মেঘের পরে মেঘ -২৪
“রুপসা।”
“হুম মা।”
“এই বাড়িটা কেমন লাগছে?নিরিবিলি আছে।তোর পড়াশোনায় সুবিধা হবে। তাই না?”
“হ্যাঁ।ভালোই।কিন্তু মা আমরা সেখান থেকে চলে আসলাম প্রলয়ের বাবা তো এডভান্সের টাকাটা ফেরত দিলো না?সেগুলো থাকলে তো তোমার কাজে লাগতো।”
“কাজে লাগতো তা ঠিক।কিন্তু কেন যেন ঐ লোকটার কাছে টাকা ফেরত চাইতে ভালো লাগেনি।লোকটার সামনেও পরতে ইচ্ছে করে না,জানিস।”
মৃদু হাসলো রুপসা।
“জানি মা।প্রলয়ের মা চাইলেই ফেরত দিতে পারতো।তারও হয়তো ইচ্ছে করেনি। ”
“সাবরিনা আপা খুব ভালো মানুষ। কিন্তু নিজের হাসবেন্ড কে অনেক ভয় পান।উনার সামনে নিজের কোন মতামত সহজে প্রকাশ করেন না।আর করলেও হয়তো তা খুব একটা গাহ্য হয় না।এসব বাদ দে তো।এমন কোন টাকা নয় এটা।এই টাকার থেকে সম্মান টা আরো বেশি দামী আমার কাছে।”
নিজের মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো রুপসা।মাথায় চুমু খেয়ে বললো,
“আমি জানি মা।আমার জন্যই তোমাকে এ অসম্মানের মধ্যে পরতে হলো।খুব রাগ করেছো তাই না?”
“না রাগ করিনি।তবে একটু কস্ট তো অবশ্যই পেয়েছিলাম।কিন্তু এখন আর কোন কস্ট নেই।তুই সবটা বুঝতে পেরেছিস এইতো অনেক। একটা কথা মনে রাখবি,কোন কিছুর বিনিময়ে নিজেকে কারো কাছে খেলো করবি না।নিজেকে ছোট ভাববি না।তাহলে দুনিয়ার মানুষ তোকে মাটিতে পিষে ফেলবে।সব সময় মাথা উঁচু করে বাঁচবি।”
“তুমি দোয়া করো মা।”
বলে মায়ের বুকে আশ্রয় নেয় রুপসা।মায়ের সাথে সম্পর্কটা এখন আগের চাইতও আরো বেশি বন্ধুত্বপূর্ন।মনের সব কথাই এখন মায়ের সাথে শেয়ার করে রুপসা।প্রলয় চলে যাওয়ার খবর যেদিন শুনেছিল,সেদিন খুব কেঁদেছিলো রুপসা।এভাবে ওকে না বলে প্রলয় চলে গেছে ভাবতেই ওর কস্ট হচ্ছিলো।সে সময় মা ই ওকে সামলেছে।বুঝিয়েছে এমন হয়।আর এতে প্রলয় নিজেও হয়তো খুব কস্ট পেয়েছে।
মায়ের কথায় কিছুটা হলেও শান্ত হয়েছে রুপসা।প্রলয়কে শায়েরীর অপছন্দ নয়।বেশ ভালো ছেলে।
মেয়েকে তো একদিন না একদিন পরের ঘরে পাঠাতেই হবে।প্রলয়ের মতো ছেলে সেখানে পাত্র হিসেবে এগিয়েই থাকবে।মাঝে মধ্যেই মনে পরে যায় সেদিনকার কথার খন্ডবিশেষ,
“আন্টি, প্লিজ বিশ্বাস করুন আমি ওকে খুব ভালোবাসি।রুপসাকে সুখে রাখার সমস্ত চেষ্টা করবো আন্টি। প্লিজ আন্টি আপনি না করবেন না।বিয়ে টা হয়ে যাক।আমি নিশ্চিন্তে বিদেশ যেতে পারবো তাহলে।”
“জানো তো প্রলয় সংসারটা একটা সমুদ্র।সেটা পাঁড়ি দেয়া বড়ো কঠিন ব্যাপার।পাশে একজন সহযোদ্ধার সাহায্য তোমাকে বহুদুর আগাতে সাহায্য করবে।কিন্তু অবশ্যই যোগ্য সহযোদ্ধা।না হলে পদে পদে তুমি থেমে যাবে।বাঁধা পাবে।এমনকি ভেঙেও যাবে।একসময় সংসার নামক এই সমুদ্র পাঁড়ি দেয়ার ইচ্ছেটাই মরে যাবে।রুপসা এখনো তোমার যোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি।যেদিন আমার মনে হবে ও তোমার যোগ্য সেদিন আর আমি বাঁধা দেবো না।”
“আন্টি একটা প্রশ্ন ছিল? ”
“বলো।”
“আমি চলে যাওয়ার পর আপনি আবার অন্য কোথাও ওর বিয়ে দিয়ে দেবেন না তো?আমাকে ছুঁয়ে বলুন?”
