মেঘের পালক চাঁদের নোলক পর্ব -১১

#মেঘের_পালক_চাঁদের_নোলক
#পর্ব_১১
#অধির_রায়

মৃত্যুর উপর কারো কোন হাত নেই৷ জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে তিনটাই আল্লাহর হুকুমে হয়৷ মানুষের জীবনে মৃত্যু অনিবার্য। যার জন্ম আছে তার মৃত্যু অনিবার্য। সকল প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে৷ কারো মৃত্যু সুখের, কারো কষ্টের, কেউ আবার এক চিলতে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা।

নিধি শাওনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে৷ উৎসাহ নিয়ে নিরবে নিভৃতে বসে আছে ঘরের কোণায়৷ কখন নিজের চোখে শ্যামলীকে দেখবে? অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে শাওন রুমে প্রবেশ করল৷ অবাধ্য চুলগুলো পাখার হওয়ায় বারবার নাড়া দিচ্ছে। নিধি উৎসাহ নিয়ে বলল,

“শ্যামলী আপু কোথায়? ডাইনিং রুমে শ্যামলী আপু?”

নিধির চোখে মুখে আনন্দের হাঁসি৷ ঠোঁটদ্বয় প্রসারিত। দ্রুত কদম ফেলে ডাইনিং রুমের দিকে যেতে নিলে শাওন নিধির হাত ধরে ফেলে৷ নিধি সন্দিহান চোখে শাওনের দিকে তাকায়৷ শাওন কথায় কথায় নিধির হাত ধরা বন্ধ করে দিয়েছে৷ সেদিন রিক্সায় যথেষ্ট পরিমাণ দূরত্ব রেখে বসেছিল। সরু দৃষ্টি মেলে তাকায় শাওনের দিকে৷ শাওনের দিকে পলক ফেলে মিনি কন্ঠে বলল,

“আপনাকে উদাস দেখাচ্ছে কেন? শ্যামলীকে আপুকে নিষিদ্ধ পল্লী থেকে নিয়ে আসতে পারেন নি?”

শাওনের নেত্রদ্বয় অশ্রু কণায় টলমল করছে৷ যেন এখনই টুপ করে গড়িয়ে পড়বে। মলিন অপরাধী কন্ঠে বলল,

“শ্যামলী নামের মেয়েটি পৃথিবীতে আর নেই৷ নিষিদ্ধ পল্লীতেই কিছুদিন আগেই নিজের প্রতি ঘৃণা থেকে আ’ত্ম’হ’ত্যা করেছে। আমি তোমার চাওয়া পূরণ করতে পারলাম না৷”

নিধি নিজের কর্ণকে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ শ্যামলী আপু নিজের প্রতি ঘৃণা থেকে এমন কাজ করল! উৎসর্গ করল নিজের জীবনকে৷ এইতো সেদিন বলা হয়েছি উৎসর্গ করবে তারা যারা আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে৷ নিধি ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ল৷ চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷ কিছুক্ষণের মাঝেই নিধির দেহ নিস্তেজ হয়ে গেল৷ নিধির ধাক্কা সামলিয়ে উঠতে পারেনি৷ শ্যামলীর মৃত্যু তার মস্তিষ্ক মেনে নিতে পারেনি৷ নিধি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে৷
_____________

সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না৷ দেখতে দেখতে চলে গেছে চারটি বছর৷ এর মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে৷ শাওনের পরিবারের মানুষগুলো খুব আপন হয়ে গেছে৷ যতই পরিবর্তন আসুক অতীত এসে কড়া নাড়ে চৌকাঠে। নিধি এখন মেডিকেল এডমিশনে কোচিং করছে৷ চলছে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার৷ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে আল্লাহকে শুকরিয়া আদায় করতে ভুলে যায় না৷ সকাল থেকে নিধির মন খারাপ৷ আজ মা বেঁচে থাকলে কত খুশি হতেন৷ তাঁর সেই ছোট নিধি আজ অনেক বড় হয়ে গেছে। আল্লাহর রহমতে একটা সুন্দর পরিবার পেয়েছে৷ চোখ যেন খুঁজে চলছে মাকে৷ মায়ের কবরটা খুব টানছে৷ ইচ্ছা হচ্ছে আটপাড়া গ্রামে চলে যেতে৷ মায়ের কবরে বসে মাকে প্রশ্ন বিভিন্ন প্রশ্ন করতে৷

সকাল বেলায় কাঠ ফাটা রোদে বসে আছে নিধি৷ সেদিকে কোন খেয়াল নেই৷ মায়ের চিন্তায় এতটা মগ্ন হয়ে আছে সূর্যের কিরণের তাপ নিধিকে জানান দিতে পারিনি৷ স্টিলের দোলনা গরমে অগ্নির রুপ ধারন করছে। শাওনের ডাকে নিধির ঘোর কাটে৷

