মেঘের আড়ালে চাঁদ পর্ব ১৬

#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ ষোল

মানুষ অতিরিক্ত ক্ষোভ আর রাগে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। তুলতুলের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। রাফসান তার হাত ছেড়ে দেওয়ার পর সে দু কদম পিছিয়ে গিয়ে রাফসানের দিকে কটমট করে তাকিয়ে রাগে ফুঁসছে। তার এখন রাফসানকে আচ্ছা করে ধুলাই দিতে মন চাচ্ছে। রাফসান কিছু না বলে চুপ করে তুলতুলকে দেখছে। মেয়েটা হঠাৎ হঠাৎ ভায়োলেন্ট হয়ে পড়ে তার যত টুকু মনে হয়। আবার মাঝে মাঝে অদ্ভুত আচরণ করে। সে কিছু ভাবছে। কিন্তু তার ভাবনা আদৌও সঠিক কিনা তা সঠিক সে জানে না। আপাতত এই ভাবনা স্থগিত করে তুলতুলের দিকে তাকায়। তারপর আবিবের দিকে তাকিয়ে বলে

-” এই তুই এখনো দাঁড়িয়ে কি দেখছিস? এটাকে নিয়ে যা। রাগে তো মুখ বেলুনের মতো ফুলে গিয়েছে। কখন দেখা যাবে টুস করে ফেটে যাবে। আর নইতো দেখা যাবে মুখ থেকে আগুন বের করে জালিয়ে দিবে সবকিছু।” শেষের কথাটা একটু ব্যঙ্গাত্মক করে বললো। রাফসানের এই কথা যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করলো। তুলতুল হঠাৎ করে নিচে থেকে একটা মাঝারি সাইজের ইটের টুকরো হাতে উঠিয়ে রাফসানের দিকে ছুড়ে মারে। রাফসান দ্রুত সরে যায় এজন্য তার গায়ে লাগে না। তুলতুল যখন ইটের টুকরোটি হাতে নেয় তখন এরকম কিছু একটা ভেবেই সতর্ক হয়ে যায়।

রাফসানের লোকজন তুলতুলের দিকে রিভলবার তাক করে দাঁড়ায়। মানে রাফসানের এক ইশারায় তারা মেয়েটাকে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিবে। এতক্ষণ ধরে মেয়েটার কান্ড দেখে আসছে। এবার একটু বেশিই করে ফেলেছে। কিন্তু তাদের বস এখনো কিছু বললো না। যেখানে বসের সামনে জোরে কেউ কথা বললে তারা রিভলবার তাক কারার সাথে সাথে বসের ইশারায় সে ব্যক্তি ফিনিশ হয়ে যায় আর সেখানে এ মেয়েটা এতক্ষণ দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে তবুও কিছু বলছে না। তারা কিছুটা বিরক্ত হয়। রাফসান ইশারায় রিভলবার নামাতে বলে সবাইকে। তারা এবার বিরক্ত নয় অবাক হয়।এমনটা কখনো হয়নি। রাফসান কাউকে কখনো এতটা সহ্য করে না। কে হয় এই মেয়ে রাফসানের? আবির এতোক্ষণ ভাবলেশহীন ভাবে দেখছিল যেন কিছুই হয়নি। কারন সেদিন সে তুলতুলকে রাফসানের বাহুতে ঝুলতে দেখেছে, আবার গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যেতে দেখেছে। রাফসানের গাড়িতে আবির ছাড়া আর কারো ওঠার পারমিশন নেই। এগুলো দেখে সে চরম অবাক হয়েছিল। আর আজকের ঘটনা দেখে সে স্বাভাবিকই রয়েছে। সে ধরেই নিয়েছে এ দুজন একসাথে হলেই অদ্ভুত কিছু না কিছু হবেই। তাই সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

