ময়ূখ পর্ব -২০+২১

#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২০

৫৮.
ব্রিজের উপর দিয়ে চলছে গাড়ি। ব্রিজের নিচে স্বচ্ছ জলধারা। এটা মূলত সিলেট-জাফলং রোড। পাশে ঐতো দূরে পাহাড় আর পাহাড়। এগুলো ভারতের পাহাড়। শুধু চূড়া নয় সম্পূর্ণ, স্ব বিস্তীর্ণ গিরিরাজের দল। আকাশের নীলচে রঙে অভাবনীয়, মোহনীয় সৌন্দর্য। মৌন গাড়ির জানালা দিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মন খুলে, সুর মেলে ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে একধ্যানে বাইরে তাকিয়ে সুরের ধারা ছড়িয়ে দিলো মৌন। বাইরে তাকিয়ে আপন মনে গাইছে সে,

চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন,
আর কবিতায় শুয়ে কাপ্লেট
আহা উত্তাপ কত সুন্দর,
তুই থার্মোমিটারে মাপলে
হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল,
মিঠে কুয়াশায় ভেজা আস্তিন
আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম,
আর তুই কাকে ভালোবাসতিস
চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন।

প্রিয় বন্ধুর পাড়া নিঝুম,
চেনা চাঁদ চলে যায় রিকশায়
মুখে যা খুশি বলুক রাত্তির,
শুধু চোখ থেকে চোখে দিক সায়
পায়ে ঘুম যায় একা ফুটপাথ,
ওড়ে জোছনায় মোড়া প্লাস্টিক
পায়ে ঘুম যায় একা ফুটপাথ,
ওড়ে জোছনায় মোড়া প্লাস্টিক
আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম,
আর তুই কাকে ভালোবাসতিস।
চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন।

পোষা বালিশের নিচে পথঘাট,
যারা সস্তায় ঘুম কিনতো
তারা কবে ছেড়ে গেছে বন্দর,
আমি পাল্টে নিয়েছি রিংটোন
তবু বারবার তোকে ডাক দিই,
একি উপহার নাকি শাস্তি
তবু বারবার তোকে ডাক দিই,
একি উপহার নাকি শাস্তি
আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম,
আর তুই কাকে ভালোবাসতিস

চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন,
আর কবিতায় শুয়ে কাপ্লেট
আহা উত্তাপ কত সুন্দর,
তুই থারমোমিটারে মাপলে
হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল,
মিঠে কুয়াশায় ভেজা আস্তিন
আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম,
আর তুই কাকে ভালোবাসতিস
চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন।

নিভৃত সারাটা সময় মন দিয়ে গানটা শুনছিলো। তার মনে হচ্ছে প্রত্যেকটা শব্দ তার জন্য গাওয়া। কি অদ্ভুত ভাবনা!
‘তুমি তো খুব ভালো গান করো।’
‘বাহবা, আজ আমার প্রশংসা করলেন যে?’
‘তোমার না তোমার গানের স্টুপিড!’
‘হুহ্। প্রশংসাও করবে আবার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে।’
‘বুঝতে পারলে জিজ্ঞেস করো কেন?’
‘আমার ইচ্ছে।’
‘একেবারে পিয়াইন নদীর অতলে চুবিয়ে আনবো। তখন দেখবো থাকে কিনা তোমার ইচ্ছে।’

মৌন বিরক্তিতে অন্যদিকে তাকালো। এই লোকের সাথে কথা মানেই ঝগড়া। দুইপাশে ধানক্ষেত দেখা যাচ্ছে। শো শো বাতাসে ধানক্ষেতের গাছগুলো এপাশ ওপাশ হচ্ছে। কিছুদূর যাওয়ার পর ঝর্ণার দেখা মিললো। কি অভূতপূর্ব পাহাড়ের গাঁ হতে নীর প্লাবিত হওয়ার দৃশ্য! গাড়ি থামলো তামাবিল জিরো পয়েন্টের কাছে। জাফলং হতে পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে তামাবিল জিরো পয়েন্ট। এটি মূলত সিলেট ও ভারতের শিলংয়ের রাস্তার মধ্যকার চৌকি। গাড়ি থেকে নেমে জায়গাটা ঘুরে দেখলো দুজনে। আশেপাশে অনেক মানুষ। মৌন উচ্ছ্বাসের সাথে দেখছে। মাঝে ফোনে কথা হলো বাড়ির মানুষদের সাথে। মিটির সাথে।

