মেঘবৃত্ত পর্ব ১১

#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_১১
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

চিরচেনা সেই পার্ক। সেই টগবগে রোদে ঝলসে যাওয়া বেঞ্চ। পার্কে হেঁটে যাওয়া ফোকলা দাঁতের সেই বুড়ি। যার হাতে পাঁচটা ছোট বেলুন। চোখে, রঙিন রংধনু। ময়লা শাড়ির আঁচল মাটি ছুঁই ছুঁই। কিছুই বদলায় নি এ কদিনে। শুধু বদলে গেছে দুটো প্রাণ। ভাগ্যের চাকা ঘুরে গিয়েছে ডান দিকে। আবদ্ধ হয়ে গেছে একটি পবিত্র বন্ধনে। মেঘা বেঞ্চে বসে আছে। হাতে বাদামের প্যাকেট। একটা একটা বাদাম মুখে পুড়ে চিবুচ্ছে। বৃত্তের হাতেও একটা বাদামের প্যাকেট। একসময় বৃত্ত বললো,
— সব প্ল্যান সাক্সেসফুল। ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছে এখন। মাথাটাও হালকা হয়ে গেছে। উফ! কি ধকল গেছে এ কদিন। কি বলিস?
মেঘ সদূরে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক স্থির, জরাজীর্ণ। সত্যিই কি সব বিপদ কেটে গেছে। কই? মেঘার তো মনে হচ্ছে, বিপদের কেবল শুরু। যখন সবাই জেনে যাবে মেঘার বাচ্চার বয়স তাদের বিয়ের বয়সের চেয়ে বেশি, তখন কি হবে? সবাই তো ঠিকই আঙ্গুল তুলবে। যতোই হোক! বিয়ের আগে বাচ্চা, বিষয়টা কেউ মেনে নিবে না। তখন? মেঘা নীরব হয়ে গেলো। অপরপাশ থেকে কোনো জবাব না পাওয়ায় বৃত্ত ঘুরে তাকালো। মেঘাকে স্থির দেহে বসে থাকতে দেখে বৃত্ত বড় বিরক্ত হলো। হাত দিয়ে মেঘাকে হেলিয়ে বললো,
— ওই? কই হারালি?
মেঘা নড়েচড়ে বসলো। হাতে লেগে থাকা বাদামের খোসা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বৃত্তের দিকে তাকালো। বললো,
— কটা বাজে? বাসায় যেতে হবে।
বৃত্ত হাতের কব্জিতে থাকা কালো রঙের ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বলল,
— বারোটা দশ বাজে। আর কিছুক্ষণ বসি? ত্রিশ বাজলে যাবো।
মেঘা তাড়া দেখালো। পাশে থাকা ব্যাগ কাধে ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বৃত্তের দিকে চেয়ে বললো,
— না। দেরি হয়ে যাবে। চল এখন। বাসায় গিয়ে অনেক কিছু ফেস করতে হবে আমার।সেটা ভেবেই আমি ভয়ে শ্যাষ। জলদি চল।
বৃত্ত হতাশ নিঃশ্বাস ফেললো। মেঘা বদলে গেছে। আগের ঝরঝরে মেঘা কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে।তার সামনে থাকা এই মেঘা বেশি কথা বলে না, হুটহাট গান গেয়ে তার কান ঝালাপালা করে না, আগের ন্যায় বাচ্চামো করে না। এই মেঘার সাথে এক সপ্তাহ আগের মেঘার বহুত তফাৎ। এ মেঘা তো কোনো অন্য কেউ। বৃত্ত কি বলবে! মেঘার কথায় সায় দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বাইকের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
— চল তাহলে। তাও শান্তি থাক, মেরি মা।
মেঘা মুচকি হাসলো। সে বদলে গেলে কি হবে ? বৃত্ত তো ঠিকই আগের মত। কথাবার্তা, আচার সব আগের ন্যায়। একটুও বদলায় নি। ভালো! খুব ভালো!
_________________________
মেঘার বাসার নিচে বৃত্ত বাইক থামালো। মেঘা তিন তলা বিল্ডিংটার দিকে একবার তাকাল। মুখখানা মলিন করে নেমে দাঁড়ালো। বৃত্তকে বিদায় জানিয়ে বাসার দিকে উদ্যত হলো।
তবে, মাঝপথে বাঁধ সাধলো বৃত্ত। পিছন থেকে ডাক দিলো,
— মেঘ?
মেঘা থেমে গেলো। পিছন ফিরে তাকালো। বললো,
— কি?
বৃত্ত কিছুক্ষণ থামলো। দূরে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো। অতঃপর, গম্ভীর সুরে বললো,
— তুই বদলে গেছিস,মেঘ। খুব বেশি বদলে গেছিস।
মেঘার প্রাণটা কেঁপে উঠলো কথাটা শুনে। সে কি সত্যিই বদলে গেছে? বৃত্ত কথাটা বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। বাইক চালিয়ে শো করে চলে গেলো। মেঘা সেখানটায়, সেই আম গাছের নিচেটায় দাঁড়িয়ে রইলো। নিজেই আনমনে মস্তিষ্ককে প্রশ্ন করলো, ‘ তুই কি সত্যই বদলে গেছিস, মেঘা?’
