#মেঘের_পরে_মেঘ
পর্ব:০৩
জাহান আরা
রেহানা বেগম এবার পুরো আটঘাট বেঁধে নেমেছেন।বড় ভাইয়ের বউয়ের থেকে খবর পেয়েছেন সুরমার জন্য ছেলে দেখা হচ্ছে। এতোদিনে সুরমার মত করতে পেরেছে সবাই। খবরটা শোনার পর থেকে রেহানা বেগম চিন্তায় পড়ে গেলেন।তার উর্বর মস্তিষ্ক কাজে লাগিয়ে চমৎকার পরিকল্পনা করে ফেললেন তিনি।
ভাইয়ের বাড়ি এসেই তিনি মরাকান্না জুড়ে দিলেন।
রেহেনা বেগমের ভাই রফিকউল্লাহ,স্ত্রী সালেহা রেহানা বেগমের এই কান্না দেখে আশ্চর্য হলেন।রেহানা বেগমের ভরা সংসার। ছেলেরা সবাই ভালো রোজগার করে,সংসারে অভাব নেই,তাহলে এই কান্নার কারণ কি কেউ বুঝতে পারলেন না।
সোফায় বসে সুরমা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফুফুকে দেখছে।সুরমার ৪ ফুফুর মধ্যে রেহানা বেগম সবচেয়ে বেশি আদর করেন সুরমা কে।যদিও তার পিছনে ফুফুর স্বার্থ আছে একটা,সেটা সুরমা জানে।জানার পরেও এই মহিলাকে তার ভাল্লাগে।
শুধুমাত্র শাহেদের মা বলেই সুরমার এই মহিলাকে ভাল্লাগে।
কতোদিন শাহেদ কে দেখে না সুরমা!
বুকের ভিতর একটা গোপন কষ্ট সুরমা কে সারাক্ষণ কাঁদায়।কেনো শাহেদ তাকে ভালোবাসে নি?
কি দিতে পারতো না সুরমা তাকে?
রূপ-যৌবন কোনটার কমতি ছিলো সুরমার?
আজও সুরমা অপেক্ষা করছে শাহেদের।যদি একবার শাহেদ কে পেতো।
মাঝেমাঝে সুরমার ভীষণ যন্ত্রণা হয়,কেনো নিরুর কপাল এতো ভালো?
কেনো মেয়েটা শাহেদ কে পেলো?
রেহানা বেগম বিলাপ করে বললেন,”আমার শাহেদ একটা ডাইনী আনছে ঘরে রে ভাই,আমার সুখের সংসার তছনছ কইরা দিছে ওই ডাইনী।
আইজ আমারে ঘর থাইকা বাইর কইরা দিছে।আমি কই যামু,কে আছে আমার তোরা ছাড়া? ”
সুরমা খুশি হলো,নিরুর নামে অপবাদ শুনলে সুরমার আনন্দের সীমা থাকে না।
রফিক মিয়া হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলো,”কি কস তুই,তোরে বাইর কইরা দিছে কেমনে?
তোর পোলা কই আছিলো,সুমনের বাপেরে (রেহানা বেগমের বড় ছেলে সুমন) কস না তুই?
রেহানা বেগম আরো জোরে বিলাপ করে বললেন,”হ্যায় তো বিদাশে-বিঘাটে থাকে,বাড়ি থাকলে না হয় একটা বিহিত করতো,আমি আসার সময় বইলা আসছি ফোন কইরা।আমার বুঝি কপাল পুড়লো রে ভাই।”
সুরমা কটাক্ষ করে বললো,”খোঁজ খবর না নিয়া পোলা বিয়া করাইয়া আনসো,মাইয়ার স্বভাব চরিত্র কেমন তার খবর ও লও না।দ্যাশে কি মাইয়ার রাট(অভাব) পইরা গেছিলো নি?”
