মেঘবিলাসী পর্ব ২৯+৩০+৩১

#মেঘবিলাসী
#israt_jahan_arina
#part_29

নিস্তব্ধ এই সন্ধ্যাবেলায় এ বিশাল বড় ফ্ল্যাটে নিজেকে ভীষণ একা লাগছে তিন্নির। অথচ এই বাসায় আরেকজন ব্যক্তির অস্তিত্ব রয়েছে। তবুও কেমন গুমোট পরিবেশ। নিজের বাসায় বাবা-মা আর দুষ্টু ভাইয়ের দুষ্টমিতে সারাটা দিনই তার কেটে যায়। কিন্তু এই মানুষটা সারাটা দিন কাজ,আর দিন শেষে বাসায় ফিরে একা।। কিভাবে একা থেকেছে এতদিন? তিন্নির কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে।

জিসান ভীষণ গোছানো একটা ছেলে। আর ভীষণ রুচিশীল। এটা বাসাটা দেখেই তা বোঝা যায়। সবকিছুই পরিপাটি। তিন্নি নিজেও অনেক গোছানো। পুরো ফ্লাট জুড়ে চারটি বেডরুম। তার মধ্যে একটা জিসানের বেডরুম। একটা তার এক্সারসাইজ রুম। আরেকটা মনে হয় বিডিং রুম। কারণ সেই রুমটাতে খুব সুন্দর একটা টেবিল আর অনেক রকমের বই আছে।আর একটা গেস্ট রুম। সেই রুমটাতে একটা খাট বিছানা আছে। একা মানুষের এত বিশাল বড় ফ্ল্যাটে থাকার কি দরকার। একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনলেই তো হতো। কষ্ট করে টাকা কামাই করছে আর সেগুলো নিজের ইচ্ছামত উড়াচ্ছে। অসভ্য লোক একটা।

তিন্নির রান্নাবান্নার তেমন ঝামেলা নেই। রোজিনা খালা রান্নাবান্না করে দিয়েছে। এছাড়াও তিন্নির মা বক্স ভর্তি খাবার নিয়ে এসেছিলো।রাতে খাবার পর তিন্নি দুজনের জন্য দুকাপ কফি নিয়ে রুমের দিকে এগুলো। জিসান সুয়ে সুয়ে টিভি দেখছে।তিন্নিকে দেখে আবারো সেই ঘায়েল করা হাসি দিলো।দুজনেই টিভি দেখছে।জিসান হঠাৎ বলে উঠলো

-“তোমাকে অনেক প্রবলেমে ফেলে দিলাম?তুমি চাইলে বাসায় চলে যেতে পারো।আমি ঠিক সামলে নিতে পারবো।আগেও বহুবার এমন হয়েছে।”

-“আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।”

-“আসলে আমি চাইনা আমার কারণে তোমার লেখাপড়ায় কোনো ক্ষতি হোক।”

-“তেমন সমস্যা নেই।পাপা বই পাঠিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া কাল শুক্রবার।আমার কলেজ অফ।দরকার পড়লে আমি এই জায়গা থেকে কলেজ যাবো।”

তিন্নি যে তাকে নিয়ে ওয়ারিড তা সে বুঝতে পারছে।তিন্নির এই কেয়ারিং আচরণ জিসানের খুব ভালো লাগছে।এমন অসুস্থ থাকলে যদি সব সময় তিন্নিকে কাছে পাওয়া যেতো,তাহলে সে সারা বছর অসুস্থ থাকতে রাজি।

তিন্নির সাথে জিসান তার মায়ের অনেক মিল খুঁজে পায়।তার মা ও ভীষণ আত্মমর্যাদার অধিকারী ছিলেন। হয়তো সে কারণে আর বাবার বাড়ি ফিরে যায় নি।তার মাও তিন্নির মত সুন্দরী ছিলেন।তার মধ্যেও তিন্নির মত গাম্ভীর্য ভাব ছিলো। মোট কথা তিন্নির মাঝে সে মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়।
এতো ভাবনার মাঝে হঠাৎ তিন্নি জিসানের কপালে হাত রাখলো।তিন্নির স্পর্শ পেয়ে জিসানের মনের কোণে শীতল হাওয়া বয়ে গেলো।তিন্নি বললো

-“এখন আর জ্বর নেই।শরীরে ব্যাথা কেমন আছে?”

এ কথা বলতে বলতে তিন্নি জিসানের পালস চেক করছে।তিন্নিকে একদম প্রফেশনাল ডক্টর দের মত লাগছে।ভবিষ্যৎ ডক্টর তিন্নি কেমন হবে এটা জিসান ভেবে ফেললো।
কিছু মনে পড়তে জিসান বললো

-“আমার কলিক তাহসান কে কেমন লেগেছে তোমার?”

এই প্রশ্ন শুনে তিন্নি মোটেও অবাক হলো না।সে বলল

-“আমার কেমন লেগেছে না জেনে সীমার কেমন লেগেছে তা জান বেশি জরুরি।”

জিসান হেসে ফেললো।তার বউয়ের আইকিউ লেভেল কেমন তা সে জেনেও কথা প্যাঁচাতে গেছে।

-“না আসলে সে সীমাকে ভীষণ পছন্দ করেছে।সে সীমার মা বাবার সাথে কথা বলতে চায়।”

-“সবই ঠিক আছে।কিন্তু সীমা অনেক ইমোশনাল মেয়ে।আর আপনাদের জবের ক্ষেত্রে এই ধরনের আঘাত অনেক সাধারণ বিষয়।মেয়েটা টলারেট করতে পারবে কিনা জানি না।”

-“তুমি যেহেতু পারছো,সেও পারবে।”

-“আমার ব্যাপারটা আলাদা।”

-“আলাদা কেনো হবে?আমরাও হাসবেন্ড ওয়াইফ।”

তিন্নির ভিতরটা কেপে উঠলো।আসলেই কি সে কারো ওয়াইফ হবার যোগ্য?
জিসান এবার তিন্নির হাত মুঠোয় পুড়ে নিলো।আর বললো

-“আমি জানিনা হাসবেন্ড নিয়ে তোমার কেমন আখাংকা ছিলো? বাট বিলিভ মী আমি আমার এক্সপেক্টেশন এর চাইতে অনেক বেশি পেয়েছি। আমি জানিনা তোমার মনে আমাদের এই সম্পর্কটা নিয়ে কি চলছে।কিন্তু আমি তোমাকে এবং আমাদের এই সম্পর্কটাকে ভীষণ সম্মান করি।”

