মেঘের বিপরীতে পর্ব ১১+১২

#মেঘের_বিপরীতে
পর্বঃ ১১+১২

নন্দিতা তার রুমের আসবাবপত্র সব খুঁতিয়ে দেখছে। পুরোনো ওয়ারড্রবটায় কাঠপোকা বাসা বেঁধেছে। কিছুক্ষণ পর পর ক্ষীণ শব্দ শোনা যায়। খুবই অদ্ভুত শব্দ। ক্যারত, ক্যারত। নন্দিতা ড্রয়ার খুলতেই প্রথমে একটি ডায়রি খুঁজে পেলো। গুড়ি গুড়ি কাঠ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একটা ভাঙ্গা আয়না পাওয়া গেলো। বেশ কিছু সাজগোজের সরঞ্জামও পাওয়া গেলো। নন্দিতা ডায়রিটা হাতে নিয়ে ড্রয়ার লাগিয়ে দিলো। উপর থেকে কাঠের গুড়ো ফুঁ দিয়ে মেঝেতে ফেললো। বিছানায় গিয়ে বসলো। ডায়রি খুললো। বেশ কয়েকটি পেইজ উল্টাতেই একটা চিঠি চোখে পড়লো। নন্দিতা চিঠির ভাঁজ যত্ন করে খুলে পড়তে শুরু করলো। পড়তে পড়তে তার চোখ ভিজে উঠলো।

প্রিয় নন্দিতা,
কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। কথাগুলো তুই কিভাবে নিবি তাও জানি না। তবুও বলতে হচ্ছে। আগামীকাল ঢাকা চলে যাবি। নতুন শহর। ভার্সিটিতে নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হবে। ব্যস্ততার ভীড়ে আমার সাথে কাটানো সময়গুলো ফিঁকে হয়ে যাবে।
তোর নতুন জগতে, নতুন মানুষদের মাঝে পুরোনো এই আমি টার জায়গা হবে কিনা জানি না। তবে আমার জগতে তোর স্থান কতটুকু তা আজ তোকে জানিয়ে দিতে চাই।
তুই যখন জন্মেছিস তখন আমিও বেশ ছোট। মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়স! সময় পেরিয়ে গেলো। আমরা বড় হলাম। হাফ প্যান্টস আর ছোট্ট ফ্রক পড়ে আমার কাঁধে বসে চারিদিক চষে বেড়ানো নন্দিতাকে একসময় শুধুমাত্র সালোয়ার কামিজে খুঁজে পাওয়া যেতো। তুই যেদিন প্রথম আগোছালো ভাবে শাড়ি পড়েছিলি, আমার এখনো মনে আছে সবাই খুব হাসাহাসি করছিলো। শাড়ির কুঁচি ঠিক হয় নি। ফুলে ফেঁপে একাকার অবস্থা! কিন্তু আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তোর দিকে তাঁকিয়ে ছিলাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম তুই আর সেই ছোট্টটি নেই। বড় হয়ে গেছিস। অনেক বড় হয়ে গেছিস।
সেই দেখার মাঝে অন্যরকম ভালোলাগা ছিলো। অন্যরকম অনুরক্তি ছিলো। সেদিনের পর থেকে সব কেমন যেনো বদলে গেলো। নৌকায় চড়ে তোর জলকেলি খেলা আমার কত রাতের ঘুম যে কেড়ে নিয়েছে তা অগুনিত থাক! মাঝে মাঝে ফুটবল খেলা বাদ দিয়ে তোর চি বুড়ি খেলা দেখতে যেতাম। খেলার মাঝে হাঁপিয়ে উঠতি। ওড়নার এক প্রান্ত দিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে কপালের ঘাম মুছতি। অবাক চোখে তাঁকিয়ে থাকতাম। বুকে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হতো। ঘুড়ি হাতে নিয়ে ক্ষেতের আইলের মাঝ দিয়ে যখন দৌঁড় দিতি দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসতো তোর চুলের ঘ্রাণ। আর যখন পেছোন ঘুরে একবার তাঁকিয়ে আমায় ডাক দিতি সত্যিই ভাষা হারিয়ে ফেলতাম।
বয়সের সাথে সাথে ভালোলাগাটা বেশ গাঢ় হয়ে গেছে রে! তুই চলে যাচ্ছিস কেনো জানি ভীষণ ভয় হচ্ছে। যদি আর বলার সুযোগ না পাই তাই আজ বলে দিতে চাই।
আমি তোকে অনেক ভালোবাসি রে নন্দিতা!
অনেক বেশি ভালোবাসি।

