মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-১৪
জ্যাক মোনা আর নিশান’কে বাসায় পৌঁছে দেয়। ওঁদের সাথে সাথে বাসার ভিতরে আসে। আশ্বস্ত গলায় বার বার বলল,
-“নার্ভাস হবেন না মোনালিসা। আমি বলে দিয়েছে কোন ধরণের প্রবলেম হবে না। আমার উপর আস্থা রাখুন।”
মোনা অসহায় চোখে তাকালো জ্যাকের দিকে।বলল,
-“না নার্ভাস হচ্ছি না।”
জ্যাক পুরুষ্ঠ ঠোঁটের নীচে দু পাটি মোটা দাঁত বের করে হেসে বলল,
-“সিরিয়াসলি নার্ভাস হচ্ছেন না?আয়নায় নিজের চেহেরা দেখুন।”
মোনা চোখে মুখের অস্থির ভাব কাটানোর চেষ্টা করে।জ্যাক মুখে চিলতে হাসি টেনে বসে পড়ে খাটের উপর।
-“ফিরে যাবেন?”
মোনা প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-“কোথায়?”
-“আমার বাসায়।”
-“আপনি বেশি বেশি চিন্তা করছেন। আমি থাকতে পারবো।”
নিশান ক্লান্ত ভর করা শরীরে চুপচাপ বসে আছে। রুমের ভিতর নিরবতা বিরাজ করছে। মোনা রুমের চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। জ্যাক সব ম্যানেজ করেছে। খুব বড়সড় রুম না। মোনা যেমনটা চেয়েছিল ঠিক তেমন’টা। রুমের পাশে সুন্দর একটা বারান্দা আছে। মোনা মাঝে মাঝে কথা খুঁজে পায়না, তখন খুব অস্বস্তিতে পড়ে। জ্যাকের সাথে কথা বলে সঙ্গ দেওয়া উচিত, জ্যাকের প্রতি মনযোগী হওয়া উচিত। মোনা খুঁজে পেল না কি কথা বলবে। জ্যাক নিজেই কথা বলতে শুরু করল।
-“মাঝে মাঝে কফি খেতে আসতে পারি?”
মোনা হাসে। মোনা শুধু ভাবছে কি করলে জ্যাকের করা এত উপকারের ঋণ শোধ করা যাবে। মানুষের কাছে ঋণী হয়ে থাকাটা অস্বস্তিকর। জ্যাক তো স্বয়ংসম্পূর্ন একজন মানুষ। জ্যাকের তো কোন কিছুর প্রয়োজন বোধ নেই। জ্যাকের উপকার করারও সুযোগ নেই।
-“ইচ্ছে হলে প্রতিদিন আসেন কফি খেতে।”
-“আপনি মাঝে মাঝে যাবেন না প্রিন্সেস’সে দেখতে?”
-“যখনই সময় পাবো তখনই যাবো। মায়া পরে গেছে প্রিন্সেসের উপর।”
জ্যাকের ফোনে কল আসে। জ্যাক একটু দূরে সরে কথা বলল। হাতের কব্জিতে থাকা সোনালী বেল্টের ঘড়ি টার দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে বলল,
-“মোনালিসা আমার যেতে হবে। জরুরী কল আসছে। কোন প্রবলেম হলে যাস্ট কল মি।আমার ধারণা কোন প্রবলেম হবেনা।”
জ্যাক বেড়িয়ে পড়ে। মোনা তাকিয়ে আছে যতক্ষণ জ্যাক কে দেখা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত। জ্যাক মোনার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে মোনা রুমটার প্রতি মনযোগী হলো। মোনার মাথায় একটা প্রশ্ন বার বার নাড়া দিচ্ছে। কি কারণে জ্যাক হেল্প করছে ও’কে? কি কারণ থাকতে পারে? মোনা অবচেতন মনে নানা রকম কারণ খুঁজে। মোনা নিশানের দিকে তাকিয়ে দেখে নিশান ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে গিয়েছে। মোনা’কে একাকিত্বে গ্রাস করে। মোনার ভীষণ রকমের মন খারাপ হয়। এই মন খারাপের কারণ বা ব্যাখ্যা মোনা দিতে পারবে না। মোনা শুধু বুঝতে পারছে ও’র একা থাকতে ভালোলাগছে না।
শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামে। সূর্যের রক্তিম আভায় লালচে রঙ ধারণ করেছে যেন চারদিকের পরিবেশ’টা। মোনার ফ্ল্যাটের পাশেও কয়েক’টা ফ্যামিলি থাকে। তা সত্ত্বেও সব শুনশান, কোন কোলাহল নেই। মোনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। মোনার চোখ অকারণে ভিজে যাচ্ছে। মোনা দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে, মোনা বার বার ডান হাত দিয়ে চোখ মুছছে। মোনা কাঁদতে ভুলে গিয়েছিলো, এখন আবার অকারণে কান্না পাচ্ছে। এমন নির্জনতায় মোনার শরীর’টা ভার হয়ে আছে। এই নিরবতায় মোনার কষ্ট বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। মোনা বই নিয়ে বসে। জোর করে পড়ায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে। এখানে লেখাপড়া করতে এসেছে, লেখাপড়া করতে হবে। মোনা মনের বিষন্নতা, বিমর্ষতার বিরুদ্ধে কঠোর হয়। জীবন’টা কে ভালো একটা অবস্থানে নিয়ে যেতে হবে। মোনা কিছুক্ষণ বই ঘেঁটে শুয়ে পড়ে। নিশান সেই কখন ঘুমিয়েছে মাত্র উঠে খেতে চাচ্ছে। মোনা রান্নার কথা ভুলে গিয়েছিলো। ওঁর যে রান্না করতে হবে একথা মোনার মাথায় আসে নি। জ্যাক বলেছে সব ম্যানেজ করে দিয়েছে। মোনা কিচেনে ঢুকে। মোনার রান্নার হাত একদম অনাড়ি। মায়ের কারণে রান্না ঘরে যেতে হয়নি। তারপর থাকলো হোস্টেলে। সেখানে পানির মত ডাল, আর হাঁটু সমান ঝোলওয়ালা ডিম রান্না খেয়েছে। মোনার হোস্টেলের ডাইনিংএ গেলেই কান্না পেতো। গলায় ভাত আটকে যেত। এত জঘন্য রান্না! মোনা সে সব দিন নিয়ে ভাবছে। মোনা রুটি বানায়। অনেক চেষ্টা করেও রুটি গোল হয়নি। মোনার চোখ-মুখে ব্যর্থতার ছাপ। নিজেই হাসছে রুটি দেখে। মোনা নিশান’কে খাইয়ে, নিজে খেয়ে নিলো। খাওয়া করে উঠতেই ফোন বাজলো। মোনা নিশ্চিত জ্যাকের ফোন। মোনা রিসিভ করেই বলল,
-“কি করছেন?”
ওপাশ থেকে বিস্মিত গলায় বলে,
-“শুরুতেই কি করছেন?”
মোনা থমকে যায়। এটা জ্যাকের গলা না। কেউ একজন শুদ্ধ বাংলায় বলেছে কথাটা। মোনা ফোনের স্ক্রিনের দিয়ে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,
-“কে?”
-“প্রিয়ম।”
মোনা কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলো। মোনা তো সিম কার্ড চেঞ্জ করে ফেলেছিল। ওপাশ থেকে বলল,
-“চুপ কেন?”
-“আপনি?”
-“হ্যাঁ আমি। প্রথমে যেভাবে কথা বলা শুরু করেছিলে মনে হলো অন্য কাউকে আশা করেছ।”
মোনা বিরক্ত ভরা গলায় বলল,
-“আপনি কেন ফোন দিয়েছেন? প্রবলেম কি আপনার? এখনো আমার পিছনে লেগে আছেন। এখন তো আমি আপনাদের বাসায় থেকে আপনাদের বিরক্ত করছি না।”
-“আচ্ছা মোনা রিল্যাক্স। আমি কি কখনো বাসায় থাকা নিয়ে কিছু বলেছি?”
মোনা চুপ করে আছে।
-“আমি তোমার বাসার নিচে। তোমায় ভীষণ ভাবে মিস করছি। দেখতে ইচ্ছে করছে। একটু দেখা করবে?”
মোনা তাচ্ছিল্য করে বলল,
-“আপনি আমায় কখনো খুঁজে পাবেন না।”
-“তোমার মত মোনালিসা কে খুঁজে পাওয়া পাঁচ মিনিটের ব্যাপার।”
মোনা এবার কিছুটা সিরিয়াস ভাবে নিলো কথাটা। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। প্রিয়ম কি ও’কে বোকা বানাচ্ছে? মোনা দ্রুত বারান্দায় গেলো। মোনা বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। প্রিয়ম সত্যি এসেছে? কিভাবে সম্ভব? মোনা নিজের চোখ কচলিয়ে ভালো করে দেখল চোখে কি ভ্রম দেখছে? মোনা দৌড়ে রুমে চলে আসে। ফোন কানের কাছেই।
-“কি চলে গেলে কেন? বিশ্বাস হয়েছে?”
