মেঘের_পরে_মেঘ পর্ব ৪

#মেঘের_পরে_মেঘ
পর্ব:০৪
জাহান আরা

চেনা নিলুর এই অচেনা রূপ শাহেদকে হতভম্ব করে দিলো।কিন্তু শাহেদ জানে না তার জন্য আরো অনেক বড় চমক অপেক্ষা করে আছে।

মামার বাড়িতে গিয়ে শাহেদ দেখলো রেহানা বেগম আর সুরমা সামনের বারান্দায় বসে কী নিয়ে যেনো ফুঁসফুঁস করছে।
শাহেদ মা’কে সালাম করলো।অনেক দিন পর শাহেদ কে দেখে সুরমার পুরো শরীর উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলো। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। সুরমা আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না শাহেদ কে ছাড়া।
এই সেই শাহেদ,সুরমার স্বপ্নের শাহেদ।সুরমার স্বপ্নের পুরুষ।
প্রার্থনায়,মোনাজাতে,ধ্যানে,জ্ঞানে,শয়নেস্বপনে,মনেপ্রাণে যেই শাহেদ কে জপে গেছে সেই কিশোরী বয়স থেকে,এই সেই শাহেদ।
শাহেদকে অবাক করে দিয়ে সুরমা শাহেদ কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।
কতো বছর পর শাহেদের গায়ের ঘ্রাণ পেলো সুরমা,খুব গভীর ঘ্রাণ।
যে ঘ্রাণ মানুষ কে মাতাল করে দেয়,যে ঘ্রাণ পেলে মানুষ ভুল করে ফেলতে ও একবার ভাবে না।

রেহানা বেগম সেখান থেকে উঠে গিয়ে ভিতরে চলে গেলেন।

এরকম অপ্রস্তুত অবস্থায় শাহেদ কখনো পড়ে নি।
ভীষণ রাগ হলো শাহেদের।

এক ঝটকায় সুরমাকে সরিয়ে দিয়ে বললো,”এসব কেমন অসভ্যতা সুরমা?আমি এসব আগেও পছন্দ করতাম না,এখনো পছন্দ করি না।”

লজ্জায়,অপমানে লাল হয়ে গেলো সুরমা।

শাহেদের কথার উত্তরে বললো,”পছন্দ করো না?
তোমার নিলু যখন ঝাপ্টাইয়া ধরে তোমারে তখন ও কী তার থেকে নিজেরে ছাড়াইয়া লও?
তারে তো ঠিকই আদরে,সোহাগে ভরাইয়া দাও।ক্যান আমার বেলায় সবসময় আইসা এরকম করো,ক্যান দেয়াল তুইল্লা দাও দুজনের মইধ্যে?
ক্যান বারবার মুখ ফিরাইয়া নাও?
রোজ রোজ এক খাবার মানুষ খায় কেম্নে?”

সুরমার এই অসভ্য কথা শাহেদ নিতে পারলো না।শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে থাপ্পড় বসালো সুরমার গালে।
ভিতরে ঢুকে মা’কে বললো,”আমি বেশ ভালো করে বুঝতে পারছি এখন মা,কেনো তুমি এই বাড়ি এলে।
তোমার উদ্দেশ্য আমার কাছে পরিষ্কার। তবে তুমি যা চাইছো তা কখনো হবে না।নিলু আমাকে ছেড়ে চলে গেছে মা।তোমার সংসারে তুমি ফিরে যেতে পারো।তবে তুমি যদি ভাবো আমাকে আবার বিয়ে করাবে কৌশল করে,তবে ভুল ভাবছো। আমি আর বিয়ে করবো না।ভয় পেও না,আমি নিলুকে ও ফিরিয়ে আনবো না যদি না সে নিজ থেকে ফিরে আসে অথবা তুমি গিয়ে নিয়ে না আসো”

এক মুহূর্ত আর না দাঁড়িয়ে শাহেদ বের হয়ে গেলো। রেহানা বেগমের পাতা ফাঁদে পা দিলো না শাহেদ।ভীষণ রাগ হলো রেহানা বেগমের সুরমার উপর।
শাহেদের সাথে এরকম গায়ে পড়া ভাব কেনো করতে গেলো সুরমা এখনই!