সাবধানে থাকিস। নিজের যত্ন নিস।
ইতি,
তোর নাইফ ভাই

চিঠির ওপর টপটপ করে চোখের পানি পড়ছে। কিছু অংশ ভিজে গেছে। সেই অবস্থাতেই নন্দিতা চিঠিটা আগের মতো ভাঁজ করে ডায়রির মাঝে রেখে দিলো। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখতে লাগলো। পাখির কিচিরমিচির ধ্বনিতে মুখরিত চারিদিক। নন্দিতা চোখ বন্ধ করলো। শেষ এক ফোটা পানি তার চোখের কোণা গড়িয়ে পড়লো। নন্দিতার ঘুম পাচ্ছে। ডায়রি বুকে জড়িয়ে সে নিজের শরীর এলিয়ে দিলো বিছানায়। এমন সময় রফিক সাহেবের গলার আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেলো। তিনি নন্দিতাকে ডাকছেন। নন্দিতা শোয়া থেকে উঠে বসলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ডায়রিটা ড্রয়ারে রেখে দিয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

রফিক সাহেব বিছানায় আধশোয়া হয়ে টিভি দেখছেন। অনেক আগের একটি নাটক দিয়েছে। হাসির নাটক। কিন্তু মুখে পান থাকার কারণে তিনি মন খুলে হাসতে পারছেন না। বিষয়টা খুবই বিরক্তিকর। এমন সময় নন্দিতা ঘরে প্রবেশ করলো। রফিক উঠে বসলেন। হাসিমুখে বাচ্চাদের মতো বলে উঠলেন,
“এই দেখো কে এসেছে! আমার নন্দুমা এসেছে। এদিকে আয়,মা। আমার পাশে এসে বোস।”
নন্দিতা বাবার পাশে গিয়ে বসতে বসতে বললো,
“বাবা, তোমাকে আগেও বলেছি না? আমাকে এই নামে ডাকবে না?”
“কোন নামে?”
“নন্দুমা।”
“কেনো? কত সুন্দর নাম।”
“যত সুন্দর নামই হোক। ওই নামে ডাকবে না। নন্দিতা বলে ডাকবে। অথবা শুধু মা বলে ডাকবে।”
রফিক সাহেব হেসে বললেন,
“আচ্ছা এখন থেকে শুধু মা বলে ডাকবো, নন্দুমা।”
নন্দিতা চোখ পাঁকিয়ে বললো, “বাবা! খুব বেশি হচ্ছে কিন্তু।”
রফিক সাহেব হেসে ফেললেন। বুকপকেট থেকে পেপারে মুড়ানো মিষ্টি পান নন্দিতার দিকে এগিয়ে দিলেন।
“এই নে পান বানানো খা। স্পেশাল ভাবে বানিয়ে এনেছি।”
নন্দিতা হেসে বললো,
“আমি শহরে যাওয়ার পর যতবার ছুটিতে বাড়ি এসেছি, বিয়ের পর যে কয়বার ঘুরতে এসেছি তুমি কখনোই পান বানিয়ে আনতে ভুলো নি, বাবা।”
“কিভাবে ভুলবো? ছোটবেলায় আমার পান চুরি করে খেয়ে ফেলতি যে! কম বদমাশ ছিলি নাকি?”
“তখন তো খেতে দিতে না। কাছে ছিলাম যে! দূরে চলে যাওয়ার পর সবার আদর বেড়ে যায়। কথায় আছে না? দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না?”
“বুঝেছি, বুঝেছি! এখন তুই পানটা খা। অনেকক্ষণ হলো পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। পরে আর স্বাদ পাবি না।”

