মেঘের বিপরীতে পর্ব ৭+৮

. #মেঘের_বিপরীতে
( পর্ব ৭+৮)
চারিদিকে রঙ বেরঙের আলো। প্রচন্ড হৈ চৈ। শাহরিনের বয়ফ্রেন্ড জিসান চলে এসেছে। সাথে তার কিছু বন্ধুও এসেছে। কেক কাটার পর্ব শেষ হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে রাতের খাবার পর্ব শুরু হবে। জিসান তার বন্ধুদের নিয়ে সামনের টেবিলে বসেছে। একজন সবাইকে ফোনের মধ্যে কি একটা ভিডিও দেখাচ্ছে। সবাই অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে দেখছে আর মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে হাসছে। শাহরিন তার বান্ধুবীদের নিয়ে আলাদা বসেছে। ব্যস্ততার জন্য এখন আর আগের মতো গল্পের আসর বসে না। আজ সুযোগ পেয়েছে। সে কোনোভাবেই এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। জমিয়ে আড্ডা দিবে তার বান্ধুবীদের সাথে।
এমন সময় অর্চিতার ফোনে ফোন এলো। সে “এক্স কিউজ” মি বলে ফোন হাতে নিয়ে রেস্টুরেন্টের বাইরে চলে এলো।

” হ্যাঁ মা। বলো।”
” বাসায় আসবি না? রাত আটটা বাজতে চললো!”
“এইতো। ঘন্টাখানিকের মধ্যে ফিরে আসবো। তোমাকে তো বলেছিলাম আজ ফিরতে একটু দেরী হবে। শাহরিন এর সাথে আছি।”
” হ্যাঁ বলেছিলি। চিন্তা হয়। দিনকাল তো ভালো না! সাবধানে আসিস। নয়টার মধ্যে বাসায় উপস্থিত থাকবি। এটা আমার হুকুম।”
” যথা আজ্ঞা মহারাণী।”
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে হাসির শব্দ শুনতে পাওয়া গেলো।
“ঠিকাছে রাখছি।”
” আচ্ছা মা।”
অর্চিতা ফোন রেখে পেছোনে ঘুরতেই চমকে উঠলো। শাহরিন দাঁড়িয়ে আছে।
” এভাবে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে নাকি? ভয় পেয়েছি।”
শাহরিন অবাক হয়ে বললো,
“এত অল্পতেই অর্চি ম্যাডাম ভয় পায় তা তো জানা ছিলো না! তুই হলো সাহসের এক অনন্য সংঙ্গা। অকুতোভয় নারী।”
অর্চিতা ব্যঙ্গ করে বললো,
” হা হা হা। ভেরি ফানি!”
অর্চিতা আবার ঘুরে দাঁড়ালো। আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ জমছে। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে এই মেঘেদের দল চাঁদটাকেও আড়াল করে ফেলবে। শাহরিন অর্চিতার পাশে এসে দাঁড়ালো।
“তোর সাথে আলাদা ভাবে কথা বলার সুযোগই পাচ্ছিলাম না। আন্টির সময়জ্ঞান অনেক ভালো। এখন বল, বসকে কেমন দেখতে?”
অর্চিতা আকাশের মেঘ দেখতে দেখতে বললো,
“একদম মানুষের মতো। দুটো হাত আছে, দুটো পা আছে। চোখ, কান, নাক, মুখ সবই আছে।”
শাহরিন অর্চিতাকে চিমটি কেটে বললো,
“ধুর! মজা করছিস নাকি তুই?”
“মজা তো তুই করছিস। বসকে কেমন দেখতে হবে আবার? মানুষের মতোই হবে!”
“আমি তার ব্যক্তিত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি এসবের কথা জিজ্ঞেস করছি।”
অর্চিতা ছোট্ট করে উত্তর দিলো, ” ভালো।”
শাহরিন কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” ব্যাস! এইটুকুই?”
” হুঁ। ”
” তুই নাম শুনে তার চেহারা যেমন কল্পনা করেছিলি তার সাথে মিল আছে?”
” না। কোনো মিলই ছিলো না।”
” বসের নাম যেনো কি? মিহাল নাকি কি একটা?”
” রেহাল ইসলাম।”
শাহরিন খোঁচা মেরে বললো,
“বসের নামটা কিন্তু সুন্দর। দেখতেও মনে হয় সুন্দরই হবেন। বিয়ে শাদী করেছেন?”
” হু। বিবাহিত।”
” বাচ্চা কাচ্চা আছে?”
” তা জানি না। মনে হয় আছে।”
” যাইহোক, আরো একবার কনগ্রেচুলেশনস। আমি সত্যি অনেক খুশি হয়েছি। অনেক বেশি।”
অর্চিতা শাহরিনের দিকে তাঁকিয়ে হেসে বললো,
” থ্যাংক ইউ।”
এমন সময় রেস্টুরেন্টের ভেতোর থেকে জিসানের গলা শুনতে পাওয়া গেলো। খাবার সার্ভ করা হচ্ছে। শাহরিন অর্চিতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” অনেকক্ষণ ধরে বাহিরে আছি। চল ভেতোরে যাওয়া যাক। খাবার রেডি হয়ে গিয়েছে। সার্ভ করা হচ্ছে।”
” তুই যা। আমি আসছি।”

