবি?এক কাজ কর।যদি এই বিষয়ে সিরিয়াস হয়ে থাকিস তাহলে
সোজা বিয়ে করে নে। এমনি আংকেল তোর জন্য মেয়ে খুঁজছে। তাই ডানে-বাঁয়ে না ঘুরে সোজা বিয়ে করে ফেল।”

-“ভাই আমার তো ইচ্ছা ছিল প্রেম করবো। স্টুডেন্ট লাইফে আব্বু এমন নজরদারি রেখেছে প্রেম করার সুযোগ হয়নি।”

-“আরে বিয়ের পরের প্রেম আরো মজা।”

-“হে ভাই তুমিতো ভাবির সাথে চুটিয়ে প্রেম করছো।”

জিসান ভাবছে ‘ আমার বউ তো প্রেমই বুঝে না।সে খালি আমাকে চরকির মত ঘুরায়।এই রহস্যময়ী নারীকে কিছুতেই বিশ্লেষন করা যায়না।”

ভাবনা থেকে বের হয়ে সে বললো
-“আমার কথা বাত দে।তুই আংকেলকে সীমার বাবা মার সাথে কথা বলতে বল।মেয়ে ভবিষ্যৎ ডক্টর।তোর পুরো চোদ্দো গুষ্ঠি ফ্রী সার্ভিস পাবে।”

-“তা ঠিক বলেছো ভাই।”

হঠাৎ জিসান এবং তাহসানের ফোন এক সাথে ম্যাসেজ আসলো।দুজনেই কপাল কুচকে ম্যাসেজ চেক করলো।ম্যাসেজ চেক করা মাত্রই দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে দ্রুত অফিসের ভিতরে চলে গেলো।

তিন্নি আর নীলিমা বের হয়েছে শপিং করতে।নীলিমার এনগেজমেন্ট ঠিক হয়েছে।তাই সে তার প্রাণ প্রিয় বন্ধুবি তিন্নিকে নিয়ে শপিং এসেছে।তিন্নিও এতদিন পর নীলিমাকে পেয়ে ভীষণ খুশি।তারা সারাটা দিন ঘুরে ঘুয়ে শপিং করলো।কিছুক্ষণ পর মৌমিতা আর আমরিন যোগ দিলো। চার বান্ধবী মিলে অনেক আড্ডা আর খাওয়া দাওয়া করলো।বিকেলের দিকে তিন্নি বাসায় আসলো।

বাসায় আসার পর থেকে তার মনটা অস্থির হয়ে আছে।বার বার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে।মানুষটা তাকে আজ একবারও কল করে নি।অন্য সময় তো সারা দিনে বেশ কয়কবার কথা হয়।তবে তিন্নি নিজে থেকে কখনো কল দেয় না।
তিন্নির অস্থিরতার মাঝে তামিম আসলো রুমে।তামিম বলে উঠলো

-“আপু তোকে বলেছিলাম না এর পর আমরা রাইমা আপুর বিয়ে খাবো?ফুপি তো রাইমা আপুর সেই ক্লাস নিয়েছে।”

তিন্নি বিরক্ত হয়ে তামিমকে বললো
-“তুই এতো খবর কোথা থেকে পাস?”

-“আমার কাছে সব খবরই থাকে।আসল খবর তো বলতেই দিলে না।রাইমা আপুর বিয়ে সায়েদ ভয়ের সাথে ঠিক হয়েছে।নেস্ট ইয়ার বিয়ে।”

-“ভালো।তোর পকপক আর শেষ হলে এখন যা।”

-“আপু তুই একটা বোরিং পারসন।পাপার কথায় বিয়ে করেছিস বলে এতো হ্যান্ডসাম একটা জামাই পেয়েছিস। তা না হলে জীবনেও তুই জিসান ভাইয়ের মত ছেলেকে পটাতে পারতি না।”

তিন্নি ভীষণ রেগে বললো
-“থাপ্পড় চিনিস?যা এখান থেকে।”

-“সত্যি কথা বললেই দোষ।”

তিন্নি তার হাতের বলিস ছুড়ে মারলো।আর তামিম ও টা ক্যাচ ধরে ফেলে। উচ্ছ্বসিত হয়ে তামিম বললো

-“আমার ক্যাচ দেখেছিস? বাংলাদেশ টিম আমাকেই খুঁজছে।”

-“বের হবি নাকি পাপাকে ডাকবো?”

