#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২২
৬৪.
‘রথিরে, আল্লাহ!’
চিৎকার করে উঠলো মৌন। মিরা ভাত খাওয়া রেখে দৌঁড়ে এলেন তার কাছে। জুলেখা, শরীফাও কাজ ফেলে ছুটে এসেছে। মৌন চিৎকার করে কাঁদছে। মিরা মৌনকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
‘এই মৌন। এই। কি হয়েছে?’
মৌন কোনো কথা না বলে কাঁদছে। পিঠাপিঠি বোন রথি। ঝগড়া তার সাথে বেশি হয় আবার বোনদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সে রথিকেই ভালোবাসে। কোনো জবাব না পেয়ে পাশে থাকা ফোনটা হাতে নিলেন মিরা। ঐপাশেও কেউ একজন আপা আপারে করে কাঁদছে। মিরা নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কি হয়েছে?’
‘ছোটআপা আত্মহত্যা করছে।’
‘কোন হসপিটালে আছে এখন?’
‘আমাগো জেনারেল হাসপাতালে।’
‘আচ্ছা, আমরা আসছি।’
নিভৃত মাত্রই ঘুম থেকে উঠে নিচে নেমেছে। মৌনকে চিৎকার করে কাঁদতে দেখে সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। মিরা মৌনকে শান্ত হতে বলছেন। তবে কোনোমতেই শান্ত করতে পারছেন না। নিভৃত সহ্য করতে পারছেনা এই চিৎকার। দৌড়ে গিয়ে মৌনকে জড়িয়ে ধরলো সে। পরিচিত, প্রিয় মানুষটার স্পর্শ পেয়ে আরো গুটিয়ে গেলো মৌন। বাচ্চাদের মতো কাঁদছে সে। যেনো তার অসহায় মুখটা বলতে চায়,
‘আমার রথির কিছু হবেনা তো নিভৃত!’
নিভৃতের হাতের একটু ছোঁয়া, পিঠে সান্ত্বনার একটু ছোঁয়াই মৌনের অশান্ত মনকে শান্ত করে তুলছে।
___________________
দীর্ঘ চারটা ঘন্টা ছটফট করেছে মৌন। গাড়িতে থাকাকালীন সময়টা সে শ্বাস নিতে পারছিলো কিনা সন্দেহ! বাড়ির কেউই ফোন ধরছিলোনা। নিভৃত একহাতে আগলে রাখে মৌনকে।
ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালের ঘি রঙা দালানের সামনে গাড়ি থামে। মৌন পাগলের ছুটে যায় ভিতরে। তার উড়না ঝুলছে মাটিতে। বোনগুলো তার প্রাণ। যাদের জন্য নিজেকে বিলিয়েছে তাদের কিছু হলে সে কিভাবে থাকবে? নিভৃত দৌড়ে এসে উড়নাটা ঠিক করে দেয়। বামহাতটা ধরে শক্ত করে। হাসপাতালে মানুষ গিজগিজ করছে। সবাই সবার প্রিয়জনের তাগিদে এসেছে। কেউবা নিজের তাগিদে। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের সামনে লাইন। এতো এতো মানুষ এতো বড় হাসপাতাল নিভৃত কি করবে বুঝতে পারছেনা। এখানে সে পূর্বে আসেনি। মৌনও নিজের মাঝে নেই। মিরা, নাজমুলকে আনেনি নিভৃত। নাজমুল অসুস্থ বলে।
পাশের লাল বিল্ডিংয়ে ছুটে গেলো মৌন। অপারেশন ওয়ার্ড এদিকেই থাকার কথা। মৌনও ঠিক করে চিনেনা। হঠাৎ সামনে আলমকে দেখতে পেয়ে নিভৃতের হাত ছাড়িয়ে বাবাকে ঝাপটে ধরে মৌন। আলম আকস্মিক জড়িয়ে ধরায় খানিকটা পিছিয়ে যান। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। মৌন ভেজা গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘রথি কই বাবা?’