প্রলয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শায়েরী হাসতে হাসতে বললো,
“এই তো বললাম।খুশি।”
প্রলয়ের চোখ চকচক করে উঠেছিল পরম নির্ভরতায়।
এতটুকুতেই ভীষণ খুশি হয়েছিল ছেলেটা।এমন ছেলেকে বিশ্বাস করাই যায়।কিন্তু ওর বাবা?আর কিছু ভাবার আগেই বাঁধা পায় শায়েরী মোবাইল বাঁজছে।
রুপসা এগিয়ে দিলো মোবাইল টা।
“কে কল করেছে রে?”
“জানি না মা।”
“দে তো দেখি।”
মোবাইল হাতে নিয়ে আননোন নম্বর দেখলো শায়েরী।বিদেশি নম্বর। কে হতে পারে?ভাবতেই কল টা রিসিভ করলো।
“হ্যালো আসসালামু আলাইকুম। ”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম।আন্টি আমি প্রলয়।শুনতে পারছেন?”
শায়েরী আঁড়চোখে একবার রুপসার দিকে চাইলো।জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চুল আচরাচ্ছে।এদিকে বোধহয় মনোযোগ নেই।
“হ্যাঁ,শুনছি।কেমন আছো বাবা?”
জ্বি, ভালো আছি।আপনারা কেমন আছেন আন্টি? ”
“আমরাও ভালো আছি।তোমার কি খবর? সব ঠিক আছে ওখানেে?”
“হ্যাঁ সব ঠিক আছে।পরশুদিন জয়েনিং।আসার সময় আপনাকে কল করতে পারিনি আন্টি এর জন্য সরি।আসলে হয়েছে কি আমার মোবাইলটা হঠাৎই হাত থেকে পরে নস্ট হয়ে যায়।নতুন একটা কিনেছি তাড়াহুড়ো করে কিন্তু কোন নম্বর সেইভ করতে পারিনি।এখানে এসে আবার জেটলেগ এ পেয়েছিল জানেন।কাটতেই চায় না যেন।এরপর দুদিন ঘুরতে হয়েছে অফিসের প্রয়োজনে।এদিকে কিভাবে যোগাযোগ করবো ভেবে মাথা নস্ট।নম্বর মুখস্থ নেই।আবার রুপসার নম্বর টাও তো চালু না।পরে মনে পরলো ফোনবুকটা তো সাথে এনেছি।সেখানেই নানা নম্বর থাকার কথা।ফোনবুক ঘেঁটে ঘেঁটে নম্বর বের করে সেইভ করেছি।ভাগ্যিস ফোনবুকে নম্বর সেইভ করার অভ্যেসটা ছিলো।তা না হলে আপনার সাথে যোগাযোগ করতাম কি করে।”
শায়েরী নিঃশব্দে হাসলো।তারপর বললো,
“বাবা শোন, চুলায় চা বসিয়ে এসেছি।নামাতে হবে।তুমি ঠিক এক মিনিট পর কল দাও আমি রিসিভ করছি।”
“ঠিক আছে আন্টি। আপনি যান।”
প্রলয়ের কথা শেষ হলে মোবাইলটা সেন্টার টেবিলের উপর রাখলো শায়েরী। বেডরুমে গিয়ে নিজের বোরখা আর পার্স বের করে নিলো এরপর বেরিয়ে এসে রুপসাকে ডাকলো।
“কি হয়েছে মা?”
বলতে বলতে সামনে আসে রুপসা।মাকে বোরখা পরা দেখে একটু অবাক হয়।
“কোথায় যাচ্ছো মা?”
