মেঘের আড়ালে বৃষ্টি পর্ব -০৪

#মেঘের_আড়ালে_বৃষ্টি
#চার
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা

সকাল নয়টায় তারা এসে টেকনাফে পৌঁছে। সবাই একে একে বাস থেকে নেমে যায়। প্রয়াস নেমে বাসের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গুনে গুনে নামাচ্ছে সবাইকে।

সকাল বলল, ” এতবার গুনতে হবে কেন! সবাই নেমে যাবে! প্রয়াশ এখানে সবাই কলেজে পড়ে কেউ বাচ্চা না।”

কিন্তু প্রয়াসের এক কথা স্যাররা তাদের উপর নির্ভর করে দ্বায়িত্ব দিয়েছেন। তাই তাদের উচিত স্যারদের নির্ভরতাকে সম্মান করা। সকাল এ কথার পর আর কিছু বলেনি।

প্রয়াশ দেখল আসার সময় যেমন একজন কম ছিল। নামার সময় ও একজন কম। প্রয়াস বাসে উঠে দেখল কে নামেনি।এতক্ষণ এদিকে ব্যাস্ত থাকায় বুঝতে পারেনি রোদ ঘুমাচ্ছে। যেহেতু দুজন একসাথে বসেছে,তার উচিত ছিল মেয়েটাকে ডেকে দেয়া। এতটা কেয়ারলেস সে কী করে হতে পারল এসব ভেবে ইতস্ততভাবে রোদকে ডাক দিল।

বাইরের রোদের আলো মানবী রোদের মুখে এসে পড়েছে তাকে যেন অপ্সরীর মত দেখাচ্ছে। মানবী রোদের মুখে প্রকৃতির রোদ ঝিকমিক করছে। প্রয়াসের ইচ্ছে হলো আরও কিছুক্ষণ এভাবে দেখতে এই দুই রোদের মিশে যাওয়া। কিন্তু সাড়ে নয়টা জাহাজ ছেড়ে যাবে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্য তাই এখন না ডাকলে দেরি হয়ে যাবে।

মিস রোদেলা, মিস রোদেলা,,কয়েকবার ডাকার পর রোদ ঘুম ঘুম চোখে তাকালো প্রয়াসের দিকে। প্রয়াস খেয়াল করল ঘুম থেকে উঠলে মেয়েদের এতো সুন্দর দেখায় জানতো না। রোদ চোখে খুললেই দেখে প্রয়াশ তার পাশে দাঁড়িয়ে ডাকছে তাকে। প্রয়াশ রোদের অস্বস্তি দেখে বলল,

“আমরা টেকনাফ এসে গেছি। আসো নাস্তা করে জাহাজে উঠতে হবে। সাড়ে নয়টা জাহাজ ছেড়ে দিবে।সময় খুবই কম।”

একটা পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে প্রয়াশ আবার বলল, “এই নাও পানি। মুখ ধুয়ে নাও। চলো সবাই নাস্তা করতে চলে গেছে।”

রোদ একটু অপ্রস্তুত হলো। এটা ভেবে যে ঘুরতে এসে এভাবে ঘুমিয়ে পড়া উচিত হয়নি। তাছাড়া উনি কী ভাবছে কে জানে। ধুর কী যে করি আমি। মনে মনে নিজেকে একশোটা বকা দিল।

প্রয়াস বলল, ” কই চলো।”

রোদ প্রয়াসকে অনুসরণ করে যেতে লাগল।
তারা এখন আছে টেকনাফের মূল সড়কে। এখান থেকে প্রতিদিন কয়েকটি জাহাজ যায় সেন্টমার্টিন এর উদ্দেশ্যে। তারা যে জাহাজে যাবে তার নাম কেয়ারি সিনবাদ। আগে থেকে টিকিট কেটে নেওয়া হয়েছে। এখন শুধু সবাই যে যার মত উঠবে।

সবাই একটা খাবার হোটেলে নাস্তা করছে। প্রয়াস আর রোদও সেখানে গেল। সুচী দূর থেকে বলল, ” এই রোদ এতোক্ষন কই ছিলি?”