‘দুতালায় মহিলা ওয়ার্ডে।’
‘আমাকে নিয়ে চলোনা বাবা।’
দুতালায় মহিলা ওয়ার্ডে প্রবেশ করে মৌন, নিভৃত। দুইপাশে হাসপাতালের বেড। রোগী, তাদের আত্মীয়স্বজনে ভরা চারপাশ। কারো হাতে ঔষধ, কেউবা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে। এককোনায় একটা বেডে শুয়ে আছে রথি। মুখটা পাণ্ডুর। হাতে স্যালাইন।
৬৫.
পাশে একটা টুলে বসে আছেন মর্জিনা। কেঁদে কেঁদে বিলাপ করছেন তিনি। আর কেউ নেই পাশে। মৌন দৌড়ে গিয়ে বোনের পাশে বসে। মুখটায় হাত বুলায়। ডাকে,
‘রথি, রথিরে। আমি তোর আপা।’
মর্জিনা পাশ থেকে বলেন,
‘ডাকিস না। ঘুমের ঔষধ দিসে। একটু ঘুমাক।’
মৌন উঠে এগিয়ে যায় মায়ের দিকে। সিক্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘মা, কি হইছিলো?’
মর্জিনা বিলাপ করে করে বলেন,
‘জানিনারে মৌন মাইয়াটার হঠাৎ কি হইলো। দুইদিন ধইরা চুপ কইরা থাকে। ভাত খায়না। আজকা সকালে হঠাৎ কইরা কয় মা আমারে মাফ কইরা দিও। আমি কিছু বুঝিনাই। আমার ময়নার গালে দুইডা থাপ্পড় দিয়া কই এগুলা কিসব কথা কস। আমার ময়নায় রাগে, কান্দে। আমি ধান ঝারতাছি হঠাৎ কইরা পুষ্পে দৌড়ায় আইসা কয় ও মা ছোটআপা নদীতে ঝাঁপ দিসে। আমার ময়নায় তো সাঁতার পারেনা। দৌড়ায় গিয়া দেখি রিপ্তে তুলছে পানিরতে। পরে কেমনে কি হইলো জানিনা। হাসপাতালে ছুইটা আইছি।’
নিভৃত পাশে দাঁড়িয়ে সবটা শুনছে। আসলে তার কি বলা উচিত সে বুঝতে পারছেনা। প্রিয়জনের কিছু হলে কেমন লাগে সে ব্যথা হয়তো তার থেকে বেশি কেউ জানেনা। সে আলমকে জিজ্ঞেস করে,
‘আংকেল, পুলিশ কেস হয়েছে? আর ওতো নদীতে কোনোভাবে পড়েও যেতে পারে?’
‘না, আব্বা। রথি নদীতে ঝাঁপ দিসে। কয়েকজন দূর থেকে দেখছিলো। আর পুলিশ আসছিলো। মেম্বাররে বলে ব্যাপারটা মিটাইছি।’
সময় যায়। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো। হাসপাতালের কোলাহল এখনো কমেনি। নিভৃত বাইরে থেকে ফল, খাবার নিয়ে এসেছে। মৌন রথির পাশে মূর্তির মতো বসে। খাবারগুলো মর্জিনার হাতে দিলো সে। মর্জিনা আঁচল দিয়ে চোখের কোণা মুছে বললেন,
‘তুমি বাড়িতে যাওগা বাবা। তোমার কষ্ট হইতাছে। বাড়িতে গিয়া বিশ্রাম করো।’
নিভৃত লজ্জা পায়। বিপদের মুখেও তার কথা ভাবছে মর্জিনা। মৌন দুইপিস রুটি, একটা কলা আর একটা আপেল নিভৃতকে খেতে দেয়। নরম কন্ঠে বলে,
‘আমি আজকে এখানে থাকবো রাতে। আপনি ফরিদপুর বাড়িতে যান। গিয়ে রেস্ট নিন। অনেকটা ধকল গেলো আপনার উপরে। এখানে থাকতে আপনার কষ্ট হবে। সারারাত বাইরে বসে থাকতে পারবেন না। কালকে রথিকে ডিসচার্জ করবে। আপনি যান।’
নিভৃতের খারাপ লাগছে। মেয়েটা কি তাকে আপন ভাবেনা একটুও।
‘থাকি কিছুক্ষণ।’
‘আপনি ক্লান্ত। ড্রাইভ করেছেন অনেকটা পথ দয়াকরে চলে যান।’
নিভৃত চলে আসে। খানিকটা অভিমান হলো কি!
