যে জীবন ফানুসের পর্ব -০২

#যে_জীবন_ফানুসের
#পর্ব– ২
#রেহানা_পুতুল
আবিদের কথাগুলো শুনতে ভালোলাগছেনা। তাই কোন প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করিনি। মন ভালো না থাকলে ভালো কথাও তেতো লাগে শুনতে। আচমকা কি থেকে কি ঘটে গেলো। এক আকাশ বিষন্নতা নিয়ে গাড়ির কাচের ভিতর দিয়ে বাইরে চেয়ে আছি। দৃষ্টির সীমানা অতিক্রম করছে কত কত চেনা অচেনা দৃশ্য। নিজেকেও এখন এই চেনা এই অচেনা লাগছে।

মাঝপথে গাড়ি থামালো আবিদ। নেমে গিয়ে একটি ফাস্টফুড় দোকানে ঢুকলো। একটু পর ফিরে এলো। হাতে একটি মিনারেল ওয়াটারের বোতল ও আরো কিছু শুকনো খাবার। আমি অন্যমনস্ক হয়ে আছি। আমার হাতে মৃদু চাপ দিলো। আমি না টের পাওয়ার ভান করে আছি। একটু টান দিলো হাতে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলাম। আমার হাতে কেকের বক্স, তেঁতুলের আচার,বিস্কুটের প্যাকেট ধরিয়ে দিলো। বলল,ঝুমুর খেয়ে নাও যেটা ইচ্ছে।

আমি খাবারগুলোর দিকে চেয়ে আছি। এই ভ্যানিলা কেক ছোটবেলা থেকেই আমার ভীষণ পছন্দ। ঠিক তেঁতুলের চাটনিও। আবিদ কিভাবে বুঝল। নাহ। এটা কাকতালীয়ভাবে মিলে গিয়েছে। জাস্ট এই। কিন্তু আমি খাবনা। খেতে ইচ্ছে করলেও খাবনা। আবিদ আর আমার আমার মাঝখানে সব খাবারগুলো রেখে পুনরায় বাইরে চেয়ে আছি।
আবিদ এবার মন খারাপ করলো। অচেনা ড্রাইভার। তাই বিশেষ ঘাটালোনা আমাকে। শুধু আমার মুখপানে অনিমেষ চেয়ে রইলো কিয়ৎক্ষন।

সিলেট চলে এসেছি। গাড়ি থেকে নামলাম। আবিদ গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে দিলো। একটা রিক্সা ডেকে আমাকে নিয়ে উঠলো। আমি এখনো নিঃশ্চুপ। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি নির্বাক। হতবিহ্বল। চাইলেও মুখ দিয়ে কোন শব্দই বের হচ্ছেনা। অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে আছে যেন। রিক্সা একটা হোটেলের সামনে এসে থামলো। আবিদ আমাকে নামতে বলল। নামলাম। এক পলক চোখ ঘুরিয়ে দেখলাম। এটা একটি আবাসিক হোটেল। দেখতে মোটামুটি সুন্দর। নাম নিরিবিলি হোটেল। পরিবেশটাও শৈল্পিক বলা যায়।

আবিদ রিসিপশনে গিয়ে কথা বলল। মনে হলো পূর্ব পরিচিত। এরপর একটা ছেলে আমাদের নিয়ে তিনতলায় উঠলো। চাবি দিয়ে একটা রুম খুলে দিলো। লাগোয়া বারান্দা। বেশ পরিপাটি ছিমছাম। আমরা ভিতরে ঢুকলাম। একটু পর অন্য একটা ছেলে এসে বিছানার চাদর চেঞ্জ করে দিলো। টেবিল মুছে দিলো। রুম ঝাড়ু দিয়ে মপ দিয়ে মুছে দিলো। ছেলেটা চলে গেলে আবিদ রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো।
এরপর টলিব্যাগ থেকে টাওয়েল বের করলো। তারপর ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে বের হয়ে এলো।

সে বের হওয়ামাত্রই আমি ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। বালতিতে জোরে পানির ট্যাপ ছেড়ে দিলাম। বানের পানির মতো বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে এলো। ঝর্ণা ছেড়ে দিয়ে ভিজতে লাগলাম। আমার সমস্ত অশ্রুগুলো পানির সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ফয়সালকে মনে পড়ছে। ঘৃনাও হচ্ছে আবার মায়াও হচ্ছে তারজন্য। তার রাগ আর অহমিকার পরিণতি এতটা নিষ্ঠুর হবে ভাবতেও পারিনি। মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