৫৯.
জাফলং। সৌন্দর্যের লীলাভূমি। ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই লীলাভূমি। পাহাড় আর নদীর অপূর্ব সম্মিলন। এর অপর পাশে ভারতের ডাওকি অঞ্চল। ডাওকি অঞ্চলের পাহাড় থেকে ডাওকি নদী এই জাফলং দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মূলত পিয়াইন নদীর অববাহিকায় জাফলং অবস্থিত। সিলেট জেলার জাফলং-তামাবিল-লালখান অঞ্চলে রয়েছে পাহাড়ী উত্তলভঙ্গ।

গাড়ি থেকে নেমে পাশের বিস্তর মাঠে দাঁড়িয়ে অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করছে দুজনে। বালিময় আস্তরণ পেরিয়ে নদী। অপরপাশে ভারতের পাহাড়! পাথর আর স্বচ্ছ পানির অভূতপূর্ব নয়নাভিরাম।

মৌনকে এতো জোর করেও পানিতে নামাতে পারলোনা নিভৃত। বেচারির মনে ভয় যদি নিভৃত তাকে সত্যিই পানিতে চুবায়। এই লোকের মাথার তাঁর ছিঁড়া। কোনো বিশ্বাস নাই এর।
নিভৃত বিরক্তি নিয়ে বললো,
‘এই মেয়ে আসো। পানিতে পা ভিজিয়ে চলে যেও।’
‘না।’
‘আশ্চর্য! তোমাকে কি আমি সত্যিই পানিতে চুবাবো নাকি?’
‘আমি কি জানি। আপনি ভালো জানেন।’
‘তুমি তো বড্ড বিরক্ত করছো আমায়! চলো বলছি।’
‘না, না। আমি যাবোনা।’
‘তো থাকো। যত্তসব।’

নিভৃত নিজেই পানিতে পা ভেজালো। মৌন আড়চোখে সাদা শার্ট, ডেনিম প্যান্ট পরিহিত লোকটাকে অবলোকন করছে। প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে পানিতে পা ভেজাচ্ছে নিভৃত। প্রিয়জন পাশে আছে বলেই পূর্ণভাবে জাফলং উপভোগ করতে পারছে মৌন। আরো কতমানুষ! সবাই সবার প্রিয়জনের সাথে এসেছে। হাতে হাত রেখে পানিতে ভিজছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে। কত আনন্দ! কত উচ্ছ্বাস চারপাশে!

‘আপু এই পাথরটা কিনবেন?’

একটা ছোটছেলের কথায় পিছনে ফিরে মৌন। ছেলেটা মায়াবী হেসে একটা রঙিন পাথর এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘নিবেন, আপু?’

মৌনর মায়া হয়। তবে তার ব্যাগ সাথে আনেনি। ছেলেটা মৌনকে চুপ থাকতে দেখে চলে যেতে নেয়। কারণ চুপ থাকার অর্থ সে ধরে নেয় মৌন পাথর কিনবেনা।
‘এই দাঁড়াও।’

ছেলেটা উচ্ছ্বসিত হয়ে পিছনে ফিরে বলে,
‘নিবেন আপু একটা পাথর? দশটাকা।’

মৌন নিভৃতকে ডাক দেয়। মৌনর ডাকে এগিয়ে আসে নিভৃত,
‘কি হয়েছে?’
‘আমাকে একশটাকা দিতে পারবেন? আমি ব্যাগ নিয়ে আসিনি। গাড়িতে উঠলে দিয়ে দিবো।’
‘আমি কি বলেছি আমাকে টাকা ফেরত দিতে হবে? স্টুপিড।’
‘না, মানে..
‘কেন চাই?’

ছোট ছেলেটিকে দেখিয়ে বললো,
‘ওকে দিবো।’

ছেলেটির দিকে তাকালো নিভৃত। ফুটফুটে প্রাণবন্ত একটা ছেলে। দুহাত ভর্তি পাথর।
‘ভাইয়া একটা পাথর কিনবেন?’