স্যালাইন শেষ হয়ে রক্ত উঠে যাচ্ছে হাতে। মৌন আশেপাশে খুঁজেও কোনো নার্স পেলোনা। দৌড়ে গেলো বাইরে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া মানে একপ্রকার যুদ্ধ। পাশের ওয়ার্ড থেকে নার্স এনে স্যালাইন খুলায় মৌন। মর্জিনা পাশে টুলে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। আলম ওয়ার্ডের বাইরে রাখা চেয়ারে বসা। পুরুষের রাতে মহিলা ওয়ার্ডে থাকা নিষেধ। এখানে আসার পর একবারও রিপ্তকে দেখেনি মৌন। ব্যাপারটায় সে খুব অবাক। তাদের বিপদে রিপ্ত সবসময় প্রহরীর মতো পাশে থাকে। অথচ আজ নেই! তাছাড়া রথিকে নাকি রিপ্তই হাসপাতালে নিয়ে এসেছে!
৬৬.
মাকে জাগাতে ইচ্ছে করেনা মৌনর। পান খেয়ে লাল করা শ্যামবর্ণ মুখটা মেয়ের চিন্তায় বিবর্ণ হয়ে আছে। মৌন রথির পাশ থেকে উঠে বেডের সামনে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তার মাথায় কেবল দুটো প্রশ্ন ঘুরছে রথি কেন পানিতে ঝাঁপ দিলো? আর রিপ্ত কই? দুইটার কি কোনো যোগসূত্র আছে?
হঠাৎ মৌনের চোখ যায় বাইরে। মানুষে ভরা নিচে। একটা রক্তাক্ত লাশ নিচে পলিথিনের উপর রাখা। পাশে দুইজন মহিলা চিৎকার করে কাঁদছেন। মৌনের কানে বারি খায় সেই চিৎকার।
‘ও ভাইরে। আমাগোরে থুইয়া তুই কেন গেলিরে। আমাগো কি হইবোরে। তোর নতুন বউটার কি হইবোরে। আল্লাহগো।’
কি আর্তনাদ! বেদনা সে চিৎকারে। চোখ ফিরিয়ে নেয় মৌন। হয়তো লোকটা এক্সিডেন্ট করেছে। কষ্ট হয় মৌনর। একটা এক্সিডেন্ট কত সহজে সব আশা কেড়ে নেয়। প্রিয়জনকে আকস্মিকভাবে হারিয়ে পরিবার স্তব্ধ, নিশ্চুপ হয়ে যায়। হাসপাতালে আসলেই কেবল বুঝা যায়, উপলব্ধি করা যায় মানুষ ঠিক কতটা অসহায়!
রথির পাশে গিয়ে বসে মৌন। চোখ লেগে যায় তার। নরম, মলিন কন্ঠস্বর।
‘আপা।’
হকচকিয়ে উঠে মৌন। রথি নিবুনিবু চোখে তাকিয়ে। মৌন রথির গাল স্পর্শ করে বলে,
‘কোথায় কষ্ট হচ্ছে। আপাকে বল।’
রথি আলতো করে মৌনর হাতটা নিয়ে তার হৃদপিণ্ডের পাশটায় রাখে। নরম স্বরে বলে,
‘এইখানটায় বড্ড কষ্টরে আপা।’
‘কি হইছে আপাকে বল।’
‘আমি রিপুভাইরে ভালোবাসি আপা।’
কথাটা শুনে থমকে যায় মৌন। অবাক চোখে রথির দিকে তাকায় সে। রথি থেমে থেমে বলে,
‘রিপু ভাই তোমারে ভালোবাসে আপা। তোমার তো এখন বিয়ে হয়ে গেছে আপা। আমি যে রিপুভাইরে ভালোবাসি আপা।ভাই কেনো বুঝেনা।’
রথি থামে। কথা বলতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার।
#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২৩
৬৭.
