মেঘের আড়ালে চাঁদ পর্ব ৩২

#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ বত্রিশ

সকালের সোনালী রোদ জানালার পর্দা ভেদ করে মুখে এসে পড়েছে। এসি বন্ধ করে দেওয়ার রোদের তাপে রুম গরম হয়ে গিয়েছে। তারপরও রাফসানের উঠার নাম নেই। সে উপুড় হয়ে হাত মাথার নিচে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। গায়ে একটা পাতলা চাদর টানা। সে শান্তিতে ঘুমাতে ব্যস্ত। কিন্তু তার এই শান্তির ঘুম বুঝি করো পছন্দ হলো না। সে এসে রাফসানের চুলগুলো জোরে টান দিল। ব্যাথা পাওয়ায় রাফসান চিৎকার দিয়ে উঠে। তারপর চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে তার দাদী। রাফসান একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে ঢুলতে ঢুলতে আবার বালিশে মাথা রাখলো। তার ঘুম সরছে না। চোখ ভেঙে ঘুম আসছে। দাদী ঘুম ভাঙানোর জন্য এসি বন্ধ করে দিয়েছে, গায়ে কাঁথা টেনে দিয়েছে যাতে গরমে উঠে যায়, কিন্তু এই বান্দার ঘুম ভাঙা নয় যেনো আরো জেঁকে বসেছে। আর কোনো উপায় না পেয়ে রোমানা চৌধুরী রাফসানের মুখে পানি মারলেন। রাফসান এতে ধড়ফড় করে উঠে। দাদীর দিকে তাকিয়ে খুব কষ্টে চোখ টেনে খুলে। হঠাৎ করেই তার এতো ঘুম কেনো আসছে? রাতে ড্রিংকস করার কারনে? কিন্তু সে তো প্রায়ই করে তখন তো এমন হয় না। সে দাদীর দিকে তাকিয়ে বলে

-” বুড়ি ডাকছো কেন? আমি আর একটু ঘুমাই ঠিকাছে?”

-” তুই খালি বালিশে মাথা রাইখা দেখ আমি তোরে চুবামু পানিতে। এতো ঘুম কই থেইকা আসে? যা উঠ।”

-” আচ্ছা তুমি যাও আমি আসছি।” রাফসান আলস্য ভঙ্গিতে বলে।

-” আমি যামু মানে? তুই বাইর হ রুম থেইকা, যা নিজের রুমে যা।”

-” দাদী কি বলো সকাল সকাল মাথা ঠিক আছে? আমি তো নিজের রুমেই আছি।”

-” থাপড়ায়ে তোমার মাথার ভূত নামাইয়া দিব। চোখ মেইলা চা, দেখ কার রুমে আছোস।” রোমানা চৌধুরী বিরক্তি নিয়ে বললো। রাফসান ভালো ভাবে তাকায়, সে সত্যিই তার রুমে নয় তার দাদীর রুমে আছে। কিন্তু কিভাবে? রাফসান দাদীর দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হেসে মাথা চুলকায়। রোমানা চৌধুরী রাফসানের ঘাড়ের ওপর দুম করে একটা বসিয়ে দিয়ে বলে

-” যা রুমে যা, ফ্রেশ হয়ে দ্রুত নিয়ে আসবি নাইলে আমি যাইয়া চড়ায় নিয়ে নামামু।”

রাফসান হেলতে দুলতে তার রুমে এসে পৌঁছায়। তারপর খাটের ওপর ধপ করে বসে পড়ে। তার মাথা ঝিনঝিন করছে, নিজের দিকে তাকায় তার গায়ে তো টিশার্ট ছিল সেটা কোথায়? আর দাদীর রুমেই বা গেলো কিভাবে? সে তো বেলকনিতে ছিল। রাফসান আর না ভেবে ফ্রেশ হতে চলে যায়। একটা ট্রাউজার পরে বের হয়ে কাবার্ড থেকে টিশার্ট বের করে। সেটা পরে পিছনে ফিরলেই তার চোখ চড়কগাছ হয়ে যায়। এলা? কিন্তু ও এখানে কি করছে? সকাল সকাল রাফসানের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এই মেয়ে কিভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এলা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাফসানের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। রাফসানকে শুধু টাউজার পরা দেখে তার মাথা আরো খারাপ হয়ে গেছে। হাত-পা ছাড়িয়ে এখন তার জোরে জোরে চিৎকার করে কান্না করতে মন চাচ্ছে। রাফসান এগিয়ে গিয়ে এলাকে একটা ধমক দেয়। ধমক খেয়ে এলা কেঁপে ওঠে।