নন্দিতার এখন পান খেতে ইচ্ছে করছে না। তবুও সে হাসিমুখে পান মুখে দিলো। নাটক এখনো শেষ হয় নি। বিজ্ঞাপন বিরতি চলছে। রফিক সাহেব একটু নড়েচড়ে বসলেন। নন্দিতা একমনে পান চিবোচ্ছে আর বিজ্ঞাপন দেখছে। রফিক বললেন,
“তোর চাচার বাসায় গেছিলাম সকালে।”
নন্দিতা টিভি দেখতে দেখতে বললো,
“হুঁ। তারপর?”
“বড় ভাই বাসার সবার সাথে অনেক রাগারাগি চিল্লাচিল্লি করেছেন।”
“কেনো?”
“আর বলিস না। নাইফ তো বিয়ে করতে চায় না। শুনেছিস মনে হয়।”
নন্দিতা হাসার চেষ্টা করে বললো,
“মনের মতো মেয়ে নাকি পাচ্ছে না তাই বিয়ে করছে না। তার যেমন মেয়ে পচ্ছন্দ তেমন কাউকে পেয়ে গেলে অবশ্যই করবে।”
“গত কয়েকবছর ধরে এই এক কথাই শুনে আসছি। এসব বাহানা ছাড়া কিছুই না।”
“আচ্ছা এই নিয়েই বড় চাচা চিৎকার চেঁচামেচি করেছেন?”
“একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। মেয়ে শিক্ষিত। অনার্স পাশ। খুব সুন্দরী। মেয়ের বাবাও ব্যবসা করে। টাকাপয়সা আছে ভালো। কিন্তু নাইফ রাজী হচ্ছে না।”
“ওহ আচ্ছা।”
“এই নিয়ে বড় ভাইয়ের রাগ। বিয়ে কি করতে হবে না? সারাজীবন একা থাকবে নাকি? শেষ বয়সে সময় কাটানোর জন্যও তো কাউকে প্রয়োজন হয়।”
নন্দিতা উদাস কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“বিয়ে করলেই কি মানুষের একাকিত্ব দূর হয়ে যায় বাবা? বিয়ের পরে কোনো মানুষ কি সংঙ্গী হীনতায় ভুগতে পারে না?”
রফিক সাহেব উত্তর দিতে গিয়ে থমকে গেলেন। এ প্রশ্নের কোনো উত্তর তিনি জানেন না। নন্দিতা হাসছে। মেয়েটা পুরো তার মায়ের হাসি পেয়েছে। থমথমে পরিবেশে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে নন্দিতা বললো,
“আমি নাইফ ভাইয়ের সাথে কথা বলে দেখছি।”
“তুই পারবি ওকে বোঝাতে?”
“চেষ্টা করে দেখি। চেষ্টা করতে তো আর দোষ নেই।”
রফিক সাহেব বললেন,
“ঠিকাছে। দেখ পাগলটাকে বলে কোনো ব্যবস্থা করতে পারিস কিনা।”
নন্দিতা ফ্যাকাসে হাসি হাসলো।
“আর একটা কথা বলতে তো মনেই নেই।”
“কি কথা?”
“তোর চাচী সন্ধ্যায় ও বাসায় চলে যেতে বলেছে।”
“কেনো?”
“বড় ভাই ইয়া বড় এক রুই মাছ এনেছে আজকে। তুই পচ্ছন্দ করিস তাই তোকে নিয়ে খাবে।”
“আচ্ছা। যাবো নি।”
নন্দিতা উঠে দাঁড়ালো। রফিক সাহেব বললেন,
“রুমে যাচ্ছিস?”
“হ্যাঁ বাবা। মাথাটা ধরেছে। একটু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকবো।”
“যা তাহলে। আর বড় চাচীকে বলিস মেয়ের ছবিটা তোকে দেখাতে।”