তিন্নি কি বলবে বুঝতে পারছে না।মানুষটা এতো সুন্দর করে কেনো কথা বলে? জিসান বললো

-“আমি কখনো তোমার উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চাইনা।বহু বছর পর আমি তোমার মাধ্যেমে একটা পরিবার পেয়েছি।এইযে তুমি আমার পাশে আছো, এতেই আমার চলবে।”

তিন্নি এবার মুখ খুললো

-“এমনও হতে পারে আপনি আমাকে যেমন ভাবেন আমি তেমন না।”

জিসান তিন্নির কথার তেমন কোনো মানে খুজে পেলো না।তিন্নি কি কিছু লুকাচ্ছে?
জিসান ইগোল তীক্ষ্ণ চোখ মানুষের মন অনেকটা পড়তে জানে।।কিন্তু তিন্নির বেলায় এসে সব ভেস্তে যায়।এই মেয়ের দৃষ্টি এতটাই ধারালো যে সে এই চোখের দিকে তাকিয়ে ক্ষতি বিক্ষত হয়ে যায়।জিসান বুঝতে পারে এই পৃথিবীতে তার একটাই দুর্বলতা।আর তা হলো তিন্নি।তার ভালোবাসা।তার অর্ধাঙ্গিনী।

-“আমি তোমাকে কেমন ভাবি ?”

-“জানিনা।”

-“তাহলে কি জানো”

-“কিছু জানিনা।”

-“কিছু না জানলে গত রাতে আমাকে শর্টলেস করেছে কে?”

তিন্নি কিছুটা চমকে উঠলো
জিসান দুষ্ট হেসে বললো

-“গত রাতে আমার অসুস্থতার সুযোগ কে নিতে চেয়েছিলো?”

তিন্নি ভীষণ ঘাবড়ে গেলো।গত রাতে সে ঘোরের মাঝে জিসানের উন্মুক্ত বুকে বেশ কয়েকটা গভীর চুমু খেয়েছিলো। কোনো ভাবে উনি টের পায়নি তো?

-“অনেক রাত হয়েছে, এখন আপনার ঘুমানো দরকার।”

জিসান মুচকি হেসে বললো

-“জানো আমার এই রুমে একটা পরী থাকে।আমি ঘুমিয়ে গেলে আমাকে ঝাপ্টে ধরে চুমু খায়।”

তিন্নির চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।তার মানে গত রাতের কথা এই লোকের সব মনে আছে?আর ভাব নিয়েছে কিছু মনে নেই।তিন্নি রেগে বললো

-“আপনি ভীষণ অসভ্য একটা লোক।”

জিসান জোরে হেসে বললো

-“অসভ্য আমি কেনো হবো?অসভ্য তো ওই পরীটা।”

তিন্নির কান দিয়ে ধোয়া বের হচ্ছে।এই লোক আত্ত ফাজিল।অথচ কি ইনোসেন্ট ফেস করে রাখে।রেগে তিন্নি পাস ফিরে শুয়ে পড়লো।
জিসান কিছুক্ষণ ঘর কাপিয়ে হেসে শুয়ে পড়লো। গভীর রাতে তিন্নির ঘুম ভেংগে গেলো।নতুন জায়গাতে তার ঘুম খুব পাতলা হয়।সে বুঝতে পারলো জিসান তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে আছে।তিন্নি মোটেও জিসানকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না।তার খুব ভালো লাগছে।মন চাইছে সেও জিসানকে ঝাপটে ধরবে।কিন্তু এই লোকের কোনো বিশ্বাস নেই।সব টের পেয়ে যায়।

আচ্ছা গত রাতে উনি আমাকে ভালোবাসার কথা বলেছে এটাও নিশ্চয়ই তার মনে ছিলো।তাহলে এই বিষয়ে কিছু বললোনা কেনো?
_________________________
সকালে রোদের তীক্ষ্ণ আলোয় তিন্নির ঘুম ভঙেছে।বাতাসে শিউলী ফুলের সুবাস।গত রাতে সে বারান্দায় একটা শিউলী ফুল গাছ দেখেছে।আড়মোড়া ভেঙে তিন্নি পাশে তাকালো।জিসান পাশে নেই।ঘড়ির দিকে চোখ গেলো। আটটা বাজে। এতো সকলে উনি কোথায় গেলেন?
তিন্নি দ্রুত বিছানা ছাড়লো। রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে টুকটাক শব্দ শুনতে পেলো। রান্না ঘরের সামনে আসতেই দেখতে পেলো জিসান কিছু বানাচ্ছে।তিন্নি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো

-“আপনি অসুস্থ শরীর নিয়ে এখানে কি করছেন?”

-“আসলে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে অভ্যাস আমার। আজও তাই হলো, ঘুম ভেঙে গেলো। তাই ভাবলাম আজ তোমাকে আমার হাতের নাস্তা বানিয়ে খাওয়াই।”

-“আমি বলেছি আপনার হাতের নাস্তা খাব? এই অসুস্থ শরীর নিয়ে আপনি এসব কেন করছেন? ঘুম ভেঙে গেলে আমাকে ডাকতেন?”

-“তুমি গভীর ঘুমে ছিলে, তোমার মিষ্টি ঘুমটা ভাঙতে ইচ্ছে করেনি।”

-“ঘুম আবার মিষ্টি হয় নাকি?”

-“হয় তো,এইযে তুমি মিষ্টি করে ঘুমাও।”

-“আপনি বের হন।আমি করছি?”

-“আই অ্যাম ডান।খেয়ে বলো কেমন হয়েছে।”

তিন্নি দেখলো জিসান প্যানকেক আর sandwich বানিয়েছে।সাথে অরেঞ্জ জুস।
তিন্নি বললো

-“আমি আগে ফ্রেশ হয়ে আসি।”

তারা টেবিলে বসে নাস্তা শুরু করলো।তিন্নি খাবার গুলো মুখে দিয়ে অবাক হলো।জিসান প্রশ্ন করলো কেমন হয়েছে?

-“হুমম!অনেক ভালো হয়েছে আপনি এতো ভালো রান্না কিভাবে শিখলেন?”

জিসান মলিন হেসে বললো

-“পরিস্থিতি শিখিয়ে দিয়েছে।মা যাওয়ার পর আমার বাধ্য হয়ে রান্না শিখতে হয়েছে।তখন রান্নার জন্য লোক রাখার মতো পরিস্থিতি ছিল না।তবে এখন আমার রান্না করতে ভালই লাগে।”

-“আপনার নানুর বাসার কারো সাথে যোগাযোগ নেই?”