“এভাবে রোদে বসে আছো কেন? নিজের দিকে খেয়াল আছে? ঘেমে একাকার হয়ে গেছো৷ একটু পর তো মাথা ঘুরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে৷ সেদিকে কোন খেয়াল আছে৷”

নিধি নিজের হাত স্পর্শ করে বুঝতে পারল সমস্ত দেহ গরম হয়ে গেছে৷ মাথাটাও একটু ব্যথা করছে। তড়িঘড়ি করে ছায়াযুক্ত স্থানে অবস্থান করে৷ মিহি কন্ঠে জবাব দিল,

“মায়ের জন্য খুব খারাপ লাগছিল৷ সেজন্য কোন দিয়ে খেয়াল ছিল না৷ আজ বারং বার উনার কথা মনে পড়ছে৷ আমি এতটা অভাগী যে কোনদিন মায়ের ভালোবাসা পেলাম না৷”

কথাগুলো বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে আসছিল৷ তবুও ভেজা ভারী গলায় বলল৷ নিধিকে এক পলক পর্যবেক্ষণ করে শাওন বলল,

“তুমি তোমায় মায়ের কাছে যেতে চাও৷ আমি তো জানতাম তোমার মা মা’রা গেছেন৷ সৎ মায়ের জন্য মন খারাপ লাগছে?”

“সৎ মায়ের জন্য নয়৷ মাঝে মাঝে আমার বোন তিতিরের কথা মনে পড়ে৷ রক্ত টান ভুলা যায়না৷ চারটা বছর চলে গেল মায়ের কবর মুনাজাত করা হয়না৷ একটা নজর মায়ের মায়ের কবর দেখতে পেলে মনের তৃপ্তি মিটবে। আমাকে আজ আটপাড়া গ্রামে নিয়ে যাবেন৷? খুব ইচ্ছা করছে।”

শাওন নিধির কথা ফেলতে পারবে না৷ একটু ভেবে বলল,

“আমরা এখনই বের হবো৷ আমরা কিন্তু গ্রামে থাকতে পারব না৷ তোমার মায়ের কবর মুনাজাত করেই চলে আসবে৷”

ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে উজ্জ্বল হাসি৷ কৃতজ্ঞতায় চোখে কোণে অশ্রু জমে৷ ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,

“আমাকে দুই মিনিট সময় দেন৷ আমি দুই মিনিটের মধ্যেই রেডি হয়ে নিব৷”

নিধি দ্রুত পায়ে কদম ফেলে ছাঁদ থেকে চলে গেল৷ শাওন চৌধুরী মুগ্ধর রুমে গেল৷ মুগ্ধ অফিসে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছে৷ মুগ্ধ শাওন চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“তুমি এখনও রেডি হওনি। অফিসে যাবে না৷ অনেক কাজ পড়ে আছে৷ আমার পক্ষে একা সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে৷”

শাওন মুগ্ধর কাঁধে হাত রেখে বলল,

“আজ একটু কষ্ট করে সবকিছু চালিয়ে নাও৷ আজ আমার একটা মিটিং আছে৷ না গেলেই নয়৷ কাল থেকে আমি কন্টিনিউ করে যাব৷”

মুগ্ধ কথা বাড়াল নয়৷ শাওন বিনা কারণে কাজে ফাঁকি দেয়না৷ মুগ্ধ কাজে ফাঁকি দেওয়ায় ওস্তাদ। মুচকি হেঁসে মুগ্ধ অফিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল৷
________________

গাড়ি চলছে নিজস্ব আপন গতিতে৷ এতটা পথ শাওনের পক্ষে এক ড্রাইভ করা সম্ভব নয়৷ সেজন্য ড্রাইভারকে সাথে নেওয়া হয়েছে৷ নিধি গাড়ির লুকিং গ্লাস নামিয়ে প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত৷ শাওন ল্যাবটপে অফিসের কাজ করছে৷ মাঝপথে দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছে৷ তারা গাড়ির ম্যাপ দেখে পৌঁছে গেছে আটপাড়া গ্রামে৷ এখন নিধিদের বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা ম্যাপ দেখাচ্ছে না৷ নিধি ড্রাইভারকে রাস্তা চিনিয়ে দিচ্ছে৷ আটপাড়া পৌঁছাতে পৌঁছাতে পড়ন্ত দুপুর৷ নিধি প্রথমে বাড়িতে প্রবেশ করে৷ বাড়িতে যেন শাওন চৌধুরী আর ড্রাইভার একটু বিশ্রাম নিতে পারে এবং ফ্রেশ হতে পারে৷ বাড়ির পরিবেশ অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে৷ সৎমা নিধিকে দেখে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না৷ নিধির সাথে শাওনকে দেখে যেন উনার মাথায় রক্ত উঠে গেল৷ কিছু বলতে যাবে তখনই ড্রাইভার অনেক বাজার নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে৷ নিধির হাতে ছিল সবার জন্য পোশাক৷ পোশাকগুলো সৎমায়ের হাতে দিয়ে বলল,

