মেঘের_পরে_মেঘ পর্ব ৬

#মেঘের_পরে_মেঘ
পর্ব:০৬
জাহান আরা

সকাল থেকে নিকু ভীষণ ব্যস্ত। মা’কে নিয়ে বাসা দেখতে গেলো নিলু।
অনেক খুঁজে মনের মতো একটা বাসা পেলো।তিন বেড রুম,ডাইনিং,ড্রয়িং,২টা টয়লেট,বারান্দা সব মিলিয়ে খুব সুন্দর বাসা।
ভাড়া কিছুটা বেশি হলেও নিলুর ভালো লাগলো বাসাটা।
মা এবার একটু যদি শান্তি পায়,সারাজীবন তো কাটিয়েছে বাবার করে যাওয়া ঘুপচি দুটো রুমের মধ্যে। নিজেকে বন্দী করে রেখেছিলো সারাজীবন ওই দুই রুমে।

বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক মধ্যবয়সী,তার ব্যবহারে নিলু সন্তুষ্ট হলো।ভদ্রলোকের নাম আশরাফুল ইসলাম আর তার স্ত্রীর নাম রোকসানা।নিলুর কাছে বেশি ভালো লাগলো তার স্ত্রী কে।ভদ্রমহিলা পান খেয়ে ঠোঁট টুকটুকে লাল করে ফেলেছেন,মনে হয় যেনো টিয়া পাখির ঠোঁট।
নিলু ঠিক করলো মাঝেমাঝে ওনার সাথে এসে পান খেয়ে যাবে।

মা’কে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে নিরু,মিরুর স্কুলে গেলো টিসি আনার জন্য।
বাসায় ফিরলো বিকেলের দিকে।সবাই নিলুর জন্য অপেক্ষা করছিলো।
বাসায় ফিরে নিলু গোসল সেরে নিলু।শিলু রান্না করে রেখেছে আজ। পাটি পেতে সবাই মিলে খেতে বসলো।খেতে বসে দেখলো ডালে লবণ কম হয়েছে।ভয়ে শিলুর মুখ শুকিয়ে গেলো।
নিলু হেসে বললো,”ভয় পাচ্ছিস কেনো,ভুল করতে করতে তো পরে ঠিক হবে।”

খাওয়া শেষ করে নিলু বোনদের বললো সবাই সবার জিনিস ঘুচিয়ে নিতে,সকাল বেলায় মিনি ট্রাক আসবে একটা।
তিন বোন উৎসাহ নিয়ে ঘুচানোর কাজে লেগে গেলো। মায়ের ফোন নিয়ে মিরু ফুল সাউন্ড দিয়ে গান চালিয়ে দিলো,গানের সুরের সাথে তাল মিলিয়ে তিন বোন কাজ করছে।
নিলু নিজের ফোন চার্জে রেখে নিজের জিনিস ঘুচাতে গেলো।

শাহেদের বুকের ভিতর এক অজানা ঝড় উঠেছে।ভেবেছিলো নিলুকে ফোন দিবে না কিন্তু এখন দেখছে সহ্য হচ্ছে না তার আর এই বিচ্ছেদ। তার স্ত্রী তার দোকানের সামনে দিয়ে আসা যাওয়া করছে অথচ একটা বার তাকাচ্ছে না!.
কেনো এতো অবহেলা করছে তাকে নিলু জানতে হবে শাহেদের।
ফোন হাতে নিয়ে নিলুকে কল দিতে গিয়ে শাহেদ টের পেলো তার হাত কাঁপছে ভীষণ।
গলা শুকিয়ে গেছে।
পানির বোতল থেকে এক চুমুক পানি খেয়ে নিলুকে কল দিলো শাহেদ।