‘ও আপা বলোনা। তুমি রিপু ভাইরে বুঝাইবা। আমি যে তাকে ভালোবাসি। তুমি তারে বুঝাও আপা।’
রথি হাঁপিয়ে যায়। মৌন বোনের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে,
‘তোর আপা আছেনা। সব হবে। তুই চিন্তা করিসনা।’
রথি থামে। নিশ্চল চোখে তাকিয়ে থাকে বোনের মুখপানে। তার মৃগনয়না চোখে কৃতজ্ঞতা। ফজরের আজান ভেসে আসছে পাশের মসজিদ থেকে। বাইরে কিছু পাখির কলরব শুনা যাচ্ছে। মৌন মাথায় উড়না টেনে দেয়। শীত পড়েছে চারপাশে। শীতল আবহাওয়ায় শরীরও হিম ধরে আছে।
_________________
সকাল দশটা বাজে। কিছুক্ষণ পর ডিসচার্জ করা হবে রথিকে। নিভৃত এখনো আসেনি হাসপাতালে। মৌন অপেক্ষায় ছিলো। ভেবেছিলো হয়তো আসবে। আলম গিয়েছেন বাইরে নাস্তা আনতে। মৌন মহিলা ওয়ার্ড থেকে বাইরে বের হয় ডাক্তারের সাথে কথা বলার জন্য। হঠাৎই চোখ যায় দূরে। এককোনায় চেয়ারে বসে আছে একজন। মাথানিচু করে আছে লোকটা। চুলগুলো উসকোখুসকো। মৌন ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসে। লোকটা স্থির, ভাবলেশহীন। মৌন নরম কন্ঠে ডাকে,
‘রিপু ভাই।’
রিপ্ত হকচকিয়ে তাকায়। মৌন তার পাশে এলো কখন? রিপ্ত মাথা নিচু করে আবার। মাথাটা চেপে ধরে বসে থাকে কেবল। মৌনও চুপ করে আছে। রিপ্তকে সে কিছু বলতে চায় তবে সময় নিয়ে। রিপ্ত ডুবে যায় আজ থেকে পাঁচদিন আগের ঘটনায়।
______________
শাপলাবিলের কিনারে বসে আছে রিপ্ত। দৃষ্টি তার দূরে। বহুদূরে। যদি দেখা মিলে কাঙ্খিত মুখটার! হায়! কোথায় সেই মুখ।
‘রিপু ভাই।’
রথি নিজের দুইটা বেণী ঝুলিয়ে চোখে গাঢ় কাজল দিয়ে এসেছে। ছটফটে, চঞ্চল রথি পাশে বসলো রিপ্তের।
‘আমাকে রিপু ভাই ডাকতে মানা করছিনা।’
‘আপা তো ডাকে।’
‘আপা আর তুই এক না।’
‘কেন রিপু ভাই?’
‘জানিনা রথি। মাথা খাইস না। নিজের কাজ কর গিয়া।’
‘আমার ধ্যান, জ্ঞান সব যে আপনে রিপু ভাই।’
একটা থাপ্পড় পড়লো রথির গালে। রিপ্ত ক্লান্ত এসব শুনে। আজ দুইটা মাস ধরে রথির ব্যবহারে অবাক হচ্ছে রিপ্ত। এগুলো বয়সের দোষ। রিপ্ত জানে। তাই ঠান্ডা মাথায় বুঝাতো কখনো মারতোও। তবে রথি নাছোড়বান্দা। এই মেয়েটা ছোট থেকেই জেদি।
রথি গালে হাত দিয়ে কাঁদে। ভেজা গলায় বলে,
‘আপার তো বিয়ে হয়ে গেছে। আমারে একটু ভালোবাসলে কি হয়?’
‘চুপ। একদম চুপ। যা এখানতে। আমার হাত উঠবো রথি।’
‘বাবা তোমারে ঠকাইছে আমি জানি। আমি তোমাদের ঝগড়া শুনছি। ও রিপুভাই সব ভুইলা আমারে ভালোবাসলে কি হয়?’