নন্দিতা মাথা নাড়ালো। কোনো উত্তর দিলো না। ধীর পায়ে নিজের রুমে চলে আসলো।দরজা-জানালা লাগিয়ে দিলো। পুরো ঘর এখন আবছা অন্ধকার। বিছানায় শুয়ে ফোনের গ্যালারীতে ঢুকলো। কিছুক্ষণ স্ক্রল করার পর রেহাল এবং তার একটি ছবি চোখে পড়লো নন্দিতার। ছবিটায় রেহাল তার কপালে চুমু এঁকে দিচ্ছে আর সে চোখ বন্ধ করে আছে। মনের অজান্তে নন্দিতার গালে হাসির রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। পৃথিবীতে খুব কম মানুষ আছে যারা নিজেদের ভালোবাসার মানুষকে সারাজীবনের জন্য পাশে পায়। যারা পায় তারা খুব ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতী। কিন্তু যারা কাছে পেয়েও নিজেদের মাঝে দূরত্বকে জায়গা করে দেয় তাদের কি বলে? অভাগা বা অভাগী? নাকি অন্যকিছু? নন্দিতার মাথা ব্যাথা বাড়ছে। এসব নিয়ে ভাবতেও তার ভালো লাগছে না। গতকাল রাতে রেহালের সাথে ছোটখাটো ঝগড়া হয়েছে
সারারাত ঘুম হয়নি। একটু ঘুমানো প্রয়োজন। নন্দিতা ফোন বালিশের পাশে রেখে দিলো। গায়ে পাতলা চাদর টেনে গভীরে নিদ্রাদেশে হারিয়ে গেলো।

লিখা: আতিয়া আদিবা

. #মেঘের_বিপরীতে
পর্বঃ ১২
নন্দিতা বড় চাচাদের বাসায় এসেছে। মিহিও এসেছে। চাচী রান্নাঘরে। রুইমাছের তরকারির ঘ্রাণ ছড়িয়ে পুরো বাড়ি ম ম করছে। নন্দিতার বড় চাচা শফিক সাহেব নাইফকে নিয়ে কোনো এক বিশেষ কাজে বিকালে বের হয়েছেন। এখনো ফিরেন নি। মিহি লুডুর বোর্ড আর গুটি নিয়ে এসেছে। তারা এখন লুডু খেলবে। নন্দিতার প্রথম চালে পর পর দুই ছক্কা পড়লো। তারপর পড়লো পাঁচ। দুটো গুটি ঘরের বাইরে। মিহির প্রথম চালে উঠলো কানা। এবার দ্বিতীয় চালের পালা। এবারো নন্দিতার পর পর দুই ছক্কা আর তিন পড়লো। মিহির পড়লো পাঁচ। সে গোমড়া মুখে বসে রইলো। খেলা নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলছে। মিহি কোনোভাবেই তার গুটি বের করতে পারছে না। এদিকে নন্দিতার শুধু ছক্কা পড়ছে। মিহি বিরক্তি নিয়ে বললো,
“আপু তুমি চিটিং করছো।”
নন্দিতা সহজ গলায় বললো,
“মোটেও না। আমি স্বাভাবিক ভাবেই খেলছি।”
মিহি মানতে নারাজ। এত ছক্কা কারো পড়ে নাকি? নন্দিতা আর মিহির খুনসুটি চলতে লাগলো। এমন সময় কলিং বেল বাজলো। নন্দিতার বড় চাচী রোকেয়া বানু দরজা খুলতে গেলো। শফিক সাহেব এসেছেন। নন্দিতা নিতুর রুমে বসে আছে। নাইফের ঘর নিতুর ঘরের ঠিক পাশে। এতক্ষণ পাশের ঘর থেকে কোনো শব্দ আসছিলো না। এখন আসছে। ফুল স্পিডে ফ্যান চালানোর শব্দ। কিছু সময় বাদে গলা খাকাড়ি দেওয়ার চিরপরিচিত আওয়াজ শোনা গেলো। নাইফ তার ঘরে চলে এসেছে। নন্দিতা মিহিকে বললো,
“তুই একটু বোস। আমি চাচার সাথে দেখা করে আসি।”
মিহি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। নন্দিতা চাচার সাথে দেখা করে সোজা নাইফের ঘরে আসলো। দরজা খোলা। কিন্তু রুমে কেউ নেই। বারান্দার দরজাটা বাতাসে একটু ফাঁক হয়ে আছে। সেখান থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে। যদিও খুব তীব্র নয়। নন্দিতা বারান্দার দরজার একদম সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সিগারেটের কড়া গন্ধ নাকে এসে লাগলো।
“নাইফ ভাই।”
নাইফ স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো, “হুঁ”
যেনো সে আগের থেকেই জানতো নন্দিতা এখন এই ঘরে আসবে।
“এখানে কি করছো?”
“বিড়ি খাচ্ছি।”
“প্রতিদিন কয়টা করে খাও?”
“বেশি না। আট থেকে দশটা।”

