মেঘের বিপরীতে পর্ব ৯+১০

. #মেঘের_বিপরীতে
( ৯+১০ম পর্ব )
নন্দিতা নিজের রুমে বিছানায় জোড় আসনে বসে আছে। কোলের ওপর বালিশ। তার ওপর গল্পের বই রাখা। সে খুব মনোযোগ দিয়ে গল্পের বই পড়ছে। রবার্ট ব্লচের সাইকো। এই গল্পের বইটি নন্দিতার কোন এক বান্ধবী তাকে জন্মদিনে উপহারস্বরূপ দিয়েছিলো। পড়বে পড়বে বলে আর পড়া হয় নি। জানালার পাশে চায়ের মগ রাখা। মগের চারপাশে কিছু লাল পিঁপড়া ঘোরাফেরা করছে। মগ এখনো গরম। সেজন্যই পিঁপড়ে গুলো দূরত্ব বজায় রেখে ঘোরাফেরা করছে। মগের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হলেই এরা লাইন ধরে চা পান করতে চলে আসবে। নন্দিতা মগ হাতে নিয়ে ছোট্ট করে চুমুক দিলো। এমন সময় ঘরে তার ছোট চাচার মেয়ে মিহি প্রবেশ করলো। মিহি এই বংশের সর্বকনিষ্ঠ কন্যা। নন্দিতার বাবা, রফিক সাহেবরা তিন ভাই। বড় ভাই শফিক এবং ছোট ভাই জহির। বড় ভাই শফিকের দুই সন্তান। এক ছেলে এক মেয়ে। গত বছর তার ছোট মেয়ে নিতুর বিয়ে হয়েছে। বড় ছেলে নাইফ পড়াশোনা শেষ করে এখন ব্যবসা করছে। বিয়ে শাদী করে নি। মিহি জহিরের একমাত্র কণ্যা। নন্দিতা লাল রঙের ছোট্ট চিকন একটি ফিতা পৃষ্ঠার মাঝে রেখে বই বন্ধ করে ফেললো। মিহির হাতে আলতা। নন্দিতা ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
” হঠাৎ আলতা হাতে মিহি রাণীর আগমন? কাহিনী কি?”
মিহি উৎসুক হয়ে বললো,
“তোমাকে আলতা পড়িয়ে দিবো।”
“আলতা! এই ভরদুপুরে আলতা পড়িয়ে দিবি?”
“হুঁ। তোমাকে আলতা পড়িয়ে নিজেও আলতা পড়বো। শুকাতে শুকাতে বেলা আরেকটু গড়াবে তারপর আমরা নদীর পাড়ে যাবো। নাইফ ভাই, ডিঙ্গি নৌকার ব্যবস্থা করেছে।”
“বলিস কি! নাইফ ভাই ব্যবস্থা করেছে? আমি তো শুনলাম ভাই ব্যবসার কাজে শহরে গিয়েছে! আসলো কবে?”
“আজ সকালে এসেছে। বড় চাচী বাসায় ছিলো না। আমাদের বাসায় নাস্তা করলো। আমি বললাম তুমি এসেছো। একবার দেখা করে আসতে। নাইফ ভাই পাত্তাই দিলো না। খেয়ে বেরিয়ে গেলো।”
“তাহলে বললি যে ডিঙ্গি নৌকার ব্যবস্থা করেছে?”
মিহি নন্দিতার পাশে বসতে বসতে বললো,
“দুপুরে খেতে এসে আমাকে বললো তুমি নাকি নৌকায় ঘুরতে বেড়াতে অনেক পচ্ছন্দ করতে। বিকালে যেনো তোমাকে ঘাটপাড়ে নিয়ে যাই। নাইফ ভাই ডিঙ্গি নৌকার ব্যবস্থা করে এসেছে।”
মিহি নন্দিতার পা নিজের কোলের ওপর নিয়ে রেখে বললো,
“এখন চুপটি করে বসে থাকো। আমি আলতা পড়িয়ে দিচ্ছি।”
নন্দিতা পা সরিয়ে বললো,
“তোকে কষ্ট করে পড়িয়ে দিতে হবে না। আমি নিজে পড়বো। অনেক দিন নিজ হাতে আলতা পড়ি না। কাউকে পড়িয়েও দেই না। আগে তোকে পড়িয়ে দিবো তারপর আমি পড়বো।”
মিহি একটু আপত্তি করলো। কিন্তু নন্দিতা শুনলো না। প্রথমে ভেজা কাপড় দিয়ে মিহির পা মুছলো। আবার শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে দিলো। এরপর খুব মনোযোগ দিয়ে মিহিকে আলতা পড়িয়ে দিতে লাগলো।