নিভৃত নরম কন্ঠে বললো,
‘নাম কি তোমার?’
‘অতুল।’
‘অতুল তুমি কি জানো এভাবে জাফলংয়ের পাথর বিক্রি একটা অপরাধ। এতে তোমার সাজাও হতে পারে।’

ছেলেটি ঘাবড়ে গিয়ে বলে,
‘কেন ভাইয়া?’
‘জাফলং আমাদের রাষ্ট্রের প্রাকৃতিক সম্পদ। এই যে তুমি নদী থেকে পাথর কুড়িয়ে বিক্রি করো একবার ভেবে দেখোতো একসময় সব পাথর ফুরিয়ে গেলে কি হবে?’
‘কি হবে ভাইয়া?’
‘প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হবে। তখন দেখা যাবে বাংলাদেশের মানুষের ঘরে ঘরে জাফলংয়ের পাথর তবে জাফলংয়েই পাথর নেই। আমি কি বলছি বুঝতে পারছো অতুল?’
‘জ্বি, ভাইয়া। আসলে পারিবারিক অবস্থার কারণে আমি এই কাজে নেমেছি।’
‘তোমার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি তবে তোমার কারণে প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হোক তা তুমি চাও?’
‘না, ভাইয়া। আমি আর পাথর বিক্রি করবোনা।’

মাথা নিচু করে বলে অতুল। নিভৃত হেসে বলে,
‘তুমি তো খুব সুন্দর বাংলা বলো। সাধারণত তোমার বয়সী জাফলংয়ের ছেলেদের এতো সুন্দর বাংলা বলতে আগে দেখিনি।’

মৌন পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছে। এ কোন নিভৃত?

‘আমরা আগে ঢাকা থাকতাম ভাইয়া। আমার আব্বু হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। মা খরচ সামলাতে না পেরে সিলেট দাদুবাড়ি চলে আসে। এখানেও সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা। মা কাপড় সেলাই করে সংসার চালান।’

মৌনর খুবই খারাপ লাগছে। এত ছোট একটা ছেলে অথচ কত কষ্ট তার।

৬০.
‘পড়াশোনা করো তুমি?’
‘না, ভাইয়া। ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলাম পরে আর পড়া হয়নি।’

নিভৃত একহাজার টাকার নোট বের করে দিতে চাইলো অতুলকে।
‘আমি এটা নিতে পারবোনা ভাইয়া। মা আমাকে বকবে।’
‘বড় ভাই দিচ্ছে। নেও।’

নিভৃত জোর করে অতুলের হাতে টাকাটা গুঁজে দিলো। মুচকি হেসে বললো,
‘তোমার মায়ের ফোন নাম্বারটা দাওতো অতুল।’
‘কেন ভাইয়া?’
‘পড়তে চাও তুমি?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমার এই ভাইয়া যদি তোমার পড়াশোনার দায়িত্ব নেয়? পড়বে তো?’
‘কিন্তু!’
‘কোনো কিন্তু নয় অতুল।’

অতুলের থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে তার মায়ের সাথে কথা বলে নিভৃত। যদিও তিনি প্রথমে মানা করছিলেন তবে ছেলের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে রাজি হয়েছেন। অতুলের থেকে বিদায় নিয়ে তারা রওনা দেয় জৈন্তাপুর রিসোর্টে। অতুল একধ্যানে গাড়িটার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। এই জাফলংয়ে কত মানুষ এসেছে। কত মানুষ তার সাথে খারাপ আচরণ করেছে। তবে আজকের মতো এমন দেবদূতের মতো কেউ আসেনি। কেউনা। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। অতুল মন ভরে দোয়া করে।

__________________

মৌন অবাক চোখে সে কখন থেকে নিভৃতকে দেখছে। নিভৃত বিরক্ত হয়ে গাড়ি থামিয়ে একদম মৌনের মুখের কাছে চলে এলো। ঘটনার আকস্মিকতায় মৌন হতভম্ব।
‘দেখো ভালো করে দেখো। আরো দেখতে চাও।’
‘আপনি এমন করেছেন কেন! দূরে যান।’

নিভৃত দূরে সরে বলে,
‘আমি সুন্দর আমি জানি। এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে নজর লাগাতে হবেনা।’
‘আমি আপনাকে ভালো ভেবেছিলাম। তবে না আমার ধারণা ভুল। আপনি একটা বদলোক।’
‘তাই। তুমি আজ জানতে পারলে। খুবই ভারাক্রান্ত হলাম শুনে। আমার কি কান্না করা উচিত?’
‘আপনি আসলেই ফালতু।’