-“নানা ভাই বেচে নেই।নানু আছে।আর এক মামা আছে।তাদের সাথে আমার যোগাযোগ নেই।তবে আমার দুই মামাতো ভাই বোন তাদের সাথে যোগাযোগ হয়।”

-“আপনি কি এখনো মামার উপর রাগ জমিয়ে রেখেছে?”

-“আসলে রাগ নেই।তবে অভিমান জমা আছে।আসলে যেই সম্পর্ক মা থাকতে ঠিক হয়নি।আমিও ঠিক করতে আগ্রহী নই।”

তিন্নি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।আসলেই আমরা মানুষরা সম্পর্ক গুলোকে কেমন জটিল করে ফেলি।
পরিস্থিতি নরমাল করতে জিসান বললো

-“আর কত দিন আপনি তে আটকে থাকবে? এবার তো তুমিতে আসো।”

তিন্নি ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিলো

-“আপনিতেই আমি বেশি কমফোর্টএবল।”
___________
তিন্নি একটু বাহিরে এসেছে।হুট করে চলে আসায় কিছুই আনতে পারে নি।পাপা ব্যাগ প্যাক করে পাঠিয়েছে।কিন্তু তবুও প্রয়োজনীয় কিছু আনা দরকার। জিসানকে বললে হয়তো তাকে আসতে দিতো না।তাই নিচে হাঁটতে যাবে বলে বেরিয়েছে।বাসায় এসে ডোর বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো।কিন্তু দরজা জিসান না অন্য একটা মেয়ে খুলেছে।তিন্নি কিছুটা অবাক হলো।
সামনে দাড়ানো মেয়েটা তিন্নিকে দেখে কপাল কুচকে ফেললো।এই এক ঘণ্টার মাঝে অন্য মেয়ে বাসায় কি করে এলো?
মেয়েটা দরজার অপজিটে অতি সুন্দরী মেয়ে দেখে ভর্খে গেলো।মেয়েটা তিন্নিকে বললো

-“কাকে চাই?”

মেয়েটার এমন কথায় তিন্নি বুজে নিলো মেয়েটা বেয়াদব।তিন্নি কিছু না বলে পাস কাটিয়ে বাসার ভিতরে চলে আসলো।মেয়েটা অবাক হয়ে বললো

-“আশ্চর্য আপনি বাসার ভিতরে কেন আসছেন? কারো বাসায় এভাবে চলে আসাটা ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না।”

এবার তিন্নির মেজাজ ভীষণ খারাপ হলো। মেয়েটিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে বয়সে তার চাইতে ছোট।
সে বললো

-“এই বাসাটা কি তোমার?”

এবার মেয়েটা কিছুটা থতমত খেয়ে রেগে বললো

-“এই বাসাটা আমার না হলেও এই বাসায় আমার অধিকার আছে।”

-“তাই নাকি? তা কি অধিকার?”

-“সেটা আপনাকে কেনো বলবো?”

-“তুমি কি জানো তুমি ভীষণ রকমের একটা অসভ্য মেয়ে? বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সে ম্যানার্স টুকু তোমার মধ্যে নেই।”

-“আপনি আমাকে অসভ্য বলছেন?”

-“শুধু অসভ্য না বাবার আদরে বখে যাওয়া মেয়ে মনে হচ্ছে তোমাকে আমার।”

-“এত বড় কথা? এখনই আমি জিসান ভাইকে বলে আপনার মজা দেখাচ্ছি।”

তাদের চেঁচামেচিতে অলরেডি জিসান দরজার পাশে এসে হাজির। তিন্নি খেয়াল করলো যে জিসানের সাথে একটা ছেলে এসেছে।
জিসান এসে বললো

-“কি ব্যাপার লেডিস? এখানে এত চেঁচামেচি কিসের?”

তিন্নি এবার রাগান্বিত চোখে জিসানের দিকে তাকালো। তিন্নির দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করে জিসান বুঝতে পারলো এখানে নিশ্চয়ই কোন সাইক্লোন বয়ে গেছে।#মেঘবিলাসী
#israt_jahan_arina
#part_30

শ্রাবণের ঝড়ো হাওয়া বইছে চারদিকে।আকাশে ঘনো কালো মেঘ ডাকছে।এমন পরিবেশে তিন্নির মন খুব ভালো থাকে।কিন্তু এই মুহূর্তে তিন্নির মেজাজ তুঙ্গে আছে।

তিন্নি জানতে পেরেছে সেই মেয়েটার নাম অদিতি।আর জিসানের পাশে যে ছেলে ছিলো তার নাম অনিক।তারা জিসানের মামাতো ভাই বোন।অনিক ছেলেটাকে সে বিয়ের সময় দেখেছে।কিন্তু মেয়েটাকে আজ প্রথম দেখলো।মেয়েটাকে তিন্নির মোটেও ভালো লাগেনি।অন্যের বাড়িতে এসে অনধিকার চর্চা করা মানুষ জন তিন্নির একদম পছন্দ না।অফিসিয়ালি এই বাড়িটাও তিন্নির।কই সে তো অধিকার দেখাতে যায়নি।আর ওই মেয়ে একদম উরে আসে জুড়ে বসেছে।

তিন্নি খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে।তিন্নির চোখে মুখে রাগ ফুটে আছে।জিসান রুমে এসে তিন্নির রাগান্বিত মুখ দেখে আরেক দফা প্রেমে পড়লো।করো রাগী চোখে তাকানো এতটা মোহনীয় হতে পারে তা তার প্রিয়তমাকে না দেখলে বুঝতে পারতো না।
জিসানকে দেখে তারা তেমন কিছু বলেনি তখন।জিসান তিন্নির সাথে অদিতির পরিচয় করিয়ে দেয়।অদিতির মুখটা কেমন চুপসে গেছিলো।জিসান বুঝতে পেরেছে কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে।

জিসানের অসুস্থতার কথা শুনে তারা ভাইবোন তাকে দেখতে এসেছে। জিসান তো প্রথমে তাদের দেখে বেশ অবাক হয়েছিল।অদিতি এই প্রথম জিসানের বাসায় আসলো।
তিন্নির যেমন অদিতিকে পছন্দ হয়নি।অদিতির ও তিন্নিকে পছন্দ হয়নি।অদিতিদের এলাকায় সেই সবচাইতে বেশি সুন্দরী।কিন্তু কিছু মেয়েদের ফোবিয়া আছে,নিজের চাইতে বেশি সুন্দরী মেয়েদের পছন্দ করে না।এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়।সে শুনেছিলো জিসান ভাইয়ের বউ সুন্দরী।কিন্তু তিন্নি এতটা স্মার্ট আর সুন্দরী হবে তা সে ভাবতে পারেনি।তিন্নির সৌন্দর্যে সে ভীষণ জেলাস হয়েছে।