“এখানে সবার জন্য কাপড় রাখা হয়েছে। আমরা এখানে থাকতে আসিনি৷ এখনই চলে যাব৷ এক ঘন্টার মতো থাকব৷ তাই কোন খারাপ ব্যবহার করবেন না৷”

নিধির কথা হজম করতে পারলেন না৷ কড়া গলায় বললেন,

“পর পুরুষ নিয়ে বাড়িতে ঢুকেই হুকুম চালাচ্ছে। এটা তোর বাড়ি নয়৷ এটা আমার বাড়ি৷ তোর কথায় চলে না৷ আমার বাড়িতে পর পুরুষের আনাগোনা চলে না৷ এটা ভদ্র লোকের বাড়ি৷

আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিধির বাবা চলে আসে৷ বাবাকে দেখে নিধির চোখের কোণায় জল চলে আসে৷ পরক্ষণেই সেদিনের কথা মনে পড়তেই নেত্রদ্বয় অগ্নির ন্যায় রুপ নেয়৷ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“বাবা উনি শাওন চৌধুরী। উনাকে বসার ব্যবস্থা করেন৷ আমি মায়ের কবর মুনাজাত করেই চলে যাব৷ আপনাদের ঘরে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই৷ শাওন চৌধুরীর একটু ফ্রেশ এবং বিশ্রামের দরকার বলে আসা৷ না হলে নিধি কখন তোমার বাড়িতে পা রাখত না।”

নিধির বাবার দেহে বয়সের ছাপ দেখা দিয়েছে৷ ভেজা ভাঙা গলায় বলল,

“মা ঘরে আসো। তোমাকে এক নজর দেখার জন্য তোমার পথ চেয়ে বসে থাকি৷”
স্ত্রীকে কড়া গলায় বললেন,
“উনাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করো৷ এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে কে বলছে?”

নিধি কিছু বলল না৷ শাওনকে নিয়ে ঘরে ঢুকে৷ নিধির বাবা শাওনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে৷ কিন্তু নিধি সেই সুযোগ দিচ্ছে না৷ শাওন ফ্রেশ হয়ে আসলে নিধি বলল

“চলেন মায়ের কবর মুনাজাত করেই সেখান থেকেই চলে যাব৷ এখানে আমার ধম বন্ধ হয়ে আসছে৷ যেখানে আমার মায়ের জায়গা হয়নি সেখানে আমি এক মিনিটও থাকতে চাইনা৷”

শাওন কোন জবাব দিল না৷ নিধির কিছু টাকা জনিয়েছিল৷ সেই টাকা বাবার হাতে তুলে দিয়ে বলল,

“ভালো ডাক্তার দেখাবেন৷”

বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে৷ নিধির বাবা খাওয়ার জন্য জোর করলেও নিধি খেতে প্রস্তুত নয়৷ দরকার পড়লে বাহিরে খেয়ে নিবে৷ নিধি শাওনকে নিয়েই চলে আসে এলাকার কবরস্থানে৷ এখানেই সমাহিত করা হয়েছে নিধি মা এবং নানীকে৷ মায়ের কবর চিনতে ভুল হয়নি৷ নিধি তার মায়ের কবের পাশে লাগিয়েছিল আমগাছ৷ অনেকে কাটার চেষ্টা করলে করলে নিধি সবাইকে বলে কাটতে মানা করে৷ মুকুলে পরিপূর্ণ আম গাছ। কবরের চারপাশ আগাছায় ভরপুর৷ করবের সামনে এসেই নিধি কেঁদে উঠল৷ মায়ের কবরের উপর শুয়ে পড়ে৷ দুই হাত দিয়ে আগলে রাখে মায়ের কবর৷ কান্না করতে করতে বলল,

“মা তুমি কেন আমায় একা করে চলে গেলে? আমাকে কেন তোমার সাথে নিলে না? মা তোমার মেয়ে জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছে৷ মা তুমি ফিরে আসো না! তোমায় ছাড়া আমার ভালো লাগে না৷ তুমি ফিরে আসো নয় আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও৷”

শাওন দৌড়ে এসে নিধিকে টেনে তুলে৷ নিধি কান্না করে বলতে থাকে,

“আমি মাকে ছাড়া কোথাও যাব না৷ মা তোমার নিধিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ মা. ও.. মা। তুমি এখনও ঘুমিয়ে থাকবে? আমি তোমাকে ছাড়া কোথাও যাব না৷”

নিধির কান্নায় চারপাশে লোক জমা হয়ে যায়৷

চলবে……

প্লিজ সবাই রেসপন্স করবেন৷ আপনাদের উৎসাহ এবং রেসপন্স আমাকে লেখার শক্তি জোগায়৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here