মেঘের_পরে_মেঘ পর্ব শেষ

#মেঘের_পরে_মেঘ
পর্ব:০৮(শেষ পর্ব)
জাহান আরা

শাহেদের জ্ঞান ফিরলো ৪ ঘন্টা পর।চোখ মেলতেই দেখতে পেলো হাসপাতালে শুয়ে আছে।গলা পর্যন্ত চাদর দিয়ে ঢাকা।মাথাটা কেমন ভারী হয়ে আছে।নড়াচড়া করতে পারছে না।কি হয়েছে তার বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো। তারপর বুঝতে পারলো এক্সিডেন্ট করেছে সে।

শাহেদের জ্ঞান ফেরার খবর পেয়ে ডাক্তারের সাথে রেহানা বেগম ও কেবিনে এলেন।ছেলের এরকম অবস্থা দেখে রেহানা বেগমের বুক কেঁপে উঠলো।
তার সোনার ছেলে কেমন বিমর্ষ হয়ে শুয়ে আছে।

হাসপাতালের সবুজ পোশাকটা যেনো একটা মূর্তিমান অভিশাপ।
শাহেদ মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তারপর ডাক্তার কে বললো,”আমি নড়াচড়া করতে পারছি না কেনো?”

ডাক্তার হেসে জবাব দিলো,”চিন্তার কিছু নেই ইয়ং ম্যান।তোমার একটা হাত,একটা পা ভেঙে গেছে খুব বাজেভাবে।প্ল্যাস্টার করে দিয়েছি।শরীরে অনেক জায়গায় কেটে গেছে।
তবে দীর্ঘদিন তুমি হাটা চলা করতে পারবে না।২ মাস প্ল্যাস্টার রাখতে হবে তোমার।”

শাহেদের মন খারাপ হয়ে গেলো শুনে।দুই মাস!
৬০ দিন।১৪৪০ ঘন্টা।৮৬৪০০ মিনিট।৫১৮৪০০০ সেকেন্ড। ভাবতেই চমকে উঠলো শাহেদ।এতোটা সময় শাহেদ ঘরে বন্দী হয়ে থাকবে?
তাও যদি নিলু থাকতো বাসায় সময় কাটতো।

মায়ের দিকে তাকিয়ে শাহেদ জিজ্ঞেস করলো,”নিলুকে খবর দিয়েছো মা?”

রেহানা বেগম মাথা নেড়ে জানালেন,দেননি খবর। এতো চিন্তার ভিতরে রেহানা বেগমের মনে ও ছিলো না নিলুর কথা।
শাহেদ বললো,”ভালো করেছো মা,ওকে কিছু বলার দরকার নেই।”

রেহানা বেগমের বুক ভারী হয়ে গেলো।ছেলেটা নিশ্চয় খুব যন্ত্রণাতে আছে।তার ভীষণ ইচ্ছে করতে লাগলো নিলুকে খবর দিতে।নিলুকে ছাড়া তনি বেশ হাঁপিয়ে উঠেছেন।এখন শাহেদের আবার এই অবস্থা।
কে করবে শাহেদের দেখাশোনা?

ব্যাংক থেকে বাসায় ফিরলো নিলু সন্ধ্যার দিকে।নিলুর ভীষণ শরীর খারাপ লাগছে।কেমন বমি বমি পাচ্ছে নিলুর।বাসায় আসার আগে ফার্মাসিতে গেলো নিলু,নিজের কিছু দরকারি জিনিস আর মায়ের ঔষধ নিলো।
বাসায় এসে মা’কে ডেকে বললো,”আমাকে একটু লেবুর শরবত দাও মা।আমার ভীষণ মাথা ঘুরছে।”

সাবিনা বেগম তড়িঘড়ি কিচেনে চলে গেলেন ।
শিলু,নিরু,মিরু বসে আছে নিলুর বিছানায়।শিলু বসে বসে টেস্ট পেপার পড়ছে।নিরু আর মিরু ছবি আঁকছে বসে বসে।
নিলুর মুখ থমথমে দেখে ৩ বোন সচেতন হয়ে গেলো। বুঝে গেলো এখন আর কোনো দুষ্টুমি করা যাবে না।আপার নিশ্চয় শরীর খারাপ করছে।

নিলু ওয়াশরুমে গেলো। ৩ বোন নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো।আপার মন খারাপ দেখলে ওদের ও মন খারাপ হয়ে যায়। আপার সাথে ওদের মন কেমন ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে।

