মেঘের পরে মেঘ -২৩
গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে প্রলয়।এখন প্রায় পৌনে পাঁচটা বাজে।কিছুক্ষন পরেই ভোরের আলো ফুটবে।রুপসার আসার কথা ছিলো চারটায়।এখনো আসেনি।তবে কি আসবে না?না আসলেও খুব বেশি কস্ট পাবে না প্রলয়।এমনিতেও তো কোথাও যেতো না ওকে নিয়ে।
শুধু চেয়েছিলো একসাথে কিছু টা সময় কাটিয়ে ওকে বুঝিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে আসবে ঘরে।
ভাবনার ঘোর কাটতেই রুপসার দেখা পেলো প্রলয়।ধীর পায়ে হেঁটে আসছে।মাথায় ঘোমটা টানা।আর সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো ওর হাত খালি।হাতে কোন ব্যাগপ্যাক নেই।ওর তো সবকিছু গুছিয়ে আসার কথা।তবে?তবে কি রুপসাও না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে?
প্রশ্নগুলো মনের ভেতর গুমড়ে ওঠতে ওঠতেই রুপসা ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে বললো,
“কখন এসেছেন?অনেকটা সময় দাঁড় করিয়ে রাখলাম, তাই না?”
“এ আর এমন কি।আপনার জন্য তো সারাজীবন দাঁড়িয়ে থাকতে রাজি।”
প্রলয়ের ঠোঁটেও মৃদু হাসি খেলে গেলো।
ফের বললো,
“চলো হাঁটি।”
রুপসা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।গেইট পেরিয়ে সামনের রাস্তায় হাঁটা ধরলো দুজন।ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।
“তো কি খবর? এতো দেরি করলে আর খালি হাতে এলে?না কি যাওয়ার মতলব নেই?”
প্রশ্ন টা ছুড়ে দিয়ে রুপসার মনের ভাব বুঝতে চেষ্টা করলো প্রলয়।
“আমি কিছু কথা বলতে চাই আপনাকে?”
সংকোচ নিয়ে বললো রুপসা।
“বলো।”
“আমরা যদি পালিয়ে না যাই,তবে আপনি কি খুব রাগ করবেন?আমাকে ভুল বুঝবেন?”
“ভুল বোঝার কি আছে?আর রাগই বা করবো কেন?এটা শুধুমাত্রই তোমার সিদ্ধান্ত। আমি কিছুই বলবোনা।তাছাড়া পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করাটা কোন ভালো বিষয় নয়।সমাজও ভালো চোখে দেখে না।”
“ঠিক বলেছেন।আমিও তাই বলি।”
“তাহলে কি করবে?পালাবে না বলছো?”
“একটা কথা সত্যি করে বলবেন?”
হাঁটা থামিয়ে প্রলয়ের মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞেস করলো রুপসা।
“বলো?”
“আপনি কি আমায় সত্যি ভালোবাসেন?”
“এখনো সন্দেহ আছে? ”
“উহুম,কোন প্রশ্ন নয়।আমি উত্তর শুনতে চাই। ”
প্রলয় রুপসা একটা হাত নিজের হাতে নিলো।খুব শক্ত করে ধরে রাখলো।তারপর গাঁঢ় স্বরে বললো,
“খুব ভালোবাসি রুপসা।খুব।এখন যদি জিজ্ঞেস করো কতোটা,তা বলতে পারবো না।শুধু এতটুকুই আমি বলতে পারবো,তোমাকে ছাড়া আমি এই আমাকে ভাবতেও পারিনা।তুমি ছাড়া আর কাউকে আমার পাশে চিন্তাও করতে পারি না।আমি আমার জীবনের ভালো খারাপ প্রতিটা মুহূর্তে তোমাকে পাশে নিয়ে কাটাতে চাই।”
রুপসার দুচোখ ছলছল করে উঠলো।ভারী গলায় জিজ্ঞেস করলো,,
“আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবেন না?”
“কেন নয়?তুমি যতোদিন চাইবে ততোদিন অপেক্ষা করবো।”
“তাহলে আমার একটা কথা শুনতে হবে? ”
“বলো।”
“আমরা আজ কোথাও যাবো না।আপনি বিদেশ চলে যান।সেখানে আপনি নিজের কাজ করুন,সফল হোন।আর আমাকে একটু সময় দিন।আমি নিজের পড়াশোনা টা কমপ্লিট করি,একটা চাকরি বাকরি করি।মোটকথা নিজেকে প্রমান করি আপনার যোগ্য হিসেবে
এরপর না হয় ফ্যামিলিগত ভাবে সব হবে।এই বিয়ে, সংসার, সবকিছু।”
প্রলয়ের বুক থেকে আঁধ মনি ওজনের পাথরটা যেন মুহূর্তেই নেমে গেলো।রুপসাকে কি করে বোঝাবে এই ভেবে এতোক্ষনে চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলো।আল্লাহ খুব রহমত করেছেন বলতে হবে,প্রলয়কে আর মুখ ফুঁটে কিছু বলতে হলো না।
রুপসার হাতের উপর হালকা চাঁপ দিয়ে ওকে ভরসা দিলো প্রলয়।
“তুমি এমনিতেই আমার জন্য যথেষ্ট যোগ্য। আলাদা করে যোগ্যতা অর্জনের দরকার নেই।ঠিক আছে। তুমি যা চাইবে,তাই হবে।শুধু তোমাকে একটা কথা দিতে হবে।”
“কি?”