-“তুমি এখানে কি করছো? তাও আমার রুমে? তোমাকে না আমি বাড়িতে আসতেই মানা করেছিলাম? তাহলে কোন মতলবে এসেছো?” রাফসানের ধমকে এলা কান্না করে দেয়।

-” আমি তো রাতে তোমাকে সরি বললাম। আর কখনো ওমন করবো না। তুমিও তো সরি এক্সেপ্ট করেছো তাহলে এখন কেনো বকছো?” এলার কথায় রাফসান একটু নরম হলো। রাতের ঘটনা তার বেশি মনে নেই। শুধু আবছা ভাবে মনে আছে সে ড্রিংক করছিল। এরমধ্যে লাল কোন ড্রেস পরা কেউ তার সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর পাশে বসে। তার মনে পড়লো সেই মানুষটির সাথে সে কিছু কথাও বলেছে কিন্তু কি বলেছে মনে করতে পারলো না। এলার দিকে রাফসান তাকিয়ে দেখে এলা লাল রঙের শাড়ি পড়েছে। তাহলে এলাকে হয়তো রাতে সরি এক্সেপ্ট করেছে তা বলেছে কিন্তু তার মনে নেই।

-” কিন্তু তুমি এখানে আমার বেলকনিতে কি করছো? আর তোমার এই অবস্থা কেন।” রাফসান শান্ত ভাবে বলে।

-” ঐ তো রাতে ভুলে এখানেই ঘুমিয়ে পড়ছিলাম হে হে হে।” এলা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করছে। মনে মনে বলে ‘তোর আর তোর দাদীর জন্য এই অবস্থা।’

রাতে এলা রাফসানকে রুমে নিয়ে যায়। রাফসান তখনো কি যেনো বিরবির করছে। এলা রাফসানকে বিছানায় বসিয়ে তারপাশে বসে রাফসানের মুখ দুহাতে নেয়। রাফসানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর রাফসান সফট, সফট বলে কিছু বিরবির করছে। এলা নিজের মুখ রাফসানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তা দেখে রাফসান মুচকি হেসে জড়ানো গলায় এলাকে কিছু বললো কিন্তু এলা তা বুঝতে পারলো না। এলা যখন রাফসানের কাছাকাছি চলে যায় তখন রাফসান হঠাৎ করেই মাকড়সার মতো তার হাতের পাঁচ আঙুল ছাড়িয়ে এলার মুখ আটকে ধরে দূরে সরিয়ে দেয়। আর এলা রাগী চোখে রাফসানের দিকে তাকায় পরমূহুর্তেই রাফসানকে মানাতে নরম গলায় কথা বলার আগেই রাফসান বলে ওঠে

-” ছিইইইই! কিপ ইউর ডার্টি টিথ অ্যান্ড ইউর ডার্টি লিপস অ্যাওয়ে ফরম মি। ইয়াককক। গো অ্যাওয়ে। হুঁশ, হুঁশ হুঁশ। ” বলে রাফসান হাত দিয়ে তাড়ানোর ভঙ্গি করলো। আর এলা এতে প্রচুর রেগে গেলো। কিন্তু রাফসানের এতে কিছু যায় আসে না। সে বিছানায় শুয়ে পড়লো টান হয়ে। এলার চোখ যায় রাফসানের শার্টের বাটন খুলে দৃশ্যমান হওয়া বুকে। এলা রাফসানের বুকে মাথা রাখতে যায় কিন্তু রাফসান গড়িয়ে অন্য পাশে চলে যায়। তারপর উঠে বসে সে এলার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। আর এলা নিজের রাগকে কন্ট্রোল করছে। রাফসানের পাগলামিতে সে কখন না হয় আবার বাস্ট হয়ে যায়। এতসময় হয়ে গেছে কিন্তু তার কাজে একটুও সফল হয়নি। মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার। আর রাফসান বিছানা থেকে নেমে পড়ে। তারপরে অদৃশ্য কিছুর সাথে হাত ঘুরে ঘুরে ওয়াল্টজ ড্যান্স করতে থাকে। তার মনে হচ্ছে সামনে একটি রূপবতী নারী রয়েছে। আর এলা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আর ওদিকে রাফসান নিজে নিজে ড্যান্স করে বলছে