“এই তো একটু সামনে।আমার মোবাইলটা রেখে যাচ্ছি কেউ কল করলে রিসিভ করিস।বলিস আমি একটু জরুরি কাজে বাইরে গেছি।ঠিক আছে?”
“আচ্ছা। ”
রুপসা মায়ের গমন পথে চেয়ে রইলো।কে কল করলো যে এমন দ্রুত যেতে হলো?কোন সমস্যা হলো না তো?”
অবশ্য সমস্যা তো ওদের নিত্যসঙ্গী।মা নেই এখন কি করবে ভাবতে লাগলো রুপসা।একটু কি পড়তে বসবে?ভর্তি পরীক্ষার তো বেশিদিন বাকি নেই।প্রলয় চলে যাবার পর থেকে বই নিয়ে বসা হয়নি একদমই।কেন যেন মন বসে না।প্রলয় গেছে আজ পনেরো দিন হয়ে গেলো।কেন যেন এখনো মনকে মানাতে পারছে না।পড়ায় ও মন বসাতে পারছে না।অথচ ভালোভাবে না পড়লে কোথাও চান্স পাওয়া যাবে না এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ভাবনার সুতো কাটলো ফের কলের আওয়াজে।
“হ্যালো,আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম।রুপসা?”
“হ্যাঁ।কে বলছেন?”
প্রলয় খুশিতে ফেটে পরলো।
“রুপসা সত্যিই তুমি?”
“প্রলয়?”
“হু।কেমন আছো?”
গলাটা একটু কাঁপলো প্রলয়ের।
আর রুপসা আবেগ ধরে রাখতে পারলো না।ঝরঝর করে অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হলো ওর চোখের কোনে।
কথা বলতে পারলো না। গলা বুজে এলো।
” এই পাগলী কাঁদছো কেন?কান্নার কি আছে?কথা বলো।আমি শুনি।কতোদিন তোমার গলার আওয়াজ পাই না।”
রুপসা কেঁদেই চললো।
“রুপসা।কথা বলো প্লিজ। কথা বলবে না?আমি কি রেখে দেবো?”
“ফাজিল লোক একটা।দিন রেখে।কে বলেছে আপনাকে কল করতে?”
কান্নামাখা আওয়াজে বললো রুপসা।
“কেন? আমার গলার আওয়াজ কি একটুও শুনতে মন চায়নি?”
ফিসফিস করে বলা কথায় রুপসার শরীর শীতল হতে লাগলো।কান্না থামিয়ে দিলো।
“আপনি আমাকে বলে গেলেন না কেন?”
প্রলয় যেন তৈরি ছিলো এ প্রশ্নের জন্য।
” বলে যেতে পারলে তো আমারই লাভ ছিলো।তাই না?একটা বিদায়ী চুম্বন তো পেতাম তোমার কাছ থেকে।”
“ফাজিল লোক একটা।এমন করলে আমি আর কথাই বলবো না।”
“সরি।”
ছোট্ট করে উত্তর করলেও প্রলয় হাসি থামালো না।
ফের বললো,
“নুর এসেছিলো?”
“হ্যাঁ।এসেছিল।”
“ও কি…….”
“শুনুন শুনুন।মা এসেছে বোধহয়। দরজা ধাক্কাচ্ছে। আপনি রাখুন এখন। ”
দরজার দিকে নজর ফেলে বললো রুপসা।”
“আচ্ছা রাখছি।এই নম্বর টা তুলে রেখো।মনিকার মোবাইল থেকে কল করো।”
“আচ্ছা আচ্ছা। রাখছি এখন।”
কল কেটে মোবাইল আগের মতোই টেবিলে রেখে দরজা খুললো রুপসা।শায়েরী ভেতরে ঢুকলো।
মেয়ের দিকে তাকাতেই ওর উজ্জ্বল মুখটা চোখে পরলো।নিশ্চয়ই প্রলয়ের সাথে কথা হয়েছে। তাই তো খুশির শেষ নেই।চেয়েও আটকে রাখতে পারছে না।সন্তান কে খুশি করতে মা কে কতো অভিনয়ই না করতে হয়।রুপসাকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরিয়ে আনতে এতটুকু দরকার ছিলো।
চলবে……..
মুনিরা মেহজাবিন।