মোনালিসা পর্ব ১৩

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-১৩
মোনা বাসায় ফিরে রুমে ঢুকে দেখে নিশান বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদছে। নিশানের মাথার কাছে বসে নিশানের পিঠে মৃদু ধাক্কা দিতে দিতে জ্যাকের একজন কাজের লোক বার বার বলছে,
-“হোয়াই আর ইউ ক্রাইং?প্লীজ টেল মি?ডোন্ট ক্রাই, ডোন্ট ক্রাই।”
প্রথমত নিশান ইংরেজি বুঝে না আর দ্বিতীয়ত বুঝলেও উত্তর দিতে পারতো না। মোনা কে দেখে লোকটা রুম থেকে চলে গেল। মোনা নিশানের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-“এই নিশান,নিশান।”
নিশান যেন এই ডাকের অপেক্ষা করছিল। তড়াক করে উঠে বসে। মোনা শক্ত গলায় বলল,
-“তোমায় কান্না করতে না করেছিলাম না? তুমি অযথা কেন কান্না করে ওঁদের বিরক্ত করছ?আমার কি ভার্সিটি তে যেতে হবে না? ভার্সিটিতে তোমায় নিয়ে যেতে পারব?”
নিশান কান্না ভেজা চোখে মোনার দিকে তাকায়। ইশারায় বলে,
-“আমি তো তোমায় ছাড়া থাকতে পারিনা।”
-“আমি তো আমায় ছাড়া থাকতে বলিনি। আমি যেটুকু টাইম ভার্সিটিতে থাকি অতটুকু টাইম একা থাকতেই হবে। কিছু করার নেই। তুমি যদি এমন পাগলামি করো তাহলে কিন্তু তোমায় লাগেজ ভরে প্লেনের পাখার সাথে বেঁধে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিবো।”
নিশানের কান্নার গতি বেড়ে গেলো। মোনা হেসে নিশানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আদুরে গলায় বলল,
-“মজা করেছি।‌‌‌কান্না থামাও। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে তোমায় খাইয়ে দিচ্ছি।”
মোনা একটা ক্ষীণ শ্বাস ফেলে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।‌ নিশান কে নিয়ে কি করবে ভেবে পায়না। নিশান কাঁদলে মোনার খারাপ লাগে খুব বেশী।ভার্সিটি, জব সব মিলিয়ে কত সময় একা থাকতে হবে নিশানের। মোনা ফ্রেশ হয়ে এসে নিশান’কে খাইয়ে দেয়। ছোট বেলা থেকে সব সময় মায়ের হাতে খেতে খেতে এমন অভ্যাস হয়েছে হাত দিয়ে খেতে পারেনা নিশান। মোনা ভাবছে ও যখন বাসায় থাকবে না তখন নিশান খাবে কিভাবে?থাকবে কিভাবে?
-“আর খাবে?”
নিশান মাথা ঝাঁকিয়ে না বলে।
-“আচ্ছা তুমি তাহলে বসো , আমি প্রিন্সেস’কে নিয়ে আসছি।”
মোনা প্রিন্সেসের রুমে গিয়ে দেখে প্রিন্সেস হাত-পা নাড়াচ্ছে আর একা একা হাসছে। মোনা কোলে তুলে নেয়।
-“প্রিন্সেস একা একা হাসছে কেন এভাবে?”
মোনার কথা শুনে প্রিন্সেসের হাসি যেন বাড়লো। মোনা প্রিন্সেসের নাক আলতো করে টেনে বলে,
-“এই বুড়ি হাসছিস কেন? তুই আমার কথা বুঝিস?”
মোনা প্রিন্সেসের গালে, চোখে চুমু খায়। প্রিন্সেস কে চুমু দিলে ওর মুখে কেমন একটা বিরক্ত ভাব ফুটে উঠে। বাচ্চা’রা চুমু খাওয়া পছন্দ করেনা কেন মোনা বুঝে না। মোনা বসে বসে ভাবছে প্রিয়মের কথা। প্রিয়মের ভাব দেখে মনে হয়েছে মোনা কে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলো। আসলেই কি চিন্তিত ছিলো? মোনা চায়নি ও বাসার কারো মুখোমুখি হতে আর। কিন্তু প্রিয়ম বাসায় গিয়ে নিশ্চই বলবে আর লিলি বেগম মোনার ভার্সিটির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে। লিলি বেগমের প্রশ্নের কি উত্তর দিবে?যুক্তিযথ কোন মিথ্যা কথা খুঁজে পাচ্ছে না। সত্যি কথা মোনা কখনো কখনোই বলতে পারবে না, কখনোই না।
জ্যাক বাসায় আসে। মোনা প্রিন্সেস কে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। জ্যাক নিচ থেকে হাত নাড়ায়। মোনা হাসে, প্রিন্সেস’কে দেখানোর চেষ্টা করে জ্যাক আসছে। কিন্তু প্রিন্সেসের দৃষ্টি সে পর্যন্ত যায় না। জ্যাক কাছে আসতেই প্রিন্সেস জ্যাকের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জ্যাকের চোখে মুখে মেয়ে’কে দেখার তীব্র তৃষ্ণা। জ্যাক কিছুক্ষণ প্রিন্সেস’কে নিয়ে ব্যস্ত থাকার পর মোনার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“কোন অসুবিধা হয়নি তো মোনালিসা?”