রিকশা ডেকে এনে রেহানা বেগম ও নিজের বাড়ি চলে গেলেন।
সুরমা একটা কথা ও বললো না।

সাবিনা বেগম ৬ মাস পরে মেয়েকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেললেন।নিলুর বাকি তিন বোন শিলু,নিরু,মিরু এসে নিলুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। যেনো সাত রাজার ধন খুঁজে পেয়েছে।
সাবিনা বেগম নিলুকে জিজ্ঞেস করলেন,”জামাই আসবে কখন?
দুপুরের খাবার এসে খাবে তো এখানে?”

নিলু এখনই মা’কে কিছু বলতে চায় নি।কিন্তু মা’কে না বললে মা শাহেদ আসার অপেক্ষায় থাকবে ভেবে সিদ্ধান্ত নিলো মা’কে সব খুলে বলবে।

“শাহেদ আসবে না মা।আমি একেবারে চলে এসেছি।”

নিলুর কথা শুনে ঘরের সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো। কি বলছে এসব নিলু?
স্বামী,সংসার ফেলে নিলু চলে এসেছে?

এতো বছর ধরে যেসব কথা নিলু নিজের ভিতরে জমিয়ে রেখেছিলো,সংসারের সব কষ্ট,সব যন্ত্রণা সব খুলে বললো মা-বোনদের।
শুনতে শুনতে চোখ ভিজে গেলো সবার।
নিরুটা খুবই আবেগী,বোনের এসব মেন্টাল টর্চারের কথা শুনে নিলুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।

বোনকে নিজের কোলে শুইয়ে দিয়ে নিলু বাকী ঘটনা খুলে বললো।
সবার মধ্যে মিরু একটু বেশি ডানপিটে। নিজের চোখ মুছে বললো,”বেশ করেছিস আপা,আর কখনো ফিরে যাবি না তুই ওখানে,আমরা তিন বোন যদি থাকতে পারি তুই ও পারবি এখানে থাকতে।অশান্তিতে থেকে তিন বেলা মাছ ভাত খাওয়ার চাইতে শান্তির উপোস থাকা ভালো। যে ভাত তোর গলা দিয়ে নামবে এখানে অন্তত খোঁটা দিয়ে তো কেউ আর সেটা পেট থেকে বের করে আনবে না এখানে।”

সাবিনা বেগম নিলুর হাত ধরে বললেন,”আমার সংসারের জন্য নিজের সংসার ভেঙে এলি মা?
আমি এতো হতভাগী মা হলাম যে মেয়ের সংসার জোড়া লাগানোর জন্য ওদের খুশি করতে কিছুই দিতে পারছি না।”

শিলু বললো,”দিবে না মা,বেশ করেছে আপা।আজ তুমি তোমার মেয়ের শান্তির জন্য ওদের চাহিদা মতো জিনিসপত্র পাঠাবে,কাল অন্য কেউ তোমার পাঠানো এসব দেখে তার ঘরের বউকে কথা শোনাবে,মা সমাজে এই অন্যায় এভাবেই বাড়তে থাকবে।যৌতুক দিয়ে কেনো মেয়ে বিয়ে দতে হবে মা?মেয়েরা কি এতোটাই অবহেলিত?”

