মেঘের আড়ালে বৃষ্টি পর্ব -০৬

#মেঘের আড়ালে বৃষ্টি
#ছয়
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা

জাহাজের পেছন দিকে গেলে দেখা যায় কতগুলো গাংচিল উড়ে আসছে জাহাজের পিছুপিছু চিপস খাওয়ার আশায়।

রোদ, সুচি, নিশি, রহিম তারা জাহাজের পেছন দিকে এসেছে সমুদ্রের জোয়ারের তীব্রতা দেখতে। এই জোয়ার কতটা শক্তিশালি সামনে থেকে দেখে কেউ বুঝতে পারবে না। মায়ানমারের নাফ নদী দিয়ে সেন্টমার্টিন যেতে হয়। প্রতিটি জাহাজে তার নিজের দেশের পতাকা থাকে। যাতে দূর থেকে মানুষ বুঝতে পারে এটা কোন দেশের জাহাজ।

নদী বা সমুদ্রের জোয়ারের কোনো দিন বা সময়ের ঠিক থাকে না। তারা আসার আগাম কোনো বার্তা দেয়না। যখন মন চায় চলে আসে। আর তার সাথে ধাক্কা দিয়ে যায় নদীর মাঝে যাত্রা করা জাহাজগুলোকে। প্রয়াস এসে রোদদের দলের পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছে রোদকে। সেটা তখনও কেউ খেয়াল করেনি।

নদীর এই জোয়ার ভাটা দেখে রোদের মন আনন্দে নেচে উঠেছে। বরাবরই ভ্রমন প্রিয় মানুষ সে। ঘুরতে খুব ভালবাসে। আর সেটা যদি হয় পাহাড় বা সমুদ্র তাহলে তো কথাই নেই। তার চোখে মুখে কেমন খুশীর ঝিলিক দেখা যাচ্ছে।
রোদের আলোয়, সাগরের মাঝখানে এমন প্রাণোচ্ছ্বল এক রমনীর এমন হাসিখুশী মুখ পাখির মত ডানা মেলা তার সাথে আছে ঝিরিঝিরি বাতাসের শব্দ যা ছন্দের মত শোনায়। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ।
এমন একটা দৃশ্য দেখে প্রয়াসের মনে এক অন্যরকম সুখের সৃষ্টি করছে।

ইচ্ছে করছে এই অষ্টাদশী নন্দিনীর সাথে তার মতো করে ডানা ঝাপটাতে। তার মতো করে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সে ভদ্রছেলে হিসেবে পরিচিত আর সেটা যদি হয় কলেজ বা নিজের পাড়ায়। তাহলে তাদের প্রতি ক্ষেত্রে হিসেব করে চলতে হয়। তাই এখন ইচ্ছে করলেও এই কাজটা করা যাবে না। করলেও আশেপাশের সব জুনিয়র আর স্যারদের চোখে পড়ে যাবে।
নিজে যেতে না পারলেও, রোদকে দেখে খুবই ভালো লাগছে তার। এই মেয়েটা আসলেই সবার থেকে আলাদা। একটু বেশিই আলাদা।

এসব ভাবতেই রহিমের চোখ যায় প্রয়াসের দিকে।চোখাচোখি হতেই প্রয়াস একটু অস্বস্তি অনুভব করে।কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,

“আমরা প্রায় চলে এসেছি বলতে বলতে এগিয়ে গেল তাদের দিকে। আর মিনিট পাঁচে…এই কথা শেষ করার আগেই রোদ দু’হাত মেলে যেভাবে ঘুরছিল হঠাৎ প্রয়াসের কথায় নিচে একটা কাঠের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যাচ্ছিল। এমন সময় প্রয়াস এসে ধরে পেলে তাকে। রোদের মাথা এই মুহূর্তে প্রয়াসের বুকের উপর প্রয়াস অনুভব করছে রোদের গরম নিঃশ্বাস। বাতাসের সাথে একটা মিষ্টি ঘ্রাণও অনুভব করছে এতক্ষন তো কোনো ঘ্রাণ লাগেনি এখন কোথায় থেকে এলো এই ঘ্রাণ কেমন যেন মাদকতা মেশানো আছে এই মিষ্টি ঘ্রানে। কয়েক মুহূর্তের মাঝেই প্রয়াস বুঝতে পারল এটা আর কিছু নয় রোদের চুলের ঘ্রাণ।

অতর্কিতে রোদ নিজেকে ছাড়িয়ে নিল প্রয়াসের থেকে। সে লজ্জা পেয়ে গেল। রোদ ভাবল ধুর এক একবার এমন কান্ডকারখানা করে সে, যার জন্য লজ্জায় পড়তে হয়। ধ্যাৎ ভাল্লাগে না।

প্রয়াস বলে আমরা চলে এসেছি। তোমরা সবাই যে যার জিনিস নিয়ে নামার প্রস্তুতি নাও। এই কথা বলেই কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যায় প্রয়াস।

রহিম বলল, ” দোস্ত তোরে প্রয়াস ভাইয়ার সাথে যা দেখাচ্ছিলো না! জোস, একদম নায়ক নায়িকার মতন। নায়িকা পড়ে যাবে এমন সময় নায়ক এন্ট্রি নিয়েছে উফস্ হোয়াট আ সিন ইয়ার!”