-” লেট মি লাভ ইউ, লেট মি লাভ ইউ বেবিইইইই,
লেট মি লাভ ইউ, লেট মি লাভ ইউ বেবিইইইই,”

বিবারের গানের এই লাইনটাই সে বারে বারে চিল্লিয়ে বলছে। আর এলার মাথায় বুদ্ধি আসে সে রাফসানের সামনে গিয়ে তার হাত এগিয়ে দেয়। রাফসান বোজা চোখে একবার তাকিয়ে মিচকে হাসি দিয়ে এলার হাত ধরে ড্যান্স করতে থাকে কিন্তু দূরত্ব বজায় রেখে। কেমন দূরে দূরে থাকছে রাফসান। তাই এলা নিজেই রাফসানের হাত নিয়ে তার কোমরে রাখে। আর রাফসান হাত সরিয়ে তাকে হাত ধরে কয়েকটা ঘুরানি দেয়। এলা ভাবে ঘুরানোর ফলে রাফসান তার হাত ধরে টান দেবে আর সে রাফসানের বুকে আছড়ে পড়বে, তারপর আবার রাফসানের সাথে ড্যান্স করবে। আহা! সে খুশিতে গদগদ হয়ে আকাশে উড়তে লাগলো। কিন্তু হঠাৎ কিছুর সাথে বারি খেয়ে তার হুঁশ আসে। সে দেখে তার মাথা দেয়ালের সাথে বারি খেয়েছে। রাফসান তার হাত ধরে জোরে ঘুরানি দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে আর এলা তখন ভাবনায় মত্ত ছিল দেখে খেয়াল করে নি। তাই ব্যালেন্স করতে না পেরে সে দেয়ালের কাছে গিয়ে পড়ে আর তার মাথা ঠাস করে দেওয়ালে বারি খায়। এলা রাফসানের দিকে তাকালো সে আবার সাচ্ছন্দ্যে তার কল্পনার নারীকে নিয়ে নাচতে শুরু করেছে। এলার যেনো রাগে শরীর কেঁপে উঠল

-” রাফসানননন।” সে রাগে একটা চিৎকার দেয়। কিন্তু রাফসানের তাতে কিছু যায় আসে না। সে প্রথমে এলার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো, তারপর একটা ভেংচি কেটে অদৃশ্য কারো হাত ধরে বলে

-” হাম তেরে বিন আব রেহ নেহি সাকতে তেরে বিনা কিয়া ওয়াজুদ মেরা….. কিউকি তুম হি হো, আব তুম হি হো জিনদেগি আব তুম হি হো….” এলা এসে রাফসানকে টেনে ধরে বলে চিল্লিয়ে

-” পাগলামি করছো? সমস্যা কি তোমার? আমাকে চোখে পড়ছে না?” কিন্তু রাফসানের কেমন করা দেখে এলা থেমে যায়। তাই ও রাফসানের কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে

-” এই কি হয়েছে এমন করছো কেন?” বলার সাথে সাথে রাফসান হড়বড় করে বমি করে দেয়। যদিও ড্রিংকস করার অভ্যাস আছে তার কিন্তু আজকে এলা ড্রাগস দেওয়া সবমিলিয়ে উল্টো রিয়াকশন হয়েছে, আর এতো সময় লাফিয়েছে তাই বমি হয়ে গিয়েছে। এলা রাফসানকে বমি করতে দেখে তার হাত ছেড়ে দিয়ে ছিটকে সরে যায়। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে তার শাড়িতে ভরে গেছে। এলা ইয়াক করে নাক চেপে ধরে তার নিজের দিকে তাকায়। কি অবস্থা! সে দ্রুত সার্ভেন্টদের আসতে বলে তাদেরকে পরিষ্কার করে দিতে বলে। আর রাফসান এলার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে তার দিকে আগায়। এলা ভ্রু কুচকে তাকায়। এতোক্ষণ সে পরিষ্কার ছিল তখন নোংরা বলেছে আর এখন নোংরা হয়ে গিয়েছে এখন কাছে আসছে কেন? যাইহোক, রাফসান কাছে আসলে এলাও আটকাবে না। তার উদ্দেশ্য সফল হয়ে যাবে। রাফসান কাছে এসে তার সামনে দাঁড়ায় তারপর তার শাড়ির আঁচলে হাত দেয়। এলাও মুচকি হেসে রাফসানের দিকে তাকিয়ে ছিল কিন্তু রাফসানের কাজে তার মুখ হাওয়া ছাড়া বেলুনের মতো চুপসে যায়। রাফসান এলার শাড়ির আঁচল নিয়ে তার নিজের মুখ মোছে তারপর টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে খেয়ে বিছানায় টান হয়ে শুয়ে পড়ে। আর এলা তা দেখে কটমট করে রাফসানের দিকে তাকিয়ে তাকে বকতে বকতে ওয়াশরুমের দিকে যায় সে এসে রাফসানকে দেখবে। জেদ চেপে বসেছে তার নিজের উদ্দেশ্য যেভাবেই হোক সফল করবে।

