#মেঘের_পালক_চাঁদের_নোলক
#পর্ব_১০
#অধির_রায়
প্রতিটি মানুষ নিজের স্থান থেকে নিষ্পাপ। মানুষদের কর্ম বলে দেয় মানুষটা কতটা ভালো খারাপ। সেজন্য মনী, ঋষি, জ্ঞানীদের কন্ঠে ধ্বনিত্ব হয়েছে জন্ম হোক যথাযথ কর্ম হোক ভালো। শাওন চৌকাঠে পা রেখেও বাহিরে গেল না৷ নেত্রদ্বয় বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিল৷
চিন্তা শক্তি কাজ করা বন্ধ করে দিলে দীর্ঘ শ্বাস নিলে চিন্তা শক্তি ফিরে আসে৷ নতুন কোন ঘটনা মাথায় ঘুরে৷ জানান দেয় নতুন কিছু বেছে নেওয়ার৷ শাওন ধপাস করে সোফায় বসে পড়ল। নেত্রদ্বয় বন্ধ, মাথা নিচু, চোখের পাতায় আঙুল রেখে গভীর চিন্তায় মগ্ন। নিজেই নিজেকে বলল,
“শাওন বাহিরে যাবি না৷ ড্রিংক্স করবি না৷ কিছুতেই বাজে পথে যাবি না৷ নিধির জন্য তুই সবকিছু ছেড়েছিস৷ তার সামান্য অবহেলায় সে পথে ফিরে যাবি৷ নিজেকে শান্ত রাখ শাওন৷ ভালোবাসলেই পেতে হবে তেমন নয়৷ দূর থেকে না হয় ভালোবাসে যাবি৷ ভালোবাসার মানুষকে ভালো রাখার জন্য সামান্য ত্যাগ করতে পারবি না৷”
শাওনের আর বাহিরে যাওয়া হলো না৷ সঠিক সময়ে মহান আল্লাহ তায়ালা শাওনের মাথায় সু চিন্তার আবির্ভাব ঘটিয়েছেন৷ শাওন রুমে এসে শাওয়ার নিয়ে পবিত্র হয়ে নিল৷ আল্লাহর দরবারে দুই রাকা’ত সালাত আদায় করে নিধির জন্য মুনাজাতে ধরেন৷ একটাই চাওনা৷ নিধিকে যেন মুনাজাতে কাছে পাই৷”
_____________
শাওন ভালোবাসার দাবী নিয়ে নিধির সামনে দাঁড়ায় নি৷ বরং নিধির বন্ধু হয়ে নিধির পাশে ছিল৷ গতকাল নিধির পরীক্ষা শেষ হয়েছে৷ আল্লাহর রহমতে পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে৷ দেখতে দেখতে চোখের পলকে সময় চলে গেল৷ প্রায় ১ বছর থেকে নিধি ঢাকা৷ মনমরা হয়ে বসে আছে নিধি৷ শাওন নিধির রুমে প্রবেশ করল৷ শাওনকে দেখে নড়েচড়ে বসে৷ ঠোঁট প্রসারিত করে মুচকি হাঁসার চেষ্টা করল৷ শাওন চৌধুরী নিধির পাশে বসতে বসতে বলল,
“জোর করে হাসতে হবে না৷ মন খারাপ জীবনের একটা অধ্যায়৷ মন খারাপ না করলে আমরা ভালো দিনের সূচনা খুঁজে পাব না৷ তো বলো, মন খারাপ কেন?”
“মনের উপর আমার কোন হাত নেই। হুটহাট করেই মন খারাপ হয়ে যায়৷ আবার হুট করেই মন ভালো হয়ে যায়৷”
“তার মানে পিচ্ছির মনটা অনেক.. খারাপ। পিচ্চির মনটা ভালো করতে কি করতে পারি?”