-“জিসান ভাই তোকে জাস্ট একবার নিয়ে যাক,তার পর আমি পাপা কে আমার দলে নিয়ে আসবো।তুই তো বেচে গেছিস।তোর কোনো দজ্জাল শশুর শাশুড়ি ননদ কিছুই নেই। তা না হলে সারাদিন তোকে দিয়ে বাসন মাজাতো।কিন্তু এখন তুই উল্টা বেচারা জিসান ভাইকে দিয়ে কাজ করাবি।”

তিন্নি এবার তেরে আসলো।তিন্নিকে আসতে দেখে তামিম দিলো ভো দৌড়।তিন্নির এখন ভীষণ রাগ হচ্ছে।সে মোটেও ওই টাইপের মেয়ে না।
তিন্নির অসস্তি যেনো আরো বাড়তে লাগলো।রাত দশটা বেজে গেলো।মানুষটার কোনো সমস্যা হলো নাতো?সে কি একবার কল করবে।ডায়েল নম্বরে কল করেও আবার কেটে দিলো।আগে কখনো সে কল করেনি।তাই কেমন অসস্তি হচ্ছে।
এমন সময় তিন্নির ফোন কল আসলো।সূচনা কল করেছে।তিন্নি দ্রুত কল রিসিভ করলো।

-“আসসালামু আলাইকুম আপু ভালো আছেন?”

-“ওয়ালাইকুম আসসালাম। তিন্নি এখন একটু জিসানের ফ্ল্যাটে যেতে পারবে?”

-“এখন? কিছু হয়েছে আপু?

-“না আসলে জিসান একটু ইনজুর।একা কি ভাবে সামলাবে বুঝতে পারছি না।আমি আর রিয়াজ ঢাকার বাইরে।”

তিন্নি কি বলবে বুঝতে পারছে না। অলরেডি তার হাত কাঁপতে শুরু করেছে। বুকের বা পাশে সূক্ষ্ম ব্যথা ও শুরু হয়েছে। নিমিষেই তার দু চোখ ভিজে উঠলো।
সূচনা বলে উঠলো

-“হ্যালো তিন্নি শুনছো? প্লিজ তুমি টেনশন করো না। নিজেকে সামলাও।”

তিন্নি কিছুই ভাবতে পারছনা।তার মাথায় শুধু একটা জিনিষ চলছে যে মানুষ একা।তাকে দেখার মতো কেউ নেই।তিন্নি দ্রুত গাড়ির চাবি নিলো।আজ তার পাপা বাসায় নেই।তার আজ নাইট ডিউটি।তাই আজ গাড়ি নিয়ে যায়নি। তিন্নি দরজার কাছে আসতেই দেখলো তামিম বসে টিভি দেখছে।সে তামিমকে বললো

-“মামনিকে বলিস আমি ACP সাহেবের বাসায় গেছি।”

তিন্নির চোখ মুখ দেখে তামিম উদ্বিগ্ন হয়ে বললো

-“কিছু হয়েছে আপু? এত রাতে তুমি জিসান ভাইয়ের বাসায় যাচ্ছ?”

-“এখন একদম সময় নেই পরে বলবো। তুই শুধু মামনিকে বলিস।”

তিন্নি আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। দ্রুত সে গাড়ি নিয়ে বের হলো। সে ড্রাইভিংয়ে একদম মনোযোগ দিতে পারছে না। বারবার তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। এত খারাপ কেন লাগছে তার? মানুষটিকে তো সে মাত্র কয়েকদিন হলো চেনে। তবুও কেমন একটা টান অনুভব করছে সে। এতদিন তো এমন হয়নি। আজ রাস্তাটাকে কতো লম্বা মনে হচ্ছে কিছুতেই ফুরোতে চাচ্ছে না।

হন্তদন্ত হয়ে তিন্নি জিসানের ফ্লাটের সামনে আসলো। পুরো শরীর কাঁপছে তার। দুবার কনিংবেল চাপলো কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না। ভিতরের ভয়টা যেন তার আরো চেপে বসল।কিছু একটা ভেবে সে দরজায় ধাক্কা দিলো।অমনি দরজা খুলে গেলো। তিন্নি বেশ অবাক তো হলো। মানুষ টা ঠিক আছে তো?