নিভৃত মিটিমিটি হেসে গাড়ি চালনায় মন দিলো। মৌন বাইরে তাকিয়ে রাগে গজগজ করছে। একটু আগেও নিভৃতকে সে ভালো ভেবেছিলো! কতটা ভুল ছিল সে! এই লোক ভালো হবার নয়।
#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২১

৬১.
জৈন্তাহিল রিসোর্ট। জায়গাটা খুবই মনোমুগ্ধকর। বিশাল বড় দুইটা রিসোর্ট পাশাপাশি। দেয়ালগুলো সাদারঙা। উপরে লাল রঙের চাল। সামনে কাঁচে আবৃত। সত্যিই দেখার মতো রিসোর্ট। মাঠের এককোণে অবস্থান তাদের। স্ব বিস্তীর্ণ মাঠে যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজ আর সবুজ ঘাস। চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা। গাড়ি থেকে নেমে মৌন উৎফুল্ল হয়ে বলে,
‘এখানে যদি সারাজীবন থাকতে পারতাম!’
‘বেশি না কয়েক কোটি টাকা লাগবে।’
‘মানে?’
‘এই রিসোর্টে একরাত থাকতেই পাঁচহাজার প্রয়োজন। আর তুমি সারাজীবন থাকতে চাইলে তো কোটি টাকাই প্রয়োজন। তাই না?’
‘আমি কি সত্যি সত্যিই থাকবো নাকি! এটা তো এখানের সৌন্দর্য দেখে বললাম। আপনি এতো প্যাঁচান কেন?’
‘আমি লজিক ছাড়া কথা পছন্দ করিনা।’

নিভৃতের কথায় মৌন অন্যদিকে ফিরে ভেংচি কাঁটলো। বিরবির করে বললো,
‘তাঁর ছিঁড়া মানুষের আবার লজিক!’
‘এই কি বললে তুমি?’
‘কিছুনা।’
‘কিছুনা বললেই ভালো।’

মাঠে দাঁড়িয়ে তর্ক করার পর মৌন বললো,
‘হইছে। নাকি আরো বাকি আছে? চলেন রিসোর্টটার ভিতরে ঘুরে আসি।’
‘এখানে কি ভিতরে ঢুকে চেয়ার টেবিল দেখার জন্য আসছি নাকি, স্টুপিড!’
‘তাহলে কেন আসছেন?’

নিভৃত বিরক্ত হলো খানিকটা। এই মেয়ের কি কোনো জায়গা সম্পর্কেই ধারণা নেই?

‘বাংলাদেশ লাস্ট হাউস দেখতে যাবো।’
‘তাই!’
‘হুম।’
‘চলুন। কথা বলে দেরি করছেন কেন!’

অবাক হয় নিভৃত। এতক্ষণ নিজেই তো ঝগড়া করলো তার সাথে। আর এখন বলছে সে দেরি করছে! জৈন্তাহিল রিসোর্টের মাঠের পাশ দিয়ে মাটির আঁকাবাঁকা রাস্তা। মৌন, নিভৃত হেঁটে চলেছে। যদিও মৌনর খুবই ইচ্ছে করছিলো নিভৃতের হাতটা ধরতে তবে কিসের যেনো বাঁধা! দুইপাশে হরেকরকম গাছপালা। পাখির কুজনে মুখরিত চারপাশ। হঠাৎই মৌনর ডানহাতটা আঁকড়ে ধরেছে নিভৃত। স্বাভাবিকভাবে সামনে হেঁটে যাচ্ছে সে। ঠিক থাকতে পারছেনা মৌন। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে হাতের বন্ধনটার দিকে! এতো দৃঢ় কেন এই বন্ধন! এই বন্ধন ছিন্ন করার ক্ষমতা যে মৌনর নেই।

__________________

একটা বিলের উপর রড দিয়ে তৈরি ঘর। সরু মাটির রাস্তা ধরে সামনে এগোচ্ছে দুজনে। একপাশে বিল। বিলে ফুটে আছে শাপলা, পদ্মফুলের দল। যদিও এখন শাপলা,পদ্মফুল ফুটার সময় না। তবে এ বিলে ফুটেছে। কি মাধুর্য সে দৃশ্যে! অপরপাশে ধানক্ষেত। দূরে ভারতের পাহাড়। রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে কাঠগাছের সারি! ঘরটার সামনে এসে থামলো দুজনে। মৌনর অদ্ভুত লাগছে। এই ঘরটি বাংলাদেশের শেষ ঘর। কি অদ্ভুত! এপাড়ে পা রাখলে বাংলাদেশ আর ওপারে ভারত। দু দেশের সীমানায় এখন নিভৃত, মৌন।

৬২.