শাহরিন চলে গেলো। অর্চিতা আবার আকাশের দিকে তাঁকালো। চাঁদ মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মৃদু বাতাস বইছে চারিপাশে। এত কোলাহলের মাঝেও অর্চিতার নিজেকে ভীষণ একা বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তার আশেপাশে কেউ নেই। জনমানবশূন্য কোনো এলাকায় সে একা দাঁড়িয়ে আছে। অর্চিতা চোখ বন্ধ করলো। সাথে সাথে তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো, রেহাল এবং তার দেড় বছরের মেয়ের খুনসুটি!
অর্চিতা দ্রুত চোখ মেললো। সে কোনোভাবেই এসব চিন্তা করতে চাচ্ছে না। অন্তত এখন নয়। চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে সে রেস্টুরেন্টের ভেতোরে চলে গেলো।

নন্দিতা বারান্দায় মাদুর পেতে বসে আছে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোয় উঠোনের ফুলগাছগুলো দেখতে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। বিশেষ করে গোলাপফুল গুলো। ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আসলে এই সোঁদা গন্ধের উৎস ভিজে মাটি নয়, মাটিতে বসবাসকারী ব্যক্টেরিয়া। বিশেষ ধরণের এক ব্যাক্টেরিয়া জিওসমিন নামের অণু সৃষ্টি করে থাকে। যখন বৃষ্টির ফোটা ভূতল স্পর্শ করে তখন জিওসমিন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধের একটি নামও আছে ‘পেট্রিকোর’। ইসাবেল বেয়ার এবং আর জি থমাস নামক দুজন অস্ট্রেলীয় গবেষক ১৯৬০ সালে এই নামকরণ করেন। মজার বিষয় হলো, ভিজে মাটির এই ঘ্রাণ মানুষের কাছে এতটাই অনুভূতিশীল যে ভারতের উত্তর প্রদেশে সেকালে সুগন্ধি হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। নন্দিতার মোবাইলে গান বাজছে। অঞ্জন দত্তের জনপ্রিয় গান,
” একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে
থাকবেনা সাথে কোন ছাতা
শুধু দেখা হয়ে যাবে মাঝ রাস্তায়
ভিজে যাবে চটি, জামা মাথা
থাকবেনা রাস্তায় গাড়িঘোড়া
দোকানপাট সব বন্ধ
শুধু তোমার আমার হৃদয়ে
ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ”
( চলবে…)
. #মেঘের_বিপরিতে
(অষ্টম পর্ব)
হঠাৎ গান থেমে গেলো। নন্দিতা একমনে চোখ বন্ধ করে গান শুনছিলো। এভাবে গান থেমে যাওয়ায় একটু বিরক্ত হলো। ভ্রুঁ কুঁচকে ফোন হাতে নিলো। ইনকামিং কলে রেহালের নাম। নন্দিতার বিরক্তিকর ভাব মুহুর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেলো। ঠোঁটের কোণায় দেখা গেলো মিষ্টি হাসির ছোঁয়া। ফোন ধরার সাথে সাথেই অপর পাশ থেকে শোনা যাবে ‘কি করছো?’। রেহাল নন্দিতার সাথে কথা বলার সময় কখনোই ‘হ্যালো’ বলে না। কোনোরকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই প্রশ্ন করে বসে। নন্দিতা ফোন রিসিভ করলো,