সে দ্রুত বাসায় ঢুকলো। চারপাশ অন্ধকার। শুধুমাত্র দূরে জিসানের বেডরুম থেকে কিছুটা আলো আসছে। তারমানে মানুষটা সেখানেই আছে। তিন্নি দ্রুত জিসানের রুমের সামনে আসলো।

জিসান এলোমেলো ভাবে বিছানায় শুয়ে আছে। তার মাথায় ব্যান্ডেজ হাতে ব্যান্ডেজ এমনকি পায়ের হাঁটুর পাশে ব্যান্ডেজ। পায়ের প্যান্ট ফোল্ড করে রাখা। তিন্নি ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো। সে কাঁপা কাঁপা পায়ে রুমে প্রবেশ করলো। গলা দিয়ে তার শব্দ বের হচ্ছে না। খুব কষ্টে সে জিসান কে ডাকলো। কিন্তু জিসান কোনো রেসপন্স করলো না।তিন্নি এবার জিসানের গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে গেলো।জিসানের গায়ে হাত দিয়েই সে অবাক হলো।জিসানের গায়ে ভীষণ জ্বর।সে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।কিছুটা সময় নিয়ে সে নিজেকে স্থির করলো। একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট হয়েও এতটা হাইপার হওয়া তাকে মানায় না।

বেশ সময় নিয়ে সে জিসানকে জলপট্টি দিলো।তার গা মুছে দেওয়াটা দরকার।কিন্তু তিন্নির বেশ অসস্তি হচ্ছে।কিছু সময় পর সে তার সকল দ্বিধা দূরে ঠেলে দিলো।একজন ডক্টরের মধ্যে এমন হাজিটেশন থাকা মোটেও শোভনীয় না।তিন্নি খেয়াল করলো জিসানের গায়ের শার্ট এ ময়লা লেগে আছে। কিছু জায়গায় রক্তের দাগ।মানুষটা বাসায় এসে ড্রেসটা ও চেঞ্জ করে নি। তিন্নি ধীরে ধীরে শার্টটা খুলে ফেললো। বুকের কিছুটা অংশে কেটে গেছে। রক্ত শুকিয়ে আছে। শার্ট লেস জিসান কে দেখে তিন্নির নিজেকে কেমন এলোমেলো লাগছে। সে মুগ্ধ চোখে জিসানকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।মনে মনে সে ভাবতে লাগলো ‘এই মানুষটা তার।’

জিসানের গা মুছে সে দ্রুত চলে গেলো রান্না ঘরে। জিসানের জন্য স্যুপ রেডি করে সে আবার চলে আসলো। যে করেই হোক জিসানকে খাওয়াতে হবে।তার পর মেডিসিন নিতে হবে। কিছুক্ষণ আগে বেডসাইডে টেবিলে সে একটা প্রেসক্রিপশন আর কিছু ওষুধ দেখেছে। নিশ্চয়ই জিসান আগে হসপিটালে গেছে।

সে জিসানকে ডাকতে শুরু করলো। বেশ কিছুক্ষণ ডাকার পর জিসান চোখ মেলে তাকালো। তিন্নির চোখে চোখ পরতেই সে মুচকি হাসলো। তিন্নি অবাক হলো, এই পরিস্থিতিতেও মানুষটা হাসছে।আবারো সেই হাসি। এই হাসিতে তিন্নি বারবার ঘায়েল হয়। জিসান বির বির করে কিছু বলছে। তিন্নি জিসানের কাছে এসে বোঝার চেষ্টা করল জিসান কি বলছে? জিসান বলছে

-“তুমি আবার এসেছো আমাকে জ্বালাতে? প্রতিদিন স্বপ্নে এসে এভাবে জালানো ঠিক না বউ পাখি।”

তিন্নি থতমত খেয়ে গেলো। সে মানুষটার স্বপ্নে আসে?
জিসান হাত বাড়িয়ে তিন্নির গাল ছুয়ে দিলো। আর বলতে শুরু করলো

-“ভালোবাসি বউ। কতটা ভালবাসি বলে বোঝাতে পারবো না। শুধু এটা জানি তুমি ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই।”