নিলু বললো,”আমার শাশুড়ীর বিয়ে হয়েছে নিশ্চয় ৩৫ বছরের বেশি। এতো বছর ধরে কি উনি পারেন নি নিজের সংসার সাজানোর জন্য জিনিসপত্র কিনতে,৩৫ বছর ধরে উনি অপেক্ষায় ছিলেন কি এ জন্য যে তার ছেলেদের শ্বশুর বাড়ি থেকে পাওয়া জিনিস দিয়ে নিজে ঘর সাজাবেন?
মা এই সমাজটা এভাবেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আজ আমি প্রতিবাদ করছি,কাল আমার দেখা দেখে অন্য কেউ করবে।
তুমি ভেবো না মা।এই সমাজ বদলাবে এভাবেই একদিন। ”

মেয়েদের মনোভাব সাবিনা বেগম বুঝলেন।কেমন একটা গর্বে তার বুক ভরে গেলো। নিজের সব কষ্ট সার্থক হলো আজ। তার মেয়েরা মানুষ হয়েছে। তিনি পেরেছেন মেয়েদের প্রতিবাদী করে গড়ে তুলতে। ”

দুপুরে সাবিনা বেগম লাল লাল করে আলু ভাজলেন,শুকনো মরিচ দিয়ে আলু ভর্তা করলেন,বেশি করে রসুন দিয়ে শুঁটকি মাছ রান্না করলেন প্রচুর ঝাল দিয়ে,ডিম ভাজি করলেন।সাথে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত।

পাটি পেতে খাবার বেড়ে মেয়েদের ডাকলেন খেতে,মেয়েরা সবাই একসাথে বসে গল্প করছে নিজেদের রুমে।মায়ের ডাক শুনে সবাই উঠে এলো,নিলু সবাই কে যেতে বলে নিজের মোবাইল হাতে নিলো।

মেসেজ চেক করে দেখলো কোনো মেসেজ আসে নি।
একটা দীর্ঘশ্বাস বুক থেকে বের হয়ে এলো।প্রতিদিন দুপুরে শাহেদ একবার টেক্সট করে নিলুকে,খেয়ে নিতে বলে টেক্সট করে। আজ করলো না।

কাঁদতে গিয়ে ও কাঁদলো না নিলু।
নিজেকে বুঝালো শক্ত হতে হবে।শাহেদ আমার নেই আর এখন।আমি সব মায়া ত্যাগ করে চলে এসেছি।শাহেদ ওর মায়ের ইচ্ছে পূরণ করবে হয়তো বিয়ে করে। ওদের বাচ্চা দরকার আমি তো দিতে পারি নি তা।
আমার প্রতি আগের ভালোবাসা থাকলে গত রাতে এভাবে মারতো না আমায়,আজ সকালে এভাবে বাজে কথা বলে সন্দেহ করতো না আমায়।

সাবিনা বেগম আবার ডাকতেই নিলু ফোন রেখে উঠে গেলো। নিজের পছন্দের সব খাবার দেখে অজান্তেই চোখে পানি চলে এলো।
মমতাময়ী মা বুঝি একেই বলে!
আফসোস,আল্লাহ তাকে বাঁজা মেয়ে বানিয়েছে।সে হয়তো কখনো এরকম ভালোবেসে নিজের সন্তানের পছন্দের কিছু রাঁধতে পারবে না।

মন খারাপ কে একপাশে সরিয়ে খেতে বসলো নিলু।

শাহেদ দুপুরে খেতে বসে ও খেতে পারলো ঠিক করে। দু নলা ভাত মুখে দিয়ে পানি ঢেলে উঠে গেলো। কি করবে বুঝতে পারছে না।
নিলুকে কি ফিরিয়ে আনবে?

পরক্ষণেই মনে পড়লো নিলু কিভাবে সব ছেড়ে চলে গেছে।কি বলে চলে গেছে।
শাহেদ তো চায় নি নিলুর ইচ্ছেতে বাঁধা দিতে,নিলু চাকরি করলেও শাহেদের আপত্তি ছিলো না বরং উৎসাহ ছিলো। কিন্তু মা’কে ও চটাতে চায় নি।তারজন্য তো নিলুকে নিষেধ করলো। নিলু কেনো বুঝলো না শাহেদের অবস্থা?
কেনো নিলু চলে গেলো এভাবে?

একবার ভাবলো না শাহেদ কিভাবে থাকবে নিলুকে ছাড়া?

চলবে…..???

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here