রাতে খাওয়া সময়টাতেও পরিবেশ বেশ থমথমে ছিলো।জিসান আর অনিক অনেক কথা বললেও তিন্নি আর অদিতি তেমন কোনো কথা বলেনি।খাওয়া শেষ করে তিন ভাই বোন অনেক সময় পর্যন্ত আড্ডা দিলো।তিন্নি তার রুমেই ছিলো।
জিসান রুমে এসেছে টের পেয়ে তিন্নি রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকালো।অনেকক্ষণ যাবত সে জিসানের জন্য অপেক্ষা করছিলো।তিন্নি রাগে কটমট করতে করতে বললো

-“এখন আপনার আসার সময় হলো?অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।আবার এতো রাত অব্দি আড্ডাও দিচ্ছেন।”

জিসান বুজলো তার প্রিয়তমা অনেক বেশি রেগে আছে।সে বললো

-“আসলে ওরা এতদিন পর আসলো তাই সময় দিলাম। তা ছাড়া অদিতি প্রথম আসলো।”

অদিতির নাম শুনে তিন্নি রাগে জিসানের মাথা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছা করছিলো।রেগে বললো

-“আপনি তো দেখা যায় এখন সুস্থ আছেন। ঘুরে বেড়াতে পারছেন,আড্ডা দিতে পারছেন। কালই আমি বাসায় চলে যাবো।আমার আর কোনো প্রয়োজন নেই।”

হঠাৎ জিসান তিন্নির দিকে এগিয়ে আসছে।জিসানের এভাবে আসা দেখে তিন্নি দাড়িয়ে গেলো।জিসান তিন্নির খুব কাছে এসে দাড়ালো।তিন্নি সরে যেতে নিলে জিসান তিন্নি কোমরে এক হাত দিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।তিন্নির চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম।জিসান বললো

-“আমার লাইফ তোমার প্রয়োজন কখনো ফুরাবে না।”

-” দূরে সরুন।ভীষণ অস্যভ্য আপনি।”

-“অসভ্য কাকে বলে জানো?”

এবার তিন্নির মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না ।
হঠাৎ জিসান তিন্নির ঘাড়ে মুখ গুজে দিলো।তিন্নি শিউরে উঠলো।জিসান পর পর তিনটা চুমু খেলো।তিন্নি যেনো বরফের মতো জমে গেলো।তার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসলো। জিসান টুপ করে তিন্নির গালেও চুমু খেয়ে নিলো।তিন্নির বিস্ময় যেনো কাটছে না।নিশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে।জিসান তিন্নির কানে কানে বললো

-“এইযে তোমার অনুমতি না নিয়ে গভীর ভাবে ছুয়ে দিলাম। এটাকে অস্যভোতা বলে।আমিকি কখনো এমন করেছি?তবে অসভ্য টাইটেল কেনো দাও?”

এই কথা বলে সে তিন্নি কানে ঠোট ছোঁয়ালো।
তিন্নির সারা শরীর কেঁপে উঠলো।মনে হচ্ছে কেউ তার গলা চেপে ধরেছে।সে নিশ্বাস নিতে পারছে না। কাপা কাপা গলায় বললো

-“এইযে মাত্র করলেন?”

-“সেটাতো তোমাকে এক্সাম্পল দিয়েছি।”

তিন্নি ভালোই বুঝতে পড়ছে জিসান তাকে জব্দ করার চেষ্টা করছে।সে জিসানের পায়ে জোরে পা চেপে ধরলো।জিসান দ্রুত পা সরিয়ে হাত দিয়ে পা চেপে ধরলো।আর বললো

-“আরে আমার পা ভেঙে ফেলবে নাকি? এমনি অসুস্থ মানুষ আমি।”

তিন্নি মুচকি হেসে বললো

-“ওহ! সরি।আপনি ব্যাথা পেয়েছেন?আমি তো অসভ্যদের কি ভাবে শাস্তি দিতে হয় তার এক্সাম্পল দিচ্ছিলাম।”

জিসান হা করে তাকিয়ে আছে।এই মেয়েকে কিছুতেই বাগে আনা সম্ভব না। এর জন্যই গুরুজনের বলে,বোকা মেয়েরা বউ হিসেবে ভালো।” কিন্তু তার বুদ্ধিমতী বউকে বোকা বানানো তার পক্ষে অসম্ভব।
___________________
সকালে ঘুম থেকে উঠে তিন্নি ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে গেলো।সেখানে যেয়ে দেখতে পেলো অদিতি কিছু রান্না করছে।তিন্নিকে দেখে সে মলিন হেসে বললো

-“জানেন ভাবী,আমাদের বাসার বউদের খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয়।আমার আম্মু ভাবীদের তাই দেখেছি।কিন্তু ঢাকা শহরের বউরা এসব মানেনা।”

-“তোমাদের বাসায় মনে হয় বউদের উপর আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করা হয়।কিন্তু আমার ফ্যামিলি শিখিয়েছে অন্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করতে।আসলে তুমি অনেক ভুলভাল শিখেছো।আমার ফ্যামিলিতে কয়েকদিন থাকো দেখবে তোমার মাথা থেকে এইসব ফালতু লজিক মুছে যাবে।”

অদিতি মুখ অপমানে লাল হয়ে গেলো।সে কিছু বলার আগেই জিসান আসলো। আর বললো

-“দুই ভাবী ননদ মিলে কি করছো?”

তিন্নি মুচকি হেসে বললো

-“আসলে আমার ননদের মাথায় কিছু কুসংস্কার ছিলো তা দূর করছি।এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমার ননদ অনেক কিছুতে আপগ্রেড হতে পারেনি।”

অদিতি তিন্নির কথায় ভীষণ অপমানবোধ করলো।জিসান বুঝতে পারছে এই দুই নারী একে অপরকে পছন্দ করে না।তাই পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে জিসান বললো

-“অদিতি তুই রান্না ঘরে কি করছিস?”

এবার অদিতি সব ভাবনা ফেলে হাসি মুখে বললো

-“জিসান ভাই আমি আপনার জন্য আলু পরোটা ঘি দিয়ে ভেজেছি।খেয়ে মজা পাবেন।”

তিন্নি বিরক্ত মুখে বললো

-“সরি তোমার ভাইয়া এইসব খেতে পারবে না।তার ডায়েট চার্ট এ এইসব খাবার নেই।আমিও এতো অয়েলি ফুড খাইনা।তবুও তুমি কষ্ট করে করেছো,আমি খেয়ে নিব।”

অদিতি যেনো পারেনা কেঁদে দে।সে রেগে বললো

-“কে করেছে এমন চার্ট?ওই ডক্টর কল করো ভাইয়া।”

তিন্নি হেসে বললো

-“আমি করেছি।”

-“কেনো আপনিকি ডক্টর?”