কল রিসিভ করলো না নিলু,শাহেদ আবারও কল দিলো।
এবার ও রিসিভ হলো না।শাহেদের মনে হলো নিলু ইচ্ছে করে কল রিসিভ করছে না।
আরো ৫ বার কল দিলো শাহেদ নিলুকে,গানের শব্দের জন্য নিলু অন্য রুমে থেকে কিছুই শুনতে পেলো না।
শেখার বার যখন রিং হচ্ছিলো,শিলু এসেছে এই রুমে নিজের বই গুছাতে এসেই দেখে শাহেদের ফোন।চার্জার থেকে ফোন নিয়ে শিলু দৌড়ে গেলো নিলুর কাছে।নিলুর কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে কল কেটে গেলো।

শাহেদের প্রচন্ড রাগ হলো। নিলু কি চায় না তবে শাহেদের সাথে কথা বলতে?
এজন্যই কি অবহেলা করছে নিলু এভাবে।
হটাৎ শাহেদের মনে হলো অন্য নাম্বার থেকে কল দিয়ে দেখবে,যদি ফোন নিলুর কাছে থাকার পরে ও নিলু ইচ্ছে করে এরকম অবহেলা করে তবে শাহেদ আর কখনো নিলুর সাথে যোগাযোগ করবে না।
কিছুতেই না।

নিজের দোকান থেকে বের হয়ে পাশের দোকানদারের ফোনটা চেয়ে নিলো শাহেদ।তারপর আবার ডায়াল করলো নিলুর নাম্বারে।

আবার ফোন বাজতেই নিলু কল রিসিভ করলো।
শাহেদ ভেবে নিলো ওর ধারণা ঠিক। নিলু ইচ্ছে করে ওকে অবহেলা করছে।
রাগে জিদে শাহেদ নিলুকে কিছুই বলতে পারলো না।শাহেদ বলতে পারলো না নিলু চলে যাবার পর প্রতি রাত শাহেদের নির্ঘুম কাটে,বলতে পারলো না রাতে বাসায় ফিরে এখন আর চা খেতে পারে না,কেউ চা এনে দেয় না এখন আর।
শাহেদের জন্য অল্প ঝাল দিয়ে কেউ রান্না করে না এখন।
মাঝরাতে ক্ষিধে পেয়েছে বললে কেউ খাবার এনে দেয় না।
গোসল করে কারো জন্য লুঙ্গি ফেলে আসতে পারে না বাথরুমে।
সকালের চা’টা বাজারে এসে খেতে হয়।

এসব কিছুই বলতে পারলো না শাহেদ বরং বললো,”আমার ফোন থেকে কল দিলে তো রিসিভ করো না,অন্য নাম্বার থেকে কল পেলে রিং হবার সাথে সাথেই রিসিভ হয়ে যায় নিলু।এতো বদলে গেলে?
এই দুদিনের বিচ্ছেদে এরকম পরিবর্তন তোমার?
আর আমি কি-না মিছেমিছি অপেক্ষায় ছিলাম তোমার।”

নিলুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলো।নিজের ফোন থেকে নিলুর নাম্বার ব্লাকলিস্টে ফেলে দিলো।

নির্বাক হয়ে বসে রইলো নিলু।কানে বাজছে শাহেদের বলা কথাগুলো।
হঠাৎ নিলুর মনে হলো শাহেদ ওকে সন্দেহ করছে?

ফোনটা আবার চার্জে রেখে নিলু লম্বা হয়ে শুয়ে পরে।যে মানুষ এই ছোট একটা বিষয় নিয়ে এরকম রিয়েক্ট করে তাকে নিলু কিছুতেই কল দিয়ে সত্যিটা জানাবে না।সে কিছুই বিশ্বাস করবে না।
মনে মনে নিলু আল্লাহ কে বললো,”আমাকে শক্তি দাও আল্লাহ।সব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে যেনো সামনে এগুতে পারি।আমার মনকে দুর্বল করো না,আমাকে কঠোর করে দাও।”