‘এই মেয়ে’
‘কি?’
‘ঐ যে মেঘের দল দেখছো?’
‘হুম’
‘পাহাড়ের সবুজে ঘেরা অভয়ারণ্য দেখছো?’
‘হুম।’
‘বিলের পানিতে পদ্মফুলের মেলা দেখছো?’
‘দেখছি তো!’
‘এই যে ছোট ঘরটা দেখছো?’
‘হুম।’
‘আমার জংলী বিড়ালটির সাথে এখানে ঘর বাঁধবো। মেঘের দলে দুজনে ভাসবো। সবুজের মায়ায় হারাবো। পদ্মফুল কানে গুঁজে দি…

হঠাৎ থেমে যায় নিভৃত। এসব কি বলছে সে! আজ সকালে গোসল করতে গিয়ে পানি লেগে যখন পিঠ জ্বালা করছিলো তখন নিভৃত নিজের অজান্তেই মৌনর নাম দেয় জংলী বিড়াল। আজ এই প্রকৃতির সৌন্দর্যে হারিয়ে মুখ ফুটে এসব কি আসছে তার! কেন এতো অদ্ভুত আচরণ করছে সে! নিজেকে প্রশ্ন করে নিভৃত। কোনো উত্তর আসেনা। মন ক্ষান্ত, মস্তিষ্ক ক্ষান্ত। এতো সহজে রুহানিকে ভুলে গেলো সে!

মৌন জানেনা নিভৃতের কথার মানে। তবে শুনতে খুবই ভালো লাগছিলো তার। নিভৃতকে চুপ থাকতে দেখে মৌন অধৈর্য হয়। উৎসাহের সাথে জিজ্ঞেস করে,
‘আর?’

নিভৃত শক্ত কন্ঠে বলে,
‘কিছুনা।’

মৌন দমে যায়। যতই সাহসী হোক। নিভৃতের শক্ত কন্ঠে তার ভিষণ ভয়।

_________________

জৈন্তা হিল রিসোর্টেই দুপুরের খাবার খেলো দুজনে। ভাত, আলুভর্তা, গরুর মাংস আর ডাল। খাবারটা খুবই ভালোলেগেছে মৌনর। যদিও পেটে খিদে থাকলে সবই ভালোলাগে। নিভৃত সারাটা সময় চুপ ছিল। মৌন বুঝে পায়না নিভৃতের আচরণ। কখনো ঝগড়া করছে কখনো আবার গম্ভীর হয়ে থাকছে। নিভৃতকে বুঝা বড় দায়!

সন্ধ্যার দিকে নাজিমগড় রিসোর্টে ফিরে এলো দুজনে। রাস্তার দুপাশে লাইট জ্বলে উঠেছে। হলুদ রঙের ছড়াছড়ি চারপাশে। দুপাশের বাগানের ফুলগুলোর রং গাঢ় দেখা যাচ্ছে। রুমে যাওয়ার আগে মৌন বললো,
‘শুনছেন?’
‘কি?’
‘ঐযে উঁচু দালানটা দেখা যায় ঐটা কি?’
‘ওয়াচ টাওয়ার।’
‘আমি যাই?’
‘একা যাবা কেন তুমি?’
‘আসলে…
‘রুমে আসো। আগে ফ্রেশ হই বিশ্রাম নেই পরে আমি নিয়ে যাবো।’
‘আচ্ছা।’

চুপসে আছে মৌন। নিভৃত কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। এমন নিভৃতকে তো মৌন চায়না। ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিয়ে মৌনকে ওয়াচ টাওয়ারে নিয়ে এসেছে নিভৃত।
মৌন অবাক চোখে তাকিয়ে চারিদিক দেখছে। পুরো রিসোর্ট দেখা যাচ্ছে। ঐ তো সারি নদী। স্থানে স্থানে জ্বলে উঠেছে হলুদ টিমটিমে লাইট। লাইটের আলোয় মুখরিত চারদিক। অভাবনীয় সুন্দর চারপাশ।

৬৩.