নাইফ ঘাঁটপাড়ে বসে আছে। তার পাশে একজন বয়স্ক মহিলা সিগারেট আর খিলিপান বিক্রি করছে। অন্যদিন মহিলাটি সাথে মাটির চুলা নিয়ে আসেন। সিগারেট আর খিলিপানের পাশাপাশি চায়ের ব্যবসাটাও জমে উঠে। কিন্তু আজকে আনেন নি। নাইফের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। নন্দিতা চা পচ্ছন্দ করে। সে চেয়েছিলো নৌকায় উঠার সময় তিন কাপ চা নিয়ে উঠবে। তা আর সম্ভব হবে না। আজকের আবহাওয়া সুন্দর। আকাশ মেঘলা নয় আবার রোদের তীব্রতাও কম। নির্মল বাতাস। নদীতে ক্ষীণ স্রোতের দেখা মিলছে। সূর্য ধীরগতিতে পশ্চিমে যাত্রা করছে। মিহি আর নন্দিতার এতক্ষণে চলে আসার কথা। কিন্তু তাদের দুজনের একজনও ঘাঁটে উপস্থিত বলে মনে হচ্ছে না। নাইফ পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো। আনমনে একদিকে তাঁকিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলো। আচমকা কাঁধে কোনো রমণীর স্পর্শ অনুভব করলো নাইফ। পেছোন ফিরে তাঁকাতেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলো সে। সিগারেটের শেষ অংশ এখনো জ্বলছে। এই অংশটুকু প্রতিটি স্মোকারের কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শেষ কয়েকটি টানে নিকোটিনের স্বর্গীয় অনুভূতি পাওয়া যায়। নাইফ বুঝতে পারলো না সে কি করবে। বাকি অংশটুকু ফেলে দিবে নাকি শেষ কয়েকটি টান দিয়েই ছাড়বে। নন্দিতা বুঝতে পারলো। সে মুচকি হেসে বললো,
“তুমি সিগারেট শেষ করো নাইফ ভাই। সমস্যা নেই।”
নাইফ লজ্জা পেয়ে গেলো। সিগারেট ফেলে দিয়ে বললো,
” না না! এ আর এমন কি। তোরা কখন পিছে এসে দাঁড়িয়েছিস খেয়াল করি নি।”
মিহি মুখ চেপে হেসে ফেললো। নাইফ তার দিকে চোখ গরম করে তাঁকালো। মিহি হাসি থামিয়ে চুপসে গেলো। নাইফকে সে বেশ ভয় পায়। বড় ভাই বলে কথা।
নাইফ গলা পরিষ্কার করে বললো,
“আচ্ছা কুশলাদি নৌকায় চড়ে হবে নি। বেলা শেষ হয়ে আসছে। আরো দেরী করলে ঠিক মতো বেড়াতেই পারবি না। সন্ধ্যা নেমে আসবে।”
নন্দিতা মাথা নাড়ালো।
“তুমি যাও তাহলে। নৌকা পানিতে নামাও। আমি মিহিকে নিয়ে আসছি।”
“ঠিকাছে।”
নাইফ হনহন করে সামনে এগিয়ে গেলো। নন্দিতা ফোন হাতে নিয়ে ক্যামেরা অন করলো। আকাশের নীল আর পানির নীল মিশে একাকার হয়ে আছে। মাঝখানে অবশ্য হলুদ কমলাটে রঙও রয়েছে। এক টুকরো মেঘের ফাঁকে সূর্যের উঁকিঝুঁকি। বেশ কয়েকটি ছবি তুললো সে। ছোটবেলায় ফটোগ্রাফির শখ ছিলো নন্দিতার। প্রকৃতি তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতো। হয়তো গ্রামীণ পরিবেশে জন্ম বলে। দূর থেকে নাইফ হাঁক ছাড়লো। নন্দিতা মিহিকে নিয়ে নদীর পাড়ে অগ্রসর হতে লাগলো।