মোনা চুপ হয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর ক্ষুব্ধ গলায় বলল,
-“কি চান আপনি? আমি তো আমেরিকান মেয়েদের মত ফার্স্ট ক্লাস না,শর্ট-কাট কাপড় চোপড় পড়ি না। আমি বাঙালি থার্ড ক্লাস, ন্যারো মাইন্ডেড মেয়ে। আমার জন্য নিজের টাইম নষ্ট না করে এখান থেকে চলে যান। আপনি কিন্তু আমায় মেন্টাল টর্চার করছেন।”
প্রিয়ম নির্লিপ্ত গলায় বলল,
-“নদীর পাড়ে যাবে? সুন্দর বেঞ্চ পাতানো আছে। সুন্দর টলমলে পানি জোছনার আলোর সাথে খেলা করে।”
-“আর ইউ ওকে? ট্রিটমেন্ট দরকার আপনার। রাখছি। নাইট ক্লাবে যান ফুর্তি করেন।”
-“আমি তোমায় ভীষণ ভাবে মিস করছি। তোমার জন্য—”
প্রিয়মে কথা শেষ না হতেই ফোন কেটে দিলো মোনা। বিরক্তিতে চোখ বন্ধ খাটের উপর বসে আছে। ফোনটা সুইচ অফ করে রেখেছে। অনেকক্ষণ কেটে যায়। মোনা কৌতুহলী হয়ে উঠে। প্রিয়ম কি এখনো ওখানে দাঁড়িয়ে আছে? মোনা উঁকি মেরে দেখে কেউ নেই। মোনা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। রুমে এসে শুয়ে পড়লো। প্রিয়ম কেন এমন আচরণ করছে?মোনা বার বার ভাবছে। প্রিয়মের বিষয়টা মোনা না চাইলেও মোনা’কে ভাবাচ্ছে।
মোনা সকালে ঘুম থেকে উঠলো। ফোনে এলার্ম দিয়ে রেখেছিল। মোনা ফ্রেশ হয়ে কিচেনে গিয়ে নাস্তা তৈরি করে। নিশান ঘুম থেকে উঠে মোনার কাছে রান্নাঘরে যায়। মোনার শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। মোনা ভার্সিটিতে জন্য রেডি হচ্ছে। নিশান মুখ ভার করে তাকিয়ে থাকে। মোনা নিশানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
-“মন খারাপ করে না, কয়েকদিন পর তুমিও স্কুলে যাবে। তখন একা থাকতে হবেনা।”
মোনা বাসা থেকে বের হয়। জ্যাক এর ভিতর একবারও ফোন দেয়নি। মোনার পাশে এসে কার থামে। মোনা তাকিয়ে দেখে জ্যাক। মোনা’কে দেখে মুখে এক চিলতে হাসি ফুটালো।
-“মোনালিসা গাড়িতে উঠুন। পৌঁছে দিই।”
মোনা গাড়ি তে উঠলো। প্রিন্সেসের কথা জিজ্ঞেস করলো। জ্যাক বলল,
-“কাল থেকে আমি নিঃশ্বাস ফেলানোর সময় পাইনি। একবারও ফোন দিতে পারেনি। সব ঠিকঠাক আছে?”
-“হ্যাঁ সব ঠিকঠাক।”
-“আমি যাবো একটু ফ্রী হয়ে কফি খেতে। আর হ্যাঁ প্রিন্সেস’কে নিয়ে যাবো ওটা আর বলতে হবে না। প্রিন্সেসের সেই কান্না থামাতে দুই ঘন্টা লেগেছে।”
মোনা ভার্সিটির সামনে এসে গাড়ি থেকে নামায়। আজকেও একাকী ক্লাসে বসে থাকতে হলো। মোনা মনোযোগ বসাতে পারছে না ক্লাসে। সবাই আড্ডা দিচ্ছে, হৈচৈ করছে আর মোনা চুপচাপ বসে আছে। কারো সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলার অভ্যাস রপ্ত করতে পারেনি। ভার্সিটি ছুটি হওয়ার পর মোনা ভেবে নিয়েছে আজ নিশ্চই লিলি বেগম আসবে। কিন্তু না আসে নি। মোনা কিছুটা আশাহত হলো। মোনা রৌদ্রজ্জ্বল পথ দিয়ে হাঁটছে, আজ রোদটা একটা প্রখর। এখানে তেমন ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। চারদিকে নির্জন, মাঝে মাঝে দুই একটা ইংরেজি তে বলা কথা শুনা যায়।
-“এ্যাই, এ্যাই।”
এই অচেনা শহরে মেয়েলি কন্ঠে কে ডাকবে মোনা কে।মোনা পিছনে ফিরে তাকায়। গায়ের রং কুচকুচে কালো, চুল গুলো চোখে পড়ার মত লম্বা মেয়েটার। চোখ গুলো ঝলঝল করছে। মেয়েটা শুদ্ধ বাংলায় বলল,
-“তুমি বাঙালি? তোমায় দেখেই বুঝা যাচ্ছে।”
-“হ্যাঁ।”
মেয়েটার কথাবার্তায় চঞ্চলতা রয়েছে। সুস্থির নয়, অস্থির ভঙ্গিতে কথা বলছে।
-“আমি শ্রুতি। ইন্ডিয়াতে বাসা। ক্লাসে সব সময় চুপচাপ থাকো কেন? অমনোযোগী থাকো।”
মোনা বুঝতে পেরেছে মেয়েটা ওঁর সাথেই পড়ে। মোনা খেয়াল করেনি। মোনা একটু হেসে বলল,
-“আমি মোনালিসা, বাংলাদেশী।”
দুইজন হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে লাগলো। শ্রুতির কথা বলার ভঙ্গি অসাধারণ। অসম্ভব রকমের চঞ্চল, গুছিয়ে কথা বলে। চোখে মুখে চপলতা রয়েছে।
(চলবে)
বিঃদ্রঃ গঠনমূলক মন্তব্য করে ভালোলাগা, মন্দলাগা বলুন