ওয়াশরুম থেকে বের হলো নিলু হাসিহাসি মুখ নিয়ে।তিন বোন স্বস্তি পেলো যেনো নিলুর হাসিমুখ দেখে। সাবিনা বেগম এনে শরবত দিলেন নিলুকে।
নিলু পুরোটা শরবত খেয়ে নিলো।তারপর মা’কে বললো,”মা চলো,আজ আমরা সবাই মিলে চাইনিজ খেতে যাই।”

নিলুর কথা শুনে সবাই খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো।
সাবিনা বেগম বললেন,”কোনো দরকার নেই এক কাঁড়ি টাকা খরচ করার এখন বাহিরে খেতে গিয়ে।আমি রান্না করেছি ঘরে খাবি।”

নিলু বললো,”আহা মা,চলো না।আচ্ছা মনে করো এটা একটা ট্রিট তোমাদের সবার জন্য আমার পক্ষ থেকে।”

শিলু বললো,”রিজন কি আপা?”

নিলু হেসে দিলো। তারপর বললো,”রেডি হ গিয়ে আগে,বেশি কথা বলিস তুই।”

সাবিনা বেগম মেয়েকে একটা ধমক দিতে চেয়েও চুপ হয়ে গেলেন।
আল্লাহ মেয়েটার মনে কতো কষ্ট দিয়েছেন।এভাবে করে যদি মেয়েটা একটু হাসিখুশি থাকে তাহলে সমস্যা কি।

রেহানা বেগম শাহেদের বেডের পাশে বসে ছিলেন।
শাহেদ বসে বসে নিলুর কথা বলছে রেহানা বেগম কে।নিলুকে নিয়ে কতো স্মৃতি শাহেদের, সব মায়ের কাছে বলছে।
ছেলের কথা যতো শুনছেন,রেহানা বেগমের ততোই বুক ভারী হয়ে উঠছে।বারবার তিনি লজ্জা পাচ্ছেন।
ঘরের লক্ষ্মী তিনি পায়ে ঠেলেছেন।কি করবেন এখন তিনি।

শাহেদকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দিলো ৩ দিন পরে।এই ৩ দিনে শাহেদের মুখ শুকিয়ে গেছে,চোখ কোটরে ঢুকে গেছে।গালে খোঁচাখোঁচা দাড়ি।চোখের নিচে কালশিটে।

রেহানা বেগম বাড়ি আসার পর আতান্তরে পরে গেছেন।বড় বৌ,মেজো বৌ কেউ শাহেদের দিকে ফিরে ও তাকায় না।রেহানা বেগমকে একবার ছুটতে হয় রান্নাঘরে,আবার ছুটতে হয় ছেলের ঘরে।

রান্নার ঝামেলা না থাকলে আর কোনো সমস্যা হতো না রেহানা বেগমের। ছেলের কাছে বসে থাকতে পারতেন তিনি।বড় দুই ছেলের কথাবার্তা ও কেমন হয়ে গেছে শাহেদের এক্সিডেন্টের সাথে সাথে।সকালে মেজো বউ এসে বললো ওরা একটা বাসা দেখেছে,দুই জা ওখানে গিয়ে উঠবে।গ্রামের পরিবেশে ওদের বাচ্চারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

কিছু বললেন না রেহানা বেগম,শুধু নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলেন এই কি ছিলো আমার কপালে?

শুক্রবারে নিলু সকাল বেলা বাসা থেকে বের হলো। মা’কে কিছু বললো না।কাউকে সাথে ও আনলো না।কিছুদিন ধরে যেসব সিম্পটম দেখা দিয়েছে তার জন্য ডাক্তার দেখাতে এসেছে নিলু।নিজে টেস্ট করার পর ও নিলু কনফিউজড।

ইউরিন টেস্ট করার পর ডাক্তার নিলু কে সুখবর টা দিলো।নিলুর মধ্যে যেটুকু সন্দেহ ছিলো তাও দূর হয়ে গেছে আজ।এতোদিনে নিলুর দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন ভেবে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো নিলু।

হাসপাতাল থেকে বের হয়ে সিএনজি নিলো নিলু।সিএনজি তে বসে ঠিক করলো আজকে বাসায় যাবে না।শাহেদের কাছে যাবে।এই সুখবর সবার আগে শাহেদকে জানাবে সে।এতোদিন নিজেদের মধ্যে যাই হোক না কেনো,এরকম একটা আনন্দের খবর সবার আগে জানার অধিকার শাহেদের আছে।