“কখনো আমার জায়গায় অন্য কাউকে আসতে দিবে না,আমাকে এখনকার মতোই সবসময় ভালোবাসবে,কখনো ভুলে যাবে না,আর আমার জন্য একটু অপেক্ষা করবে,,পারবে না রুপসা?”
টলমল চোখের পানি পরতে গিয়ে কোন বাঁধাই পেলো না।ঝরতে থাকলো রুপসা কপোল বেয়ে।সে অবস্থায় থেকেই রুপসা বললো,
“করবো।কথা দিলাম।”
প্রলয়ের চোখেও পানি।কেউ কাউকে থামানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করছে না।দুজনেই আকুল হয়ে কাঁদছে।পুরুষ মানুষের না কি কাঁদতে নেই।কিন্তু কাঁদতে পেরে প্রলয়ের ভালো লাগছে।বুক টা একটু হলেও হালকা লাগছে।
বেশ কিছুটা সময় পাড় হওয়ার পর প্রলয় রুপসাকে নিয়ে ফিরতি পথ ধরলো।সূর্য তখন তার আলোর জানান দিচ্ছে।রাস্তায় দু একজন করে লোকও দেখা যাচ্ছে। সামনেই রাস্তা টা দু দিকে বেঁকে গেছে।সেখানে এসে প্রলয় থামলো।
“রুপসা, তুমি বরং ওই দিকের পথটা দিয়ে চলে যাও।আমি এই পথ দিয়ে যাই।”
“গন্তব্য তো একই।”
“হলেও বা।এক সাথে সেখানে যাওয়ার সময় তো এখনো হলো না।তাই আলাদা পথেই যাই।এতো সকালে রাস্তায় আমাদের একসাথে দেখলে অনেকেই অনেক কথা বলবে।তার চেয়ে এই ভালো।”
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে তাতে সায় দিলো রুপসা।তারপর নির্দিস্ট পথে হাঁটতে শুরু করলো। ওর গমন পথে এক দৃষ্টিতে অনেকক্ষন তাকিয়ে রইলো প্রলয়।তারপর নিজেও নিজের রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলো।
_________
দিন দশেক পরে হুট করেই প্রলয়ের টিকিট ওকে হয়ে গেলো।অবস্থা এমন যে নিজের বাড়ি আসারও সময় হলো না।খুব ইচ্ছে ছিলো যাওয়ার আগে রুপসার সাথে কিছু টা সময় কাটাবে।ওকে কিছু একটা গিফট করবে নিজের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে।কিন্তু কিছুই হলো না।
সেই দিনের পর রুপসার কাছে মোবাইলটাও ছিলো না যে ওর সাথে কথা বলবে।কি করবে?কি করবে এতো সংক্ষিপ্ত সময়ে ভেবে পায় না প্রলয়।হঠাৎই মনে হলো, দু লাইনের একটা চিঠি তো রুপসার উদ্দেশ্যে লেখাই যায়।
হুটহাট যা মনে আসলো, তাই লিখে চললো চিঠির পাতায়।নিজের হাতে ছোট একটা প্লাটিনামের আংটি সবসময়ই পরে থাকতো প্রলয়।সেই আংটি টা খুলে চিঠি সমেত একটা প্যাকেটে ঢুকিয়ে তা নুরের হাতে তুলে দিলো রুপসার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
এরপর প্রলয় পাড়ি জমালো সুদূর অস্ট্রেলিয়ায়।
_______
প্রলয় চলে যাওয়ার দুদিন পর মৌলভীবাজার এসে পৌঁছে নুর।প্রলয়ের মা বাড়িতেই ছিলো।ছেলের সাথে এতোদিন ঢাকা থেকে, ওকে বিদায় দিয়ে গতকালই ফিরে এসেছেন।একমাত্র ছেলে চলে যাওয়ায় একটু ভেঙেই পরেছেন।
নুর কে দেখে তিনি যারপরনাই খুশি হলেন।ছেলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর আপ্যায়নে কোন ত্রুটিই রাখলেন না।দুপুরে ভরপেট খেয়ে না চাইতেও ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো নুর।