মস্তিষ্ক কাল বিলম্ব না করে উত্তর করলো, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ।’
___________________________
মেঘা বাসার কলিংবেল চাপলো। বুকের ভিতরটা ‘ধুকপুক’ করছে। যদি বাবা বাসায় থাকেন? তাহলে, আজকে মেঘা শেষ। বাবা মেরে ফেলবেন পুরো। মেঘার মনে হচ্ছে, তার মাথা চক্কর দিচ্ছে। আর একটু চিন্তা করলেই সে মাটিতে লুটিয়ে যাবে।
একটু পর মেঘার মা দরজা খুললেন। মেঘাকে দেখেই তার মুখ কঠিন হয়ে গেলো। মেঘা অস্ফুট সুরে সালাম দিলো। মেঘার মা সেই সালাম কানে তুললেন না। বরং, মুখখানা কিড়মিড় করে পাশ কাটিয়ে ঘরে চলে গেলেন। মেঘা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ঘরে ঢুকে সদর দরজা আটকে দিলো। নিজের ঘরে যেতে যেতে একবার রান্নাঘরে তাকালো। মা রান্না করছেন। মেঘা খুব মন চাইলো, মাকে জড়িয়ে ধরতে। মায়ের কাছে নিজের কষ্টের ঝুলিটা উপুর করে দিতে। মায়ের সাথে মন খুলে কথা বলতে। তবে, মেঘা তার কিছুই করতে পারলো না। না পারার আফসোসে মেঘা অসংখ্য দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চোখ সরিয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে এলো।
বাথরুম থেকে গোসল সেরে বের হলো মেঘা। মনটা বড্ড চা, চা করছে। এই মুহূর্তে একটা কড়া লিকারের চা খাওয়া প্রয়োজন। মেঘা মাথার চুলে টাওয়াল পেঁচিয়ে রান্নাঘরে গেলো। মা নেই সেখানে। মেঘা দু কাপ চা বানিয়ে ট্রেতে নিলো। অতঃপর, ধুকপুক মন নিয়ে ট্রেটা নিয়ে নিজের মায়ের ঘরে গেলো।
মেঘা মায়ের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো। মা বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে আছেন। তবে, মেঘা জানে মা মোটেও ঘুমাচ্ছেন না। এ সময়ে মা টিভি দেখেন। ড্যান্স বাংলা ড্যান্স দেখে সারাঘর মাতিয়ে তোলেন। তবে, আজকে তার শুয়ে থাকার কারন মেঘা নিজেই। মায়ের এমন ভগ্ন আচরন দেখে মেঘার ভারী কষ্ট হলো। মেঘা ট্রে নিয়ে রুমে ঢুকলো। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আলতো গলায় ডাক দিলো,
— মা? ও মা?
মেঘার মা মেয়ের গলা শুনে চোখ খিঁচে ঘুমানোর ভান করলেন। মেঘা মায়ের এমন বাচ্চামো দেখে মনে মনে হাসলো। ট্রেটা টি টেবিলের উপর রেখে মায়ের কাছে বসলো। মায়ের কোনো চুলে হাত বুলিয়ে বললো,
— মা? চা এনেছি। খাবে না?
মেয়ের ওমন আদুরে কথা শুনে মেঘার মায়ের মন অজান্তেই গলে যেতে শুরু করলো। তবুও, তিনি তাকালেন না। কঠিন সুরে বললেন,
— আমি তোর হাতের বানানো কিছুই খাবো না। এখন ঘুমাবো আমি। লাইট নিভিয়ে রুম থেকে চলে যা।
মেঘা বড্ড আশাহত হলো। মায়ের এমন কঠোর রূপের সাথে মেঘা মোটেও পরিচিত নয়। আরো একবার কিছু বলতে গেলে মেঘার মা কঠোর সুরে বললেন,
— এখনো যাচ্ছিস না কেনো? বললাম তো, ঘুমাবো আমি।
মেঘা এবার ভেঙেচুরে গেলো। চোখে জমলো দু ফোঁটা জল। এত কষ্ট হচ্ছে কেনো ওর? মেঘা আর অপেক্ষা করলো না। মায়ের জন্যে করা চায়ের কাপ টি টেবিলে রেখে ট্রে টা নিয়ে চলে গেলো। রুম ছাড়ার আগে মায়ের কথামত ঠিকই লাইট নিভিয়ে গেলো। মেঘা রুম ছেড়ে যেতেই মেঘার মা উঠে বসলেন। টি টেবিলে চায়ের কাপ দেখে তার মনটা বিষিয়ে গেলো। মেয়েটা কেনক এমন করলো? কেনই বা আজকে এ দিন দেখতে হলো? মেয়ের প্রতি তিনি কখনোই কঠোর ছিলেন না।আজকে পরিস্থিতির চাপে পড়ে তাকে কঠোরতার মুখোশ পড়তে হচ্ছে। এর চেয়ে বিশ্রী অনুভূতি আর কিছুই হতে পারে না। মেঘার মা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একটা, দুটো, অতঃপর অসংখ্য।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here