যে জীবন ফানুসের পর্ব -০৬

#যে_জীবন_ফানুসের
#পর্বঃ৬
#রেহানা_পুতুল
আড়চোখে আবিদকে খেয়াল করলাম। ইউটিউবে নিউজ দেখছে। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে আছি বেশ। বিক্ষিপ্তভাবে চিন্তারা দলবেঁধে অনুপ্রবেশ করেছে মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ থেকে কোষে। এই একটি মেসেজ সারাটিরাতের ঘুম কেড়ে নিলো। আমার জন্য আরেকজন বিনিদ্র রজনী পার করুক। তা একদম চাইনা। এমনিতেই কম ঝক্কি ঝামেলা পোহায়নি আমাকে কেন্দ্র করে। তাই আবিদকে জানালামনা। জোর করে ঘুমানোর চেষ্টায় মগ্ন হলাম।

গভীর রাতে ঘুম নামলো আঁখিজুড়ে। কখন যে ভোর শেষ হয়ে বেলা হলো টের পাইনি।

আবিদ আমাকে ছোট্ট শিশুর মতো করে নেড়েচেড়ে ডেকে তুললো । তবুও আমি হাই দিয়ে যাচ্ছি। বিছানা ছাড়তেই পারছিনা। আবিদ গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলো। রোদের কড়া ঝাঁঝ ঠিকরে আমার চোখে এসে পড়লো। আমি তাকাতেও পারছিনা। পিটপিট চোখে চাচ্ছি বিড়ালের মতো। আলসেমিতে উহু আহহ করছি। হাই দিচ্ছি। এপাশ এপাশ হচ্ছি বিছানার।

আবিদ নিবিড় হয়ে নেশাতুর চাহনীতে আমাকে দেখছে। আমি তার চোখে চেয়ে লজ্জাতুর পাতার মতো গোপনে চুপসে গেলাম। পরক্ষণেই দুঠোঁট বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, অমন করে কি দেখছ? আমি চিড়িয়াখানার কোন আজব প্রাণী আফ্রিকার জংগল থেকে ধরে আনা?

বিরহ কাতর প্রেমিকের মতো কন্ঠে রোমাঞ্চ মিশিয়ে বলল,
একটি রুম। দুজন নর নারী। একজন যুবতী একজন যুবক। এরা নিপাট ভদ্রজন না হলে এভাবে সম্ভব? এরা মানব নয়। এরা মহামানব। বর্তমানে যেসব নিউজ হয় প্রিন্ট মিডিয়ায়,অনলাইন মিডিয়ায়,ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। সেই হিসেবে এই বিষয়টাও নিউজ হওয়ার মতো। পত্রিকার চিপাচাপা দিয়ে হলেও। টিভি নিউজের নিচে শিরোনাম হওয়ার মতো।

আবিদের কথা শুনে কুটকুট করে হাসছি। কিছু মানুষ আছে। হাসির কথাকেও এমন সিরিয়াস করে বলতে পারে,না হেসে পারা যায়না। আবিদ ও সেই মানুষগুলোর একজন।

সেই নিউজ লিখবে কে আবিদ?
বলল,আমিই লিখবো।
কি লিখবে?
কি লিখবো? শুনো তাহলে মন দিয়ে।

এবার গ্রাম গঞ্জের ভিন্ন খবর। গাইবান্দা থেকে রিপোর্ট করছেন জহিরুল। ফারিহা আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি সিলেটের সেই ‘ নিরিবিলি ‘ নামক আবাসিক হোটেলের সামনে। এখানে আবিদ নামের এক যুবক ঝুমুর নামের এক যুবতী মেয়েকে তুলে এনে বিয়ে করেছে। পরে জানা গিয়েছে মেয়েটি স্বেচ্ছায় এসেছে। তারা লুকিয়ে অবস্থান করছে এখানে একটি রুমে। চমকপ্রদ খবর হলো এই যুবকের স্ত্রী বর্তমান। আরো গরম খবর হলো এরা দুজন আজ অবধি শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি। অথচ তাদের বিয়ের বয়স চারমাস চলছে।

শেষের বাক্য শুনেই আমি ঝট করে বিছানা থেকে নেমে গেলাম। আবিদ হাত টেনে ধরলো। উহু লাগছে ছাড়ো।

দেখলে পাখি কি কড়া ডোজ দিয়ে বিছানা ছাড়ালাম তোমার?

ফ্রেস হও। নাস্তা খাব। আমিতো আর কারো মতো ভুলোমনা নয়। নিষ্ঠুর ও না।
আমি তাকে চোখ পাকিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। বের হয়ে দেখি আবিদ নেই। কিছুসময় পর এলো নাস্তা নিয়ে। গরম গরম খাস্তা পরোটা,কলিজা ভুনা, মুগডাল, সুজির হালুয়া।

পরোটা ছিঁড়ে মুখে পুরে দিতে দিতে বলছি, আজকের নাস্তা দারুণ পছন্দ হয়েছে আমার। পরোটা যেমন গরম। তেমনি তুলতুলে ও আছে।

সাথে সাথে সে রিপ্লাই দিলো হ্যাঁ ঠিক তোমার মতো।
আমি চোখ কটমট করে চাইলাম আবিদের দিকে।

বলল, একদন্ড ও ভুল বলিনি। তুমি যেমন গরম তেমনি তুলতুলে নয় কি?

গরম টা না হয় বুঝলাম। আমার আচরণে বারবার সেটা প্রকাশিত। কিন্তু তুলতুলে তুমি কিভাবে বুঝলে?
রাতে আমি ঘুমিয়ে গেলে…?