“কি করছো?”
“এইতো বারান্দায় বসে আছি। তুমি?”
“অফিস থেকে ফিরে গোসল করলাম। তারপর খাবার গরম করে খেলাম। এখন শোবার ঘরে। তুমি খেয়েছো?”
“না। একটু পর খাবো। অফিস কেমন ছিলো আজ?”
“সবসময় যেমন থাকে তেমনি।”
নন্দিতা গলা পরিষ্কার করে বললো,
“ভিন্ন কোনো অনুভূতি হয় নি?”
“না তো। কেনো? ভিন্ন অনুভূতি হওয়ার কোনো কারণ আছে কি?”
“নতুন পিএ এসেছে। অনুভূতি না হওয়ার কোনো কারণও তো নেই।”
রেহাল কোনো উত্তর দিলো না। বৃষ্টির বেগ ক্রমশ বাড়ছে। মাঝে মাঝে বজ্রধ্বনি শোনা যাচ্ছে। নন্দিতা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। ফোনের অপর পাশের নিরবতা সে ভীষণ উপভোগ করছে। নন্দিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু বলতে পারলো না। তার আগেই রেহালের কন্ঠ শোনা গেলো।
“তুমি যে অনুভূতিটার কথা বলছো সেটা এখন অনুভব করতে পারছি। মেঘলা আকাশ, ঠান্ডা বাতাস। আজকে তোমার আমার সাথে থাকাটা অনেক বেশি প্রয়োজন ছিলো।”
নন্দিতা নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কেনো?”
“উত্তরটা আমার চেয়ে তুমি ভালো জানো, নন্দিতা। এমন আবহাওয়ায় একজন স্বামী তার স্ত্রীকে কেনো পাশে চাইবে? তুমি তো বিবাহিত। অভিজ্ঞতা নেই?”
রেহালের কন্ঠে দুষ্টুমি। নন্দিতা লজ্জায় চুপসে গেলো। তাদের বিবাহিত জীবনের চার বছর হতে চললো। অথচ রেহালের স্পর্শে এখনো নন্দিতা কেঁপে উঠে। ঠিক প্রথম স্পর্শে যেভাবে কেঁপে উঠতো। বিষয়টা রেহালও বুঝতে পারে। হয়তো সেজন্যই এসব প্রশ্ন করে মজা পায়। নন্দিতা নড়েচড়ে বসলো। প্রসঙ্গ পালটে বললো,
“ঢাকায় বৃষ্টি হচ্ছে?”
“না, কিন্তু হবে।”
“আমাদের এখানে সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি। কারেন্ট চলে গেছে। কখন বৃষ্টি থামবে, কখন কারেন্ট আসবে কে জানে!”
“তোমাকে মিস করছি, নন্দিতা।”
নন্দিতার চোখ ভিজে উঠলো। গলা চেপে আসতে লাগলো। কয় মাস পর রেহাল তার অনুভূতি ব্যক্ত করলো তা নন্দিতার মনে নেই। তবে কি সত্যিই সম্পর্কে দূরত্বের প্রয়োজন আছে? রেহাল আবার বলে উঠলো,
“চুপ করে আছো যে?”
প্রত্যুত্তরে নন্দিতা বললো,
“এমনি। আমিও মিস করছি তোমাকে”
আবারো কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা।
“ঠিকাছে। অফিসিয়াল কাজ আছে কিছু। সেগুলো শেষ করতে হবে। থাকো তাহলে। রাখছি।”
“ঠিকাছে।”