তুলতুল আর কিছু না বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাফসানের দিকে তাকিয়ে অন্যদিকে চলে যেতে লাগলো। যাওয়ার সময় রাফসানের দলের মধ্যে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের পায়ে একটা লাথি মারে। লোকটিকে লাঠি দিয়ে একজনকে পেটাতে দেখেছে তুলতুল। লোকটি পা ধরে নিচু হয়ে পড়ে। তুলতুল দ্রুত হাঁটতে লাগে। কিছুক্ষণ আগেও রাফসান তার গলা চেপে ধরেছিল। মনে হচ্ছিল তাকে মেরেই ফেলবে। তার রাগ হচ্ছে, খুব রাগ হচ্ছে। নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে। রাফসানের করা সব অকাজগুলো ফ্ল্যাশব্যাক আকারে তার চোখের সামনে ভাসছে। সে এতদিন তিয়াসের কথা অনুযায়ী ভাবতো সত্যিই হয়তো রাফসান নির্দোষ কারো ক্ষতি করে না। কিন্তু আজকের কাজের জন্য সে বুঝলো তার ধারণা ভুল। রাফসান সবার অবাক দৃষ্টি দেখে রেগে যায়। চিৎকার করে বলে

-” কি এখানে কি সিনেমা হচ্ছে? সবাই কাজ ফেলে এভাবে হা করে কি দেখছিস? আর একটাকেও যদি এমন হাবার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি তো হাড়গোড় একটাও আস্ত থাকবে না।” রাফসানের এই কথায় কাজ হলো। সবাই যার যার কাজ করতে থাকে ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী। রাফসান আবিরকে বলে

-” ফাইন্ড আউট অল দি ইনফরমেশন এবাউট হার। ইন ডিটেইলস। কুইকলি। ” আবির মাথা নাড়লো। রাফসান আবার তুলতুলের দিকে তাকায়। এতক্ষণ কেমন ধেইধেই করে হেঁটে যাচ্ছিল আর এখন খুব আস্তে আস্তে যাচ্ছে। হঠাৎ তুলতুলের সামনে একটা বাইক থামে। একটা ছেলে নেমে এসে তুলতুলের কাঁধে হাত রাখে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুলতুল ছেলেটির গায়ে ধলে পড়ে। সে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছে। ছেলেটিকে অস্থির আর উত্তেজিত হয়ে তুলতুলকে ঝাঁকাতে আর ডাকতে লাগে। পরমূহুর্তেই তুলতুলকে কোনোরকমে বাইকের তুলে নিজের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে বাইক আস্তে টেনে নিয়ে যায়। রাফসান এতোক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সব দেখছিল। তার মনে প্রশ্ন জাগছে ছেলেটি কে? আর মেয়েটি এতোটুকুতেই অজ্ঞান হলো কেন?

.

তুলতুল চোখ খুলে নিজেকে নিজের রুমে আবিষ্কার করে। সে কিছুক্ষন ভাবে তার কি হয়েছে। চট করেই তখনকার কথা গুলো মনে পড়ে যায়। তুলতুল যখন হেঁটে আসছিল তখন হঠাৎ করেই তার অস্থির লাগতে শুরু করে এবং মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নেয়। জ্ঞান হারানোর আগ মূহুর্তে প্রান্তর চেহারা নজরে আসে। প্রান্ত এসে ধরে ফেলে তাকে। আর কিছু মনে নেই। তুলতুল তাড়াতাড়ি উঠে বসতে যায়। আর তখনই আবার তার মাথা ঘুরে উঠে। সে মাথা চেপে ধরে।

-“এই তুই উঠছিস কেনো? তুলতুলের মা ঘরে ঢুকেই ঢুকতে বলে। পাশে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে -” এখন কেমন লাগছে? মাথা কি খুব ব্যাথা করছে?”

-“নাহ! এখন ঠিক আছি।” তুলতুল আস্তে করে বললো।

-” তুই ঐ সময় বাইরে বেরিয়েছিলি কেন? ওখানে তো ঝামেলা হচ্ছিল। আমি মানা করেছি শুনলি না তো এখন দেখ কি অবস্থা হলো। আমার কথা কেউ শুনে না। না তোর বাপ শোনে আর না তুই শুনিস। সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে যাব তখন বুঝবি।” আফসা বেগম রাগ করে বললো।

-” মা আমি অসুস্থ। আর তুমি আমাকে বকছো?