শাহেদের দোকানের সামনে এসে দেখলো দোকান বন্ধ হয়ে আছে।কিছু না ভেবে নিলু সিএনজি নিয়ে শাহেদদের বাড়ি চলে গেলো। সিএনজি থেকে নামতেই নিলুর পুরো শরীর কেঁপে উঠলো।
এই সেই বাড়ি,কতো সুখের,দুঃখের স্মৃতি এই বাড়িকে ঘিরে।
ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো রেহানা বেগম রান্নাঘরে।ঘামে রেহানা বেগমের সারা শরীর ভিজে আছে। এই কয় দিনে নিলুর মনে হচ্ছে রেহানা বেগম যেনো অনেক বুড়িয়ে গেছেন।
ভীষণ মায়া হলো নিলুর রেহানা বেগমের জন্য।

ভিতরে থাকা সব রাগ,ক্ষোভ,অভিমান সব ভুলে গেলো নিলু।
পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো নিলু রেহানা বেগম কে।তারপর সালাম দিলো।

ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন রেহানা বেগম নিলুকে দেখা।তারপর চিৎকার করে কেঁদে দিলেন।
নিলু এই কান্নার কারণ কি বুঝতে পারলো না।রেহানা বেগম কে জিজ্ঞেস করলো নিলু শাহেদের কথা।

ফ্যালফ্যাল করে নিলুর দিকে তাকিয়ে রইলেন কতোক্ষণ তিনি।তারপর শাহেদের রুমের দিকে নিয়ে গেলেন।
শাহেদ কে হুইলচেয়ারে বসে থাকতে দেখে এক মূহুর্তের জন্য নিলুর দুনিয়া থমকে গেছে যেনো।কাকে দেখছে নিলু এই?
কি হয়েছে শাহেদের?

ছুটে গেলো শাহেদের কাছে নিলু,তারপর ভেঙে পড়লো কান্নায়।
অনেকদিন পরে নিলুকে দেখে শাহেদের মন ভালো হয়ে গেলো। রেহানা বেগম সরে গেলেন রুম থেকে। রান্নাঘরে গিয়ে মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলেন যেনো নিলুর মন ঠিক করে দেয় আল্লাহ।নিলু যেনো আর না যায়।

অনেকক্ষণ ধরে নিলুর কান্নাকাটি চললো। বাম হাত তুলে শাহেদ নিলুর চোখ মুছে দিলো।কিভাবে কি হয়েছিলো সব বললো নিলুকে।কান্না বন্ধ করে নিলু বললো নিলুর চাকরির কথা,শহরে বাসা মেয়ার কথা।শাহেদ সব শুনলো,নিলুকে অভিনন্দন জানালো।
এটা সেটা বিভিন্ন কথা বলার পরেও নিলু আসল কথাটা বলতে পারলো না শাহেদকে।ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিলো নিলু।নিলুকে আমতা-আমতা করতে দেখে শাহেদ জিজ্ঞেস করলো,”কিছু বলবে নিলু?
এরকম নার্ভাস কেনো তুমি?”

কিভাবে কি বলবে নিলু বুঝতে পারলো না।মুখ দিয়ে কথাটা বের হচ্ছিলো না।
কেমন হাঁসফাঁস করতে লাগলো নিলু।শেষে উপায়ান্তর না পেয়ে উঠে দাঁড়ালো নিলু।তারপর শাহেদের বামহাত নিজের পেটের উপর রেখে চোখ বন্ধ করে বললো,”এখানে তোমার সংসারের একজন অতিথি আসতে চলেছে।”

শাহেদ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না যেনো শুনে।হাঁ করে তাকিয়ে রইলো নিলুর দিকে।চোখ বন্ধ করে আছে নিলু এখনো।চোখে মুখে কেমন স্বর্গীয় এক সুখ ফুটে উঠেছে নিলুর।
শাহেদ মন্ত্রমুগ্ধের মতো বললো,”কি বললে নিলু,আবার বলো?”