রেহানা বেগম ফোৎ করে নাকে সর্দি ঝেড়ে বললেন,”তাবিজ করছে রে মা,ওই ডাইনী আমার শাহেদরে তাবিজ করছে,মাইয়া দেখতে গেছে যখন অই সময় আমার শাহেদরে চিনি পড়া দিয়া শরবত বানাইয়া খাওয়াইছে,পান পড়া খাওয়াইছে,এর জন্যই তো আমার শাহেদ এতো দেওয়ানা হইছে।”
সুরমার মা আফসোস করে বললেন,”থাউক আপা,কাইন্দেন না,আসছেন যখন কয়েকটা দিন বেড়ান।”
রেহানা বেগম কন্ঠে কাঠিন্য এনে বললেন,”এই বার আমি সিদ্ধান্ত নিয়াই আসছি,হয় ওই বাঁজা মাইয়ারে আমার পোলা ছাইড়া দিবো,আর নাইলে ওই মাইয়ার উপরে আমি শাহেদরে আবার বিয়া করামু,আমার সুরমা মা’র মতন লক্ষ্মী একটা মাইয়ারে বিয়া করামু আমি ওরে,ওর বান্দীদ মাইয়া সতীনের ভাত খাইবো”
কথাটা শুনে সুরমার মুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো খুশিতে।এ তো মেঘ না চাইতে বৃষ্টি।
সুরমার মনে আনন্দ আর ধরে না।এতোদিনের স্বপ্ন কি এবার সত্যি হবে?
★
সকালে ঘুম থেকে উঠেই শাহেদ গোসল করে রেডি হলো,নিলু চুপচাপ নাশতা বানিয়ে এনে শাহেদের সামনে রাখলো।
শাহেদ রেডি হতে হতে বললো,”তাড়াতাড়ি রেডি হও নিলু।”
নিলু ঠান্ডা গলায় বললো,”আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি,আমি যাবো না কিছুতেই।”
নিলুর এই বাড়াবাড়ি রকমের জেদ শাহেদের কাছে অচেনা লাগলো। বরাবরই নিলুকে দেখেছে শান্ত থাকতে,তবে কেনো আজ সেই নিলু এতো কঠোর হলো?
শাহেদের মনে হলো হটাৎ করে যে নিলু কি বদলে গেছে?
পরক্ষণেই মনে পড়লো,নিলু যফি বদলায় ও তারজন্য শাহেদ দায়ী,শাহেদের পরিবার দায়ী।
নিলু শাহেদের এই নীরবতা দেখে বললো,”আমি আজ বাড়ি যাবো।”
শাহেদ প্যান্টের বেল্ট লাগাতে লাগাতে বললো,”কোনো দরকার নেই,তোমার সংসার এটা,এখানেই তোমার বাকী জীবন কাটাতে হবে।”
নিলুর সহ্য হলো না এরকম স্বার্থপরের মতো কথা।আর একটা কথা ও না বলে নিলু সোজা গিয়ে ব্যাগ গুছাতে লাগলো।
শাহেদ হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নিয়ে বললো,”তুমি কোথাও যাবে না।”
নিলু জোর গলায় বললো,”আমার বাপের বাড়ি আমি একশো বার যাবো,৬মাস ধরে বাড়ি যাই নি,আমার বুকের ভিতর কি পরিমাণ কষ্ট জমে আছে তা তুমি জানো না।আমাকে যেতেই হবে মায়ের কাছে।বাবার কবর দেখে আসবো,নিজের ভিতরে জমে থাকা কষ্ট সব বাবার কবরের কাছে বলে আসবো।”
নিলুর এসব কথা শুনে শাহেদের মাথায় রক্ত উঠে গেলো। কি এমন কষ্ট পাচ্ছে নিলু যে এভাবে বলছে।কিসের এতো কষ্ট?
নিলুকে জিজ্ঞেস করলো শাহেদ,”কি এমন কষ্ট তোমার?এখানে কি তোমার ভাত কাপড়ের অভাব,নাকি কিসের অভাব?”
নিলু মুখের উপর জবাব দিলো,”মায়ের অভাব এখানে আমার।”
“আমার মায়ের এটুকু তুমি সহ্য করতে পারো না নিলু?”