পরদিন সকালে সব বেঁধে নিয়ে মিনি ভার্সন রওনা হলো।
সাথে দুটো সিএনজি তে করে নিলুরা সবাই গেলো।শাহেদের দোকানের সামনে আসতেই নিলুর মনে হলো নিজের কলিজাটা যেনো নিকু এখানেই রেখে যাচ্ছে।
এক পলক তাকালো ভিতরের দিকে।দেখতে পেলো শাহেদ ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম বের করছে।

এক মুহুর্তের জন্য নিলুর ইচ্ছে হলো সবকিছু ছেড়ে শাহেদের বুকে ঝাপিয়ে পড়তে।পর মুহুর্তে নিজেকে সামলালো নিলু।তাকে এখন কঠোর হতে হবে।

বাসা দেখে শিলু,নিরু,মিরু হতবাক।এতো বড় বাসা ওরা প্রত্যাশা করে নি।রুমের সাথে বড় বড় বারান্দা ওদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করলো।
তিন বোনের আনন্দ দেখে নিলু নিজের মনের কষ্ট ভুলে গেলো।
সব ঠিকঠাক করতে করতে দুপুর হয়ে গেলো। নিলু সবাইকে থাকতে বলে বের হলো হোটেল থেকে খাবার কিনে আনার জন্য।বের হতেই বাড়িওয়ালি চাচী সাথে দেখা হলো।উনি খাবার নিয়ে এসেছেন নিলুদের জন্য।
ভিতরে এসে সবাইকে দেখে হাসিমুখে সাবিনা বেগম কে বললেন,”আপা,আপনারা তো আজকে অনেক ব্যস্ত থাকবেন তাই ভাবলাম আজকে আপনাদের খাবারের ব্যবস্থা আমার বাসায় হোক।আমি নিজেও খাই নি আপনাদের সাথে খাবো বলে।”

সাবিনা বেগম খুশি হয়ে ডাইনিং হলে পাটি বিছিয়ে নিলেন।
নিলু বললো,”আপনি আমাদের জন্য বাড়তি কষ্ট করলেন চাচী।”

তিনি হাসিমুখে বললেন,”কি করমু মা কও,আমার তো কোনো সন্তান নাই,বাসায় মানুষ দুই জন আমর।আমি আর তোমার চাচা।সারাদিন তো অবসর থাকি,কথা বলার জন্য ও কাউরে পাই না।
অন্য ভাড়াটিয়া আছে কিন্তু সবার বাসায় পুরুষ মানুষ আছে,তাই কারো বাসায় যাওয়া হয় না।তোমাদের দেখে বড় আপন মাঝে হলো।”

খাবারের আয়োজন দেখে সবাই মুগ্ধ হলো,চিকন চালের ভাত,গরুর মাংস ভুনা,ইলিশ মাছের ডিম,ফুলকপি দিয়ে ইলিশ মাছ রান্না,মুরগির রোস্ট,মুগডাল,শুটকি ভর্তা।

সবাই মিলে খেতে বসলো। খেতে খেতে অনেক বিষয় নিয়ে কথা হলো।নিলুর কথা শুনলেন রোকসানা বেগম।শুনে মুগ্ধ হলেন,মেয়েটি কি সাহসী তা ভেবে ভীষণ ভালো লাগলো তার।

খাবার পর রোকসানা বেগম কাপড়ের আঁচল থেকে এক খিলি পান বের করলো।
নিলু বললো,”চাচী পান খাবো আমিও। ”

নিলুর কথা শুনে শিলু,নিরু,মিরু ও বললো ওরা ও পান খাবে।রোকসানা বেগম হেসে উঠে বললেন,”একটু খারাও মা জননীরা,আমি অহনই পান আন্তাছি।”
সিড়ির মুখে গিয়ে রেশমা বলে কাউকে ডেকে বললেন উপিরে তার পানের বাটা নিয়ে আসতে।পরমুহূর্তে রেশমা এলো পান নিয়ে।
আয়েশ করে সবাই মিলে পান খেলো।

বাকীটা সময় কাটলো গল্প করতে করতে।

চলবে…..??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here