-“না।”
-“আপনাদের জন্য বাসা ঠিক করেছি,আমার এত বড় বিজনেস ,জব তো আপনি সেখানেই করতে পারেন।”
কথা বলতে বলতে জ্যাক বাসার ভিতরে যায়। জ্যাক ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোফায় বসে।
-“উফ!কি লং জার্নি।”
মোনা তাকায় জ্যাকের দিকে।ওর এই দুঃসময়ে জ্যাক যেন আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে দিলো। তীব্র খরার পর এক পশলা বৃষ্টি তে যেমন মানুষের মন প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়, মোনার মনও প্রশান্তি’তে ছেয়ে যায়। আল্লাহ কখনো সবগুলো দরজা বন্ধ করে দেয় না, কোন না কোন একটা দরজা, একটা উপায় কিংবা একটা মাধ্যম ঠিকই বের করে দেয়। মোনার এই খারাপ সময়ে জ্যাক ও ঠিক তেমন।
__
প্রিয়মের কথা শুনে লিলি বেগমের চোখে-মুখে বিস্ময়ের ছাপ পড়ে। বিস্মিত গলায় বলে,
-“তুই সত্যি দেখেছিস তো?”
-“উফ্ আম্মু! তুমি আমায় পাগল করে ছাড়বে। আমি ওর সাথে কথা বলেছি,ওর হাত ধরেছি। কিন্তু ও আমার সাথে এমন বিহেভ করেছে যেন আমাদের উপর ওঁর অনেক ক্ষোভ।”
-“আমি মোনা’কে এই কয়দিনে যতটুকু চিনেছি তাতে আমার মনে হচ্ছে না মোনা কোন কারণ ছাড়া এবাড়ি থেকে চলে গেছে। নিশ্চই কোন কারণ আছে যা আমরা জানি না।”
-“কারণ আছে কিনা জানিনা, কিন্তু ওঁদের এভাবে চলে যাওয়া’টা অদ্ভুত লেগেছে আমার কাছে।”
লিলি বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মোনার কোন ক্ষতি হয়নি, ওঁরা দুইজন ঠিক আছে এই ভেবে। ওঁরা যে কারণেই চলে গেছে যাক।লিলি বেগম এই কয়দিন চিন্তায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। প্রিয়ম’কে বলল,
-“আমি কাল যাবো ওঁর সাথে দেখা করতে। আমায় নিয়ে যাস কাল।”
প্রিয়ম ওঁর রুমে গেলো। মোনা মেয়েটা সাধারণের মধ্যেও কেমন অসাধারণ। এমন বিশেষত্ব প্রিয়ম কখনো এখানকার মেয়েদের মধ্যে খুঁজে পায়নি। কয়েক দিন যাবৎ নাইট ক্লাবেও যাচ্ছে না প্রিয়ম। অদ্ভুত এক পরিবর্তন এসেছে। প্রিয়ম গভীর ভাবে ভাবছে মোনার কথা। মোনার বিষয়টা প্রিয়ম’কে এত ভাবাবে প্রিয়ম বুঝতে পারেনি। মোনা আগের রাগ মনের মধ্যে পুষে রেখেছিল?নয়ত কেন এমন করছে? প্রিয়ম গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায়। রুমে একা একা থাকলেই মোনা’কে নিয়ে সব চিন্তা এসে ঘাড়ে চাপে।
জ্যাক বাসায় এসে বিশ্রাম নিলো অনেকক্ষণ। তারপর মোনা কে রুমে ডাকলো।
-“নতুন বাসায় কবে উঠছেন?”
-“আজই তো উঠতে চাচ্ছিলাম।”
-“দুই ভাই-বোনে থাকবেন, ভয় পাবেন না রাতে? আপনি ভীতু তা আমি জানি।”
মোনা একটু হেসে বলে,
-“না।”
-“আপনি তো ভার্সিটি তে থাকবেন,জব করবেন ,আপনার ভাই তো একা কান্না করবে।”
মোনা চিন্তিত মুখে বলল,
-“এটা নিয়ে তো কিছু করার নেই।”
-“আচ্ছা আপনার ভাইয়ের একটা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে,কথা বলতে পারে না। তাই বলে সে লেখাপড়া করবে না? কত মানুষ রয়েছে হাত-পা নেই অথচ পৃথিবী জয় করে ফেলে।”
জ্যাকের কথায় মোনা ভাবনায় পড়ে যায়। আসলেই মোনা কখনো নিশানের লেখাপড়া নিয়ে ভাবে নি কখনো। এত সব প্রবলেমের মধ্যে ভাবার সময় কোথায়? জ্যাকের দিকে মোনা বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে। এই লোকটা এত কিছু বুঝে কিভাবে? এত কিছু ভাবে? আমেরিকার মত জায়গায় কিভাবে ভাই’কে লেখাপড়া করাবে?