রিপ্ত রথির গাল চেপে ধরলো। রাগ উঠলে তার মাথা ঠিক থাকেনা।
‘এই কথা যদি আর কেউ জানসেরে রথি তোরে আমি জ্যান্ত পুঁতে ফেলমু।’
রথি ভেজা চোখে দৌড়ে চলে যায়। রিপ্ত ধপাস করে পাশে বসে পড়ে। একোন পরীক্ষার মুখোমুখি সে। ভেবেছিলো বাকিটা জীবন একা কাটাবে।
হঠাৎ করে বদলে গেলো রথি। চুপ করে থাকে। কোনো চঞ্চলতা নেই, লাফালাফি নেই একেবারে চুপ। গতকাল সকালে নদীর পাড় থেকে গরুর জন্য ঘাস কাটছিলো রিপ্ত। হঠাৎ পিছন থেকে রথি চিৎকার করে বলে,
‘রিপু ভাই আমারে ভালোবাসবেন?’
রিপ্ত না ফিরেই বলে,
‘পাগলামি করিস না। মাইর খাবি।’
‘শেষবারের মতো বলতেছি রিপুভাই।’
‘পাগলামি করিসনা।’
‘ঠিক আছে।’
ধপাস করে একটা শব্দ হলো।
‘রিপু ভাই?’
মৌনর ডাকে স্তম্ভিত ফিরে রিপ্তর। নিচে তাকিয়ে বলে,
‘কিছু বলবি মৌনি?’
৬৮.
‘আমি যদি তোমার কাছে কিছু চাই। দিবা আমাকে?’
রিপ্ত নিচে তাকিয়ে মলিন হাসে। মনে মনে বলে,
‘আমার ছটফটে পিচ্চিটা জান চাইলে জান দিতেও রাজিরে মৌনি। জান দিতেও রাজি।’
‘কি চাই তোর?’
‘তুমি রথিকে বিয়ে করো রিপুভাই।’
‘মৌন!’
রিপ্ত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ভালোবাসার মানুষটা আজ বলছে তুমি অন্যকারো হয়ে যাও! যদিও ভালোবাসাটা একতরফা। মৌন বুঝে একতরফা ভালোবাসার কষ্ট। তবে সে নিরুপায়।
‘রথি তোমাকে ভালোবাসে রিপুভাই। একটা মরিচীকার পিছনে আর কত দৌড়াঁবে তুমি? এবার নিজের জীবনটা গুছিয়ে নাও।’
‘এটাই তোর ইচ্ছা।’
‘তুমি কি রাগ করলে রিপুভাই?’
‘না।’
‘দয়াকরে আমায় ভুল বুঝোনা রিপুভাই। আমার বোনটা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসছে। ওঁরে তুমি বাঁচাও।’
রিপ্ত বিরবির করে,
‘বোনের কষ্টটা দেখলি আর আমার জ্বলনটা দেখলিনা তুই।’
‘তাই হবে।’
‘সত্যি রিপুভাই।’
‘হুম।’
নিভৃত আসতে চেয়েছিলো। তবে মৌন তাকে মানা করে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর রথিকে ডিসচার্জই করা হবে।
বাড়িতে আনা হয়েছে রথিকে। খাটে শুয়ে আছে। শরীরটা বড্ড দুর্বল তার। সোফায় বসে আছেন আলম। পাশে নিভৃত বসা। মৌন দাঁড়িয়ে আছে। কোথ থেকে ছুটে এলো রিপ্ত। তার সাথে দেওয়ান কাজী।
‘চাচা?’
‘রিপ্ত। তুই দেওয়ান কাজীরে আনছোত কেন?’
‘চাচা। আপনে অনেক কিছু করছেন। আমি কিছু বলিনাই। আজ আমি বলমু আপনি শুনবেন। আমি এই মুহূর্তে রথিরে বিয়া করবার চাই।’
‘বিয়া!’