রাফসান ওপরের সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে। তার কেনো জানি ছোটবেলার মতো দাদীর সাথে দুষ্টুমি করতে মন চাইলো। আজকে তার মাথাটা পুরাই গেছে। সে চট করে উঠে বসে। মুখে বড় একটা হাসি ঝুলিয়ে দাদীর রুমে যায় ঢুলতে ঢুলতে। গিয়ে দেখে দাদী ঘুমাচ্ছে। রাফসান দুষ্ট হাসি দিল। তারপর দাদীর পায়ের কাছে বসে তার পায়ে কাতুকুতু দিল যে এই ভেবে আগের মতো এখনও তার দাদী লাফ দিয়ে ওঠে পড়বে। কিন্তু অনেকক্ষণ পরেও রাফসানের দাদী উঠলো না। এতে রাফসান আশাহত হলো, তার মুখ ভার হলো। সে গিয়ে দাদীর মাথার পাশে বসলো। দেখতে লাগলো কেন তার দাদী উঠল না। এতোক্ষণ তো উঠে তাকে কয়েকটা মার দেওয়ার কথা। কিন্তু সে তো জানে না যে এলা তার দাদীকে ঘুমের ঔষধ দিয়েছে। তাই তার নিদ্রারত মস্তিষ্কে কিছু অনুভব করতে পারে নি। নাহলে রাফসানের খবর ছিল আজ। রাফসান মুখ ফুলিয়ে কিছুক্ষণ দাদীর দিকে তাকিয়ে থাকলো তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে একসময় দাদীর পাশেই তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে।

এদিকে এলা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে রাফসানকে সারারুম খুঁজেও পায় না। তার মাথা খারাপ হয়ে যায়। সে রুম থেকে বের হয়ে সবজায়গা খুঁজে শেষে রোমানা চৌধুরীর রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। রুমের ভিতর গিয়ে দেখে রাফসান এখানে তার দাদীকে ধরে ঘুমিয়ে আছে। এলা রেগে রাফসানের মাথার কাছে গিয়ে তাকে জোরে ডাকতে থাকে আর ঝাঁকাতে থসকে। এতে রাফসান বিরক্ত হয় সে কেবলই ঘুমিয়েছে। একটু নড়েচড়ে তার গায়ের ওপর কারো হাত সরাতে সে হাত জোরে নাড়াতে থাকে। এতে এলা নিচে বসে হালকা আর্তনাদ করে উঠে। রাফসান হাত ভাজ করে জোরে নাড়ানোর ফলে তার কনুইয়ের গুঁতা লাগে জোরে এলার পেটে। এলা কিছুক্ষণ পেটে হাত দিয়ে ঝিম ধরে বসে থাকে তারপর উঠে রাফসানকে উঠাতে চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। এদিকে এতজোরে ডাকার ফলে রোমানা চৌধুরীর ঘুম হালকা হয়ে নড়েচড়ে ওঠে। এতে এলা ভীতভাবে তাকায় এই বুড়ি উঠলে নিশ্চিত তাকে মেরে ফেলবে। সে রাফসানকে উঠানো বাদ দিয়ে ভয় নিয়েই রুম থেকে বের হয়ে রাফসানের রুমে চলে যায়। তারপর বেলকনিতে বসে থাকে। নিজের উদ্দেশ্য সফল না হওয়ায় রাগে নিজেও রাফসানের অর্ধেক শেষ করা ড্রিংকস এর বোতল নিয়ে পুরো খেয়ে ফেলে। তারপর ওখানেই কান্না করতে থাকে আর পরবর্তীতে নিজের কাজ হাসিলের নানা উপায় খুঁজতে লাগে।