নন্দিতা কিছু বললো না। চুপ করে রইলো। নাইফ আগে এত সিগারেট খেতো না। এখন খায়। দিন যত যায় নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের ঝোঁক তত বাড়তে থাকে। প্রতিটি সিগারেটের প্যাকেটে সতর্ক বার্তা দেওয়া থাকে। ধূমপান মৃত্যুর কারণ। ধূমপানের ফলে ক্যান্সার হয়। অথচ প্যাকেটের এই সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে লোকজন সিগারেট কিনে। রেহালকে নন্দিতা কতবার বারণ করেছে সিগারেট না খেতে। সে কথা শুনে নি। নন্দিতার বেশিরভাগ কথাই সে শুনে না। নন্দিতা আকাশের দিকে তাঁকিয়ে থেকে বললো,
“কি সুন্দর! তাই না?”
” কি?”
” রাতের আকাশ।”
” হুঁ সুন্দর।”
“পরিস্কার আকাশ। লক্ষাধিক তারকারাজি। কি সুন্দর জ্বলছে। তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে!”
নাইফ শান্ত গলায় বললো,
“কিন্তু চাঁদ নেই। চাঁদ ছাড়া রাতের আকাশ অপরিপূর্ণ। এই সৌন্দর্যে ঘাঁটতি রয়েছে।”
“চাঁদ তো আকাশ থেকে নেমে তোমার ঘরে এসে পড়েছে। শুধু তুমি তাকে রাখতে চাইছো না।”
নাইফ অবাক চোখে নন্দিতার দিকে তাঁকালো। সে কি বলতে চাইছে তার বোধগম্য হয় নি। নন্দিতা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।
“আমি তোর কথা বুঝতে পারি নি।”
“নাইফ ভাই, মেয়েটা অনেক সুন্দর। শিক্ষিত ঘরের। নম্র। ভদ্র। কেনো এমন করছো তুমি?”
নাইফ হেসে ফেললো। এ হাসি সুখের নয়। আনন্দের নয়।
“তুই আমাকে একথা জিজ্ঞেস করছিস? আমি কেনো এমন করছি! বিশ্বাস হচ্ছে না।”
নন্দিতা মাথা নিচু করে বললো,
“সাত বছর আগের একটা কাহিনী নিয়ে এখনো পড়ে থাকবে তুমি?”
“তোর কাছে কাহিনী ছিলো। আমার কাছে ছিলো না। আমার অনুভূতি, ভালোবাসা সবটা সত্যি ছিলো। আর আমি আমার বাস্তবতা নিয়ে এখনো ভালোভাবেই বেঁচে আছি। তোরা খামোখা আমার পিছে লেগে আছিস।”
“অতীত নিয়ে পড়ে থাকতে হয় না, নাইফ ভাই। সামনে এগিয়ে যেতে হয়। অতীত মানুষের জীবনে অন্ধকারের মতো। আর একটানা অনেকদিন অন্ধকারে থাকলে কি হয় জানো? মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। তুমি অন্ধ হয়ে গেছো। তাই বর্তমানে রঙ খুঁজে পাচ্ছো না। ভবিষ্যতের উজ্জ্বল আলো দেখতে পারছো না।”
নাইফ করুন কন্ঠে বললো,
“আমি যেমন আছি। বেশ আছি, নন্দিতা। কাজ করছি। রোজগার করছি। খুদা লাগলে খাচ্ছি। ঘুম পেলে ঘুমাচ্ছি। আমি আট দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করছি। জীবন তার মতো করে আমাকে গুছিয়ে নিয়েছে। দয়া করে আবার এলোমেলো করে দিস না! প্লিজ।”
নন্দিতার চোখ ভিজে উঠলো। সে ধরা গলায় বললো,
“আমি তোমার জীবন এলোমেলো করে দিয়েছিলাম, নাইফ ভাই?”
“ঢাকা যাওয়ার আগে তুই আমার চিঠি পাস নি?”
“পেয়েছিলাম।”
“পড়ে দেখিস নি?”
“দেখেছিলাম। কিন্তু চিঠির মানে বোঝার মতো বয়স তখন আমার ছিলো না।”
নাইফ এবার হো হো করে হেসে উঠলো।
“তাই? তখন চিঠির মানে বোঝার বয়স ছিলো না অথচ তার এক বছরের মধ্যে রেহালের প্রেমে পড়ার বয়স হয়ে গেছিলো। চমৎকার!”
নন্দিতা আরো একবার নাইফকে বোঝানোর চেষ্টা করলো। বিয়ের জন্য রাজী করানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। নাইফ তার প্রতিজ্ঞায় অনড়। সে বিয়ে করবে না। এমন সময় রোকেয়ার গলা শোনা গেলো। খাওয়ার জন্য ডাকছে। নন্দিতা চোখ মুছে বললো,
“চাচী ডাকছে। খেতে যাবে চলো।”
নাইফ নন্দিতার দিকে না তাঁকিয়ে বললো,
“তুই যা। আমি আসছি একটু পর।”
নন্দিতা বারান্দা থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে মিহির সাথে ধাক্কা খেলো। মিহি ব্যস্ত হয়ে বললো,
“তুমি এখানে? আমি তোমাকে সারাবাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি! চাচী খাবার বাড়ছে। খেতে আসো।”
“আমি ওদিকেই যাচ্ছিলাম। চল।”