” কিছু করতে হবে না৷ আমি ভেবেছি, আমি আজ সবার জন্য নিজের হাতে রান্না করব৷ আমাকে তো কেউ কোন কাজই করতে দেয়না৷ আমি ধীরে ধীরে সব কাজ ভুলে যাচ্ছি। আর আপনি অফিসে যাননি কেন? দাঁড়ান মাকে বলছি৷”
“আজ অফিসে যাব না৷ আজ পিচ্চিটার সাথে ঘুরতে যাব৷ পিচ্চিটার মন খারাপ। আমি কি পিচ্চিটার মন খারাপ রাখতে পারি?”
নিধি কিছু বলল না৷ শাওনের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখের পাতা নামিয়ে নিল৷ মলিন কন্ঠে জবাব দিল,
“আমি কোথাও ঘুরতে যাব না৷ আমি এমনি ঠিক আছি৷ বাহিরে ঘুরতে গেলে অনেকে অনেক কথা বলবল৷”
শাওন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমি পাশে থাকতে কে আমার পিচ্চিটাকে কথা শুনাবে৷ খু*ন করে ফেলব৷ জলদি তৈরি হয়ে নাও৷ আমি এখনই আসছি৷ কোন কথা শুনতে চাইনা৷”
শাওনের প্রস্তান হয় রুম থেকে৷ নিধি বসা থেকে উঠে মনের সুখে নৃত্য করতে থাকল৷ এই প্রথম কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে নিধি৷ বিষয় টা মাধবী ভাবীর সাথে শেয়ার করতে মন চাচ্ছে৷ কিন্তু শেয়ার করলে শাওন চৌধুরী যদি মানা করে দেয়৷ দ্বিধায় বলা হলো না৷ নিধি সাদা রঙের একটা গাউন পড়ে নিল৷ শাওন চৌধুরী কিছুদিন আগেই কিনে দিয়েছে৷ লোকটা পছন্দ আছে৷ ছেলে মানুষের এত সুন্দর পছন্দ ভাবতেই পারিনি।
____________________
আপন গতিতে রিক্সা চলছে ধানমন্ডির লেগে৷ পাশাপাশি বসে আছে দু’জন। দু’জনের মাঝে নিরবতা বজায় থাকলেও গাড়ীর হনের অনেক শব্দ। নিধি কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল,
“আপনি গাড়ি নিয়ে বের হলেন না কেন? রিক্সা ভাড়া অনেক। ঢাকার বুকে রিক্সা ভাড়া সোনার দানের থেকেও বেশি৷”
নিধির কথা শুনে শাওন ফীক করে হেঁসে দিল৷ কোন রকম হাসি থামিয়ে বলল,
“এসব জায়গায় গাড়ি নিয়ে ঘুরা যায়না৷ তুমি কি গাড়ি দিয়ে সব জায়গায় যেতে পারবে? ঘুরাঘুরির জন্য রিক্সা ভালো বোকা পিচ্চি। এখানে রবীন্দ্র সরোবরে কিছু সময় পার করে আমরা জিয়া উদ্যানে যাব৷ রবীন্দ্র সরোবরে জড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস৷ সেগুলো তোমাকে অন্যদিন বলব৷”
নিধি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল৷ নিধি জানে কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই৷ নিধি এখন নিজের থেকে বেশি বিশ্বাস করে শাওনকে৷ দৃঢ় বিশ্বাস শাওন তার কোন ক্ষতি হতে দিবে না৷ সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবে। সেদিনের পর থেকে আর কোনদিন ভালোবাসার দাবী নিয়ে সামনে আসেননি৷ সব সময় বন্ধু হয়ে পাশে ছিল৷ সকল ক্ষেত্রে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন৷ মানুষটার চরিত্র খারাপ হলেও মনটা অনেক ভালো৷
ধানমন্ডির লেগে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে নিধি শাওন৷ শাওন প্রতিটি দৃষ্টি নিধিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে৷ নিধি নতুন শাওনকে আবিষ্কার করল৷ স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ফটো ফ্রেমে বন্ধি করছি কিছু দৃশ্য। বাদ পড়েনি নিধির অপলক দৃষ্টির চাহনি৷ মায়াবী সেই মুখের হাসি৷ আনন্দের সাথে নিধি নিধি সবকিছু উপভোগ করল৷ দুপুরের খাবারের পর রিক্সা ছুটে চলছে বিজয় স্মরনীয় উদ্দেশ্য। বর্তমান