এবার জিসান হেসে বললো

-“আরে তোর ভাবী মেডিকেল স্টুডেন্ট জানিস না?”

অদিতি অবাক হলো। এতক্ষণ তিন্নির রূপে সে জেলার ছিলো। কিন্তু এখন তিন্নির যোগ্যতার সামনে নিজেকে বেশ ছোট মনে হচ্ছে।সব ক্লাসে সে কোনো মতে পাস করে। HSC টেস্ট পরীক্ষায় সে তিন সাবজেক্টে ফেল করেছে।টাকা দিয়ে অ্যাডমিট কার্ড পেয়েছে।

তিন্নি জিসানের জন্য স্যান্ডউইচ এবং ভেজিটেবল স্যুপ করেছে। আর অদিতির বানানো খাবার সে কিছুটা খেয়েছে।
নাস্তা করতে করতে অনিক বললো

-“ভাবী আমিও মেডিকেলে 2 বার ট্রাই করেছি।কোনো বার হয়নি।আর আমাদের অদিতিকে নিয়ে সেই ভরসা নেই।এইবার টেস্ট পরীক্ষায় তিন সাবজেক্টে ফেল।পড়ে আব্বু প্রিন্সিপালকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করেছে।”

অদিতির মন চাইছে নিজের ভাইয়ের মাথা ফাটাতে। মানুষ সব জায়গায় নিজের বোনের সুনাম করে আর এই ছেলে সারাজীবন তার দুর্নাম করে আসলো।
তিনি হেসে বললো

-“আসলে তেমন কঠিন কিছু না বাজে চিন্তা বাত দিয়ে মনোযোগ দিয়ে একটু পড়তে হবে।”

তিন্নির কথার মানে সে ভালোভাবে বুঝতে পারলো।
অনিক জিসানকে উদ্দেশ্য করে বললো

-“জিসান ভাই আমাদের কিন্তু আজ ফিরতে হবে।”

-“কেনো?আর কয়েক দিন থেকে যা।”

অদিতিও বললো

-“ভাইয়া আর কয়দিন থাকি?”

অনিক ধমক দিয়ে বললো
-“আরে বেকুব তোর জন্যই তো যাওয়া লাগতেছে, সামনে না তো পরীক্ষা।”

অদিতি মুখে আঁধার নেমে এলো। জিসান বললো
-“মন খারাপ করিস না, তোর পরীক্ষা শেষ হোক আমি নিজে গিয়ে তোকে নিয়ে আসব।”

তিন্নির এখন নিজেরই খারাপ লাগছে। মেয়েদের ছোট। তার সাথে এতটা শক্ত হওয়া উচিত হয়নি। তাই সে অদিতির সাথে কথা বলতে তার রুমে গেলো।
অদিতি তার ব্যাগ প্যাক করছিলো, তিন্নিকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো।তিন্নি তাকে দেখে মিষ্টি হাসি দিলো।আর বললো

-“তোমাদের বাস কয়টায়?”

অদিতি বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো
-“সন্ধ্যা সাতটায়।”

-“তুমি কি আমার উপর ভীষণ রেগে আছো?”

অদিতি অবাক হয়ে তিন্নির দিকে তাকালো। তিন্নির মুখে এমন কিছু শুনবে সে ভাবতে পারেনি। তিন্নি আবার বলে উঠলো

-“তুমি জানো আমাদের মেয়েদের সবচেয়ে বড় সম্পদ কি?”

অদিতি মাথা নেড়ে না জানালো। তিন্নি আবার বলতে শুরু করলো

-“আমাদের মেয়েদের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে আত্মমর্যাদা। অনেকেই সেটাকে ইগো বলে থাকে। যেকোনো পরিস্থিতিতে কখনোই নিজের আত্মমর্যাদা কে বিসর্জন দিবে না। জীবনে চলার পথে অনেক কিছুই তোমার অনেক পছন্দ হবে।কিন্তু সে জিনিসটা যদি অন্য কারো সম্পদ হয়,সেটা জেনেও তার আশা রাখাটা বোকামি।তুমি নিশ্চই বোকার দলে না?তুমি এখনো অনেক ছোট।একটু বড় হও, দেখবে তোমার কদর কতো বেশি।আমার মতে তুমি তার কাছে ধরা দাও যে তোমাকে ভালোবাসে।তার সাথে থাকো যে তোমাকে তোমার প্রাপ্য সম্মান দিতে পারবে।”

এতক্ষণ অদিতি চুপ করে তিন্নির কথা শুনছিলো। এই মুহূর্তে এসে আরো একটা জিনিস আবিষ্কার করলো। তিন্নি খুব সুন্দর করে কথা বলতে জানে।না চাইতেও কেনো যেনো তার তিন্নিকে ভালো লাগতে শুরু করলো। পরবর্তী মুহূর্তে সেটাও ভাবলো

-“জিসান ভাইয়ের জন্য এই মেয়েটাই সবচেয়ে পারফেক্ট।”

তিন্নি মুচকি হেসে বললো
-“তোমার ভাইকে রাজি করিয়ে আমি একসময় তোমাদের বাসায় যাব। তোমার দাদীকে বলবে আমার বিরিয়ানী অনেক পছন্দ।আমার উপর কি এখনো তোমার ক্ষোভ রয়ে গেছে?”

অদিতি হেসে বললো
-“আমার দেখা সবচেয়ে শুদ্ধতম নারী আপনি। আসলেই এক পলকে কাউকে জাজ করা যায় না।”#মেঘবিলাসী
#israt_jahan_arina
#part_31

অদিতি আর অনিক চলে গেলো সন্ধ্যা নাগাত।তিন্নি আর জিসান ও বেরিয়ে পড়লো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।তিন্নি ড্রাইভে করছে।জিসান পাশে বসে আছে।তিন্নি ড্রাইভিং খুব ভালো জানে।মূলত হাসবেন্ডরা ড্রাইভে করে,আর ওয়াইফ পাশে বসে থাকে।কিন্তু নিয়মটা উল্টো হলে যে এত ভালো লাগে তা আগে জানা ছিল না।জিসান বিষয়টা খুব এনজয় করছে।হঠাৎ সে তিন্নিকে বললো

-“আচ্ছা তোমার আর অদিতির মধ্যে কি হয়েছিলো বলো তো?আসার পর তোমরা খুব একটা কথা বলনি।কিন্তু যাওয়ার সময় সে তোমাকে হাগ করে গেলো।কাহিনী বুজলাম না।”

তিন্নি মুচকি হেসে বললো
-“কাহিনী কিছুই না।সে একটা ধাঁধার মধ্যে আটকে গেছিলো।আমি জাস্ট সলভড করে দিয়েছি।”

-“কি ধাঁধা?”