-” সমস্যা কি? এভাবে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছো কেন? যাও এখান থেকে। আমার রুমে বা আমার সামনে আসবে না।” এলার ধ্যান ভাঙে এতে। সে ড্যাবড্যাবিয়ে রাফসানকে দেখছিল। সে মাথা নাড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। চোখের কাজল লেপ্টে রয়েছে মেকাপ নষ্ট হয়ে গিয়েছে তার কান্নার কারনে, লিপস্টিক ও মুছে গেছে, তাকে পাগল পাগল লাগছে চুলগুলোও আলুথালু। বাইরে বের হয়ে মনে মনে ভাবে এসবের সব শোধ সে নেবে। এলাকে অপমান করার ঝাঁঝ তোমরা সবাই বুঝবে।

.

-“পাওয়ার অব এটর্নি কোথায়?” তিয়াস চোয়াল শক্ত করে তীক্ষ্ণ চোখে সামনের বসা মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলে৷ হাতে রিভলবার সেটা লোকটির দিকে তাক করে আছে। আর লোকটি ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। এ যে তিয়াসের আগের রূপ। এই রূপের সাথে পরিচিত সে তাইতো ভয় লাগছে। মনসুর জানে তিয়াস রেগে গেলে তখন তার মাথা ঠিক থাকে না। মানুষজন ছোট বড় নেই একদম ডাইরেক্ট একশান! সে তারপরেও কোনোভাবে বললো

-” বিক্রি করে দিছি।” তার কথা শুনে তিয়াসের মাথা খারাপ হয়ে যায়। নেহাতই লোকটাকে পেপারের জন্য বাঁচিয়ে রেখেছে নাহলে এতক্ষণ এমন কথা বলতে পারতো না। সোজা ঠিক জায়গায় গুলি ঠুকে দিত। তিয়াস সামনে থাকা টি টেবিলে একটা লাথি দেয়। টেবিলসহ চায়ের কাপ,কেটলি উল্টে পড়ে ঝনঝন শব্দ হয়। এতে মনসুর কেঁপে ওঠে।

-” শালা পাওয়ার অব এটর্নি বেচে দিয়ে তুই অফিসে কি করছ? চা দিতে আইছস? তো কারে দিতে আইছোস? মালিক কো? ডাক তারে শালা।”

মনসুর ঢোক গিলে। সে তো মিথ্যা বলেছে তার কাছেই আছে সেটা। আর আজকে উকিল আসার কথা ছিল অফিসে তাই সে পাওয়ার অব এটর্নির পেপার এখানে নিয়ে এসেছে। যদি এটা তিয়াসের হাতে লেগে যায় তো সব শেষ। তিয়াস এরপর আর তার পরোয়া করবে না, তাকে মেরে তার পরিবারকে পথে বসিয়ে দেবে। সে জানে তিয়াসের এই রুপ কিন্তু এতোদিন পর কেন ঘুমন্ত তিয়াস জেগে আগের রুপ নিলো সেটাই তিনি বুঝতে পারছে না। যখন সে ম্যানেজার পদে ছিল তখন সে অন্য শেয়ারহোল্ডারদের সাথে ষড়যন্ত্র করে তাদের পুরো কোম্পানি হাতিয়ে নেয় তারপরে কিছু হুমকি ধামকি ছাড়া তিয়াস কিছু করে নি। চাইলেও তখন তাকে মেরে ফেলতে পারতো। কারন তখনও তিয়াস এমন বেপরোয়া, কঠোর আর রগচটা স্বভাবের ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই সে সবখান থেকে উধাও হয়ে যায়। তার খোঁজ পাওয়া যায় না। কিন্তু চারবছর পরে তিয়াস কেনো হঠাৎ আগের রুপে ফিরে এসেছে তার হিসাব সে মিলাতে পারছে না। তিয়াস কঠিন ভাবে মনসুর এর দিকে তাকায়। এতদিন কিছু বলেনি দেখে এখন যে ছেড়ে দেবে তা নয়। এতদিন সে তার বাবার কথার জন্য এদের কিছু করেনি। কিন্তু আর ছাড় দেবে না এদের। তিয়াস মনসুরের কাছে থেকে কোন উত্তর না পেয়ে প্রান্তকে ডাক দেয়। সে এতোক্ষণ লোকজন নিয়ে অফিস স্টাফদের অফিস ছাড়া করেছে। তিয়াসের ডাকে ভিতরে আসে।

