মোনালিসা পর্ব ৩৩

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৩৩
মোনার জীবনে প্রথম প্রেম। কি এক ধারালো অনুভুতিময় মুহুর্তে। মোনার অন্তরতম প্রদেশে যেন বসন্তের আবির্ভাব ঘটেছে। মোনা বিভোল চিত্তের কল্পনা দিগ্বিগিক মাতিয়ে তুলেছে । অদ্ভুত এক প্রেমাবেগ বসন্তের হিমেল মারুতের মত মোনার মনে মৃদু দোলা দিচ্ছে। মোনা মাঝে মাঝে স্থান,কাল ভুলে প্রিয়ম’কে নিয়ে ভাবনায় বিবশ হয়ে যায়।‌‌‌ ঠোঁটের কোণ প্রদেশে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ক্ষুদ্র তরঙ্গের ন্যায় দোলা দেয়।
কয়েকদিন কেটে গেলেও মোনা প্রিয়মের চোখের দিকে তাকিয়ে সহজভাবে কথা বলতে পারে না। প্রিয়মের উপস্থিতিতে মোনার হাঁসফাঁস অবস্থা হয়।‌ ধরণীর সব আড়ষ্ট’টা মোনার মনে ভর করে। প্রিয়মের চোখে দিকে তাকানো যেন দুরূহ কাজ। অথচ আগে এই চোখের দিকে শ্যেন দৃষ্টি’তে কয়েক’শ বার বিরক্ত হয়েছে মোনা। সম্পর্ক’টা প্রেমে পরিণত হওয়ার পরপর’ই সব কিছু বদলে গেছে।
মোনা ভার্সিটি’তে যায়। মোনার খিটখিটে মেজাজ ইদানিং শীতল হয়ে গেছে। মোনার মর্মদেশে যে দুশ্চিন্তা গুলো বার বার উঁকি দিতো সে গুলো আজকাল স্থান পায় না। মোনার প্রতি প্রতিমুহূর্তের সহচর ছিলো যে বিষণ্নতা, সে ও যেন আজকাল মোনার দেখা পায়না।শ্রুতি গুরুত্বর চিন্তিত মুখে মোনার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তোমার এতসব পরিবর্তনের কারণ কি? মোনা আমি না তোমার এই বৈচিত্র্যময় আচরণ নিয়ে চিন্তিত।”
মোনা হৃষ্টচিত্তে হাসে। উচ্ছ্বাসিত সে হাসি। শ্রুতির দিকে তাকিয়ে বলল,
-“ক্ষুদ্র এই জীবনে অনেক মোড়। কিছু কিছু মোড়ে মানুষ কাঁদে,কিছু কিছু মোড়ে হাসে।”
শ্রুতির মুখ দেখে মনে হলো মোনার বলা কথা গুলো দুর্বোধ্য লাগলো ওঁর কাছে। শ্রুতির সব কথার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জটিল করে উত্তর দিবে মোনা। সেসব কথার মানে খুঁজতে খুঁজতে শ্রুতি ধৈর্যচ্যুত হয়ে যায়।
মোনার ভার্সিটি ছুটি হয়। ভার্সিটি থেকে বের হতেই প্রিয়মের ম্যাসেজ। মোনা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায়।
-“ভার্সিটির কাছে অপেক্ষা করো আমি আসছি।”
মোনা ম্যাসেজ’টার দিকে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। প্রিয়ম অফিস বাদে আসবে?মোনার এসব ভাবনা চিন্তা শেষ হতে না হতেই প্রিয়ম চলে আসে। মোনা’কে দেখেই খানিক’টা দূর থেকেই ঠোঁট প্রসস্থ করে হাসে। প্রিয়ম মোনার কাছে এসে দাঁড়ায়। প্রিয়ম কাছে আসতেই মোনা স্বভাব অনুযায়ী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ফেলে। ওপাশে ফিরানো মুখ’টা দেখার জন্য প্রিয়ম কৌতূহলী হয়ে ওঠে। গলায় কিছু’টা রোষাবেশ নিয়ে বলে,
-“ওভাবে মুখ ঘুরিয়ে রাখলে আমি চলে যাবো কিন্তু।”
মোনার কোন পরিবর্তন নেই। কিছুক্ষণ পেরিয়ে যায় যায়। প্রিয়ম ব্যগ্র হয়ে বলে,
-“আমি অফিস রেখে এসেছি। আর তুমি আমার কি তাকাতেই লজ্জা পাচ্ছো। এত লজ্জা আগে কোথায় ছিলো?ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিয়েছো কত।”
প্রিয়ম যেন হতাশ হলো।মোনা প্রিয়মের দিকে তাকালো। মোনার মুখে বিরক্তি আর লাজুকতা। নিঃশব্দ’তা ভেঙে মোনা বলে,
-“অফিস রেখে কেন এসেছেন?”