ভিজতে ভিজতে সারা শরীরে কাঁপুনি ধরে গেলো। বেশ সময় পার হয়ে গেলেও আমি বের হচ্ছিনা দেখে আবিদ ওয়াশরুমের দরজায় টোকা দিচ্ছে। আমি ভিতর থেকে কোন কথা বলছিনা। এবার জিজ্ঞেস করলো কোন সমস্যা কিনা। আমি ওয়াশরুমের দরজা খুলে দিলাম।

আবিদ আমাকে দেখে রোষপূর্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠলো। ঝুমুর তুমি এভাবে কাঁদছ কেন? তোমার চোখ কি লাল হয়ে গিয়েছে নেশাখোরের মতো। আর এতসময় ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে এমন ভিজে চুপসে গেলে কেন? আরেহ! তুমিতো ঠকঠক করে কাঁপছ। সমস্যাটা কি তোমার? জামা কোনটা দিব?

আমি কিছুই বলছিনা। ঠায় দাঁড়িয়ে আছি দাঁড়কাকের মতো। আবিদ নিজেই ব্যাগ থেকে একটা সুতী ড্রেস বের করে দিলো টাওয়েলসহ। আমি দরজা বন্দ করে ড্রেস চেঞ্জ করে বের হলাম। রুমে সিংগেল দুটো বেড়। আমি একটাতে গিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে শুয়ে গেলাম। বসে থাকতে পারছিনা। কাঁপছি ভেজা বিড়ালছানার মতো। আবিদ চোখমুখ খিঁচে আমার দিকে চাইলো। রুম থেকে বের গেলো। আমি একিভাবে শুয়ে আছি।

বেশকিছু সময় পরে আবিদ ফিরে এলো। হাতে কিছু জিনিসপত্র। টেবিলের উপরে সব রাখলো। একটি সরিষার তেলের বোতলের ছিপি খুলে তার হাতে একটু ঢেলে নিলো। আমার হাত টেনে নিলো। আমি তার হাত সরিয়ে দিলাম এক ঝটকায়। নিজেই হাতে পায়ে তেল মালিশ করলাম। তেল দেওয়াতে হাত পা এখন একটু উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। ক্ষুধায় মরে যাচ্ছি। ভীষণ কাহিল লাগছে।

আবিদ দুটো প্যাকেট আমার সামনে রাখলো বিছানার উপরেই। নিচে পেপার বিছিয়ে নিলো। প্যাকেট খুলে এক প্যাকেট আমার দিকে দিয়ে খাও। বিফ তেহারি এনেছি। এই যে লেবু,পেয়াজ,শসা,কাঁচামরিচ আছে। সব চেয়ে এনেছি তোমার জন্য।
ভাবছি বিফের যেকোন কিছুই আমার দারুণ ভালোলাগে। আবিদ কিভাবে বুঝলো। আমি খাচ্ছিনা দেখে রেগে গেলো।

প্লিজ ঝুমুর খাও। খুব বাড়াবাড়ি করছ অহেতুক। তুমি যা চাও তাই হবে প্রমিজ। এখন খাও। নিজের কি হাল করেছ আয়নায় দেখে নিও। পুরো প্যাকেট খেয়ে নিলাম। একটু আরামবোধ করছি। কিন্তু শরীর খারাপ লাগছে। হাত ধুয়ে আবার ও হাঁটু ভাঁজ করে শুয়ে গেলাম।

কখন চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো টের পাইনি। ঘুম ভাঙার পর দেখি আমার গায়ের উপর পাতলা একটা কাঁথা। আবিদ কি আমাকে জয় করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে? কিন্তু সে জানেনা আমি কোন ধাতুর তৈরি। সহজ এ গলানো দুষ্কর।

পাশের বেড়ে নজর ফেলতেই দেখি আবিদ নেই। বারান্দা থেকে তার গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ফোনে কথা বলছে। মনে হলো আমার ও বাড়িতে ফোন দেওয়া জরুরী। বাবা মাকে সব জানাতে হবে। প্রবাসে থাকা ভাইটাকেও সব জানাতে হবে। আমার একমাত্র আদরের ছোটভাই রাসেল। যার জন্য রাজী না হয়েও হতে হলো এই বিয়েতে।

গতরাত থেকেই মোবাইলের সুইচড অফ করে রেখেছি। সুইচড অন করলাম। কয়েকটা মেসেজ চোখে পড়লো। মেসেজ না পড়েই মাকে ফোন দিলাম। বিস্তারিত খুলে বললাম। মা বিষাদ কন্ঠে শান্তনা দিলেন।