-” প্রান্ত ওদের ভিতরে আসতে বল। সারা কেবিন যেনো তন্নতন্ন করে খুঁজে। একটা কোণাও যেনো বাদ না যায়। এখানে না পেলে ওর বাড়িতে পাঠাবি ওখানেও না পেলে ব্যাংকে পাঠাবি। লোক আছে কাজ হয়ে যাবে। কিন্তু আমার পেপার চাই চাই।”

তিয়াসের কথায় প্রান্ত তাদের লোককে ভিতরে আসতে বলে। এসে পুরো কেবিন উল্টে পাল্টে ফেলে কিন্তু কোথাও পায় না। মনসুর মনে মনে খুশি হয়। সবজায়গা দেখা শেষ, কেবিনের অবস্থা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে। তিয়াস ভ্রু কুচকে মনসুর এর দিকে তাকায়। তার চোখ হঠাৎ পড়ে কেবিনের এককোনায় থাকা ওয়ালকেবিনেট এর ওপর। তিয়াস ইশারা করে ওটা ভাঙার। মনসুর ঘামতে শুরু করে। তিয়াসের লোকজন ওটা ভেঙে ফেলে। প্রান্ত এগিয়ে গিয়ে একটা ফাইল পায়। ফইলের ভেতর থাকা পেপার দেখে সে মুচকি হেসে তিয়াসকে ইশারা করে। তিয়াসের মুখেও হাসি ফুটে ওঠে। আর মনসুর আতংক ওঠে প্রান্তর কাছে গিয়ে ওটা ছিনিয়ে নিতে যায় কিন্তু পারে না তিয়াস পেছন থেকে তার পায়ে গুলি করে। তিয়াস প্রান্তের কাছ থেকে ফাইলটা নিয়ে তাতে চোখ বুলায়। তার বাবার কঠোর পরিশ্রমের ফল ছিল এই কোম্পানি। এতদিন কিছু পশুর দখলে ছিল তা। কিন্তু বাবাকে এখনি কিছু বলতে পারবে না সে৷ লুকিয়ে রাখতে হবে তাকে।

-” এই একে ইচ্ছা মতো পেটাবি। কিন্তু দেখিস মরে যেনো না যায়। এটা ওরা করবে যাদের কাছে পাওয়ার অব এটর্নি বিক্রির কথা ছিল। অগ্রিম টাকা নিয়েছে যে। সেই টাকার কিছু অংশ আসবে ওর চোখ, কিডনি, হার্ট থেকে। বেইমান একটা! যার খেয়ে বড় হয় তাকেই মাড়িয়ে আরো ওপরে যেতে চায়।” তিয়াস অফিসের বাইরে বেরিয়ে এসে সিগারেট ধরায়। কিছু কাজ, কিছু বোঝা যেন তার ওপর থেকে নেমে গেলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে তারপর সিগারেটের আগুন নিভিয়ে তা ফেলে দিয়ে সে বাইকে বসে। প্রান্তও বের হয়, সে চোখে সানগ্লাস দিয়ে মুড নিয়ে নিজের বাইকে বসে। তিয়াস আলতো হাসে প্রান্তকে দেখে। তারপর দুজনেই বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায়।
.

