মেঘের আড়ালে বৃষ্টি পর্ব -০৫

#মেঘের_আড়ালে_বৃষ্টি
#পাঁচ
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা

নদীর জোয়ার কিছুটা কমেছে। রোদ এতক্ষণ যে প্রয়াসকে ধরে ছিল ভয়ের ছোটে সেটা খেয়ালই করেনি। যখন প্রয়াসের ভারী নিঃশ্বাস তার গায়ে পড়ে নদীর জোয়ার কমে যাওয়ায় সঙ্গে ধীরে ধীরে তা বুঝতে পারে। রোদ লজ্জায় সরে যায়।

রোদের কাছাকাছি আসায় প্রয়াসের ভেতর যে ঘোরের তৈরি হয়েছে তা রোদের সরে যাওয়ায় তা কেটে যায়। নিজেকে অনেক অশান্ত মনে হচ্ছে তার। ভেতরটায় কেমন রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এমন কেন হচ্ছে। এটাতো হওয়ার কথা না। মনের ভেতরে ঝড় উঠেছে তা কাউকে বুঝানো যাবে না। তাই এখন আপাতত এই মেয়ের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
তার জন্য এখান থেকে একটু আলাদা হতে হবে কিন্তু মেয়েটা একা ভয় পায় কী করা যায় ভাবতেই বলল,

“আমি একটু আমার বন্ধুদের সাথে কথা বলতে গেলে তুমি একা ভয় পাবে নাতো?”

“না আমি একা হলে ভয় পাইনা। আমার ভয় নদীর জোয়ারকে।”

“ও আচ্ছা আমি তো ভুলে গেছি আপনি আবার সাহসী মেয়ে।”

উত্তরে রোদ সুন্দর একটা হাসল।

প্রয়াস উঠে চলে যেতে লাগলে সকাল, শশী, সাবা,সবাই চলে আসে তাদের কাছে গিটার হাতে নিয়ে।
সকাল বলল, “আরে কই যাচ্ছিস? বসে পড় আমরা সবাই গান গাইতে আসলাম আর তুই উঠে যাচ্ছিস।”

প্রয়াস কিছু বলার আগে রোদ বলল, ” আরে উনি আপনাদের কাছেই যাচ্ছিলেন। ”

সাবা বলল, “তাহলে তো আমরাই চলে এসেছি আর যেতে হবেনা। চল গান শুরু কর।”

প্রয়াস বুঝতে পারল এখন এদের হাত থেকে তার নিস্তার নেই। তাই সে চুপচাপ বসে পড়ে গিটার হাতে।

গিটারের সুর শুনে সবার নজর পড়ে এই দলটির দিকে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে আকাশে সূর্যের তেজ বেড়ে লাল আকার ধারণ করেছে। তার সাথে গিটারের সুর মিশে যেন কোনো অপার্থিব দৃশ্য তৈরি করেছে। যা মনে প্রাণে অন্যরকম এক ভালো লাগার জন্ম দিয়েছে।

প্রয়াস চোখ বন্ধ করে গান গাইছে। রোদ একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে প্রয়াসের দিকে। ভাবছে কী সুন্দর গানের গলা। এতো সুন্দর করে দরদ দিয়ে গান গাইছে সবকিছু এতো ভালো লাগে। মুহুর্তে যেন পরিবেশটা এক অন্যরকম ভালোলাগা শুরু হয়েছে। একটু আগের নদীর জোয়ারে ভাসিয়ে যাওয়ার ভয় যেন নিমিষেই উধাও হয়ে গেল।

এমনও হয়!