নৌকা মাঝ নদীতে এসে পড়েছে। এখানে বাতাসের তীব্রতা আরো বেশি। নন্দিতার শাড়ির আঁচল এলোমেলো ভাবে উড়ছে। পতপত শব্দ হচ্ছে। মিহি নৌকার এক কোণায় বসে ফোনে কথা বলছে। নন্দিতা দুই পা পানিতে নামিয়ে রেখেছে। শাড়ির নিচের অংশ ভিজে পায়ের সাথে লেপ্টে আছে। নাইফ বৈঠা চালাচ্ছে। ফাঁকে ফাঁকে আঁড়চোখে নন্দিতাকে দেখছে। শেষ বিকালের আলোয় নন্দিতাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। পানিতে এলোমেলো ভাবে পা ফেলতে ফেলতে নন্দিতা বললো,
“তোমার এখনো মনে আছে আমি নৌকায় ঘুরতে পচ্ছন্দ করি?”
নাইফ সহজভাবে উত্তর দিলো,
“মনে না থাকার কি আছে? ছোট বেলায় কম জ্বালিয়েছিস নাকি এই নৌকায় চড়ার জন্য? তোর জন্য মাছ ধরতে পর্যন্ত লুকিয়ে আসতে হতো।”
নন্দিতা উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। যেনো খুব মজার কোনো কথা বলে ফেলেছে নাইফ।
“এত হাসার কি আছে?”
“হাসছি অন্য কারণে। একটা কথা মনে হলো।”
“কি কথা?”
“মনে আছে? একবার তুমি বাবাকে না বলে আমাকে নিয়ে নৌকায় ঘুরছিলে। হঠাৎ নদীর মাঝখানে এসে দেখা গেলো নৌকা ফুটো। আমি সে কি কান্নাকাটি! ভাগ্যিস! ওই পুরান বাজারের জেলে চাচাও তখন নদীতে মাছ ধরতে এসেছিলেন। নাহলে কি যে হতো সেদিন!”
নাইফ মুখ গোমড়া করে বললো,
“যা হয়েছিলো তাও বা কম কিসে? বাসায় গিয়ে বেতের বারি তো সব আমারই খেতে হয়েছে।”
নন্দিতা আবার খিলখিল করে হেসে উঠলো। নাইফ মুগ্ধ হয়ে দেখছে। নৌকা থেকে কিছুদূরে বেগুনী রঙের একটি জলজ ফুল দেখা গেলো। নন্দিতা অবাক হয়ে বললো,
“এটা কি ফুল? আগে কখনো দেখি নি তো!”
“কোথায়?”
নন্দিতা আঙ্গুল দিয়ে দেখালো। নাইফ নৌকা সেই ফুলটির কাছে নিয়ে গেলো। নন্দিতা সাথে সাথে ফুলটি ছিঁড়ে নিলো। নাইফ বললো,
“ফুলটা সুন্দর কিন্তু নাম জানি না।”
“আমি গুগুল করে বের করে ফেলবো। কোনো সমস্যা নেই।”
নাইফ হেসে বললো, “আচ্ছা।”
হঠাৎ নন্দিতার কি মনে হলো সে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“নাইফ ভাই, তুমি বিয়ে করছো না কেনো?”
এমন প্রশ্নে নাইফ যেনো চমকে উঠলো। চেহারার মাঝে থেকে চটপটে ভাব হারিয়ে গেলো। একরাশ মলিনতা ভর করলো তার চোখে মুখে। বৈঠা ফেলার মাঝেও জড়তা চলে এলো। থমথমে পরিবেশের রেশ কাটিয়ে সে হাসার চেষ্টা করে বললো,
“এমনি। মনের মতো মেয়ে পাচ্ছি না তাই।”
নন্দিতা লক্ষ্য করলো নাইফের চোখ লাল হয়ে এসেছে। তার মন খারাপ হয়ে গেলো। নাইফ কেনো বিয়ে করছেনা তার উত্তর আর কেউ না জানলেও নন্দিতা জানে। সে নাইফকে কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু বলতে পারলো না। তার আগেই মিহি এসে পড়লো। নন্দিতা হেসে মিহিকে বললো,
“কি? কথা বলা হলো?”
“হ্যাঁ। শেষ।”
নন্দিতার হাতে ফুল দেখে মিহি অবাক হয়ে বললো,
“কি সুন্দর ফুল! কই পেলে নন্দিপু? আমিও নিবো। কোথা থেকে তুলেছো বলো না?”
নন্দিতা কোনো উত্তর দিলো না। সে একদৃষ্টে নাইফের দিকে তাঁকিয়ে আছে। নাইফ অন্যদিকে ঘুরে বৈঠা চালাচ্ছে। তার দৃষ্টি উদাস। ছেলেটার মনে ক্ষত আছে তা নন্দিতা জানতো। সেই ক্ষতের কারণ নন্দিতা নিজেই সেটাও সে জানতো। কিন্তু এই ক্ষত সে আজীবন বয়ে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিবে তা নন্দিতা জানতো না। এক তরফা ভালোবাসা সবার ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী না হলেও কারো কারো ক্ষেত্রে হয়তো হয়। নন্দিতার চোখ ভিজে উঠলো।
ঝাপসা চোখে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে সহজ কন্ঠে বললো,
“নৌকা ঘুরাও নাইফ ভাই।”
নাইফ কোনো উত্তর দিলো না। নৌকা ঘুরিয়ে ফেললো। উদ্দেশ্য _ ঘাটপাড়।
(চলবে…)