প্রিয়ম বিদ্রুপ করে বলল,
-“কেন এসেছি তুমি বুঝো না?”
মোনা প্রত্যুত্তর করল না। কিছুক্ষণ আবার আগের মত চুপ থাকলো। প্রিয়ম অধৈর্য হয়ে বলল,
-“এভাবে চুপ হয়ে আছো কেন?মোনা হয়েছে’টা কি তোমার?এত লজ্জা আসে কোত্থেকে?”
প্রিয়ম একটু থেমে আবার বলল,
-“গাড়ি’তে উঠো।”
মোনা প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়।প্রিয়ম বলে,
-“এক জায়গায় যাবো।”
মোনা আর কোন প্রশ্ন না করে গাড়ি’তে উঠলো। প্রিয়ম গাড়ি স্টার্ট করলো। মোনা আগের মত অরব থাকলো। মোনার এই শব্দহীন’তায় প্রিয়ম বিরক্ত হয় মাঝে মাঝে।
-“মোনা রবীন্দ্র সংগীত শুনবো?”
মোনা মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলে। প্রিয়ম রবীন্দ্র সংগীত ছাড়ে।মোনার খেয়াল মোটেও গানের দিকে নেই। মোনার মস্তিষ্ক অদ্ভুত এক অনুভূতি’তে অবশ করে রেখেছে। মোনা নিসাড় পরিবেশ’টা কে অবকাশ দিয়ে বলল,
-“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
-“আমার একটা পছন্দের জায়গা আগে সেখানে নিয়ে যাবো তোমায়। আচ্ছা মোনা এর আগে কোন সম্পর্ক ছিলো তোমার?”
প্রিয়মের প্রশ্নে মোনা বিরক্ত হলো মনে মনে। আগে সম্পর্ক থাকা’টাও অস্বাভাবিক কিছুনা। কিন্তু মোনার ছিলো না, তাই মোনার কাছে অবান্তর লাগলো। মোনা ভারি গলায় বলল,
-“না। আপনার কয়’টা ছিলো?”
মোনার প্রশ্নে প্রিয়ম উচ্চস্বরে হাসলো। হাসি থামতে সময় লাগলো বেশ। গলায় হাসির রেশ বিদ্যমান রেখেই প্রিয়ম বলল,
-“আগে রিলেশন ছিলো কিনা তা জিজ্ঞেস না করে জিজ্ঞেস করলে কয়’টা ছিলো?অবশ্য যৌক্তিক প্রশ্ন করেছো।হ্যাঁ অনেক গুলো ছিলো।”
মোনা অন্তরতম অঁচলে সূক্ষ্ম পীড়া অনুভব করলো।প্রিয়মের ক্ষেত্রে এসব অস্বাভাবিক না মোনা জানে,তবুও কেন জানি এরূপ যন্ত্রনা। মোনা বিমর্ষতাপূর্ণ গলায় বলল,
-“এখনো আছে?”
প্রিয়ম সহজ গলায় বলল,
-“হ্যাঁ আছে তো।”
মোনা বজ্রাহত হলো যেন। মুখের অবস্থা সঙ্কটজনক। মোনা তীব্র যন্ত্রনায় দগ্ধ হচ্ছে যেন। নির্বাক, রক্তশূন্য দৃষ্টি’তে তাকায়। প্রিয়ম মোনা অবস্থা বুঝতে পেরে মোনার একটা হাত শক্ত করে ধরে গাঢ় গলায় বলল,
-“হ্যাঁ আছে আমার সম্পর্ক তোমার সাথে। আর কারো সাথে নেই।”
মোনার একটু আগের সব শঙ্কা মিছে হয়ে গেলো। বুকের ভেতর যে সূক্ষ্ম যন্ত্রনা অনুভূত হয়েছিল তা উবে যায়। এক রাশ অভিমান নিয়ে তাকায় প্রিয়মের দিকে।‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ প্রিয়ম হেসে আবার বলল,
-“কি ভেবেছিলে?”
মোনা প্রিয়মের হাত থেকে নিজের হাত’টা ছাড়িয়ে নিয়ে বিরক্ত গলায় বলল,
-“ধ্যাত!কিছু ভাবিনি।”
-“ভেবেছো অনেক কিছু।”
মোনা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিছু’টা লাজুক ভাব মোনার মুখে। প্রিয়ম মোনার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে বলল,
-“আমায় কি তুমি বলা যাবে?নাকি প্রিয়ম ভাই ই ডাকবে সারাজীবন? ছেলে-মেয়ে মামা ডাকবে আমায়। কি লজ্জার ব্যাপার!”