তিন্নির কেমন দম বন্ধ করে অনুভূতি হচ্ছে। রুমটাতে মনে হয় অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে। মাত্রাতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড তার প্রাণ নিয়ে ছাড়বে। ঘামতে শুরু করলো তিন্নি। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে শুরু করলো তার। মানুষটা কি তাকে আসলেই ভালোবাসে? এই ভালবাসার মূল্য কি সে আদো দিতে পারবে? তিন্নির হাত আপনা আপনি জিসানের বুকে চলে গেলো। মানুষটা আসলেই ভীষণ একা। অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলেও তাকে দেখার কেউ নেই। পরিবার ছাড়া এই মানুষটা এত দিন কিভাবে ছিলো? দিন শেষে এ ফ্লাটে নিশ্চয়ই তার দম বন্ধ হয়ে আসে? এসব ভেবে তিন্নির চোখ থেকে আরও কয়েক ফোটা পানি বেরিয়ে আসলো।
সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিসান কে বললো

-“একটু উঠে বসুন তো। আপনার কিছু খাওয়া প্রয়োজন খেয়ে মেডিসিন নিবেন।”

-“তুমি পাশে থাকলে আমি এমনিই সুস্থ হয়ে যাব।”

-“আমি হেল্প করছি, প্লিজ একটু উঠে বসুন।”

ভীষণ কষ্টে জিসান একটু উঠে বসলো। তার পুরো শরীর ব্যথা করছে। কিন্তু এই মেয়েটা পাশে থাকলে এই ব্যথা তার জন্য কিছুই না। তিন্নি ভীষণ যত্নে জিসানকে খাওয়াতে শুরু করলো। আর জিসান এক দৃষ্টিতেই তিন্নিকে দেখছে। হঠাৎ জিসান বলে উঠলো

-“তিন্নি তুমি কি সত্যিই আমার সামনে?”

তিন্নি কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। মানুষটাই এমন ভাবে তাকায় কেন? এই দৃষ্টি দিয়ে এই মানুষটা তাকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতে পারে।

তিন্নি কেনো জবাব দিলো না,সে চুপচাপ জিসানকে খাওয়াতে লাগলো। খাওয়া শেষ করে সে জিসানকে মেডিসিন দিলো।

কিছুক্ষণ পর তিন্নির পাপা কল করলো। আনিসুর রহমান বললেন

-“সব ঠিক আছে মা? এত রাতে তুমি জিসানের বাসায় গেলে। তোমার মামনি ভীষণ টেনশন করছে।জিসান ঠিক আছে তো?”

তিন্নি তার বাবাকে সব খুলে বললো। তিনি মেয়েকে চিন্তা করতে মানা করলেন আর আজকে রাতে জিসানের পাশে থাকতে বললেন।

-“মা তুমি তো জানো জিসানের প্রফেশন সম্পর্কে। তোমার নিজের মনটা একটু শক্ত রাখতে হবে। একজন এসিপির ওয়াইফ তুমি। তোমাকে তো জিসানের চাইতেও বেশী মজবুত থাকতে হবে। আমি ডিউটি শেষ করে সকালে আসছি। তুমি কোন চিন্তা করো না আর দরকার হলে আমাকে কল করো।”

বাবার সাথে কথা বলে তিন্নির মনটা কিছুটা শান্ত হলো। তার পর সে সূচনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো।
জিসান ঘুমিয়ে আছে দেখে তিন্নি পাশে শুয়ে পড়লো। সে শোয়ার সাথে সাথে জিসান একটানে তিন্নিকে তার বুকে নিয়ে আসলো। শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো

-“এখন আমার ভীষণ আরাম লাগছে। তুমি জানো তোমাকে বুকে নিয়ে ঘুমানোর কত ইচ্ছা ছিলো আমার?