. #মেঘের_বিপরীতে
(১০ম পর্ব )

ঘড়ির কাটা টিক টিক করতে করতে এগারোটায় গিয়ে পৌঁছালো। রেহাল অফিসে তার রুমে একা বসে আছে। অর্চিতা এখনো আসে নি। অফিস আসার পথে রাস্তায় তেমন জ্যাম ছিলো না। আবহাওয়া যথেষ্ট ভালো। ঝলমলে সকাল পেরিয়ে রৌদ্রদগ্ধ দুপুর হতে চললো। তাহলে অর্চিতা কেনো এখনো অফিসে এসে পৌঁছায় নি? জয়েন করেছে মাত্র কয়েকদিন হলো। এখনই অফিস আসতে দেরী? নিয়ম কানুন মানছে না দেখা যায়! নাকি রেহাল দুই দিন অনুপস্থিত ছিলো দেখে মেয়ে মনে করেছে সময়ানুযায়ী না গেলেও চলবে? বস ডিসিপ্লিন মেনে চলে না। অর্চিতা এমন কিছু ভেবে থাকলে অনেক বড় ভুল করছে। তার এই ভুল ভাঙ্গিয়ে দিতে হবে। রেহাল ঠিক করলো অর্চিতাকে ফোন দিয়ে কঠিন কিছু কথা বলবে। নরম ভাবে কিছু বললে এই মেয়ে আরো পেয়ে বসবে। সেই সুযোগ দেওয়া যাবে না। ফোন আনলক করে কন্টাক্ট লিস্টে ঢুকলো রেহাল। বেশি কষ্ট করতে হলো না নাম্বার খুঁজতে। প্রথম চারটি নাম্বারের পরেই অর্চিতার নাম্বার পাওয়া গেলো। স্ক্রীনের দিকে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে থেকে মোবাইল আগের জায়গায় রেখে দিলো রেহাল। টেবিলের ওপর থেকে কফির মগ নিয়ে বড় করে চুমুক দিলো। আগে কফি শেষ করবে তারপর পিএ কে কল করবে সে। এদের এত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। যে নিয়ম মানবে না, তাকে এই কম্পানি থেকে বহিষ্কার করা হবে। দেশে বেকার মানুষের অভাব নেই। একটি পোস্ট খালি হলে তার জন্য সিভি জমা পড়ে কমপক্ষে দেড়শো! তাই একজনকে বহিষ্কার করা নিয়ে রেহালের দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে না।