রাফসান গাড়ির স্টিয়ারিং এ পায়ের ওপর পা দিয়ে সিটে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। পরনে ব্লাক টিশার্ট আর ধূসর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। সামনে তার লোকজন কয়েকজনকে পেটাচ্ছে সেই দিকে তার নজর থাকলেও মন অন্য দিকে। যাকে ভুলার জন্য কাল সারারাত মাতাল হয়ে ছিলো সেই আবার মাথায় জেঁকে বসেছে। নিজের মনকে চেয়েও কন্ট্রোল করতে পারছে না। না চাইতেও মনে আনমনে কিছুক্ষণ পর পরই তার মনের ভেতর উঁকি দিচ্ছে। সকাল থেকে সব কাজ ভুলে যাচ্ছে, আবিরের কথায় তা মনে পড়ছে তখন তড়িঘড়ি করে সব করতে গিয়ে সে আরো উল্টো পাল্টা করছে। এইতো কিছুক্ষন আগে লোকগুলো নিজের হাতে পেটানোর কথা তার, সেজন্য নিজেকে তাদের সামনে শক্ত করতে হবে কিন্তু সে পারছিল না। মেয়েটার চেহারা মনে করেই তার মুচকি হাসি পাচ্ছিল মেয়েটা মাঝে মাঝে কেমন কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকিয়ে থাকে। এতে তার লোকজনও ভ্যাবাচ্যাকা খায়। সে নিজেও যখন বুঝতে পারে নিজেকে কঠোর আর চোয়াল শক্ত করে কাটখোট্টা টাইপ চেহারা বানাতে চায় কিন্তু পারে না এতে নিজের ওপরই রাগ করে ওদেরকে পেটাতে বলে। নিজের কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল তাও সে বেমালুম ভুলে সকালে আস্তে ধীরে ব্রেকফাস্ট করে। আবির যখন এসে তাকে এসে বলে তখন তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে পাশের পানির গ্লাস হাত লেগে পড়ে ভেঙে যায়। তারপর উঠে যাওয়ায় সময় আরেকটা চেয়ারে নিজে গুতা পড়ে যাওয়া ঠকাতে টেবিল হাত না দিয়ে টেবিল ক্লোথ ধরে টান দেওয়ায় টেবিলের সব জিনিস পড়ে ভেঙে চুরে ছাড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু রাফসানের দাদী কিছুই বলে নি, তাকে দেখে মনে হয়েছে এটা স্বাভাবিক, হওয়ারই ছিল এসব। তাই সে চুপচাপ দেখেছে কিন্তু মিটিংয়ে তাকে যেতে দেয়নি শুভ-অশুভ কিসব বলে। ফলে তার কতটা লস হয়ে গেলো। কিন্তু এতেও তার কিছু মনে হচ্ছে না। সে নিজের মনেই উল্টো পাল্টা ভাবতে ব্যস্ত। আচ্ছা সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? নাকি অন্য কিছু হয়েছে? মেয়েটাকে তার ভালো থাকার টনিক মনে হচ্ছে। তার ওপর কি জাদু করেছে কে জানে। আচ্ছা সে কি দ্বিতীয় বার প্রেমরোগে আক্রান্ত হতে যাচ্ছে? কিন্তু কিকরে সে ওই মেয়েটাকেই.. রাফসান নিজের মাথা চেপে ধরে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। তাকে দেখার জন্য মন আবার উতলা হয়ে গিয়েছে। রাগে সবকিছু শেষ করে দিতে মন চাচ্ছে তার। এমন সময় আবির এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলে

-” ভাই বাড়ি খালি। সবাই চলে গিয়েছে। শুধু একা আছে বাড়িতে।” রাফসানের মুখে হাসি ফুটে। সে বলে

-” ঠিকঠাক খোঁজ নিয়েছিস তো? আর ক্যামেরা?”

-” ভাই ওটাও মেনেজ হয়ে গিয়েছে।” আবিরের কথায় রাফসান আর কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট দেয়। আবিরও পাশে বসে। আর তার লোকজন হা হয়ে তা দেখে কোথায় গেলো তার বস এভাবে তাদেরকে না নিয়ে? তারা কি ফলো করবে? পরে মুবিন মানা করে ফলো করতে গুরুত্বপূর্ণ হলে তাদেরকে আগে থেকে বলা হতো।

তুলতুল কেবল ঘুম থেকে উঠলো। কাল সারারাত ছাঁদে কান্না করেছে। যার কারনে ঘুম হয়নি, তাই ভোরে নামাজ পড়ে এসে শুতেই একদম ঘুমে নেতিয়ে গেছে। বাঠিতে কেউ নেই। বাবা দোকানে গিয়েছে, তিয়াস কাজের নাম করে বেরিয়েছে, তাওহী স্কুলে, আর তার মা গিয়েছে প্রান্তদের বাড়ি। যাওয়ার সময় তাকেও নেয়ার জন্য ডেকেছে কিন্তু ঘুমের ভেতর কিনা কি বলেছে মনে নেই। আফসা বেগম বিরক্ত হয়ে যায় তাতে। মেয়েকে একা কিভাবে ফেলে যায়? পরে তুলতুলের রুমের বাইরে ছিটকিনি আর মেন গেইটে তালা লাগিয়ে চলে যায়। তাড়াতাড়ি এসে পড়বে এই ভেবে। তুলতুল বিছানা থেকে নেমে চুলগুলো হাত খোঁপা করে, কাটাচুল গুলো মুখের পাশে ছড়িয়ে আছে। ওড়ানা গায়ে দিয়ে দরজার দিকে তাকাতেই সে থমকে যায়। সে কি সত্যি দেখছে? নিজের চোখ কচলিয়ে আবার তাকায় না এখনোতো দেখছে। তার বোধহয় হ্যালুয়েশন হচ্ছে নাহলে রাফসান এখানে আসবে কিভাবে? সে একটা ক্যাবলা মার্কা হাসি দিয়ে রাফসানের দিকে তাকায়। কেমন করে যেনো দাঁড়িয়ে আছে। টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার পরায় আজকে অন্য দিনের থেকে আলাদা লাগছে তুলতুলের কাছে। বেশিই কিউট লাগছে একটু। তুলতুল হ্যালুয়েশন মনে করায় রাফসানের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দ্বিধাবোধ করছে না। তার মনে হচ্ছে ঘুম থেকে উঠার কারনে এমন লাগছে।