ঘুম ভাঙলো বিকেল বেলা।এক কাপ কফি আর প্রলয়ের দেয়া চিঠির প্যাকেট নিয়ে ও চললো ছাঁদের উদ্দেশ্যে।সমস্ত দিকনির্দেশনা প্রলয়ই ওকে দিয়েছে।কখন গেলে রুপসাকে একা পাবে সেটা ওর জানা ছিলো।ছাঁদে পৌঁছে ঘড়ির দিকে তাকালো নুর।সাড়ে চারটা বাজে।প্রলয় বলেছিলো রুপসার মা পাঁচটা, সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বাড়িতে আসে।সে হিসেবে এখন রুপসা একা।
ভাবতে ভাবতেই দরজায় টোকা দিলো নুর।প্রথমবারে দরজা খুললো না।নুর আবারো টোকা দিলো।এবার দরজায় খুটখাট শব্দ হলো।বোধহয় দরজা খুলছে।
নুর একটু দুরে সরে প্রস্তুত হয়ে রইলো রুপসার দেখা পাবার।
একটু পরেই রুপসা দরজা খুলে নুর কে দেখে কপাল কুঁচকে ফেললো।নুর রুপসার নিকট একদমই অপরিচিত। আর নুর যেন এ দুনিয়ায় নেই এমন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রুপসার দিকে।এ কি দেখছে নুর!নিজেকেই যেন নিজে জিজ্ঞেস করে। এতো সুন্দরী কেও হতে পারে?রুপসার রুপের ছটায় নুরের চোখ যেন ঝলসে গেলো।ওর ঘোর ভাঙলো রিনরিনে মিস্টি গলায়।
“কাকে চাই?”
“আপনি কি রুপসা?”
কোনমতে বললো নুর।
“হ্যাঁ।কিন্তু আপনি কে?আপনাকে তো চিনলাম না?”
“আমি নুর।প্রলয়ের বন্ধু। ”
এবার একটু সহজ হলো রুপসা। দরজা খুলে অপরিচিত লোক দেখে একটু ভড়কে গিয়েছিল।
নুরের নাম ও প্রলয়ের মুখে অনেক শুনেছে।তাই না চেনার কারন নেই।
“ভালো আছেন ভাইয়া?আসলে মা বাড়ি নেই।তাই আপনাকে ভেতরে আসতে বলছি না।”
“অসুবিধা নেই।আমি বসবো না।শুধু একটা কথা বলতে এসেছি।”
“কি কথা ভাইয়া?”
“গত পরশু প্রলয় অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। হুটহাট সব হয়ে গেছে তাই আপনাকে জানাতে পারেনি।আমাকে বলে গেছে যেন আপনাকে জানিয়ে দেই।ওখানে গিয়ে সব ঠিকঠাক করতে একটু সময় লাগবে,তারপরই আপনার সাথে যোগাযোগ করবে ও।”
“ও।”
এর বেশি আর কিছু বলতে পারলো না রুপসা।কেউ যেন গলা চেপে ধরেছে।সমস্ত কান্নাগুলো উপচে পরতে চাইছে যেন।এই অপরিচিত লোকটার সামনে কাঁদতে একদমই মন চাইছে না।ও চলে গেলো আর রুপসা জানতেই পারলো না?একবার চোখের দেখাও দেখতে পারলো না?বুকটা অসহ্য ব্যথায় কুঁকড়ে গেলো একদম।
নুর রুপসার দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটার মুখে রক্ত জমেছে যেন।যে কোন সময় হয়তো কেঁদে দিবে।
কাউকে কাঁদতে দেখতে একদমই ভালো লাগে না নুরের।আর এ মেয়ে কাঁদবে কেন?কান্না তো ওকে একদমই মানাবে না।এ মেয়ে শুধু হাসবে।ওর হাসিতে আলোকিত হবে চারিদিক।
“আসি।”
বলেই কোন রকমে চলে আসলো নুর।এ মেয়ের সামনে আর কিছুক্ষন থাকলে নুর এমনিতেই বেহুশ হয়ে যেতো।এতো সুন্দরী মেয়ে নুর কি কখনো দেখেছে?না দেখেনি।নিজেই নিজেকে উত্তর দেয় নুর।আজ বুঝতে পারছে কেন প্রলয় ওর থেকে এতো ছোট একটা মেয়ের জন্য এমন পাগল হয়েছে।এ মেয়ের জন্য তো যে কেউ পাগল হবে।এখন যেমন নুর,কেন যেন বন্ধুর দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না।ভাবতে ভাবতে প্রলয়ের রুমে ঢুকলো নুর।
রুমে এসে কফির কাপটা টেবিলের উপর রাখতে গিয়ে মনে হলো প্রলয়ের দেয়া প্যাকেট টা ও রুপসাকে দেয়নি।পরক্ষনেই মন বদলালো,না সে দেবে না।
চলবে………..
মুনিরা মেহজাবিন।