নার্সের ডাকে ঘুম থেকে জাগনা পেলো অর্চিতা। নিজেকে চেয়ারে অবিষ্কার করলো। সারারাত একই ভাবে চেয়ারে বসে ছিলো। চোখে ঘুম নেমে এসেছে সূর্য পুরোপুরি উঠে যাওয়ার পর। সম্ভবত সাতটা সাড়ে সাতটার দিকে। এতক্ষণ অচেতনের মতো চেয়ারেই ঘুমিয়েছে সে। চোখ ডলতে ডলতে অর্চিতা হাতঘড়ির দিকে তাঁকালো। সাড়ে এগারোটা বাজে। সে ব্যস্ত হয়ে নার্সকে বললো,
“মা, কেমন আছে এখন?”
“উনি ভালো আছে। ডাক্তার আসছিলো রাউন্ডে। আপনার মাকে দেখে গেছে। কিছু মেডিসিন প্রেসক্রাইব করে গেছে।”
একথা বলে নার্স ডাক্তারের দেওয়া প্রেসক্রিপশন অর্চিতার দিকে এগিয়ে দিলো।
“এই ওষুধগুলো নিয়ে রোগীর কেবিনে আসেন। ডাক্তার আবার বিকালে রাউন্ডে আসবে। তখন রোগীর পরিবারের মানুষও থাকতে হবে।”
অর্চিতা চোখ ডলতে ডলতে প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে বললো,
“ঠিকাছে। আমি ওষুধ নিয়ে আসছি।”
নার্স সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো। অর্চিতা প্রেসক্রিপশনে কি লিখা আছে তা পড়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু পড়তে পারলো না। ডাক্তারদের হাতের লিখা বেশিরভাগ সময়ই বোঝা যায়না। শুধু ফার্মেসির লোকেরা বুঝতে পারে। অর্চিতার পরিচিত একজন ডাক্তার আছেন যার হাতের লিখা খুব সুন্দর। গোটা গোটা লিখা। দেখে মনে হয় কম্পিউটারে টাইপ করে প্রিন্ট করা হয়েছে। সব ডাক্তারদের লিখা তার মতো হলে কত ভালো হতো! চেয়ার ছেড়ে উঠে পাঁচ তলা থেকে নিচতলায় নামলো অর্চিতা। মায়ের ওষুধ কিনতে হবে। ফার্মেসির থেকে ওষুধ কিনে কেবিনে ফেরার সময় অর্চিতার ফোনে রিং বেজে উঠলো। সে ফোন ধরলো না। ফোন ধরতে চাইলে এখন তার ব্যাগ কাধ থেকে নামাতে হবে। চেন খুলতে হবে। তারপর মোবাইল বের করতে হবে। কারো কল রিসিভ করার জন্য এত আয়োজন করতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া এখন অর্চিতার কারো সাথে কথা বলার মন মানসিকতা নেই। সে ওষুধের প্যাকেট হাতে নিয়ে কেবিনে ঢুকলো।

বিকালে ডাক্তার আসলো রোগীকে দেখতে। আরো নতুন কিছু ওষুধ প্রেসক্রাইব করে দেওয়া হলো। টেস্ট দেওয়া হলো। এমন সময় আবার অর্চিতার ফোন বেজে উঠলো। ডাক্তার হাসিমুখে অর্চিতাকে বললো,
“রোগীর ঘরে ফোন সবসময় সাইলেন্ট মুড করে ঢুকবেন।”
“অবশ্যই। এরপর থেকে ঢুকবো।”
“নতুন কিছু মেডিসিন লিখে দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল থেকে কন্টিনিউ করবেন।”
“জ্বি করবো।”
“বেশ কিছু টেস্ট করতে হবে রোগীর। আমি সব লিখে দিয়েছি। সেগুলোও আগামীকাল করিয়ে ফেলবেন।”
“ঠিকাছে।”
ডাক্তার কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। পিছে পিছে অর্চিতাও বের হয়ে গেলো। বিরক্তি নিয়ে মোবাইল বের করলো ব্যাগ থেকে। দুটি মিসড কল উঠে আছে। শাহরিন কল করেছে একবার আর একবার রেহাল হোসেইন! অর্চিতা ফ্যাকাসে মুখে ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাঁকিয়ে রইলো।