মিহিকে নিয়ে নন্দিতা নাইফের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। নাইফের গাল গড়িয়ে পানি পড়ছে। বিষয়টা বুঝতে পেরে সে তাড়াতাড়ি হাতের তালু দিয়ে গাল মুছে ফেললো। এই সমাজে ছেলে মানুষের কাঁদতে মানা। কেউ দেখে ফেললে, কেলেঙ্কারি বেজে যাবে। কষ্টের দাঁড়িপাল্লা যত ভারীই হোক, ছেলে মানুষ কাঁদতে পারবে না। তাদের হৃদয় হতে হবে পাথরের মতো কঠিন।

শফিক সাহেব খুব রসিক মানুষ। তার স্ত্রীর সাথে হরহামেশাই রসিকতা করেন। সবাই খাবার ঘরে চলে এসেছে। রোকেয়া সবার প্লেটে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। ঘামে তার কপাল ভিজে গেছে। এতক্ষণ চুলার পাড়ে রান্না করেছে হয়তো সেজন্য। শফিক সাহেব আঁড়চোখে তার বউয়ের দিকে তাঁকিয়ে হঠাৎ সুর দিয়ে বলে উঠলেন,
“ঘামলে তোমায় লাগে আরো ভালো! রোকেয়া বানু চলেছে বাটি হাতে, খাবার বেড়ে দিবে সবার পাতে।”
রোকেয়া বাদে বাকি সবাই হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে মিহির গলায় খাবার আটকে গেলো। সে কাশতে লাগলো। নন্দিতা দ্রুত তার পানির গ্লাস মিহির দিকে এগিয়ে দিলো। মিহি ঢকঢক করে পুরো পানি খেয়ে নিলো। রোকেয়া চেতে গেলেন।
“খাওয়ার সময়ও আপনার মজা করা লাগে।”
“আহা গিন্নি! রাগো কেনো? অবশ্য রাগলেও তোমাকে মন্দ লাগে না।”
মিহি এক হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরলো। নাইফ আর নন্দিতাও মুচকি মুচকি হাসছে। রোকেয়া বানু গলার স্বর কয়েক ডিগ্রি উপরে উঠিয়ে বললেন,
“আপনাকে বলে কোনো লাভ নাই। আপনি আমার কোনো কথাই শুনেন না।”
শফিক সাহেব দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বললেন,
“এত বড় অপবাদ দিলা গিন্নি? ঠিকাছে আজকের মতো এখানেই সমাপ্ত। আবার অন্যদিন তোমায় নিয়ে গান বানাবো।”
আবার একচোট হেসে নিলো সবাই। নন্দিতার বেশ ভালো লাগছে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক এমনই তো হওয়া উচিত। এ সম্পর্কে একটুখানি রাগ থাকবে। অভিমান থাকবে। খুনসুটি থাকবে। দুজনের প্রতি দুজনের দায়িত্ব থাকবে। কর্তব্য থাকবে। আবার অনেক অনেক ভালোবাসাও থাকবে। এর নামই তো সংসার। নন্দিতার বিবাহিত জীবনের শুরুটা ঠিক এমন ছিলো। সময়ের সাথে সাথে সব কেমন পালটে গেলো! তার জীবন থেকে বসন্ত হারিয়ে গেছে। ঝরে পড়া পাতাগুলোর জায়গায় নতুন কোনো সতেজ পাতার দেখা এখনো মিলে নি। তবে