সবাই চুপ হয়ে গান শুনছে। প্রয়াসের বন্ধুরা মাঝে মাঝে সুর মেলাচ্ছে।

লাস্ট লাইনটা শেষ করার আগে প্রয়াস চোখ খোলে রোদের দিকে তাকায়। পরপর তিনবার লাস্ট লাইনটা বলে গান শেষ করে। সে সময়টুকু একবারও সে রোদের মুখ থেকে চোখ সরায়নি।

প্রয়াসের চোখের দিকে চোখ পড়তেই রোদ দেখল, প্রয়াসের চোখ রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে। একটু আগেও তো মানুষটার চোখ কেমন শান্ত স্বাভাবিক ছিল, এর মধ্যে কী এমন হলো যে তার দুচোখ এমন হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগের চাহনির মাঝে আর এখনকার চাহনির বিস্তর ফারাক। এই চাহনি মনে হচ্ছে অনেক কিছু বলতে চাইছে। অনেক কথা যেন হাজার বছর ধরে জমা করে রেখেছে। এই অতৃপ্ত চোখের ভাষা পড়তে কষ্ট হচ্ছে রোদের।

প্রয়াসের বন্ধুরা সবাই আবার বায়না করছে আরেকটি গানের জন্য। কিন্তু সকাল প্রয়াসের চোখের ভাষা খুব ভালো করে বুঝতে পারছে। কারণ সেই ছোট বেলা থেকে সে দেখছে প্রয়াসকে। অল্পতে এমন করার মত ছেলে প্রয়াস না। তাই সে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

“আজ আর নয়,আমরা তো একসাথে আরও তিনদিন আছি। এখন সব শুনে নিলে বাকি তিনদিন কী শুনবি?”

এসব বলে কাটিয়ে নিল সকাল। প্রয়াসের দৃষ্টি নিচের দিকে।
সকাল বলল,

“চল একটু ওইদিক থেকে ঘুরে আসি।”

প্রয়াস বুঝতে পারে সকাল তাকে সবার থেকে আলাদা করার সুযোগ করে দিচ্ছে। প্রয়াস সকালের সাথে উঠে চলে যায় ডেকের দিকে।

তারা কামরার বাইরে যায়। প্রয়াস জাহাজের রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছে দৃষ্টি আকাশের দিকে।
সকাল সিগারেট ধরিয়ে টান দিচ্ছে। হঠাৎ প্রয়াস সিগারেটটা ছো মেরে নিয়ে ধোঁয়া উড়াতে লাগল। সিগারেটের ধোয়া তার নাকে মুখে বেরুতে লাগল।
সকাল ইচ্ছে করে সিগারেট ধরিয়েছে যাতে সে সহজে বুঝতে পারে প্রয়াসের কী হয়েছে।
কারণ প্রয়াস সিগারেট খায়না।
খুব বেশী মানসিক চাপে থাকলে এভাবে সিগারেট ছো মেরে নিয়ে নেয়। তাই এই সহজ পদ্ধতি কাজে লাগাল সকাল।

প্রয়াস দুই মিনিটে সিগারেট শেষ করে ফেলে।
সকাল সিগারেট শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছিল।
কারন সে জানে সিগারেট শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রয়াস কোন কথার উত্তর দিবে না।

তাই এবার প্রশ্ন করে, “তুই কী রোদেলাকে ভালোবেসে ফেলেছিস?”

প্রয়াস চুপ করে চোখ বন্ধ করে আছে।
সকাল আবারও জিজ্ঞেস করল, ” তুই রোদেলাকে ভালোবাসিস প্রয়াস?”

প্রয়াস উত্তর দেয়, ” জানিনা।”

সকাল বলল, ” কেন জানিস না? তোর মনের কথা কী পাশের বাসার ভাবি জানে?”

“প্লিজ সকাল হেয়ালী ভালো লাগছে না।”

“তাহলে উত্তর দে?”