‘হ, চাচা।’
নিভৃত হতবিহ্বল হয়ে রিপ্তকে দেখছে। ছেলেটা রেগে আছে খুব। আলম কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না। কেবল মাথা নুইয়ে রাখলেন। যার অর্থ তিনি রাজি। তিন কবুল বলে বিয়ে সম্পন্ন হলো তাদের। মৌনর দিকে ফিরে কৃতজ্ঞতায় ভরা হাসি দিলো রথি। কতটা প্রাণবন্ত সে হাসি! মৌনর আগামীকাল পরীক্ষা। তাই আজই রওনা দিতে হবে তাদের। নিভৃত বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। রাত আটটা প্রায়। বাঁশবাগানের পাশে বসে সিগারেট টানছে রিপ্ত। মাথাটা বড্ড ধরেছে তার।
‘রিপু ভাই’
‘চলে যাবি শুনলাম?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওহ্।’
‘রথি এখন তোমার স্ত্রী রিপুভাই। ওঁরে কষ্ট দিয়োনা। জীবনটাকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে নাও। ও তোমাকে ভালোবাসে। পবিত্র বন্ধনের জোরে তুমিও একদিন ভালোবাসতে শুরু করবা। দেখে নিও। আমাকে না হয় মরিচীকা ভেবে ভুলে যেও। আমাকে ভুল বুঝোনা। তোমাদের ভালোর জন্যই এমনটা করেছি আমি। তোমাদের জন্য দোয়া করি। সুখে থেকো।’
চলে আসে মৌন। পিছনে রেখে আসে ছলছল করা দুটো আঁখির মালিককে।
৬৯.
আজ প্রায় দেড় মাস হয় তারা গ্রাম থেকে ফিরেছে । মৌনর শরীরটা প্রতিনিয়ত খারাপ লাগে। কাউকে বলতেও পারেনা আবার সইতেও পারেনা। মৌনকে খাইয়ে দিচ্ছেন মিরা। মেয়েটা একদম নিজের যত্ন নেয়না। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠায় জুলেখাকে ডেকে বললেন খুলে দিতে।
অহনা আর রিজভীকে দেখে জুলেখা সালাম দিয়ে ভিতরে ঢুকতে বলে। অহনা, রিজভী ড্রয়িং রুমে এসে সোফায় বসেন। জুলেখা ডাইনিং টেবিলে ছুটে গিয়ে হাঁপিয়ে বলে,
‘বড়আফা। অহনা ম্যাডাম আইছে।’
রুহানির মা, বাবা এসেছে শুনে থমকে যান মিরা। তারা তো অস্ট্রেলিয়া চলে গিয়েছিলো।
‘ভাবি। কেমন আছেন?’
কথাটা বলে মৌনকে দেখে থমকে যান অহনা। পরখ করেন আগে দেখেছেন কিনা। তবে মনে পড়েনা তার। মিরা দাঁড়িয়ে হাসি মুখে বলেন,
‘ভালো আছি ভাবি। আপনি কেমন আছেন? অস্ট্রেলিয়া থেকে কবে ফিরলেন? শুনলাম না যে।’
‘গতকাল রাতেই ফিরেছি। আবার চলে যাবো। মেয়েটার কবর একটা নজর দেখতে আসলাম। তিনদিন পরে তো মেয়েটার মৃত্যুবার্ষিকী।’
মৌন দুজনের কথা শুনছে দাঁড়িয়ে। মহিলাটাকে সে চিনেনা। তবে যতদূর বুঝতে পারছে তিনি রুহানির মা।
‘ভাবি, ও কে?’
‘ও নিভৃতের বউ।’
অহনা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। নিভৃত এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিলো? এই নিভৃতের ভালোবাসা?
‘নিভৃতের বউ মানে? নিভৃত বিয়ে করেছে?’
‘হ্যাঁ।’
অহনা আর দাঁড়ালেন না। ড্রয়িংরুমে চলে এলেন। নিভৃত বাবার ঘরে ছিল। ড্রয়িং রুমে এসে অহনা, রিজভীকে দেখে থমকে দাঁড়ালো সে। পিছন থেকে ডাকলো,
‘আম্মু।’
অহনা শুনলেন না। রিজভী সাহেবও কিছু বুঝতে পারছেন না। রিজভী সাহেবকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন অহনা। নিভৃত নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো সেদিকে। মৌন সবটাই দেখছে। তবে তার দোষটা কোথায়?
টিএসসিতে বসে আছে মৌন, লুবনা আর ঝিনিয়া। মৌনর সাথে ভালো সখ্যতা তাদের। মৌন চুপচাপ বসে আছে। আজ নিভৃত তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। অনেকটা এড়িয়ে চলেছে। মৌন ভেবে পায়না তার দোষটা কোথায়! সে তো কিছু করেনি। সবাই কেনো তার প্রতি রাগ দেখায়। সবার রাগের কেন্দ্রবিন্দু কেন সেই হয়!
(চলবে)…..
(চলবে)…..