আয় আমাদের পাশে বস নাস্তা করবি। রোদ প্রয়াসের দিকে তাকিয়ে সৌজন্য হাসি দিয়ে চলে যায় তার সূচীদের কাছে। প্রয়াস ও তার বন্ধুদের কাছে যায়।
,
সকাল বলল, ” কী ব্যাপার মামা কেমন কাটলো জার্নি? সুন্দরী বাচ্চার সাথে নিশ্চয়ই ভালো কাটছে।”

সাবা বলল, “আরে মামা বুঝনা! সব ছেলেরই মেয়েদের সাথে জার্নি করতে ভালো লাগবে। আর সে যদি হয় রোদেলার মত তাহলে তো কথাই নেই।”

সাবার কথা শুনে সবাই হাসছে।
প্রয়াস সকালের মাথায় চাপড় মেরে বলল, “সবাই তোর মত নাকি শালা। চুপ কর, তাড়াতাড়ি খেয়ে জাহাজে যেতে হবে। হাতে সময় খুব কম।”

এই তোর কাছে আমি আমার বোনকে বিয়ে দিব নাকি! শালা বললি কেন?” প্রয়াস মুচকি হাসছে কিন্তু কিছুই বলল না।

শশী বলল, “ওই সকাইল্লে তুই সব সময় আমার বেচেরা বন্ধুর পেছনে লাগিস কেন? সবাই কী তোর মতো মেয়ে দেখলেই ক্রাশ খায় নাকি। শালা ছাগইল্লা একটা!”

“ওই শশানী তুই আমারে সকাইল্লে বলতেছিস কেন?আবার গালি ও দিচ্ছিস। আমি তোর শালা হইলাম কেমনে? শালি গে মনে হয়। আমার বোনকে বিয়ে করতে চায়।”

“ওই তুই চুপ থাক। আমারে গে কইলি কেন?
শুনলি তোরা ও আমারে গে কইতেছে? কত বড় কথা কইছে। তোরা কেউ কিছু বলতেছিসনা কেন? তোরা আমার বন্ধু না সব কয়টা শত্রু। ” শশীর কপাল কুচকে বলল।

সাবা বলল, “এই তোরা থামবি?
কী শুরু করলি? এখানে আমাদের জুনিয়ররা আছে তারা কী ভাববে বলতো?”

“ওই সাবা তুই এমন করে বলতেছিস কেন? আমরা কি এখানে খারাপ কিছু করছি নাকি যে তারা কিছু মনে করবে। আর সকাইল্লে আমারে কি বলছে শুনিসনি?
কিছু বললি না কেন?”

“শসা একটু কথা কম বলবি। আমি তোরে কিছু বলিনি। তুই আগে আমারে গালি দিছোস। তুই যা বলছিস আমি শুধু কথার পিঠে কথা বলছি। তোর কোনদিক দিয়ে আমারে গে মনে হচ্ছে?
কত বড় কথা বললি তুই! তোকে বলতে হবে আমাকে গে মনে হচ্ছে?”

প্রয়াস এতক্ষণ এদের কথা শুনে হাসছে। এরা একটা যা শয়তান এখন যদি সে না থামায় এরা আর থামবে না তাই বলল,

” এই তোরা যদি চুপচাপ ৫মিনিটের মধ্যে না খেয়ে উঠিস। তোদের রেখে চলে যাব। এবার তোরা ভেবে রাখ তোরা কী করবি।”

নিজের কথা বলে খাবার শেষ করে সবাইকে জাহাজে উঠিয়ে দিতে যায় প্রয়াশ। সবাইকে যার যার সিট বুঝিয়ে দেয়। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে বাসের মত জাহাজে ও তার পাশে রোদের সিট। খাবার সময় ভুলে গিয়েছিল সকালকে বলতে সে এমন কাজ কেন করল।