“আমি নিজেই জানি না দোস্ত আমার সাথে কী হচ্ছে!
আমার চারপাশে এত মেয়ে ছিল। এতো মেয়ে আমাকে প্রস্তাব দিয়েছে তোদের সামনে আমি কত সহজে তাদের রিজেক্ট করে দিয়েছি। কখনো এমন হয়নি আজ এই পিচ্চি মেয়েটা আমার কাছে আসায় আমার বুকের ভেতরটা এই উত্তাল সমুদ্রের চেয়ে বেশী উত্তাল হয়ে গেছে।
আমি কোনোভাবেই এই মেয়েটাকে উপেক্ষা করতে পারছি না।”

“ওয়াও! কংগ্রেসুলেশান দোস্ত। এট লাস্ট তোর মনে কেউ জায়গা করতে পারল। যে প্রয়াস কোনো মেয়ের স্পর্শ নিতে পারত না। বিরক্ত হত সেই কি-না এখন অন্য একজন মেয়ের স্পর্শের জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। উফ! এটা খুবই খুশীর খবর ডিয়ার। এখনই সাবা শশীকে বলতে হবে।”

“না সকাল এখন কাউকে কিছু বলবি না তুই। এই কয়দিনে কী ভালোবাসা হয়?
আমি চাই আরও সময় নিয়ে বুঝতে আসলে আমার মনে যা আছে তা কি ভালোলাগা নাকি কোনো মোহ!
নাকি সত্যিকারের ভালোবাসা?

আমার জীবনে এর আগে কখনো সত্যিকারের ভালোবাসা আসেনি। তাই ভালবাসা কী তা বুঝতে আমার কিছুদিন সময় লাগবে দোস্ত। ”

“আচ্ছা তুই যত ইচ্ছে সময় নেয়। কিন্তু বেশী দেরি করিস না। কারণ ভালোবাসার কথা বলতে বেশী সময় নেয়া উচিত না। যেকোনো মুহূর্তে অন্যের হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
ভালোবাসা যত তাড়াতাড়ি প্রকাশ করা যায় ততই ভালো দোস্ত। ভালোবাসায় কোনো রিস্ক নিতে নেই।”

প্রয়াস সকালকে জড়িয়ে ধরে বলল, ” কোনো রিস্ক নেব না দোস্ত। ব্যাস একটু সময় লাগবে আমার।”

সকাল প্রয়াসকে জড়িয়ে ধরে পিঠে চাপড় মেরে বলল, ” অল দ্যা বেস্ট দোস্ত। আই এম হ্যাপি ফর ইউ।”

আবার হঠাৎ জোরে জোয়ার আসে প্রয়াস দৌঁড়ে যায় সকালকে বলল, ” দোস্ত জোয়ার এলে রোদেলা ভয় পায় তুই আয় আমি যাচ্ছি।”

সকাল দাড়িয়ে থেকে হাসে আর ভাবে এরপর ও বলবি তুই মেয়েটাকে ভালোবাসিস না।

প্রয়াস এসে দেখে রোদ ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।সাবা শশী সবাই যার যার আসনে চলে গেছে। রোদ একা বসে আছে। কিন্তু দুহাত মুষ্টিবদ্ধ আর দুচোখ বন্ধ। দেখেই বুঝা যাচ্ছে কী পরিমাণ ভয় পাচ্ছে।
প্রয়াস গিয়ে রোদকে দুহাতে আলগা করে ধরে নেয়।দুজনের মাঝে অল্প দূরত্ব। দুজনের নিঃশ্বাস দুজনের গায়ে পড়ছে।

রোদের চোখ বন্ধ কিন্তু প্রয়াস চেয়ে আছে সে ভয় পাওয়া চোখ বন্ধ মুখটার দিকে। এভাবেই ভালো লাগছে দেখতে তার। প্রয়াসের মুখে সুখের হাসি।

জোয়ার বন্ধ হয়ে গেলে দুজন আগের মত বসে পড়ে, কারো মুখে কোনো কথা নেই। তারপরও মনে হচ্ছে অনেক কথার মেলা বসেছে চুপিসারে সব কথাই যেন বলা হয়ে গেল!
নীরবতাই যেন সব না বলা কথার জানান দিচ্ছে।
আর মিনিট দশেক পরে পৌঁছে যাবে তারা তাদের গন্তব্যে।
মনে থেকে যাবে এই সুন্দর জার্নিটা।
আর কিছু সুক্ষ্ণ স্মৃতি। যা দুজন মানুষের মনের গভীরে তালাবদ্ধ করে নিল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here