উদ্দেশ্য হলো চন্দ্রিমা বা জিয়া উদ্যান৷ গোধূলি বেলায় জিয়া উদ্যানের দৃশ্য অপরুপ। গোধূলি বেলার সোনালী সূর্যের আলো জিয়া উদ্যানের সৌন্দর্য হাজার গুন বাড়িয়ে দেয়৷ চারিপাশ প্রদক্ষিণ করে অপরুপ দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত নিধি৷ কখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে জানা নেই? চন্দ্রিমার স্মৃতি ফুটো বন্ধি করতে ভুলেনি৷ সন্ধ্যায় রিক্সা করে বাড়িতে ফিরে আসে৷ সদর দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই মাধবী অভিমানী কন্ঠে বলল,
“আমাকে একা রেখে তোমরা কিভাবে ঘুরতে গেলে৷”
শাওন মাধবীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে নিজের রুমে চলে যায়। আটকা পড়ে নিধি৷ নিধিকে দিতে হচ্ছে হাজারটা প্রশ্নের উত্তর। ঘুরাঘুরি কেমন হলো? শাওন কি তাকে কিছু বলছে কিনা? নিধি কেন মাধবীকে রেখে শাওনের সাথে ঘুরতে গেল?
মাধবী অনেক ভালো মেয়ে। সব সময় নিধিকে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে৷ মাধবীকে পেয়ে তিতিরের কষ্ট ভুলে গেছে৷ মাধবীও নিধিকে ছোট বোনের মতো ভালোবাসে। ঘুরাঘুরি নিয়ে চলছে দু’জনের মাঝে তুমুল ঝগড়া। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়৷ ঝগড়া বলতে ভালোবাসার ঝগড়া৷ নেই কোন অন্য অভিযোগ অন্য অভিমান৷ মুগ্ধ রুমে প্রবেশ করতে করতে বলল,
“এবার ঝগড়া থামাও। মাধবীকে আমি ঘুরতে নিয়ে যাব৷ আর আমাদের সাথে নিধিও যাবে৷ আমরা নিধি, শাওনের মতো ছোট মনের মানুষ নয়৷ আমরা একাধিক মানুষকে সাথে নিয়ে ঘুরতে যেতে পারি৷”
নিধি অভিমানী কন্ঠে বলল,
“আমি যাব না তোমাদের সাথে৷ তোমাদের মাখে কাবাবের হাড্ডি হতে চাইনা৷ আমি ঘুরতে গেলে শাওন চৌধুরীর সাথে ঘুরতে যাব৷”
নিধি ভেংচি কেটে চলে যায়৷ নিধি চলে যেতেই মুগ্ধ, মাধবী অট্টহাসিতে মেতে উঠে৷ রুমে এসে মনে পড়ে নিধি ভুল বলে ফেলছে৷ আসলে এত কথার মাঝে আসল কথাই ভুলে গেছে৷ মনে মনে নিজেকে হাজারটা গা/লি দিচ্ছে। মুখ ফুটে শাওন চৌধুরীর নামই বলতে হলো৷ আর কোন নাম ছিল না৷
_____________________
ঘুম নেই চোখের পাতায়৷ সারাদিনের ঘটনা চোখের পাতায় নাড়া দিচ্ছে। শাওন চৌধুরীর সাথে পুরো একটা দিন ঘুরাঘুরি করেছে৷ খারাপ লাগে নি বরং ভালোই লাগছে৷ নিধি নিজেই নিজেকে আবারও গা/লি দিচ্ছে৷ কেন বারং বার শাওন চৌধুরীর কথা মাথায় আসে? রাতের শীতল হাওয়া গায়ে মাখাতে নিধি চলে আসে ছাঁদে। ছাঁদের দোলনায় অনেক আগে থেকেই বসে আছে শাওন৷ যেন নিধির জন্য অধীর আগ্রহে বসে ছিল৷ নিধি আসতেই শাওন চৌধুরী নিধিকে পাশে বসতে বলে৷ নিধি কোন ভনিতা না করে পাশে বসে পড়ল৷ শাওন চৌধুরী আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ঘুম আসছিল না তন্দ্রাবিলাসী। যে মেয়ে তন্দ্রাঘোরে মগ্ন থাকে তার চোখের পাতায় ঘুম নেই! অনেক হাঁটাহাঁটি করছো ঘুমানোর কথা তাড়াতাড়ি। কিন্তু আমি ভিন্ন দেখছি৷”
নিধি মলিন মিহি কন্ঠে জবাব দিল,
“ঘুম আসছিল না৷ গায়ে শীতল হাওয়া লাগাতে ছাঁদে আসলাম৷ রাতের বেলা ঢাকার বুকে শীতল হাওয়া খুব ভালো লাগে৷ দিনের বেলা থাকবে সূর্যের প্রখর তাপ৷ কিছু ভালো লাগে না৷”
“সবই বুঝলাম৷ তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও? কোনদিন তো বললে না তোমার স্বপ্নের কথা!”