তিন্নি পুরো ফ্রিজড হয়ে গেছে। তার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। এই মানুষটার বুকে এতটা প্রশান্তি পাবে সেটা ভাবতে পারেনি।#মেঘবিলাসী
#israt_jahan_arina
#part_28

গালে ধারালো কিছুর আঘাতে তিন্নির ঘুম ভাঙলো। চোখ খুলতেই করা পারফিউমের গ্রান নাকে এলো।ভালো করে তাকাতেই দেখতে পেলো জিসানের খোঁচা খোঁচা দাড়ি তার গালে বিদছে।সে খুব সাবধানে জিসানের কাছ থেকে নিজেকে ছড়িয়ে নিলো।জিসান কিছুটা নড়ে চরে আবার ঘুমিয়ে গেলো।তিন্নি এক দৃষ্টিতে জিসানকে দেখছে।ফর্সা মুখটা কেমন লাল হয়ে আছে।নিশ্চয়ই জ্বরের কারণে এমন হয়েছে।তিন্নি কপালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা চেক করলো। এখনো হালকা জ্বর আছে।

হঠাৎ তিন্নির চোখ পড়লো জিসানের উন্মুক্ত শরীরে।রাতে শার্ট চেঞ্জ করে টিশার্ট পরাতে চেষ্টা করেছে।কিন্তু জিসানকে সে কিছুতেই জায়গা থেকে নাড়াতে পারেনি। আর জিসানকে যখন খাওয়াতে উঠালো তখন জিসানের ওই সব কথার পর সে আর নিজের মধ্যে ছিল না।।সারা রাত সে এই অবস্থায় জিসানের বুকে ছিলো ভেবে ভীষণ লজ্জা পেলো।এতো পারফেক্ট বডি সে কখনো দেখে নি।নিশ্চয়ই রেগুলার এক্সারসাইজ করে।সে তো সারা জীবন এটাই ধারণা করেছে এইসব ACP দের বিশাল ভুঁড়ি থাকে।কিন্তু জিসান আর তার সব কলিকরা ভীষণ ফিট।

সে ভাবছে জিসানের মা নিশ্চয়ই অনেক সুন্দরী ছিলেন।জিসান তাকে একবার তার মা বাবার ছবি দেখিয়েছে।সেখানে জিসান অনেক ছোট।ছোট বেলার জিসান ছিলো গলুমোলু।ছবি দেখে যা বুঝেছিল জিসানের মা বাবা দুজনেই সুন্দর।কিন্তু জিসানের মা ভীষণ সুন্দরী।

তিন্নি ওয়াশ রুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।তার জামাটা চেঞ্জ করা জরুরি।সকালে পাপা কল করেছে।তিন্নি সাথে একটা জামা নিয়ে আস্তে বললো।আসলে তারা হুরার মধ্যে সে বাসায় পড়ার ড্রেস পরে চলে এসেছে।

তিন্নি ওয়াশ রুম থেকে বের হতেই ডোর বেলের আওয়াজ পেলো।সে দরজা খুলতেই দেখতে পেলো মধ্যে বয়সী একজন মহিলা দাড়িয়ে।তিন্নিকে দেখেই সে চোখ কুচকে ফেললো।আর বলে উঠলো

-“এই মাইয়া তুমি কেডা?”

তিন্নি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো।মহিলাটি আবার বললো
-“এত্ত সক্কালে একটা বেডা মাইনসের বাসাত কি করো?তোমারে আগেতো দেহিনাই?”

তিন্নি কি বলবে বুঝতে পারলো না।মহিলা আবার রেগে বললো

-“চুরি করণের মতলব নাই তো?”

তিন্নি বেশ অপমান বোধ করলো।তাকে দেখে কি চোর মনে হয়?কিছু একটা ভেবে সে বললো

-“আপনি কি রোজিনা খালা?”

মহিলাটি এবার ভীষণ চমকালো।আর বললো

-“আমার নাম জানেন কেমনে?”

তিন্নি কিছু একটা বলার আগেই মহিলাটি বললো

-“আল্লাহ! আফনে জিসান বাবার বউ না?”

জিসানের বউ কথাটি শুনে তিন্নির মনে শীতল হাওয়া বয়ে গেলো।তিন্নি মাথা নেড়ে হ্যা জানালো।
রোজিনা খালা ভীষণ এক্সাইটেড হয়ে বললো

-“আরে বউ রানী আমারে মাফ কইরা দেন।পর্থমে আফনেরে চিনি নাই।মেলা দিন আগে ছবি দেকছিলাম।তাই ভুইল্লা গেসিলাম।”

-“না সমস্যা নেই।আপনি ভিতরে আসুন।আসলে উনি অসুস্থ তাই রাতে এসেছি।”

-“আল্লাহ কি কন? কি হইসে জিসান বাবার?”

