মেঘমালা পর্ব ৮

#মেঘমালা
#পর্বঃ৮
#Sohana_Akther
মেঘ যখন দশ বছরের ছিল তখন ওর মা ইলা তার পাঁচ বছরের ছোট বোন ইরাকে নিয়ে অন্য একটি ছেলের হাত ধরে তারই চোখের সামনে দিয়ে চলে যায় । মেঘ তার মা বাবাকে অনেক ভালোবাসতো । ইলাকে একটু বেশিই ভালোবাসতো, ছোট থেকেই ছেলেটা বড্ড মা পাগল ছিল ।

মেঘের প্রতিটি কাজে তার মায়ের প্রয়োজন । কিন্তু দু’দিন পর পরই ইলা ও মেঘের বাবা আকাশের মধ্যে ঝগড়া হতো । আকাশ ছিল অনেক শান্ত প্রকৃতির, সে ঝগড়ার সময় খুব কম কথাই বলতো , বারবার ইলাকে বুঝানোর চেষ্টা করতো যে বাচ্চারা বড় হচ্ছে এখন তাদের সামনে ঝগড়া করলে তাদের মানসিক বিকাশে সমস্যা হবে । বাচ্চাদের সুস্থ ও সুন্দর ভাবে বেড়ে ওঠার জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ প্রয়োজন যা আমরা মা বাবাই করতে পারি ।

কিন্তু ইলা থার তার কোনো কথা কানে তুলতো না। ছোট খাটো বিষয়ে আকাশের সাথে ঝগড়া করা , কথা কাটাকাটি করা তার নিত্যদিনের কাজ হয়ে পড়েছিল । মেঘ তখন থেকেই তার মার থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছিল । মেঘ অনুভব করতে পারতো তার মায়ের জন্য তার বাবা সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকে । মেঘের ছোট বোন ইরাও তাকে বলতো ‘ ভাইয়া আম্মু কেনো সবসময় আব্বুর সাথে ঝগড়া করে ‘? তার এই কথার কোনো জবাব থাকতো না মেঘের কাছে । মেঘের মত ইরাও একদম মা পাগল, মাকে ছাড়া এক মিনিট ও থাকতে পারে না ।

_________________________________

একদিন মেঘ আবিষ্কার করলো তার মায়ের ও বাবার মধ্যে ঝগড়া আগের থেকে অনেক কম হয়। মেঘ খুশিতে আত্মহারা হয়ে ভাবলো এখন হয়তো তার পরিবার আবার আগের মতো হয়ে যাবে । কিন্তু সে কি জানতো যে , এইতো তুফানের আগের নিরবতা ।

সেই দিনটি ছিল মেঘের ও আমাদের সকলের জীবনের এক বিশাল সমুদ্রের মত কষ্টের দিন । আমরা সবাই সেই কথা ভুলে গেলেও মেঘ এখনো ভুলতে পারেনি । ঐদিন মেঘ স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখলো তার মা তার বাবার সাথে বিশ্রী ভাষায় কথা বলছে । মেঘের মা তার বাবার কাছ থেকে নাকি শারীরিক সুখ সম্পূর্ণ ভাবে পেতে পারেনি ও তার কোনো চাওয়া পাওয়া পূরণ করতে পারেনি । তাই সে অন্য একটি ছেলেকে ভালোবাসতে শুরু করছে যে তাকে শারীরিক ও আর্থিক সকল প্রকার সুখ দিবে ।

দশ বছরের মেঘ চুপচাপ দাড়িয়ে তার মায়ের বলা প্রতিটি কথা শুনছিল । আকাশ ও একদম স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল । ইলা যে তার সাথে এমন করবে তা সে কল্পনাও করতে পারে নি । মেঘ ব্যথাতুর দৃষ্টিতে একবার তার বাবার দিকে তাকালো । বিশ্বাস ভেঙে, ভালোবাসা হারিয়ে , জর্জরিত হয়ে পরা বাবার দিকে তাকিয়ে তার মায়ের জন্য একরাশ ঘৃণা সৃষ্টি হলো তার মনের ভিতর । ইলা ঐদিনেই মেঘের ছোট বোন ইরাকে সাথে নিয়ে ঐ ছেলের সাথে চলে যায় । মেঘ একটিবার ও তার মাকে আটকাবার চেষ্টা করেনি কিন্তু ইরাকে আটকাবার চেষ্টা করছে । কিন্তু সফল হতে পারেনি , ইলা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে তার সংসার , স্বামী, সন্তান রেখে চলে গেল।