সব জুনিয়ররা এবার একটু এদিকে তাকাচ্ছে। তারা নিশ্চয়ই ভাবছে একসাথে বাসে আবার জাহাজেও! দূর এটা কোন কথা হলো। সকালের উপর যা রাগ হচ্ছে না তার।

সবাই সবার মত উঠে গেছে। রোদ ভয় হচ্ছে। কারণ সে কখনো জাহাজে উঠেনি। তার উপর বাবা-মা থাকলে হয়তো তাদের ধরে বসে থাকলে ভয় কম লাগতো। কিন্তু এখানে সুচী রাহাতের সাথে বসে আছে। সনি রহিমের সাথে। তারা থাকলেও হতো। কিন্তু তার পাশে কি না কলেজের বড় ভাই বসা। কী করবে বুঝতে পারছেনা সে।

এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে আসলে একটা প্রেম করা দরকার ছিল। অন্তত হাতটা ধরে বসে থাকার জন্য যেন ভয় না লাগে। আর মনে মনে সূচী আর সনিকে একশো একটা অভিশাপ দিচ্ছে। কেন তারা তাদের বয়ফ্রেন্ড এর সাথে বসেছে!

প্রয়াস রোদকে দেখে বুঝতে পারে যে মেয়েটা হয়তো ভয় পাচ্ছে। তার চোখেমুখে ভয় স্পষ্ট।

“ভয় হচ্ছে আপনার?”

“না।”

এই না এর অর্থ যে হ্যাঁ এটা বুঝতে দেরি হলো না প্রয়াসের।

“জাহাজে এই প্রথম?”

“জি।”

“তাই এতো ভয়?”

“না আমি ভয় পাচ্ছি না।”

“তা ঠিক ভয় কেন পাবে। তোমার চেহারায় একটা সাহসি ভাব আছে। আর আমরা এখানে অনেকজন আছি ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তোমার কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবে।”

“আচ্ছা বলব।”

“তোমাকে যদি তোমার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি তুমি কিছু মনে করবে?”

“না না কেন কিছু মনে করব। বলেন কি জানতে চান?”

“তোমরা ভাই বোন কয়জন। আমরা দুইবোন।এক ভাই। আমি মেঝো। বড় ভাইয়া। আর বোন আমার ছোট।”

“তোমার বাবা কি করেন?”

“আমার বাবার ব্যাংকে চাকরি করেন। মা গৃহিণী।”

“ভাইয়া কিসে পড়ে?”

“ভাইয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে।আমেরিকা গেছেন উচ্চশিক্ষার জন্য।”

“আচ্ছা। ছোট বোন?”

“ছোট বোন এবার টেনে উঠেছে।”

তোমার ভাইয়ার নাম কি বলোতো? চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পরিচিত অনেকে আছে বললে চিনতে পারবে।”

“ইবান রহমান রিহান। সবাই রিহান বলে ডাকে।”

“আচ্ছা।”

কথা শেষ হতেই রোদের ফোনে কল আসে। সে ফোন ব্যাগ থেকে বের করতেই প্রয়াসের চোখ যায় ফোনের স্কিনে। একটা ছবি ভেসে উঠেছে। দুইজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ ও মহিলাকে ঘিরে রেখেছে। তিনটি ছেলে মেয়ে।
এরাই হয়তো রোদের পরিবার।

রোদ ফোন রিসিভ করে বলল,
“কেমন আছো ভাইয়া?”

“ভালো তুই?”

“খুব ভালো। আমি এখন সেন্টমার্টিন যাচ্ছি ভাইয়া।”

“তোর চাওয়া পূরন হচ্ছে। কেমন লাগছে তোর বোন?”

“খুব ভালো ভাইয়া। এডভেঞ্চার আমার ভীষণ প্রিয় তুমি তো জানো।”

“কোনো সমস্যা হচ্ছে নাতো?”