-“তেমন কিছু না।উনি এখন ভালো আছে।”

-“ও! তা এতো দিন পরে কেন আইলেন? নিজের সোনার সংরার ফালাইয়া কেউ এত্ত দিন বাফের বাইত ফইরা থাহে?”

তিন্নি বুঝতে পড়লো এই মহিলা বেশি কথা বলে।তিনি তিন্নিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে আবার বলতে শুরু করলো

-“মাশাআল্লাহ ! কইতে হইবো জিসান বাবা একখান পরী বিয়া করছে।”

এই কথা শুনে তিন্নি ভীষণ লজ্জা পেলো। হঠাৎ তিনি চোখ কুচকে বললো

-“হায় আল্লাহ! এডি কি ফিন্দা রইছো?নতুন বউ শাড়ি পিনদা ঘুরবা।”

তিন্নি এবার ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে।কথা বলার কোনো প্রতিযোগিতায় এই মহিলাকে নিয়ে গেলে চোখ বন্ধ করে ফার্স্ট হবে।
তিন্নি আর তেমন কিছু বললো না।রোজিনা খালা নাস্তা বানাতে চলে গেলো।
কিছু ক্ষন আগে তিন্নির বাবা আসে।তিনি সোজা হসপিটাল থেকে জিসানের বাসায় চলে এসেছেন।তিনি জিসানকে কিছু ক্ষন পর্যবেক্ষণ করে তিন্নিকে বললো

-“কোনো সমস্যা নেই।ভালো করে রেস্ট নিলেই ঠিক হবে।
পায়ের ব্যাথার জন্য কিছু দিন হয়তো ঠিক ভাবে হাঁটতে পারবে না।মা তুমি এক কাজ করো?জিসান ঠিক না হওয়া পর্যন্ত তার পাশে থাকো।তোমাকে এখন তার প্রয়োজন।ড্রাইভার একটু পর তোমার জামা কাপড় দিয়ে যাবে।।”

তিন্নি মাথা নেড়ে সায় দিলো।সে নিজেও মানুষটাকে এই অবস্থায় রেখে যেতে চায় না।
তিন্নি দেখলো তার পাপা সারা রাত ডিউটি করে বেশ ক্লান্ত।তাই সে তার পাপা কে বাসায় পাঠিয়ে দিলো।বেশ কিছুক্ষন পর জিসানের ঘুম ভাঙলো।কিছু টা নড়তেই বুঝতে পারলো শরীরে অনেক ব্যাথা।গত কালের তুলনায় আজ ব্যাথা বেশি।তার গলাটাও শুকিয়ে গেছে।পাশের টেবিলে পানির জগ আছে।কিন্তু তার মোটেও নিয়ে খেতে ইচ্ছা করছে না।এটা তার জীবনে নতুন না।এমন বহু বার অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলো।একটা গ্লাস পানি ঢেলে দেওয়া মত কেউ ছিলো না।এক মাত্র সূচনা তার খবর রাখতো।কিন্তু এখন সূচনা ঢাকায় নেই।

জিসান খুব কষ্ট করে একটা গ্লাসে পানি ঢালতে যেয়ে হাতের ধাক্কায় গ্লাসটা পরে ভেঙে গেলো।জিসান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এমন সময় হঠাৎ তার বাথরুমের দরজা খুলে কেউ বের হলো।জিসান অবাক হয়ে সে দিকে তাকিয়ে আছে।
তিন্নি! ও কখন আসলো? তাহলে এতক্ষণ রাতের যে ঘটনাগুলোকে আমি স্বপ্ন ভাবছিলাম সেটা সত্যি ছিলো? সত্যিই কি সে এসেছে আমার জন্য? মনের মধ্যে প্রশান্তি বয়ে গেল জিসানের।
হঠাৎ কিছু ভাঙ্গার শব্দ পেয়ে তিন্নি দ্রুত ওয়াশরুম থেকে বের হলো। বের হতে দেখলে বিছানার পাশে একটা গ্লাস ভেঙে পড়ে আছে। আর জিসান অদ্ভুতভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিন্নি দ্রুত এগিয়ে আসতে গেলে জিসান বলে উঠলো

-“এই সাবধানে নিচে ভাঙা কাচ পড়ে আছে?”