ঐদিনের পর হাস্যজ্জল ছেলেটা একদম মিইয়ে গেল । মেঘ একদম চুপচাপ হয়ে গেল , ইলা যাওয়ার সাথে সাথে মেঘের হেসে খেলে বেড়ে ওঠা শৈশব কেড়ে নিয়ে চলে গেল । আর আকাশ সে তো ভিতর থেকে একদম ভেঙে নিঃশ্ব হয়ে গিয়েছিল । এরপর আকাশ আর বিয়ে করেনি , মেঘ নিয়েই বাকি জীবন পার করবার সিদ্ধান্ত নিল । সারা দিন রাত পরিশ্রম করে তার ছোট্ট ব্যবসাটিকে আজ এত বড় করেছে ।

মেঘ তখন থেকেই কোনো মেয়েদের দেখতে পারতো না , তার মতে সকল মেয়েরাই তার মায়ের মত । মেয়ে মানেই ধোকা আর কিছু না ।
ইলার যাওয়ার পর আকাশের হার্টের সমস্যা দেখা দিল । ছেলের দিকে চেয়েই অনেক বছর পারি দিল কিন্তু একদির হার্ট এট্যাক করে আকাশ মারা গেল । মেঘ তখন ভার্সিটিতে পড়ে । আকাশের মৃত্যু মেঘকে একদম পাথর বানিয়ে দিয়েছিল । সে তার বাবার মৃত্যুর দায়ী ইলাকেই মনে করে । ইলার ছেড়ে যাওয়ার পরই আকাশের স্বাস্থ্যের অবনতি । তার মায়ের প্রতি ঘৃনা আরো বেড়ে গেল ।

__________________________

এসব থেকে মেঘ এখনো বের হয়ে আসতে পারে নি । তার মতে সব মেয়েরাই ধোঁকাবাজ , কেউ সত্যি কারের ভালোবাসে না । তোমাকেও বিয়ে করার জন্য রাজি হয়নি , অনেক কষ্টে ওয়াদা নিয়ে বিয়ে করালাম । অল্প সময়ের মধ্যেই মেঘ তোমাকে ভালোবেসে ফেললো , তুমি এমন একটি মেয়ে যাকে ভালো না বেসে কেউ থাকতে পারবে না । আমি মেঘের চোখে তোমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি । কিন্তু সমস্যা এক জায়গায় মেঘ তোমাকে এখনো বিশ্বাস করতে পারেনি , তার ধারনা সুযোগ পেলেই তুমিও তার মায়ের মত তাকে ছেড়ে চলে যাবে ।

তাই যে কোনো উপায়ে মেঘ তোমাকে নিজের করে রাখতে চায় । দয়া করে আমার এই পরিবার হারা এই সন্তানটিকে একটু আগলিয়ে রেখো । আর তাকে এমন ব্যবহারের জন্য ক্ষমা করে দিও , একদিন তোমার ভালোবাসা তাকে ঠিকই আগের মতো করে তুলবে ।

_____________________

এতোক্ষণ মালা বাকরুদ্ধ হয়ে ফুফির প্রতিটি কথা শুনছিল । ফুফি কথাগুলো বলতে বলতে কেদেই দিল , মালার চোখেও জল টলমল করছে । চোখের পলক ফেললেই পানি গড়িয়ে পরবে । মালা কখনো ভাবতেও পারেনি যে মেঘের সাথে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে । কতটা কষ্টের মধ্য দিয়ে এতটা জীবন পার করেছে সে । পরিবার ছাড়া একটা জীবন কখনোই কল্পনা করা যায় না। আর মেঘ তা অনুভব করেছে । মেঘের জন্য মালার অনেক মায়া হতে শুরু করলো । এতক্ষণ সে মুখ খুললো ,