নিলু কিছু বললো না।শাহেদ তো জানো না যতক্ষণ শাহেদ বাসায় থাকে ততক্ষণ নিলুকে কতো অপমান হজম করে যেতে হয়।
নিলু এই প্রসঙ্গে কিছু বললো না।শাহেদের মনে নিজের মায়ের সম্পর্কে খারাপ ধারণা জন্মাক নিলু তা চায় না।তার জন্য মা ছেলের সম্পর্কে ফাটল ধরুক নিলুর তা কাম্য নয়।
নিজের জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো নিলু।শাহেদ অবাক হয়ে গেলো নিলুর এই সাহস দেখে।শাহেদের কথা অমান্য করছে নিলু আজ?
গোসল করে নিলু একটা হালকা গোলাপি সুতি শাড়ি পরে বের হলো।হালকা একটু সেজে নিলো মুখে ক্রিম,পাউডার,কাজল আর লিপস্টিক দিয়ে।
শাহেদের প্রচন্ড রাগ হলো।শাহেদ নিলুকে সবসময় বলতো,নিলু যাতে বাহিরে বের হবার সময় একটু ও না সাজে,নিলুর এই অপরূপ সৌন্দর্য অন্য কেউ যাতে না দেখে,অথচ নিলু কি-না সেজেছে!
রাগে চিৎকার করে শাহেদ বললো,”কার জন্য এতো সেজেগুজে বের হচ্ছো তুমি?
কাকে দেখাতে যাচ্ছো?
আমি নিষেধ করার পরে ও তুমি সেজেছো কেনো,তবে কি মায়ের কথাই ঠিক?
এসব রংঢং করতেই তুমি চাকরি করতে চাইছো?”
প্রতিবাদের কোনো ভাষা খুঁজে পেলো না নিলু,নিলু ভেবেছিলো সাজলে শাহেদে নিজেই এগিয়ে আসবে নিলুর কাছে,হয়তো এসে নিলুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে,আর তাতেই নিলুর মনের সব কষ্ট মুছে যাবে।কিন্তু এখন দেখছে বিষয় টা অন্যরকম ভেবে নিয়েছে শাহেদ।
নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলো নিলু,”তবে শাহেদ কি আমাকে অবিশ্বাস করছে?”
চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো নিলুর এটা ভাবতেই।না আর একটা কথা ও বলবে না সে শাহেদের সাথে।
নিলুকে চুপ দেখে শাহেদ বললো,”নিলু,আমার একটা কথা শুনে রাখো,মনের কষ্ট দূর হলে ফরে আসবে বুঝলাম,তবে জেনে রাখো আমি চাই না তুমি চাকরি করো।কোনোভাবে তুমি ইন্টারভিউ দিতে যাবে না কোথাও।২ দিন থেকে চলে আসবে বাড়িতে।যে চাকরি নিয়ে এতো অশান্তি সেই চাকরি আমি তোমাকে করতে দিবো না। ”
নিলু দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দিলো,”আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি একাউন্টিং থেকে,একটা ভালো রেজাল্ট করেছি,আমার যোগ্যতা কে রান্নাঘরে আর হাড়ি পাতিলে সীমাবদ্ধ করে রাখার জন্য নয়,যে রাঁধে সে চুল ও বাঁধে।আমার বাবা নেই,ভাই নেই।সংসারের হাল আমাকে ধরতে হবে।
৩টা বোনকে মানুষ করতে হবে।তার জন্য যা করতে হয় আমি করবো শাহেদ,যদি তোমার মায়ের কথা অনুযায়ী সংসার ছাড়তে হয় তাতেও আমি রাজি।”
শাহেদ কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিলু ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে এলো।
হতভম্ব শাহেদ দাঁড়িয়ে নিলুর গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলো।
চলবে…..?
(রিচেক দিই নি,টাইপিং মিস্টেক হলে দুঃখিত)