তিন্নিও দাঁড়িয়ে গেলো। মানুষটা সব সিচুয়েশনে খেয়াল রাখতে জানে।
জিসান আবার বলে উঠলো

-“রোজিনা খালা এসেছে?”

-“হু”

জিসান জোরে জোরে খালাকে ডাকতে লাগলো।
আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই খালাও চলে আসলো।এসেই তিনি বললো

-“আল্লাহ তোমার তো সারা গায়ে পট্টি দেওয়া। এহন শরীরডা কেমন?”

-” আমি ভালো আছি খালা। আপনি আগে নিচের কাচ গুলো পরিষ্কার করেন ভালোভাবে।”

রোজিনা খালা দ্রুত ফ্লোর পরিষ্কার করে বেরিয়ে গেলো। তিন্নি জিসানের বিছানার পাশে দাড়িয়ে জিসানের দিকে পানির আরেকটা গ্লাস বাড়িয়ে ধরলো।

-“নিন পানি খেয়ে নিন।”

-“তুমি কখন এসেছ?”

-“রাতে, কেন আপনার মনে নেই? আসলে সূচনা আপু কল করে আপনার বিষয় বললো।”

-“এত রাতে তুমি একা কেনো আসলে?বাবা তো হসপিটালে ছিলো?”

তিন্নি বেশ অবাক হলো জিসান পাপার বিষয়ে কিভাবে জানে? তার মানে পাপার সাথে তার রেগুলার যোগাযোগ হয়।
-“এত রাতে একা আসা তোমার একদম ঠিক হয়নি।”

তিন্নির এবার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর?অথচ তার অসুস্থতার কথা শুনে আমি দৌড়ে আসলাম। আসলে আমার আসাটাই ভুল হয়েছে।
কিছুটা রেগে তিন্নি বললো

-“তাহলে কি আমার পুলিশ ফোর্স নিয়ে আসা দরকার ছিলো?”

জিসান বুঝতে পারলো তিন্নি রেগে গেছে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বউয়ের রাগী চেহারা তার ভীষণ ভালো লাগছে। সে তো এমনই একটা সংসার চেয়েছিলো। যেখানে তিন্নি হাজার বা তার উপরে অভিমান করবে। আর সে ভালোবাসা দিয়ে তার অভিমান ভাঙাবে।

-“বাবার সাথে সকালে আসতে পারতে?”

তিন্নির এবার মন চাইছে জিসানের মাথা ভেঙে ফেলতে। এই অসভ্য লোকটার জন্য আমি সারারাত জেগে ছিলাম। আমার যত্ন তার চোখে পড়লো না। সে ভীষণ রেগে জিসান কে বললো
-“আমায় অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে, আমি এখনই চলে যাচ্ছি।”
কথাটা বলে তিন্নি চলে যেতে নিলেই,জিসান তার হাত ধরে এক টানে নিজের বুকে ফেলে দিলো। এতে করে সে নিজেও কিছুটা ব্যথা পেলো। তবুও এই পরীটা বুকের মাঝে থাকলেও শান্তি।
তিন্নি অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। এমন কিছু হবে সে ভাবতেই পারেনি। গতরাতে জিসান জ্বরের ঘোরে অনেক কিছুই বলেছে। তাতে তিন্নি এতটা অবাক হয়নি। কিন্তু এখন, এখন তো সে সজ্ঞানে আছে।
জিসান তিন্নির মুখের সামনে আসা চুলগুলো তার কানে গুঁজে দিলো। আর কানে কানে ফিসফিস করে বললো

-“রাগলে তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগে। তোমার এই সরু নাকটা আরো লাল হয়ে যায়। আরে গাল দুটো একদম টুকটুকে লাল হয়ে যায়। মন চায় গাল টেনে দেই।”

জিষণ অবশ্য তাই করলো। সে সত্যি সত্যিই তিন্নির গাল টেনে দিলো। তিন্নি যেন 440 ভোল্টের শক খেলো। মানুষটার জ্বরের ঘোর কী এখনো কাটেনি?