রেহাল অর্চিতার সামনে বসে আছে। মেয়েটার মুখ শুকনা লাগছে দেখতে। কপালে হালকা ঘাম জমেছে। এরকম ঘাম অর্চিতা যেদিন প্রথম অফিসে জয়েন করেছিলো সেদিন জমেছিলো। কিছুটা নার্ভাসও লাগছিলো দেখতে। আজ অবশ্য তাকে দেখে নার্ভাস বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু যথেষ্ট চিন্তিত দেখাচ্ছে। তার যথার্থ কারণ রয়েছে। গতকাল রাতে হঠাৎ করে মায়ের বুকে ব্যাথা শুরু হয়। অর্চিতার ভাই নানুর বাড়ি বেড়াতে গেছে। রাতের বেলা একা একজন মেয়ে মাকে নিয়ে হসপিটালে এসেছে। বুকে ব্যাথার কারণ এখনো জানা যায় নি। টেস্ট না করানো পর্যন্ত জানা সম্ভব নয়। এরকম অবস্থায় চিন্তিত থাকা খুব স্বাভাবিক। রেহাল অর্চিতার দিকে মেন্যু এগিয়ে দিলো।
“কি খাবে অর্ডার দাও।”
অর্চিতা কথা না বলে মেন্যু দেখতে লাগলো। সারাদিন একটি দানাও পেটে পড়ে নি। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে তার। বিকালে রেহালকে কল করে সব খুলে বলেছে অর্চিতা। একমাসের বেতন এডভান্স নিয়ে হসপিটালে চলে এসেছে রেহাল। অর্চিতার মায়ের সাথে দেখা করে হসপিটালের পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে বসেছে। অর্চিতা প্রথমে আসতে চায় নি। রেহাল জোরাজোরি করার ফলে না করাও সম্ভব হয় নি।
“আমি এই সেট মেন্যুটা নিবো।”
রেহাল মাথা নাড়িয়ে ওয়েটারকে ডাক দিলো।
“পাঁচ নাম্বার সেট ম্যানু দুইটা দিবে।”
ওয়েটার অর্ডার খাতায় নোট করে চলে গেলো। অর্চিতা হাসার চেষ্টা করে বললো,
“আপনি কিছু না দেখেই নিজের জন্য অর্ডার করে দিলেন? আমার যেটা ভালো লাগে আপনার ভালো নাও লাগতে পারে!”
রেহাল পকেট থেকে ফোন বের করে টেবিলে রাখলো। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো,
“যার ড্রেস আপ সেন্স এত ভালো, তার খাবার চয়েজ খারাপ হবে না। এটা আমার বিশ্বাস। অভিজ্ঞতাও বলতে পারো।”
অর্চিতা এবার হেসে ফেললো।
“তুমি বসো। আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।”
অর্চিতা মাথা নাড়লো। রেহাল ওয়াশরুমের দিকে এগোতেই তার ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো। অর্চিতা কৌতূহলবশত ফোন হাতে নিলো। স্ক্রীনে হালকা হলুদ রঙের জর্জেট শাড়ি পড়া এক মেয়ের ছবি উঠে আছে। কপালে কালো টিপ। চুল হালকা করে খোঁপা করা। চোখে কালো কাজল। মেয়েটা তার আঁচল ঠিক করায় ব্যস্ত। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ছবিটি ক্যান্ডিড। না বলে তোলা হয়েছে। ইনকামিং কলে নাম উঠে আছে ‘নন্দিতা’। অর্চিতা ফোন পুনরায় আগের স্থানে রেখে দিলো। আরো বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোন শান্ত হয়ে গেলো। অর্চিতার ভালো লাগছে না। অস্বস্তি লাগছে। এই মেয়ে তার বসের স্ত্রী হতে পারে ভাবতেই
মন খারাপ হয়ে গেলো। এতে মন খারাপ হওয়ার কি আছে অর্চিতা বুঝতে পারলো না। আজকাল কারণে অকারণে তার মন খারাপ হয়। কখনো চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কখনো একাই হাসে। কখনো বিষাদের ছায়া নামে। কখনো উৎফুল্ল মনে কেটে যায় সারাবেলা।

রেহাল ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসেছে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো চারটা মিসডকল উঠে আছে। সে কল ব্যাক করলো না। খুব স্বাভাবিক ভাবে ফোনটা আবার রেখে দিলো। খাবার চলে এসেছে। ফ্রাইড রাইস, হোয়াইট ভেজিটেবল, চিকেন ফ্রাই আর ম্যাক্সিকান চিকেন কারি। সাথে সফট ড্রিংকস। রেহাল ঝাল খেতে পারে না। হোয়াইট ভেজিটেবলও তার খেতে ইচ্ছে করছে না। তাঁকিয়ে দেখলো অর্চিতা পানসে মুখে বসে আছে। রেহাল চিকেন ফ্রাই হাতে নিয়ে বললো,
“বসে আছো কেনো? খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
“স্যার, আপনি শুরু করেন। আমিও করছি।”
রেহাল চিকেন খাওয়া শুরু করলো। অর্চিতাও নিঃশব্দে খাচ্ছে। রেহালের ফোন আবার বেজে উঠলো। সে আঁড়চোখে একবার ফোনের দিকে তাঁকালো। অর্চিতার দৃষ্টিও সেদিকে। ফোনের ভাইব্রেশন অফ করে পুনরায় খেতে লাগলো। রেহাল খাওয়ার সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কল ছাড়া অন্য কারো কল সে রিসিভ করে না। কোনো ক্লাইন্টের কল যদি থাকতো বা অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কল যদি থাকতো তাহলে রিসিভ করতো। একজন ব্যবসায়ীর জীবনে অবশ্যই এরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নন্দিতা তাদের মধ্যে পড়ে না। সে রেহালের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেউ নয়।
(চলবে…)

লিখাঃ Atia Adiba

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here