রিসোর্ট টার প্রতি একটা মায়া জন্মেছে মৌনর। কত স্মৃতি কুড়ালো নিজের ঝুলিতে! ছেড়ে যেতে খুবই কষ্ট লাগছে তার। তবে মানুষের জীবন থেমে থাকেনা। পার্থিব জীবনে অনেক কিছু তাদের ত্যাগ করতে হয়। মানুষের মন বড় নরম। বিশেষ করে মেয়েদের। তাইতো তিনদিন কাটানো স্থানের প্রতিও মৌনর কতো মায়া, টান, আবেগ জড়িয়ে আছে!
খয়রী রঙা টয়োটা প্রিমিউ গাড়িটা ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে চলছে। নিভৃত একমনে গাড়ি চালাচ্ছে। মৌন বাইরে তাকিয়ে আছে। নিভৃতকে বোঝা হয়তো তার সান্নিধ্যে নেই। এই কুহকের ধাঁধা বড়ই জটিল।

________________

বাড়ি ফিরেছে আজ বিশদিন হলো। মৌনর সাথে বেশি কথা বলেনা নিভৃত। সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মৌন। বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বাহিরে দেখতে তার ভিষণ ভালোলাগে। মিটি তার কাঁধে বসে। লালচে রংয়ের আকাশের দিকে তাকিয়ে পড়ন্ত বিকেলের মোহে পড়ে গেলো মৌন। বিরবির করে বললো,
‘জানিস মিটি আমার জীবনটা একটা ধাঁধা।’

মিটি কিছু না বুঝে কেবল বাকবাকুম করে। মৌন মলিন হাসে।
‘আমি যদি তোকে স্বাধীন করে দেই তুই আমার হয়ে আকাশটা ঘুরতে পারবি রে মিটি?’

মিটির কি হলো কে জানে। মৌনর কাঁধ আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। সে কোথাও যাবেনা।
‘সবাই আমায় ব্যবহার করে তুই কেন বাদ যাবি রে মিটি।’

মিটি হয়তো মনে মনে বলছে,
‘আমি তোমায় ছেড়ে যেতে পারবোনা মৌন বুবু। আমার মালিক যে তোমায় নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। সে যে তোমাকে দেখে রাখার দায়িত্ব দিয়েছে আমায়! আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবোনা বুবু।’

মৌন আবার তাকায় পড়ন্তবেলার লালচে আকাশে।

____________________

মৌন এখনো নিচে থাকে। শীত পড়েছে তীব্র। শীতে কষ্ট হয় মৌনর। পাতলা একটা চাদর বিছিয়ে থাকায় শরীর হিম হয়ে থাকে যেন। মৌন নিচে বিছানা করছিলো প্রতিদিনের মতোই। নিভৃত ল্যাপটপে কাজ রেখে বললো,
‘বিছানায় ঘুমাতে পারো তুমি।’
‘না, থাক।’
‘থাকবে কেন! বিছানায় থাকতে বলেছি চুপচাপ শুয়ে পড়ো।’

নিভৃতের ধমকে চুপসে যায় মৌন। পাশে শুয়ে পড়ে সে। নিভৃত আড়চোখে তাকায়। কি করে বলবে সে, এই মেয়েটা পাশে না ঘুমালে তার ঘুম আসেনা। বিগত রাতগুলো সে মৌনের মুখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়েছে। মেয়েটা ঠকঠক করে কাঁপতো। সে নিজের কম্বল দিয়ে দিতো মেয়েটার শরীরে। আজ হয়তো নিভৃতের একটু ঘুম হবে। হঠাৎ নীল ডিমলাইটের আলোয় রুহানির ছবির দিকে চোখ যায় নিভৃতের। নিভৃত চোখ সরিয়ে নেয়। একটা অপরাধবোধ কাজ করে তার মাঝে। রুহানির চোখে চোখ রাখার সামর্থ্য তার নেই।

একটুপর ক্লাস শুরু হবে। এখনো বাড়িতেই মৌন। তাড়াহুড়ো করছে প্রচন্ড। ইদানীং খাবারে বড়ই অনীহা তার। মিরা জোর করে দুই লোকমা ভাত মুখে তুলে দিলেন। মৌন বের হবে তার আগেই ফোন বেজে উঠলো তার। মায়ের নাম্বার দেখে হাসি মুখে কল রিসিভ করলো মৌন। ফোনের ওপাশে কেউ কাঁদছে। পুষ্প কেঁদে হেচকি তুলে বললো,
‘আপা, ছোটআপা আত্মহত্যা করছে।’

ছোটআপা মানে তো রথি! ধপাস করে নিচে বসে গেলো মৌন।

(চলবে)…..
(চলবে)…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here