নিধি আনন্দের সহিত বলল,
“আমি ডাক্তার হতে চাই৷ যারা বিনা চিকিৎসায় মা/রা যান আমি তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই৷ বিনা ভিজিটে আমি রোগী দেখতে চাই৷ আমার মতো কেউ যেন মাতৃহারা না হয়৷”
মায়ের কথা মনে পড়তেই চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷ মায়ের ভালোবাসা পাওয়া হলো না জীবনে৷ সৎমায়ের সংসারে সইতে হয়েছে অমানবিক অত্যাচার৷ নিধিকে শান্ত করতে শাওন পুনরায় বলল,
“আর কিছু চাওয়ার নেই৷ তবে আমি তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করি৷ আমিও চাই তুমি গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াও৷”
নিধি আমতা আমতা করে বলল,
“আপনাকে একটা কথা বলব বলব বলে বলা হয়নি৷ কিন্তু কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না?”
শাওন অভয় বানী দিয়ে বলল,
“ভয়ের কিছু নেই৷ মনে যা আছে বলে দাও৷ কখনও কিছু চেপে রাখতে নেই৷”
শাওনের ধারণা নিধি তাকে ভালোবাসার কথা বলবে৷ কিন্তু শাওনের ধারণা ভুল প্রমাণ করে নিধি বলল,
“এখন নিষিদ্ধ পল্লীতে যান না কেন?”
নিধির এমন প্রশ্নে শাওন ঘাবড়ে গেল৷ নিজেকে সামলিয়ে বলল,
“প্রয়োজন নেই৷ যাকে ভালোবেসেছি তাকেই পাইনি৷ অন্য কাউকে পাওয়ার চেষ্টা নেই৷”
“আপনি একদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আমি যা চাইব আপনি তাই দিবেন৷ আজ আমি সেই জিনিস চাই৷ আমাকে দিতে হবে৷”
শাওন সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিধির দিকে৷ স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দিল,
“সাধ্যের মাঝে হলে এখনই দিব৷ কঠিন কিছু হলে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করব৷”
শাওনের উত্তরে নিধি খুব খুশি হলো৷ নিধির ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল উজ্জ্বল হাসি৷ কোন রকম ভনিতা না করে বলল,
“নিষিদ্ধ পল্লীতে শ্যামলী নামে একজন মেয়ে থাকেন৷ উনাকে সেই নরক থেকে আপনাকে মুক্ত করতে হবে৷”
শাওন বিচলিত দৃষ্টিতে নিধির দিকে তাকাল৷ তবুও নিধিকে প্রশ্ন করল না কিছু৷ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কাল শ্যামলীকে দেখতে পাবে৷ আল্লাহ যদি আমার সহায় হোন তাহলে আমি শ্যামলীকে নরক থেকে মুক্ত করব৷”
চলবে……
দুই দিন থেকে অসুস্থ। আজও লিখতে পারছিলাম না৷ তবুও কষ্ট করে লিখেছি৷ এক পর্ব লিখতে প্রায় পাঁচ ঘন্টা সময় লেগেছে৷ টানা ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারিনা৷