-“বলা যাবেনা।সিক্রেট।”

-“তোমরা নারীরা নিজেরাই এক একটা ধাঁধা।আমরা নিরীহ জাতি এই ধাঁধা সমাধান করতে করতে নিঃশেষ হয়ে যাবো।”

তিন্নি শব্দ করে হেসে ফেললো।আর জিসান মুগ্ধ চোখে সেই মনোরম দৃশ্য দেখতে লাগলো।হাসলে তিন্নির চোখ ছোট হয়ে আসে।এই বিষয়টা জিসানের খুব ভালো লাগে।
আজ জিসানের ব্যান্ডেজ খোলা হবে।হসপিটালের করিডোরে বসে আছে তিন্নি।কিছুক্ষন পর জিসান আসলো।তিন্নি দ্রুত তার হাত ধরলো।তিন্নি বললো

-“পায়ের কি অবস্থা?আবার নতুন ব্যান্ডেজ কেনো?ঘা এখনো শুকায় নি?”

জিসান বললো
-” না ফ্র্যাকচার আছে।আরো কিছু দিন লাগবে ঠিক হতে।”

তিন্নিকে ভীষণ চিন্তিত দেখা গেলো।জিসান তিন্নির দিকে আড় চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।আসলে তার ঘা অনেক টা শুকিয়ে গেছে।কিন্তু সে তবুও আবার ব্যান্ডেজ করিয়েছে।সে আরো কিছুদিন তিন্নিকে নিজের কাছে রাখতে চায়।তাকে অসুস্থ রেখে তিন্নি কখনো যাবেনা।তারা সোজা বাসায় চলে আসলো।

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে তিন্নি পড়তে বসলো।কয়েক দিন তার পরা ঠিক মত হয়নি।জিসান তাকে পড়তে বসতে বলতো।কিন্তু সে মনোযোগ দিতে পারতো না।তাই আজ সে মন স্থির করে পড়তে বসলো।জিসান ল্যাপটপে কাজ করছে।তিন্নি অনেক সময় চেষ্টা করেও পড়ায় মনোযোগ দিতে পারেনি।
তিন্নি বেশ অবাক হলো।আগে কখনো এমন হয়নি।বই হচ্ছে তার সব চাইতে প্রিয় বন্ধু।তবে আজ কাল এই বন্ধুর সাথে তার সখ্যতা কমে যাচ্ছে।তিন্নি তার মনকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না।তার জিসানের সাথে কথা বলতে মন চাইছে।তিন্নিকে ছটফট করতে দেখে জিসান বললো

-“কোনো সমস্যা তিন্নি?তোমার কোনো অুসুবিধা হচ্ছে?”

তিন্নি ভাবছে কি করে বলবে যে সে পড়ায় মন দিতে পারছেনা।তার গল্প করতে মন চাইছে।এই কথা মামনি জানলে নির্ঘাত হার্টফেল করতো।মামনির মতে সে বই ছাড়া কিছু বুজে না।পারলে বই বাথরুমে নিয়ে যায়।আর সেই তিন্নির পড়তে ভালো লাগছে না।ভাবনা থেকে বের হয়ে সে জিসানকে বললো

-“না,কোনো সমস্যা নেই।কফি খাবেন?”

-“দরকার নেই।তুমি আগে পড়া শেষ করো।”

তিন্নির এবার রাগ লাগছে।সে কফির বাহানায় আখান থেকে উঠতে চাইছে।আর এই ফাজিল ব্যাটা তাকে এখানে বসে থাকতে বলছে।এই ফাজিল লোক কি তার চাইতে বেশি পড়ুয়া নাকি?

-“আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।আমি পরা কমপ্লিট করে নিবো।”

-“আমি চিন্তা না করলে আর কে করবে বলো?আমার সেবা করতে যেয়ে যদি দেশে একটা ডক্টর কমে যায়,তবে জাতি কি আমায় মেনে নিবে?”

-“আপনাকে জাতির চিন্তা করতে হবে না।নিজের চিন্তা করুন।”

তিন্নি ঝটপট দুই কাপ কফি নিয়ে আসলো।তিন্নি জিসানের ল্যাপটপে চোখ রেখেই আবার ফিরিয়ে নিলো।জিসান বেশ কয়েটা মেয়ের লাশের পিক দেখছিলো।আর কিছু রিপোর্ট পড়ছিলো।তিন্নি চোখ বন্ধ করে ফেললো।জিসান বুঝতে পেরে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলো।আর বললো
-“ভয় পেয়েছ?”

-“না,আমি সহজে ভয় পাইনা।তবে খারাপ লাগে।”

-“এই জব করতে যেয়ে আমার মনের অনেক আফসোস দূর হয়েছে।অন্যদের কষ্ট দেখে মনে হয়েছে আমার লাইফ অনেক ভালো কাটছে।”

-“মেডিকেলে যেহেতু পড়ছি।তাই লাশ দেখাটা আমাদের জন্য সহজ ব্যাপার হয়ে যাবে।তবে একটা মানুষ মারা গেলে তার সাথে পুরো পরিবারই শেষ হয়ে যায়।ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগে।যারা অন্যায় করে তারা বুক ফুলিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়ায়।আর ভিকটিম আর তার পরিবার সমাজের ভয়ে মুখ লুকিয়ে থাকে।কিন্তু ক্ষমতার কাছে আইন মুহূর্তেই বিক্রি হয়ে যায়।আর জানোয়ার গুলি ছাড়া পেয়ে যায়।”

-“আমরা মানুষরা ওদের জানোয়ারের সাথে তুলনা করে ভুল করি।কারণ মানুষ জানোয়ারের চাইতেও বেশি হিংস্র।আর সবাই ক্ষমতার কাছে বিকে যায়না।”

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর জিসান মুচকি হেসে বললো

-“জানো আমার দেখা সব চাইতে স্ট্রং পার্সোনালিটি সম্পন্ন মানুষটা তুমি।”

তিন্নি চমকে উঠলো।জিসান হেসে বললো
-“যারা রূপের মোহে পড়ে,তারা একটা সময় সেই মোহ থেকে বেরিয়ে আসে।কিন্তু যদি কেউ কারো গুন বা ব্যাক্তিত্বের প্রেমে পড়ে।তবে তা সারা জীবন রয়ে যায়।”

-“আপনি কিসের মোহে পড়বেন?”