-” তোর মা ওই একটা কাজই বেশি পারে। শুধু কথা শুনাতে।” তুলতুলের বাবা তফিজ আহমেদ এসে তুলতুলের পাশে বসতে বসতে বললো।

-” কি বললে তুমি? আমি বেশি কথা শুনাই? সারাদিন কতক্ষণ তোমরা দুইজন বাসায় থাকো যে আমার এতো কথা শুনা লাগে। আমি তো সেই রান্না ঘরেই পড়ে থাকি। কাজের বুয়া পেয়েছে। তাই কথার দাম দেয় না। কোন কথা তোমরা শুনোনা দেখেই তো আমার কথা বলা লাগে। ভালোর জন্যই। এইযে এই একটা। বলেছিলাম যাস না। তবুও বাইরে গেল। ভালো হয়েছে না? ভালোর জন্য কথা বললেই বেশি কথা বলি? থাকো তোমরা বাপ- বেটি। আমি বেশি কথা শুনাই তো চলে যাচ্ছি। ” বলে আফসা বেগম দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। তার রাগ হচ্ছে। সন্তানদের একটু ভালোর জন্য বলতেও পারবে না।

-” আরে আরে কই যাও। এই! রেগে যাচ্ছ কেন? আমিতো মজা করেছি। তাই মা বল তো।”

-“হ্যাঁ মা বাবা তো মজা করে বলেছে।কই যাও? আমি অসুস্থ তো। আমার কাছে বস।” তুলতুল কাঁদো কাঁদো ভাবে বললো।

-” হ্যা হ্যা! মজাই তো করেছো। তোমরা বাপ- বেটি মিলে মজা কর। আমি বুঝিনা মজা, আমি যাই।” আফসা বেগম রুম থেকে বের হয়ে গেল। এখানে বসে থাকলে আর মেয়ের খাওয়া হবে না। তিনি তুলতুলের জন্য খাবার আনতে চলে গেলেন।

-” থাক মা মন খারাপ করে না। তোর মায়ের রাগ এখনি পড়ে যাবে।” তফিজ আহমেদ বললো।

-” বাবা তুমি ঠিক আছো তো? তুলতুল তার বাবার দিকে তাকিয়ে বললো। তার বাবাকে স্বাভাবিক লাগছে। এটা কি তার সামনে রয়েছে দেখে স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করছে?

-“হ্যা ঠিক আছি। আমার কি হবে? তোর কি হয়েছে বলতো?”

-“হুম ঠিক থাকলেই ভালো। তুমি চিন্তা করো না। আমরা আবার ওখানেই দোকান দেব।”

-” দোকান দিবি কোথায়? আর কেনো দিবি? একটা তো আছে। এটাই সামলাতে কষ্ট হয়।” তুলতুলের বাবা সন্দিগ্ধ হয়ে প্রশ্ন করলো।

তুলতুল তার বাবার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো তার বাবা কি বলছে। দোকান আগের টা মানে? আগেরটা তো রাফসানরা এতোক্ষণে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে হয়তো। তাহলে তার বাবা কি কল্পনায় দেখছে। আঘাত পেয়ে বাবা অসুস্থ হয়ে গিয়েছে? সব ওই রাফসানের জন্য। ছাড়বে না তাকে সে। তুলতুল কান্না করে বললো

-“বাবা আমরা আগেরটার মতোই ওরকম করে করবো। তুমি চিন্তা করো না। হ্যাঁ?