জ্যাক আবার বলল,
-“আপনি ভার্সিটি তে থাকবেন আপনার ভাই স্কুলে থাকবে। এখানে অনেক ভালো স্কুল।”
মোনা চিন্তিত গলায় বলল,
-“আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলেন তো? আপনি কেন আমায় এত হেল্প করছেন? আপনি কি সবাইকে এমন হেল্প করেন?”
জ্যাক হেসে বলে,
-“আমি এত হেল্পফুল মানুষ না। আপনায় হেল্প করার কারণ আছে, সেটা অন্যদিক বলবো।”
-“এখন বলা যাবে না?”
-“না।”
মোনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-“আপনি বলেছিলেন না আপনার বিজনেস আছে,সেখানে জবের কথা। আমি জবটা করবো না।”
জ্যাক ভ্রু কুঁচকে বলে,
-“কেন?”
-“কারণ এই জবটা করার যোগ্যতা আমার এখন পর্যন্ত হয়নি। আপনি আমার প্রতি সহানুভূতি থেকে জবের অফার’টা করেছেন জ্যাক। আমি চাই নিজের যোগ্যতায় কোনো কিছু করতে।”
-“এই মেয়ে আপনি তো আমায় ইমপ্রেসড করে ফেলেছেন। আচ্ছা তাহলে তুমি লেখাপড়া আগে কমপ্লিট করেন। আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ,তোমায় জোর করব না।”
জ্যাকের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মোনার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। পৃথিবীতে কিছু মানুষ হাসনেহেনা ফুলের মত স্নিগ্ধ, পবিত্র হয় আর কিছু মানুষ নর্দমার কীট। জ্যাক মোনার চাহনির অর্থ বুঝতে পেরে বলল,
-“আপনি আমায় যতটা ভালো ভেবেছেন আমি ততটা ভালো নই মোনালিসা, বলতে পারেন আপনার জন্য ভালো।”
মোনা উত্তরে হাসলো শুধু। কি এমন কারণ? জ্যাকের সাথে তো আমেরিকায় এসেই দেখা হলো। কি কারণ থাকতে পারে? কারণটা ভালো না খারাপ? জ্যাক বলল,
-“ঘাবড়াবেন না। কোন খারাপ কারণ নেই।”
-“আপনি মন পড়তে পারেন?”
-“না চোখের ভাষা বুঝি।”
মোনা নিজের ব্যাগ, লাগেজ গোছাচ্ছে। খারাপ লাগছে এখানে থেকে যেতে। জ্যাক,প্রিন্সেস দুইটা মানুষের জন্য তীব্র মায়ার জন্ম হয়েছে।মোনার অদ্ভুত এক কারণে কান্না পাচ্ছে। এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে যেন। মোনা ঠোঁট চেপে কান্না চাপানোর চেষ্টা করছে। মোনার এই ছোট্ট জীবনে খুব কম মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা, সহানুভূতি পেয়েছে। তাই হয়ত এমন হচ্ছে।
জ্যাক গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মোনা আর নিশাক কে নতুন বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য। মোনা বার বার বাসা’টার দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। জ্যাক হেসে বলল,
-“এভাবে না তাকিয়ে থেকে যান।”
মোনা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলো। জ্যাকের কোলে প্রিন্সেস। মোনার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে প্রিন্সেস বুঝতে পেরেছে মোনা চলে যাচ্ছে। মোনার বুকের সাথে মিশে আছে। জ্যাক মোনার কোলে থেকে নেওয়ার চেষ্টা করছে প্রিন্সেস কে, প্রিন্সেস ঘাপটি মেরে আছে। মোনা হাসছে। কেয়ারটেকার কে বলল,
-“ও’কে নিয়ে যাও,আমরা বের হবো।”
কারো কোলে যাবে না প্রিন্সেস। জ্যাক বিরক্ত হয়ে তাকায় প্রিন্সেসের দিকে।রাগি গলায় বলে,
-“প্রিন্সেস এদিকে এসো।”
মোনার কোল থেকে জোর করে নিতেই কান্না শুরু করে। মোনার প্রচন্ড খারাপ লাগছে। ফ্যাকাশে মুখে তাকাচ্ছে প্রিন্সেসের দিকে। জ্যাক বলল,
-“মোনালিসা আপনিও কি প্রিন্সেসের মত কেঁদে দিবেন?”
মোনা ম্লান হেসে গাড়িতে উঠে। হাত নাড়িয়ে প্রিন্সেস কে টাটা দিচ্ছে।
(চলবে)
বিঃদ্রঃ- ইদানিং প্রচুর টাইপ মিস্টেক হচ্ছে। ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিবেন নয়ত নিজ দায়িত্বে বুঝে নিবেন। নাইস, নেক্সট এসব কমেন্ট থেকে দূরে থাকুন। ওসব কমেন্ট দেখলে গল্প দিতে ইচ্ছে হয়না।

আমার গল্প লেখার ছোট একটা গ্রুপ। এড হয়ে নিন সবাই—

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here