আর রাফসান দরজার সামনে হা করে দাঁড়িয়ে আছে। তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে এখানে এভাবে চুরি করে এসে ভুল করেছে। এতক্ষণ যাও ভালো ছিল এখন পাগল হয়ে যাবে সে। তুলতুল ধূসর টিশার্ট আর কালো রঙের প্লাজু পরে আছে, ওড়না গায়ে ভালো করে পেচানো, চুলগুলো হাত খোঁপা করা, মুখের আশেপাশে ছড়িয়ে পড়েছে, চোখ মুখ ঘুমের কারনে ফোলা ফোলা হয়ে আছে, চোখ ছোট ছোট করে ঠোঁট বাঁকিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে রুমের ভেতর ঢোকে। রাফসানকে রুমের ভেতর ঢুকতে দেখে তুলতুল হকচকিয়ে যায়, কল্পনাও কি মানুষের এতটা জীবন্ত হয়? তুলতুল হাত তুলে রাফসানকে রাগী ভাবে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাফসান দ্রুত বেগে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। আর সে রাফসানের বুকে আছড়ে পরে কিছুক্ষণ বোধ-বালাইহীন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। রাফসান শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরেছে। রাফসানের হার্ট বিট সে শুনতে পারছে। তুলতুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাফসান তার মুখ দুহাতে সামনে এনে কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোয়ায়। আর তুলতুল ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক মানুষের মস্তিষ্ক কাজ করে না ঘুম থেকে উঠার পর, অনেক কিছুই মনে করতে পারে না বা তৎক্ষনাৎ কিছুই বুঝতে পারে না, মস্তিষ্কে সচল হতে কিছুসময় লাগে তাদের এতে আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক হয়। তুলতুলের প্রায়সময়ই এমন হয়। যেমন এখন সে কোনো কিছুই অনুভব বা বুঝতে পারছে না। শুধু ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছে রাফসানের দিকে। রাফসান তুলতুলের মুখের দিকে একটু তাকিয়ে তড়িৎ বেগে রুম থেকে বের হয়ে যায়। এখানে থাকলে নির্ঘাত সে পাগল হয়ে যাবে। এ মেয়ে কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে, মনে চাচ্ছে গালগুলো টেনে দিতে কিন্তু এতে তার ঘোর ভেঙে যাবে। রাফসান তা চায় না। সে রুম থেকে বের হয়ে রুমের দরজা আটকিয়ে বড় বড় পা ফেলে বাইরে গিয়ে জোরে নিঃশ্বাস নেয়।

আর তুলতুল অনেকক্ষণ একভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর নিজের হাত দিয়ে কপাল ঘষে, সে বাস্তব আর কল্পনা বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুই ধরতে পারলো না। আস্তে আস্তে তার মাথা কাজ করছে বোধহয়। রাফসান কেনো তার রুমে আসবে? গুন্ডা পান্ডা মানুষ, অন্যকে না মেরে তার রুমে কেন আসবে? কল্পনাই হবে তার। এইতো রুমের দরজাও তো দেয়া আর সে উল্টো পাল্টা ভাবছে? মাথা তার গেছে রাফসানকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে। কিছুই হয়নি, সে মাছি তাড়ানোর মতো ভাব করে আবার গায়ে কাঁথা টেনে শুয়ে পড়ে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও পড়ে।

চলবে….

ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here