মারে কপালের লিখার উপরে কোন হাত নেই। যেহেতু শিলা চলে গিয়েছে। আবিদ ত যাকেই হোক বিয়ে করতো। আর যেখানে তুই বলছিস এত মায়া যত্ন ফয়সালের কাছেও পাসনি। তাহলে আবিদের সাথে সারাজীবন থাকতে পারিস। ফয়সাল রাগের মাথায় হলেও তোকে তালাক দিয়েছে। এবং সেটা আইন অনুযায়ী তিনমাস পর কার্যকর ও হয়েছে। আমরা কি তোকে অন্য কারো কাছে বিয়ে দিতাম না? অবশ্যই দিতাম। বাকিটা তোর ইচ্ছে। আমরা কোন জোর খাটাবোনা। সাবধানে থাকিস। আচ্ছা মা ভালো থেকো বলে মার থেকে বিদায় নিলাম।

এবার মেসেজগুলো অন করলাম। পরপর পাঁচটা মেসেজ। ফয়সাল দিয়েছে। আমি নিবিড়ভাবে মেসেজগুলো পড়ছি। আবিদ রুমে এসে অপর বেডে বসলো বালিশে হেলান দিয়ে। দৃষ্টি আমার দিকে।

কি দেখছ ফোনে? জিজ্ঞেস করলো।

তার কথায় আমার মন নেই। মেসেজ পড়া শেষে উঠে গিয়ে বারান্দায় যাচ্ছি। তখনি চিলের মতো ছোঁ মেরে আবিদ আমার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে নিলো।

আমি কিছু বললাম না। ধীর পায়ে বারান্দায় চলে গেলাম। সুন্দর একটি কাঠের চেয়ার পাতা রয়েছে। চেয়ারে বসলাম। বাইরে রাস্তায় আলো আঁধার খেলা করছে। একটি ল্যাম্পপোস্টের আলোর নিচে চোখ পড়লো। ছোট্ট একটি বিডালছানা মিউমিউ করে ডেকে যাচ্ছে। হয়তো তার প্রিয়জনকে খুঁজে ফিরছে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একজন পথচারী। সে থেমে গিয়ে বিড়ালছানাটিকে কোলে তুলে নিলো। এদিক ওদিক চাইলো তার মা বা সঙ্গীদের দেখা মেলে কিনা। না আশেপাশে কোন বিড়ালকে দেখা যাচ্ছেনা। সে বিড়াল ছানাটির তুলতুলে শরীরে হাত বুলিয়ে আদুরে স্পর্শ দিতে লাগলো। অমনি বিড়ালছানাটি শান্ত হয়ে গেলো। আর মিউমিউ করছেনা।

জগতের প্রতিটি প্রাণীই ভালোবাসা চায়। ভালোবাসায় যত্নে ভালো থাকতে চায়। আমিও চেয়েছি ফয়সালের কাছে। তার বুকের পশমের ওমে থেকে নিজেকে শিহরিত করতে চেয়েছি প্রতিটি রাত। জনমভর।
কিন্তু আমার… লম্বা দীর্ঘশ্বাস না পড়তেই পাশে এসে দাঁড়ালো আবিদ।

আমাকে শুনিয়ে পটপট করে মেসেজগুলো পড়তে লাগলো।

” ঝুমুর শতবার ট্রাই করেও তোমার ফোন অফ পেলাম। তুমি জানো আমি কেমন মানুষ। যদি তোমাকে না পাই আমি আবিদকে খুন করতে বাধ্য হবো। আমার বোন শিলা এখন আর ওর স্ত্রী নই। সো কোনো পিছুটান নেই ওই প্রতারক, নিমকহারাম, অমানুষটার জন্য। তোমার কাছে আর কতবার ক্ষমা চাইবো ভুলের জন্য। ভুল তো মানুষ ই করে। সমস্ত ভুলত্রুটির উর্ধ্বে শুধুমাত্র একজন। আর সেই আল্লাহর কাছে ভুলের ক্ষমা থাকলে তোমার কাছে ক্ষমা নাই কেন? আমি কি চাইলেই পারিনা থানায় জিডি করতে? এই মর্মে, আমার বোন চলে গিয়েছে। তাই তার স্বামী আমার স্ত্রীকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছে প্রতিশোধ নিয়ে আমাদের অপমানিত করার জন্য সমাজে? আমাকে ফোন দিও জরুরীভাবে। ফয়সাল। ”

মেসেজ পড়া শেষ করে আবিদ বলল, ভাবী আমি ভয় পেয়েছি। আপনাকে সকালে গ্রামের বাসে তুলে দিব। আপনি চলে যান ফয়সাল ভাইয়ের কাছে।

আমি নিমিষেই মুখ তুলে চাইলাম আবিদের দিকে। বললাম ঠিকাছে আবিদ ভাই।

চলবে…(২)

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here