— ফুফি আপনি একদম চিন্তা করবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে । আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি মেঘকে আমি একটি স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো । সে আমাকে ঠিকই বিশ্বাস করবে।

—- এমনটাই যেনো হয় মা , দোয়া করি খুব ।

— আচ্ছা আপনি এখন যেয়ে বিশ্রাম নিন, আমি রাতের খাবারের আয়োজন করছি ।

— আচ্ছা যাহ ।

রান্না করার সময় মেঘের কথা ভাবতে ভাবতে বেখেয়ালি ভাবে মালা তার হাত পুড়ে ফেললো ।
সন্ধ্যায় সাত বেজে বিশ মিনিটে মেঘ বাড়িতে আসলো । বাড়িতে এসে তার ফুফিকে দেখে অনেক খুশি হয়ে পরলো ।

— কেমন আছো ফুফি?

— আলহামদুলিল্লাহ, মেঘ তুই কেমন আছিস?

— একদম ভালো । তুমি কখন আসলে ? আমাকে একটি বার ফোন করে বললে আমি নিজেই তোমাকে নিয়ে আসতাম । তোমার এত কষ্ট করে একা আসার কি দরকার ছিল ?

— তুই আর তোর বউ দুটোই এক । মালাও আমাকে এই কথা বলেছে আর তুইও । একা আসলে কি হয়েছে, আমার ছেলে মেয়েদের দেখতে ইচ্ছে হলো তাই চলে আসলাম । আমি কি আসতে পারি না কি ?

— একদম আসতে পারো ফুফি , এটা তোমার বাড়ি যখন ইচ্ছ তখন আসবে কে কি বলবে ।

— এই যে এখন তুই বলছিস । ( মেঘের ফুফি দুষ্টুমি করে বললো )

— আচ্ছা বাবা ভুল হয়েছে আমার, এবার মাফ করে দেন ফুফিজান । আচ্ছা তুমি রেস্ট নেও আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি ।

— মালা আমার জন্য এক মগ কফি নিয়ে আসো , আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি ।

— আচ্ছা নিয়ে আসছি ।

মালাকে কফির কথা বলেই মেঘ রুমে যেয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল । ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে এসে দেখলো মালা কফির মগ হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে । আজ মেঘের কাছে মালাকে দেখতে অন্যরকম লাগছিল । মালা এত একটা কথা বলে না , সবসময় চুপচাপ থাকে । কিন্তু আজ তার এই নীরবতায় তাকে অন্য রকম লাগছে ।

— কি ব্যাপার এভাবে কফি হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছো কেনো , টেবিলে রাখলেই তো পারো ।

মেঘের কথা মালার কানে গেল বলে মনে হলো না। সে একনাগাড়ে মেঘের দিকেই তাকিয়ে আছে।

— মালা , এই মালা কোথায় হারিয়ে গেলে ।

— কই নাতো, এই নিন আপনার কফি । আমি যেয়ে দেখে আসি ফুফির কিছু লাগবে নাকি ।

— আচ্ছা যাও দেখে আসো ।

মালা চলে যাওয়ার পর মেঘ নিজে নিজেই বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,

— এই মালার কি হলো আজ এমন কেনো ব্যবহার করছে । কি হলো তার কি জানে !

রাতে খাওয়া দাওয়ার পর মেঘের ফুফি মেঘকে বললো ,

— মেঘ তুই একটু আমার রুমে আস , তোর সাথে আমার জরুরী কথা আছে । এক্ষুনি রুমে চলে আয় ।

এই বলে তিনি রুমে চলে গেলেন । অনেক কঠিন হয়ে তিনি কথাটি বললেন । মেঘ চিন্তায় পড়ে গেল যে ফুফি কি জরুরী কথা বলার জন্য এভাবে বলে গেল । মালাকে রুমে যেতে বলে মেঘ তার ফুফির রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো ।

চলবে . . .

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here