নন্দিতা ফোন পাশে রেখে দিলো। এখন আর তার গান শুনতে ইচ্ছে করছে না। বারান্দার দরজায় ক্যাঁড় করে বিচ্ছিরি শব্দ হলো। শারমিন বেগম এসেছেন। নন্দিতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“কি করছিস একা একা?”
“কিছু না। বসে আছি। বৃষ্টি দেখছি।”
“চা খাবি? বানিয়ে নিয়ে আসি?”
“না, মা। এখন আর চা খাবো না। তুমি বসো। গল্প করি।”
শারমিন বারান্দায় রাখা মাঝারি সাইজের টুল নিয়ে মেয়ের পাশে বসলেন। বৃষ্টির পানি ছিটে আসছে। তার শাড়ির নিচের অংশ ভিজতে শুরু করেছে। তিনি ব্যস্ত হয়ে বললেন,
“বৃষ্টির পানি না ছিটে আসছে? ঠান্ডা লেগে যাবে তো।”
” লাগবে না। একটু দেয়ালের দিকে চেপে বসো।”
শারমিন দেয়ালের দিকে সরে বসতে বসতে বললেন,
“জামাইয়ের সাথে কথা হয়েছে?”
“হুঁ। মাত্রই হলো।”
“খাবার দাবারে কষ্ট হচ্ছে না তো?”
“না। সব রান্না করে রেখে এসেছি। মাইক্রোওভেনে গরম করে খাচ্ছে। সমস্যা নেই।”
“কয়েকটা দিন থেকে গেলে কি হতো কে জানে!”
নন্দিতা কোনো উত্তর দিলো না। এই প্রশ্নের উত্তর দীর্ঘ এই কয় বছরে সেও কম খুঁজেনি! কিন্তু যথার্থ উত্তর পাওয়া যায় নি।
“আচ্ছা, নন্দিতা। তুই কি আর ডাক্তার দেখিয়েছিলি?”
হঠাৎ শারমিনের কন্ঠস্বর অন্যরকম শোনায়।
“দেখিয়েছি।”
“কি বলে ডাক্তার?”
নন্দিতা উদাস কন্ঠে বললো,
“ওই এক কথা। সমস্যা আমারো নেই, রেহালেরও নেই। তার পরেও কেনো কন্সিভ এ সমস্যা হচ্ছে এটা নিয়ে তারাও চিন্তিত।”
“রেহাল কিছু বলে?”
” না। এসব নিয়ে রেহাল কিছু বলে না। তবে রেহালকে বলে। ওর মা ওকে অনেক কিছুই বলে। নেহাত তোমার জামাই শিক্ষিত ছিলো! নইলে এতদিন তোমার মেয়ের সতিন নিয়ে সংসার করতে হতো।”
একথা বলে নন্দিতা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। আলোর ঝলকানিতে শারমিন দেখতে পেলো তার মেয়ের চোখ ছলছল করছে। সে টুল ছেড়ে উঠে মাদুরে গিয়ে বসলো। মেয়ের মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। নন্দিতা ধরা গলায় বললো,
“কাঁদছো কেনো মা?”
শারমিন বেগম কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলেন,
“মায়ের কাছে কষ্ট লুকাবি? আমি সব বুঝি। সব! জানিনা, কেনো সৃষ্টিকর্তা আমাদের এতবড় শাস্তি দিচ্ছেন।”
“শাস্তি আমাকে দিচ্ছে। আর ভুগছো তোমরা সবাই। আমাকে মাফ করে দিও মা।”

ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। মাটিতে বৃষ্টি পড়ার টিপ টিপ শব্দ হচ্ছে। সোঁদা গন্ধে ভরে আছে চারিদিক। এরই মাঝে অশ্রুসিক্ত নয়নে মাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কাঁদছে নন্দিতা। মায়েদের এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। তারা সন্তানদের মন পড়তে পারেন। তাদের কষ্ট আর কেউ বুঝতে পারুক বা না পারুক, মায়েরা ঠিক পারেন! নন্দিতা যদি কখনো মা হতে পারতো, হয়তো সেও এই ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী হতো।

(চলবে….)

লিখা: আতিয়া আদিবা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here