“ওই রহিম্মা কী আজে বাজে কথা শুরু করলি! উনি আর আমি কেমনে কি? আমি তোদের মতো না। এসব রোমান্টিকতায় আমি নাই।”

“রোদ এটা তুই কি বললি আমরা কীসের রোমান্টিকতা করলাম রে?”

“হুম রোমান্টিকতা না করলে তোরা আমার বন্ধু হয়ে আমাকে তোদের সাথে বসতে দিলিনা কেন। তাও আবার আমার থেকে আলাদা কামরায় তোদের সিট কেন বলতো?”

নিশি বলল, “এই রোদ শোন আমরা কেউ টিকেট কাটিনি। কেটেছে প্রয়াস ভাই আর সকাল ভাই। তাই কে কোথায় বসবে সেটা উনারাই ঠিক করেছে বুঝলি?
আর সুচী, রাহাত প্রেম করছে সেটা বুঝলাম কিন্তু আমি আর রহিমতো প্রেম করছিনা। তাহলে তুই আমাদের কেন বললি?”

“আচ্ছা তোমরা প্রেম করো না। তাহলে সব সময় এমন দুজন দুজনের সাথে চুইংগামের মত লেগে আছো কেন? সব কয়টা বদের হাড্ডি!”

রহিম আর কথা বাড়াতে না দিয়ে এদের নিয়ে চলে যায়। রোদ হয়তো বলে ফেলবে রহিম যে সনিকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। অনেক কষ্টে সনিকে বুঝিয়েছে সে ভালবাসে না এখন আর তাকে। শুধু বন্ধু হয়ে থাকতে চায়। এখন আগের কথা মনে হলে। এই ভ্রমণটাই মিথ্যে হয়ে যাবে। তাই রোদকে টেনে নিয়ে চলে যায় রহিম।

নদীর পানিগুলো স্বচ্ছ দেখতে।এ ই পানিগুলো দেখলেও মন ভালো হয়ে যায়।
প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্যে নিজেকে নতুন করে ফিরে পাওয়া যায়।

আমাদের দেশ আসলেই খুব সুন্দর। প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যের লিলাভুমি এই দেশে প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যাই আমরা।

★★★

জাহাজ থেকে নেমে যাচ্ছে সবাই একে একে। পৌঁছে গেছে তারা সেন্টমার্টিন দ্বীপে।
চারপাশ এত সুন্দর! যেদিকে তাকায় চোখ আটকে যায়।

রোদ বিমোহিত হয়ে বলল, ” ইশ কী সুন্দর! এত সুন্দর জায়গা বাংলাদেশে আছে জানতাম নাতো।

“সবে তো এলে আরও অনেক সুন্দর দেখা বাকি আছে।” রোদের কথায় উত্তর দেয় প্রয়াস।

রোদের চোখে কৌতুহল দেখা যাচ্ছে। প্রয়াস কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সামনে চলে যায় হালকা হেসে।

★★★

তারা উঠবে, “প্রাসাদ প্যারাডাইস রিসোর্টে।” সেখানে তাদের জন্য বুকিং দেয়া হয়েছে। তারা এখানে এসেছে মোট ৪০জন। স্যার ৮জন আসছেন। বাকি স্যাররা আসেনি। ছাত্রছাত্রী হচ্ছে ৩২ জন। তাদের জন্য মোট ১০টি কক্ষ বুকিং করা হয়েছে। একটি কক্ষে চারজন করে থাকবে। চার জনের জন্য একটি।

সমস্যা ঘটে তখন যখন তারা রিসোর্টে যায়। দেখে তাদের নামে আটটা রুম বুক করা আছে। কিন্তু বাকি দুটো রুম অন্য কেউ নিয়ে নিয়েছে।

প্রয়াস সকালকে বলল, ” তুই বলেছিলি তোর পরিচিত আছে এই রিসোর্টে তাই আমি তোকে রুম বুক করতে বলেছি। কিন্তু এটা কি হলো? দশটা রুমের জায়গায় আটটা হাও ইজ ইট পসিবল সকাল?”
একটু কড়াভাবে কথাটা বলল প্রয়াস।
সকালের ভুল হয়েছে এটা সে নিজে বুঝতে পারছে। তাই ও চুপ করে আছে।

সকালের কাজিন রনি এই রিসোর্টে কাজ করে,তার মধ্যে দিয়ে রুম বুক করা হয়েছে। সে হয়তো ফোনে ভুল শুনেছে। তাই দশটা রুমের জায়গায় আটটা রুম বুক করা হয়েছে।

রনি এসেছে সকালের কাছে সব কিছু তার আর সকালের ভুল এটা বুঝতে পেরে সে বলল,
“আপনারা এখানে কতজন আছেন?”