নন্দিতা জানে, একদিন ঠিক কাঠ ফাটা রোদে প্রায় মরে যাওয়া ডাল ভেদ করে উঁকি দিবে নতুন কোনো পাতা। দেখতে দেখতে পুরো গাছ সবুজে ছেয়ে যাবে। আকাশ ভেঙ্গে নেমে আসবে ঝুম বৃষ্টি। নতুন পাতাগুলো স্নান সেড়ে নিবে। এই শুকনো পাতার মরশুম ঠিক বদলাবে। সবাই চুপচাপ খাচ্ছে। রোকেয়া কোনো এক কাজে আবার রান্নাঘরে গিয়েছে। খেতে খেতে শফিক সাহেব বললেন,
“হ্যাঁ রে নন্দিতা। জামাই বাবার খবর কি? ব্যবসা বাণিজ্য কেমন চলে?”
“আলহামদুলিল্লাহ, চাচা। ভালো চলছে।”
“রেহালকে দুই তিনদিনের জন্য রেখে দিতে পারলি না?”
“বলেছিলাম। রেহালের ইচ্ছে ছিলো থেকে যাওয়ার। হঠাৎ জরুরী একটা মিটিং এর ডাক পড়লো। তাই চলে যেতে হলো।”
“ছেলেটাকে একবারো ভালো মন্দ কিছু খাওয়াতে পারলাম না।”
নাইফ এতক্ষণ কোনো কথা বলে নি। এবার সে টিটকারি মেরে বললো,
“কি যে বলেন, বাবা! বড়লোক ঘরের ছেলে। আমাদের সঙ্গে একসাথে বসে খাবে নাকি?”
নন্দিতা হাসিমুখে প্রতিবাদ করলো।
“না খেতে পারার তো কিছু নেই, নাইফ ভাই। রেহাল যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। এটুকু ক্ষমতা ওর আছে বলেই আজ এ পর্যায়ে আসতে পেরেছে।”
প্রত্যুত্তরে নাইফ হাসলো। শফিক সাহেব নন্দিতার সাথে সহমত প্রকাশ করলেন।
“তা ঠিক বলেছিস। জামাই বাবা অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তার ব্যক্তিত্ব অসাধারণ। তবে কাজের চাপে নিজের পরিবারকে ভুলে গেলে হবে না। সামাজিকতা রক্ষা করে চলতে হবে। রেহালকে বলিস তোকে যখন নিতে আসবে দুই তিনদিনের জন্য সময় নিয়ে যেনো আসে।”
“জ্বি চাচা। বলবো।”
রোকেয়া ফিরে এসেছে। শফিক সাহেব ইশারায় সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়েছেন। নন্দিতা রেহালকে না জানিয়েই খেতে বসে গেছে। অন্যসময় কল অথবা টেক্সট করে জানিয়ে দেয়। আজ একটাও করা হয়নি। এতে তার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। হঠাৎ মোবাইলে টুং করে নোটিফিকেশন আসলো। রেহাল ম্যাসেজ পাঠিয়েছে।
“আজ মুরগীর তরকারি গরম করে খাচ্ছি। রান্না মজা হয়েছে।”
নন্দিতার অস্বস্তি ভাব কেটে গেলো। মেজাজ ফুরফুরে হয়ে গেছে। সে খাওয়ায় মনোযোগী হলো। আজ রাতে অনেকক্ষণ রেহালের সাথে কথা বলবে সে।

(পর্বটি কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন।

(চলবে…)

লিখাঃ #Atia_Adiba

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here