“না ভাইয়া তুমিতো জানো আমি ঘুরতে কতটা ভালবাসি। আমার অনেকদিনের ইচ্ছে পূরন হচ্ছে তাই কোনো সমস্যাই হচ্ছে না। তুমি একদম চিন্তা করো না।”

প্রয়াস খুব মনোযোগ দিয়ে রোদের কথা শুনছে আর দেখছে। মেয়েটা কত উৎফুল্ল হয়ে ভাইয়ের সাথে কথা বলছে। একদম বাচ্চাদের মত। মনে মনে ভাবছে আমি আসলে ভালোই করেছি একে পিচ্চি ডেকে। ভেবেই মুচকি হাসছে প্রয়াস।
রোদের কথায় তার ভাবনায় ছেদ পড়ে।

“আপনি একা একা হাসছেন কেন?”

“এমনি পিচ্চি।”

“রোদ এবার একটু নিভলো। আবার পিচ্চি বলা শুরু করে দিয়েছে। এই একটু আগে রোদেলা বলল। যদিও তার সাথে মিস যোগ করায় কেমন একটা লেগেছে। তবুও পিচ্চি থেকে এটা ভালো ছিল। কিন্তু আবার পিচ্ছি ডাকছে।”

প্রয়াস রোদকে খেয়াল করল রোদের মুখ কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। একটু আগের আনন্দটা নেই।

“তোমার কথা শেষ?”

“হুম।”

“শোনো সমুদ্রে হঠাৎ কখন জোয়ার উঠে বলা যায় না। তাই সতর্ক থাকতে হবে। তুমি ভয় পেও না। কারণ সমুদ্রেরের কাজই জোয়ার-ভাটা । আমি আছি তোমার সাথে।

প্রয়াস কথা শেষ না হতেই হঠাৎ জাহাজ দুলে উঠল। রোদ এসে প্রয়াসের গায়ে পড়ল। দোলার সাথে।
প্রয়াসও আচমকা অপ্রস্তুতভাবে রোদকে দুহাতে আলগা করে ধরে বলল, ” মনে হচ্ছে জোয়ার এসেছে। তাই এমন ঢেউ দিচ্ছে। ভয় পেও না রোদেলা। ”

রোদের কানে কিছু ঢুকছে না। সে প্রয়াসের শার্ট খামছে ধরে আছে। প্রয়াসের শিরদাঁড়ায় এক অজানা শীতল স্রোত বেয়ে যাচ্ছে। এই শীতের সকালে গভীর সমুদ্রে এক মানবীর স্পর্শ তিরের মত ফুটছে তার হৃদয়ে। এই প্রথম কোনো নারী তার এতটা কাছে আসতে পেরেছে। এতটা কাছ থেকে কোনো নারীর নিঃশ্বাস ফেলছে তার গায়ে। সেই নিঃশ্বাসের গরম তাপ তার মনে প্রানে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে। চাইলেও সরাতে পাচ্ছে না। এই ছোট্ট পিচ্চি মেয়েটিকে। এই অপ্রত্যাশিত নারীকে।

কই সাবা শশীও তো মেয়ে তারা সবসময় থেকেছে তার আশেপাশে। কখনো তো এমন মনে হয়নি!
ইনফ্যাক্ট কখনো তাদের মেয়ে বলে আলাদা কোনো অনুভূতিই হয়নি। তাহলে আজ এমন কেন হচ্ছে?
কী এমন আলাদা কিছু আছে এই মেয়ের মাঝে যে,এভাবে তার সংস্পর্শে বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কী হচ্ছে এসব। কেন এমন হচ্ছে?
তবে কী সে এমন কোথাও বাধা পড়তে যাচ্ছে যাতে সে কখনো পড়েনি। এমন দুর্বোধ্য অস্পষ্ট কিছু যা তার কাছে নতুন বড্ড এলোমেলো অগোছালো!

এটাকেই কী বলে মন কেমনের অনুভূতি!

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here