-“হাত ছাড়ুন প্লিজ আপনি ব্যথা পাবেন।”

-“সকাল সকাল তোমাকে দেখেই তো আমার সব ব্যথা অর্ধেক চলে গেছে।”

তিন্নি কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। মন চাইছে এক দৌড়ে এখান থেকে পালাতে। বুকের ভেতর কেমন ধক ধক শব্দ হচ্ছে। আচ্ছা উনি এই শব্দ শুনে ফেলবে না তো?
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে তিন্নি বললো

-“আপনি দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসুন। নাস্তা করে মেডিসিন নিতে হবে।”

জিসান বুঝতে পেরে তিন্নিকে ছেড়ে দিলো। কিন্তু সমস্যা হলো সে ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। তিন্নি জিসানকে ফ্রেশ হতে হেল্প করলো। তিন্নি ভাবছে সে যদি না আসত তাহলে কিভাবে ম্যানেজ করতো উনি?
তিন্নি জিসান কে সকালের নাস্তা খাইয়ে মেডিসিন দিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর তিন্নির মা বাবা ও তামিম আসলো জিসানের বাসায়। অবনী রহমান বিভিন্ন ধরনের খাবার বানিয়ে নিয়ে এসেছেন। জিসানের আজ ভীষণ ভালো লাগছে। অনেকগুলো বছরে পর সে তার অসুস্থতার সময় পরিবারকে তার পাশে পেয়েছে। তিন্নির বাবা জিজ্ঞাসা করলেন এসব কিভাবে হল? জিসানও সব খুলে বললো।
মূলত জিসান একটা হাই প্রোফাইল কেস নিয়ে কাজ করছিলো। একজন বড় নেতার মেয়েকে একটা গাং কিডন্যাপ করেছিলো। উনার রেপুটেশন এর কথা চিন্তা করে বিষয়টা গোপন রাখা হয়েছে। তারা মেয়েটাকে খুঁজে বের করেছে।তাদের ইনফর্মার মেয়েটার লোকেশন জিসানদের গ্রুপকে জানিয়েছে। গতকাল জিসান আর তাহসান এর কাছে এই মেসেজটা এসেছিলো। তারা পুরো টিম মিলে সেই লোকেশনে যাওয়ার পর মেয়েটাকে সুস্থভাবে উদ্ধার করে। কিন্তু জিসান সেখানে খুব খারাপ ভাবে আহত হয়। রিয়াজ ঢাকায় না থাকাতে এ পুরো টিমটাকে জিসান লিড করছিলো।

মনে মনে আনিসুর রহমান জিসানকে নিয়ে ভীষণ প্রাউড ফিল করছে। এত সাহসী ছেলের কাছে তিনি তার মেয়ের হাত তুলে দিয়েছেন। অবনী রহমানের চোখ ভিজে উঠলো জিসানের অবস্থা দেখে। ছেলেটা এত রিস্কি প্রফেশনে কেন গেলো। জিসানের প্রতি ভীষণ মায়া কাজ করে অবনী রহমানের।
তামিম চুপিচুপি জিসান কে বললো

-“ভাইয়া এটাই সুবর্ণ সুযোগ আপুকে দিয়ে ইচ্ছামত খাটাও।সারাদিন শুধু শুধু আমার পিছনে লেগে থাকে। এইযে দিয়ে গেলাম আপুকে আর বাসা থেকে বের হতে দিবে না। বেশি ঝামেলা করলে তোমার রিভলভের দিয়ে ভয় দেখাবা।”

-“শালাবাবু তোমার বোনতো রিভলভার একটুও ভয় পায় না।”

-“আপনিতো এসিপি। আসামিদের রিমান্ডে যেসব থেরাপি দেন আপুর উপরে এপ্লাই করবেন।”

-“তুমি তো ভীষণ চালাক শালাবাবু। আমি তোমার বোনকে তোমার আইডিয়া অনুযায়ী অত্যাচার করি তারপর তুমি নিজেই আমার উপর কেস ঠুকে দিবা তাই না? তাছাড়া বউ পেটানোর অভ্যাস আমার নেই।তোমার বোনকে তো রানী বানিয়ে রাখতে চাই।”

-“আপু ভীষণ লাকী।”

-“আমার তো মনে হয় আমি ভীষণ লাকী।”

অনেকক্ষণ কথা বলে তিন্নির পরিবারের সবাই চলে গেলো আর তিনি রয়ে গেলো জিসানের সাথে। মূলত আনিসুর রহমান চাইছেন এ সুযোগে তারা দুজন একটু কাছাকাছি আসুক। দুজন দুজনকে বুঝুক।

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here