গুনে দেখল তারা এখানে ৩৬ জন আছে বাকিরা কোথায়!

৪জন নেই এখানে। সকাল বলল, ” বাকি চারজন রিসোর্টের বাইরের দিকটা দেখছে মনে হয়।”

রনি বলল, ” ভালোই হলো তারা বাইরে আছে, এখন এখানে যারা আছে তাদের মধ্যে থেকে ৩২ জনকে এখানে থাকার ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি। আর বাইরের চারজন আর আপনাদের থেকে চারজন মিলে পাশের রিসোর্টে থাকার ব্যাবস্থা করছি আমি। প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না।” রনি খুব বিনয়ের সাথে কথা বলছিল। এটা দেখে প্রয়াস আর কিছু বলতে পারল না।

তাই স্যাররা সহ ৩২ জনের এখানে থাকার ব্যাবস্থা করা হলো। আর বাইরের চারজন সহ এখানের সাবা, শশী, সকাল,প্রয়াস,এরা থাকবে অন্য রিসোর্টে। এখানে যেহেতু স্যার আছে এদের দেখার জন্য, তাই ওই রিসোর্টে তাদের দেখার জন্য প্রয়াস আর সকালকে বললেন স্যাররা। তাদের বন্ধু হিসেবে সাবা শশীকে ও থাকতে বলল। কারণ স্যাররা জানে তারা কত ভালো বন্ধু।

সবাইকে রুম বুঝিয়ে দিয়ে প্রয়াসরা বের হয় রনির সাথে অন্য রিসোর্টে যাওয়ার জন্য। তারা বের হতেই দেখে বাইরে যারা আছে তারা আর কেউ না।রোদ,সুচি,সনি,রহিম।

এতোক্ষন রুমের চিন্তায় রোদের কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল প্রয়াসের। এখন আবার সামনে দেখে মনে হলো। তার মুখে আনন্দের হাসি ফুটল।রোদ তাহলে তাদের সাথে একই রিসোর্টে থাকবে।
সকাল প্রয়াসকে একটা ধাক্কা দেয় হাতের কুনুই দিয়ে।প্রয়াসের মুখ আবার গম্ভীর করে ফেলে।
সকাল কানে কানে বলল, ” কী ব্যাপার বন্ধু এতক্ষণ আমার উপর রাগ করে থাকলেও, এখন মনে হয় আমাকে একটা ধন্যবাদ দেয়া উচিত তোর। কেননা তোমার,,,,,”
আর কিছু বলতে না দিয়ে প্রয়াস একটা চিমটি কাটে সকালের কোমরে।

রোদদের সব বুঝিয়ে বলে সকাল। রোদ বলল স্যাররা আমাদের থেকে আলাদা থাকবে? আর আমাদের ক্লাসের সব এখানে থাকবে, আমরা অন্য জায়গায়? ”

সকাল বলল, “তোমার কাছের বন্ধুরাইতো রইল।তাছাড়া প্রয়াসতো আছেই। প্রয়াসের ধাক্কায় সকাল কথা ঘুরিয়ে বলল, ” আরে মানে আমরা বড় ভাইরা আছি তোমাদের দেখার জন্য এতো চিন্তা কিসের!
আর আমরা সবাই ঘুরব একসাথে,শুধু রাতে আলাদা আলাদা জায়গায় ঘুমাব এই যা।”

রোদ সুচিকে বলল, “তোর জন্য এমন হয়েছে। বাইরের জায়গাটা একটুপরও দেখা যেত। ওখানে থাকলে আমরাও রুম পেতাম।
সকাল বলল, ” যা হয় ভালোর জন্যে হয়।
চলো।”

সবাই রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে, ৩০ মিনিটের মতো রেস্ট নিবে, তারপর বের হবে ঘুরতে।

তাই আমাদের হাতে সময় খুব কম। পাশে অন্য রিসোর্টে তারা দুটো রুম বুক করে। একটায় থাকবে সাবা,শশী, সুচি, নিশি রোদ।

আর একটায় থাকবে সকাল,প্রয়াস, রহিম। বিপত্তি ঘটে এবার এক রুমে একজন বেশী, আর অন্য রুমে একজন কম হয়ে গেছে।
প্রয়াস বলল, “তোরা পাঁচজন কীভাবে থাকবি এক রুমে?”

সাবা বলল, ” কোনো ব্যাপার না মামা। দুটো রাত দেখতে দেখতে কেটে যাবে।”

সুচি বলল, “রোদ তুইতো এত মানুষের মাঝে ঘুমাতে পারিস না। কীভাবে ঘুমাবি?”

রোদ বলল, “আরে কোনো ব্যাপার না। সাবা আপু বললেন না দেখতে দেখতে কেটে যাবে।”

পাশাপাশি রুম তাদের। মেয়েরা তাদের রুমে আর ছেলেরা তাদের রুমে চলে গেল। প্রয়াস যেতে যেতে পেছনে তাকাতেই রোদের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। হয়তো এতেই হয়ে গেল অনেক কথা।

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here