নিলু আবারও বললো কথাটা।শাহেদের চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।চোখে মুছে নিয়ে শাহেদ চিৎকার করে রেহানা বেগম কে ডাকলো।

রান্নাঘর থেকে শাহেদের ডাক শুনে রেহানা বেগমের বুক ধড়ফড় করে উঠলো। তিনি বুঝতে পারলেন নিলু নিশ্চয় বলেছে আর থাকবে না এই বাড়িতে।টলমল পায়ে রেহানা বেগম গেলেন শাহেদের রুমের দিকে।
গিয়ে দেখতে পেলেন অন্য এক দৃশ্য।

নিলু দাঁড়িয়ে আছে আর শাহেদ নিলুর পেটে মাথা গুঁজে আছে,বাম হাত দিয়ে নিলুর কোমর জড়িয়ে ধরে আছে।শাহেদ যেনো একটু কেঁপে কেঁপে উঠছে,কাঁদছে কি শাহেদ?
রেহানা বেগম ভেবে পেলেন না তিনি কি ভিতরে ঢুকবেন না-কি সরে যাবেন।ছেলে বৌ অপ্রস্তুত হয়ে যাবে তাকে দেখলে হয়তো।

তিনি সরার আগে শাহেদ বললো,”এদিকে আসো মা।দুটো সুখবর শোনো।একটা বড় সুখবর আর একটা ছোট। আগে ছোট টা শুনো।”

রেহানা বেগম এগিয়ে যেতেই শাহেদ চিৎকার করে বললো,”আমি বাবা হবো মা’গো,আমি বাবা হবো।।”

আনন্দে রেহানা বেগম নিলুকে জড়িয়ে ধরলেন।

তারপর বললেন,” এর চাইতে বড় সুখবর কি? ”

শাহেদ কাঁদতে কাঁদতে বললো,”আজকের পর থেকে তুমি আর আমার নিলুকে বাঁজা মেয়ে বলে কথা শুনাতে পারবে না মা।আমার নিলুকে এই অপবাদ আর দিতে পারবে না তুমি।এটা হচ্ছে আমার সবচেয়ে বড় খুশির কারণ। ”

লজ্জায় রেহানা বেগম মাথা নিচু করে ফেললেন।তিনি কিছু বলার আগে নিলু বললো,”আমি কিছু মনে রাখি নি মা আপনি ও রাখবেন না।সব ভুলে গেছি আমি।আপনি আমাকে মাফ করে দিয়েন আপনার মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে।”

দুপুরের খাবার পর নিলু শাহেদ রেহানা বেগম কে বললো,”মা আমি চাই আপনারা এখান থেকে আমার সাথে চলে আসেন শহরে।আমার ব্যাংক ওখানে।এখানে আপনি একা তো আপনার ছেলের সেবা করতে পারবেন না।ওখানে গেলে আমি আছি,মা আছে,হাসপাতাল ও ওখানে কাছেই।আপনার ছেলের থেকে আমি সব শুনেছি।ভাবীরা ও যখন চলে যাবে এখান থেকে আপনি আর একা থাকবেন কেনো।

রেহানা বেগম বললেন,”তুমি চাকরি না কইরা ওর সেবা যত্ন করবা?”

নিলু হেসে বললো,”তাহলে তো ভালোই হয় মা।”

রেহানা বেগম তড়িঘড়ি করে বললেন,” না না,একটু ও ভালো হয় না।আমি এতোদিন ভুল বুঝছি।সবারই প্রতিষ্ঠিত হওন দরকার।তুমি চলে গেছো শুইনা তোমার শ্বশুর রাগ কইরা আমারে এক টাকা ও পাঠায় নাই।জানো মা,কতোদিন গেছে ২ বউ বাহির থাইকা খাবার আইনা খাইছে,আমি সকালে না খাইয়া আছিলাম।আমি ও যদি কিছু করতাম তাইলে আর এরকম কইরা প্রতিমাসে তোমার শ্বশুরের দিকে তাকাইয়া থাকা লাগতো না।”

নিলু মুচকি হাসলো শাশুড়ির কথা শুনে।তারপর নিজের মা’কে কল দিয়ে সবকিছু বললো।রাতের জন্য রান্না করে রাখতে বললো মা’কে। আজকেই শাহেদ আর রেহানা বেগম কে নিয়ে যাবে নিলু।

বিকেলের দিকে সিএনজি এলো।সিএনজি তে বসে নিলু নিরবে কাঁদতে লাগলো। আল্লাহ চাইলে কি না হতে পারে। সব কিছু ঠিক করে দিতে আল্লাহর এক সেকেন্ড ও লাগে না।মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো নিলু।
তারপর শাহেদের মাথাটা নিজের কাঁধে এনে রাখলো।

সিএনজি চলছে।
এ এক সুখের যাত্রা নিলুর,নিলু আল্লাহকে বললো,”আল্লাহ,এই সুখের রাস্তা যেনো সারাজীবন চলতে থাকে।সবাইকে সুখী করো।”

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here