-“মা তোর কি হয়েছে। কি আগেরটার মতো করে দিবি? আগেরটাতো রয়েছেই। তোর কি খুব মাথা ব্যাথা করছে।” তফিজ আহমেদ চিন্তিত ভাবে বললো

-” আগেরটা রয়েছে মানে ওটা তো ভেঙে ফেলেছে।” তুলতুল কনফিউজড ভাবে বললো।

-” কি বলছিস কে ভাঙবে দোকান? আমি তো দোকান থেকেই এখন আসলাম।”

-“কেনো রাফসানের লোকজন। আজকে তো কতগুলো ভেঙে ফেললো। আমি নিজে দেখেছি। আর দোকান তো বন্ধ ছিল। তুমি ছিলে না তো বাবা।”

-“রাফসানের লোকজন আমাদের দোকান ভাঙবে কেনো? ওর কি আর কাজ নেই। আর আমি একটু কাজে গিয়েছিলাম তাই দোকান বন্ধ ছিল। মা তুই রেস্ট নে ঠিকাছে? আর দোকান ঠিক আছে নাকি সেটা পরে দেখে আসবি।”

তুলতুল আর কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই তাওহী দৌড়ে এসে তুলতুলের কোলে বসে পড়লো। তুলতুলের বাবা তুলতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যাওয়ার সময় তাওহীকে বলে গেলো তুলতুলকে যেনো জালাতন না করে। তাওহী চলে আসায় তুলতুল আর কিছু জিজ্ঞাস করলো না। কিন্তু ওর মাথায় সবকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। রাফসান তাদের দোকান ভাঙে নি। সে যখন গিয়েছিল তখন সামনের দোকানটা ভাঙা হচ্ছিল। এরপরই তাদের দোকান ছিল।তাহলে কি তাদের দোকান ভাঙা হয়নি? তার বাবার কথায় কোনো বিচলিত ভাব বা অন্য কোনো কিছুই নেই। তাদের দোকান যদি নাও ভাঙে তো অন্য গুলো তো সব গুড়িয়ে দিয়েছে এগুলো দেখে তো তার বাবার একটু হলেও বিচলিত হওয়ার কথা বা চিন্তিত হওয়ার কথা। কিন্তু এমন কিছুই না। আর কেনোই বা তাদেরটা কিছু করলো না? সে রাফসানকে মানা করেছে তাই? কিন্তু সে তো খারাপ বিহেব করেছে রাফসানের সাথে। আর রাফসান তার কথা কখনো শুনবে না এটা তুলতুল জানে। নাকি এতে রাফসানের কোন উদ্দেশ্য আছে। উফফ, তুলতুলের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সে কি স্বপ্নে দেখেছে এগুলো নাকি বাস্তব। তাওহীর কথায় তার ভাবনার সুতো কাটে। তাওহী তার কোলে বসে তর ওপর হেলান দিয়ে বলে

-“আচ্ছা আপু কিছুদিন পর পরেই কি তোমার মিরকি ব্যারাম হয়?”

-” কি? কি বললি? মিরকি ব্যারাম কি?” তুলতুল অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো।

-” শোনো আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে আছে। সে কিছুদিন পর পরেই অসুস্থ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে জিহবা উল্টে পড়ে যায়। আর কারো সাথেই কথা বলে না। তখন আমাদের এক স্যার বলে তোর কি মিরকি ব্যারাম হইছে। পড়া বলিস না কেনো। বেতের বারি দিলে ঠিক হয়ে যাবি। তো তোমার কি এখন বেতের বারি দিয়ে ঠিক করতে হবে যাতে সুস্থ হয়ে যাও?” বলে তাওহী খিলখিল করে হাসা শুরু করলো।

-” তবেরে আমার কোলে বসে আমাকেই মার খাওয়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে? এটা যে তোর স্যারের নয় তোর কথা বুঝতে পেরেছি। দাঁড়া তুই। ” তাওহী ততক্ষণে তুলতুলের কোল থেকে নেমে গিয়েছে। আর তুলতুল এই কথা বলার পর সে ঝেড়ে দৌড় দেয়। জানে এখানে থাকলে এখন কানমলা খাবে।

.

রাফসানের সামনে একজন বসে রয়েছে। চেয়ারের সাথে তার হাত পা বেঁধে রাখা হয়েছে। লোকটির ভয়েই প্রাণ যায় এমন অবস্থা। রাফসান চোখ মুখ শক্ত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লোকটির দিকে তাকিয়ে আছে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here