জিসান আবার তিন্নিকে সেই দম বন্ধ করা হয় উপহার দিয়ে বললো

-“আমিতো অলরেডী পরে গেছি,তোমার মোহে।তবে সেটা শুধু রূপে না তোমার ব্যাক্তিত্বের মোহেও।”

তিন্নি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পরলো।তিন্নি এবার নিজেকে সামলালো।এই মানুষটার মোহে পড়ে গা ভাসানো মোটেও উচিত হবে না।সে মোটেও এতটা স্পেশাল না। তাই সে বললো

-“আমার মনে হয় আপনার একবার নানুর সাথে দেখা করা উচিত?”

-“ঠিক বলেছো।তোমার নানুকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে।উনি ভালো টিপস দিতে পারে।”

তিন্নি কপাল কুঁচকে বললো
-“আমি আমার নানুর কথা বলিনি।আপনার নানুর কথা বলেছি।”

-“তিন্নি তুমি জানো আমি কেনো যেতে চাইনা।”

-“মায়ের সাথে নানা ভাই আর মামা সম্পর্ক নষ্ট করেছে।নানু কিন্তু স্বামী আর ছেলের ভয়ে কখনো মায়ের কাছে আসতে পারেনি।”

তিন্নি জিসানের মাকে মা বলে সম্মধন করেছে শুনে জিসান খুশি হলো।সে বললো

-“তোমাকে কে বলেছে?”

-“আমি অদিতির কাছে শুনেছি।নানু আপনাকে একবার দেখতে চায়।অনেক কান্নাকাটি করে অদিতির কাছে।কিন্তু সে ভয়ে আপনাকে বলতে পারেনি।আপনার একবার যাওয়া উচিত।”

-“ভেবে দেখবো।”
_____________________
সকাল সকাল তিন্নির ঘুম ভাঙলো জিসানের ফোনের শব্দে।জিসান তখনও ঘুমাচ্ছে।তিন্নি ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো ‘রিয়াজ ভাই’ লিখা।কলটা রিসিভ করবে কিনা ভেবে পাচ্ছে না।উপায় না পেয়ে কল রিসিভ করলো।
কল ধরার সাথে সাথে ওপর পাস থেকে সূচনা বলে উঠলো

-“জিসান তুই কই?আমাকে এক্ষুনি এই বাসা থেকে নিয়ে যা।এই ফালতু লোকের সাথে আমি থাকবো না।”

তিন্নি কি বলবে বুঝতে পারছে না।তবে সূচনার আর রিয়াজ ভাইয়ের ঝগড়া তার খুব ভালো লাগে।ভীষণ মিষ্টি ঝগড়া তাদের।আচ্ছা সেও কি এই মানুষটার সাথে এমন মিষ্টি ঝগড়া করবে?
সূচনা আবার বললো

-“এই গাধা আমার প্রেগনেন্সির খবর শুনে আধা ঘণ্টা ধরে বেকুবের মতো কাদতেছে। এমনিতেই আমার শরীরটা ভাল না। আর এই বেকুবের কান্ড দেখে আমার মাথা ধরে গেছে।”

তিন্নির ভীষণ হাসি পাচ্ছে। এত ভালো একটা খবর কেউ এভাবে দিতে পারে সেটা সে ভাবতেই পারেনি। জিসান আর সূচনার বন্ধুত্বের এই বন্ডিং টা সচরাচর দেখা যায় না। এবার তিন্নি বললো

-“কংগ্রাচুলেশন আপু।”

-“এই কে তুমি ?জিসানের ফোন তোমার আছে কেন?”

তিন্নি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো। সে বললো
-“আপু আমি তিন্নি বলছি।”

-“তিন্নি! তুমি এখনো আছ জিসানের বাসায়। এইজন্যেই এই ফাজিল আমার কল রিসিভ করেনা। ব্যাটা বউয়ের সাথে রোমান্স করতে ব্যস্ত।”

তিনি ভীষণ লজ্জা পেলো। সে বুঝতে পেরেছে সূচনার মাথা গরম। তা না হলে সে কখনোই তিন্নি সাথে এভাবে কথা বলে না। হঠাৎ পাশের চোখ পড়তেই দেখলো জিসান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তুমি আবারও লজ্জা পেলো। বিনা অনুমতিতে কারো ফোন ধরা একদমই উচিত না। তিন্নি এবার ফোনটা জিসানের দিকে বাড়িয়ে বললো

-“সূচনা আপু কল করেছে।”

জিসান হ্যালো বলতেই সূচনা ধমক দিয়ে বললো

-“বেটা বউ পাশে থাকলে দুনিয়াতে কিছু চোখে পড়ে না।”

-“কি হয়েছে এত রেগে আছিস কেন?”

-“আমি এই গাধার সাথে সংসার করব না তোর বাসায় আমাকে নিয়ে যা।”

-“আবার কি হয়েছে? তোরা কি দুই দিনও শান্তিতে সংসার করতে পারিসনা?”

-“আমার প্রেগনেন্সির খবর শুনে এই গাধা আধাঘণ্টা ধরে কানতেছে। মনে হচ্ছে আমি প্রেগনেন্ট না আমি ক্যান্সারের রোগী।”

জিসানের মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে বললো

-“এমন একটা খবর তুই এভাবে দিচ্ছিস।”

-“তো কি করব। এই বেকুব কান্নাকাটি করে আমার সমস্ত আনন্দটাই নষ্ট করে দিলো।”

-“এখন ঝগড়া ঝাটি বন্ধ কর,বিকেলে আসছি।”

-“অসুস্থ শরীর নিয়ে কেমনে আসবি?”

-“আরে এখন অনেকটা সুস্থ আছি, আমি বিকেলে আসছি।”

-“সাথে তিন্নিকে নিয়ে আসবি।”

-“আচ্ছা ঠিক আছে।”

কল কাটার পর জিসান আর তিন্নি একসাথে হেসে উঠলো।
বিকেলে জিসান তিন্নি রেডি হচ্ছে। সূচনার বাসায় যাবে।
তিন্নি একটা সুন্দর সালোয়ার কামিজ পড়েছে। লাইট পার্পল কালারের জামাটা তিন্নির রূপকে যেন দ্বিগুন বাড়িয়ে দিলো।তিন্নি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছে। আর জিষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে। জনমানবহীন এই বাসাটা আজ জান্নাতের বাগিচা মনে হচ্ছে। আর তার ঠিক সামনে বসে আছে জান্নাতের হুর।
হঠাৎ তিন্নি বললো

-“আমাদের তো কিছু গিফট নিয়ে যাওয়া উচিত?”