মোনা অস্বাচ্ছনদ্য বোধ করে এসব কথায়। মুখ ভারি করে বলল,
-“আচ্ছা ভাই ডাকবো না। শুধু আপনি বলব। কিন্তু পরবর্তীতে এসব অসংলগ্ন কথাবার্তা বললে খারাপ হবে।”
মোনার মুখের ভাব দেখে প্রিয়ম মজা পায় যেন। বিস্মিত হওয়ার ভান করে বলল,
-“অসংলগ্ন কথাবার্তা কি বললাম?
মোনা কপাল কুঁচকে ফেলে।মোনা চোখ লাল করে তাকায় প্রিয়মের দিকে। প্রিয়ম হাসি থামিয়ে বলল,
-“আচ্ছা.. আচ্ছা বলবো না। কিন্তু ভাই ডাকলে আবার বলল।”
কথা শেষ না হতেই প্রিয়ম গাড়ি থামায়।প্রিয়ম গাড়ি থেকে নেমে মোনায় নামতে বলে। মোনা নামে গাড়ি থেকে। ঝকঝকে নদীর তীর,একটু তফাতেই বেঞ্চ।জায়গা’টা মনমুগ্ধকর! মোনা আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখছে চারপাশ’টা। কিছু মুহূর্ত পর প্রিয়ম বলল,
-“বসো।”
মোনা বসলো,প্রিয়ম মোনার পাশে’ই। মাঝখানে একটু দূরত্ব রয়েছে। মোনা প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আচ্ছা আপনা আগে যে সব প্রেম ছিলো সব ব্রেকাপ হয়ে গেছে? তাঁদের ছাড়তে আপনার কষ্ট হয়নি?”
প্রিয়ম স্বাভাবিক গলায় বলল,
-“এখানে ব্রেকাপে মানুষ কষ্ট পায় না তেমন। আর তাঁদের প্রতি তেমন কোন অনুভূতি ছিলো না আমার। যেটা তোমার প্রতি আছে।”
মোনা কিছুক্ষণ উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে। প্রিয়ম মোনার একটু কাছে এগিয়ে বসে বলল,
-“অতীতের কথা বাদ দিই।বর্তমান, ভবিষ্যতের কথা ভাবি।”
-“অতীত যদি কখনো সামনে আসে?”
প্রিয়ম জোর গলায় বলল,
-“আসবে না।”
মোনা স্বভাব অনুযায়ী আবার চুপ হয়ে থাকলো।প্রিয়ম মোনার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আবেগপূর্ণ গলায় বলল,
-“মোনা তোমার কপালে একটা চুমু খাই?”
নিঃসংকোচ আবেদন। মোনা শিউরে উঠে। শীতল রক্ত স্রোত প্রবাহিত হয় হৃৎপিণ্ড ছেয়ে‌। শ্বাস দ্রুততর হয়। লাজুক লতার মত নুয়ে পড়ে। মোনার নীরবতা দেখে প্রিয়ম মোনার দুই গালে হাত দিয়ে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মোনা ঈষৎ কেঁপে উঠে। নেত্র দুটো বুঁজে আছে মোনার, ওষ্ঠদ্বয় কাঁপছে। চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। মোনার একদম সম্মুখে প্রিয়ম। চোখ খুললেই প্রিয়মের চোখাচোখি হবে। মোনার হৃদস্পন্দন ক্রমশ বাড়ছে। প্রিয়ম তাকিয়ে আছে মোনার দিকে। বাড়াবাড়ি রকমের এক সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে মোনার চেহেরায়।প্রিয়ম কিছুক্ষণ পর দূরত্ব রেখে বসলেও মোনা সহজ ভাবে তাকাতে পারছে না। ঘোরলাগা অবস্থা মোনার। মহীর সমস্ত লজ্জা মোনা’কে আড়ষ্ট করে রেখেছে।এক তীক্ষ্ণ অনুভূতি মোনার ভিতরে তোলপাড় শুরু করছে। সারা রাস্তা প্রিয়মের দিকে তাকালো না মোনা। প্রিয়ম পুনরায় হতাশ গলায় বলল,
-“এত লজ্জা কোত্থেকে আসে? মোনা তাকাও বলছি আমার দিকে।”
মোনা তাকায়। আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়। মোনার লজ্জা পাওয়ায় প্রিয়ম অন্যরকম এক সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছে। অনিমেষ দৃষ্টিতে মোনার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রেমিকা’দের এমন লাজুক রূপ প্রিয়ম প্রথম দেখলো, এর আগে কখনো দেখেনি। মোনা অফিসেও যায় নি আজ। প্রিয়ম বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে।
(চলবে)

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here