-“আচ্ছা চলো, যেতে যেতে দেখা যাবে কি নেওয়া যায়।”

সন্ধ্যা নাগাদ তারা সূচনার বাসায় পৌঁছলো।কিন্তু বাসায় পৌছে আরেক কাণ্ড।রিয়াজ রান্না করছে আর সূচনা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। তাদেরকে বসতে বলেই সূচনা বললো

-“এই লোকের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সকাল থেকে আমাকে একটা কাজও করতে দেয়নি। আজকের সব রান্নাবান্না সে নিজেই করছে।”

জিসান হেসে বললো

-“ভালো তো। তোর জামাই আমাদের দিয়ে অনেক খাটায়। বাসায় ওকে বেশি করে খাটা।”

এদের কথা শুনে তিন্নি চোখ বড় করে তাকালো। হঠাৎই রিয়াজ ভাইয়ের জন্যও তিন্নির ভীষণ মায়া হচ্ছে। এই দুই ফ্রেন্ড মিলে বেচারাকে ভীষণ চাপে রেখেছে।
রিয়াজ রান্নাঘর থেকে এসে তিন্নির উদ্দেশ্যে বললো

-“তিন্নি তুমিতো মেডিকেল স্টুডেন্ট। প্লিজ ওকে বোঝাও এই সময় সাবধানে থাকতে হবে।”

-“আপু ভাইয়া কিন্তু ঠিক বলেছেন। আপনাকে এখন অনেক সাবধানে থাকতে হবে। তবে ভাইয়া আপনাকেও বলি। প্রেগনেন্সি খুবই স্বাভাবিক একটা জিনিস। আপু কিন্তু স্বাভাবিক সব কাজকর্ম করতে পারবে। বরং একদম বসে পড়লে সমস্যা।”

সূচনা রেগে বললো

-“এই কথাটা এই লোকটাকে কে বোঝাবে। এমন একটা ভাব করছে যেন আমি অসুস্থ। এখানে শুধু শেষ না। বিকেলের দিকে সে বাচ্চার জন্য জামা কাপড় এমনকি দোলনা ও কিনে নিয়ে আসছে।”

তিন্নি হেসে দিলো। আর বললো

-“ইটস ওকে আপু। ভাই আসলে ভীষণ এক্সাইটেড। তাই এমন করছে।”

এবার রিয়াজ বললো

-“আরে আমি আমার বেবির জন্য জামা কাপড় এনেছি তাতে তোমার সমস্যা কি?”আগে থেকে একটা প্রিপারেশন রাখতে হবে না।”

সূচনা রেগে বললো

-“তাই বলে তুমি সাত মাস আগে থেকেই সব কিনে রাখবে?”

জিসান তাদের থামিয়ে বললো

-“প্লিজ এবার তোরা থাম। সামান্য কিছু নিয়ে ঝগড়া করা লাগবে।”

এবার রিয়াজ বললো

-“যখন নিজে বাবা হবি তখন আমার ফিলিংসটা বুঝতে পারবি।”

এবার তিন্নি অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। জিসান আড়চোখে তিন্নিকে দেখছে আর মুচকি হাসছে।
সবাই মিলে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিলো।রিয়াজ তাদের জন্য স্পেশাল তেহেরী রান্না করেছে। এটা নাকি সে মেসে থাকতে শিখেছে।
সূচনা তিন্নিকে নিয়ে তার রুমে আসলো।আর একটা ব্যাগ বাড়িয়ে বললো

-“এই সালটা তোমার জন্য। দেখে মনে হলো তোমাকে খুব মানাবে।”

-“আসলেই খুব সুন্দর থ্যাংক ইউ আপু।”

-“বুঝলে আমি এক পাগলের সাথে সংসার করি। না হলে বাচ্চার কথা শুনে কেউ এভাবে কাঁদে।”

-“বেবি কথা শুনে ভাইয়া ভীষণ খুশি হয়েছে।”

-“আমি জানি। মানুষটা স্ট্রিক অফিসার হলে কি হবে। সে আসলে ভীষণ ইমোশনাল। এই এতিম মানুষ গুলো খুব অল্পতেই খুশি হয়ে যায়। আমাকে যেদিন বিয়ে করেছে সে দিনও কেঁদেছে। আমার ভাইটাও কিন্তু এতিম। ওকে কখনো কষ্ট দিওনা। তুমি অনেক বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে। নিশ্চয়ই নিজের স্বামীর চোখের ভাষা পড়ার ক্ষমতা তোমার আছে। আমি জানি যেকোনো পরিস্থিতি আসুক না কেন রিয়াজ কখনো আমার হাত ছাড়বে না। আর তোমাকেও গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, সকল পরিস্থিতিতে জিসান তোমার পাশে থাকবে।”

তিন্নির চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু ঝড় গেলো।তার পাপা ছাড়া এই একটা মানুষের সামনে সে তার ইমোশন ধরে রাখতে পারে না।সে সূচনা বললো

-“আসলেই কি সে আমার পাশে থাকবে?”

-“অবশ্যই থাকবে।আমি ওকে চিনি।তবে তুমি বিশ্বাস করো বা না করো এই কথা সত্যি যে তুমি জিসানকে ভালোবেসে ফেলেছো।”

তিন্নি অবাক হয়ে তাকালো।সূচনা হেসে তিন্নির গালে হাত ছুঁয়ে বললো

-“তোমার মনে কিছু একটা চলছে।যা তুমি জিসানকে বলতে চাও but পারছনা।তাইনা?”

তিন্নি এবার আরেক দফা অবাক হলো।সূচনা আপু কি মানুষের মন পড়তে জানে?সে কেনো তার মায়ের পেটের বোন হলনা।তাহলে জীবনটা তার জন্য অনেক সহজ হয়ে যেত।সূচনা বললো

-“সম্পর্কের ভিত্তি হলো বিশ্বাস।তুমি চোখ বন্ধ করে জিসানকে বিশ্বাস করতে পারো।সে তোমাকে নিরাশ করবে না।”

তিন্নি ছলছল নয়নে সূচনা দেখে বললো

-“আমার জীবনে আপনি আরো আগে কেনো আসেননি?”

সূচনা হেসে বললো

-“জিসান আসেনি তাই।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here