উফফস! তোমার হাত ধরেছি না কতবার ?

আচ্ছা আমরা এখানে থেকে আর কাজ কি? চল ফিরে যাই। পরে চাকরি নট হয়ে যাবে আমার।

চাকরি এমনিতেই নট হয়ে গিয়েছে।

শুনে মুহুর্তেই মন খারাপ হয়ে গেলো আমার। মনমরা হয়ে বললাম যাওয়াটাই স্বাভাবিক। আর কত।

আরে আমি না করে দিয়েছি তোমার অফিসে বিস্তারিত জানিয়ে। তুমি গিয়ে রিজাইন লেটার দিয়ে দিলেই হবে।

কেন করলে এটা তুমি?

আশ্চর্য! আমি ঢাকায় থাকবো। আর তুমি গ্রামে থাকবে?

শিলাওতো গ্রামে থাকতো?

শিলার সাথে বোঝাপড়ায় অমিল ছিলো।

আমার সাথে খুব মিল হচ্ছে বুঝি?

তা একদম না। তবে লক্ষন পজেটিভ।

আমি বলছি তোমার কাছে থাকবো?

বলনি। বাট বলতে কতক্ষন?

এত আত্মবিশ্বাস নিজের উপর?

নিঃসন্দেহে। আত্মবিশ্বাস শব্দটার জোর অনেক। এ শব্দটা ভারী মজবুত। এ আত্মবিশ্বাসটুকু নিজের উপর না থাকলে কোন মানুষই লাইফে সফল হতে পারতোনা। কেবলমাত্র এই আত্মবিশ্বাসের ধাক্কায় সে এগোতে থাকে তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে।

তো তুমি কোন গন্তব্যের দিকে ধাবিত হচ্ছো?

এই যে তোমাকে পাওয়ার দিকে। কি এগোচ্ছেনা?

জানিনা বলে নিরব হয়ে গেলাম।

মেসেজ দেয়া মানুষটার কথা মনে পড়লো। দুম করে ফয়সাল ও উদয় হলো হৃদয় আরশীতে। কেমন যেন লাগছে ঠিক বুঝেও বুঝিনা।

আবিদ বলল এখনো জাননা ঝুমুর? তোমার এই জানাটার জন্য আমার আর কি কি করতে হবে?

বৃষ্টি থেমে গেলেও ঘরের চাল থেকে টুপ করে বৃষ্টির ফোটা পড়ার মতো এক চিলতে হাসি মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো।

হাসি বন্ধ হলো কেন? আমিতো আজকাল তোমার কাছে হাসির পাত্র। কিছু বললেই ফিক করে হেসে ফেলো। আর একদিন পরেই আমাদের সিলেট যাপনের এক সপ্তাহ পূর্ণ হবে। শপিংয়ে চলো। তোমাকে কিছু উপহার দেই।

আরেহ। একদম না। এমনিতেই বেশ খরচ হয়ে গিয়েছে। প্রতিবেলা কিনে কিনে খাওয়া। দুবেলা নাস্তা। রুম ভাড়া।

সব ঢাকায় গিয়ে পুষিয়ে নিব। তুমি বাসায় সুস্বাদু করে নানাপদ করবে। আর আমি শুধু খাবো আর খাবো।

আমি কোন জব করবোনা আবিদ?

অবশ্যই করবে। ঢাকায় জবের ব্যবস্থা করে দিব। কাটুক না এভাবে কয়েকমাস।

নিষ্পাপ শিশুর মতো এক আকাশ খুশী হয়ে , এইই…তারমানে তুমি আমাকে ছেড়ে যাবেনা?

নাহ যাবনা। মায়ের কথাই আমার কাছে শিরোধার্য।
ভনিতা না করেই জানিয়ে দিলাম।

মায়ের কথা শুধু? তোমার কথা না? লুকোচুরি? বাহানা? বলে আবিদ আমাকে হ্যাঁচকা টানে বিছানায় ফেলে দিলো। এমন সময় দরজা ঠকঠক করে শব্দ হলো। আবিদ মুখ খিঁচিয়ে শালার শালীরা আর সময় পেলোনা। দরজা খুলে দিলো।

এইই ঝুমুর বাসর হইছে? চট করে হিমা জিজ্ঞেস করলো।
আমি কিছু না বলতেই, আবিদ নতুন বরের মতো চিনিগুড়া হাসি দিয়ে,সখীরা বাসর না সাজিয়ে দিলে বাসর হয়?

ওহ হো। তাইতো। এই আজি আয়োজন করবো কি বলিস? বলল রিমা।

বাকিদুজন রিমার কথায় সায় দিয়ে, আরতো মাত্র একরাত। সো আজি। পরশু সবাই একসাথে ঢাকায় ব্যাক করবো।

আমি নাক লাল করে বসে আছি। সায়না বলল,ঝুমুর আমরা কিছু শপিং করবো এখানের মার্কেট থেকে। একটু মজা মাস্তিও হবে। তোরা দুজনও চল।
আবিদ বলল,আমার একটা অফিসে যেতে হবে। ঝুমুরকে নিয়ে তোমরা যাও। আর আমার পক্ষ থেকে ওকে একটা শাড়ি কিনে দিও। মেয়েদেরকে ফুলসজ্জায় শাড়ি পরা দেখতেই সুন্দর লাগে। ফুল ও কিনবে আমার টাকায়। অন্যের টাকায় বাসর হলে মনে ফূর্তি কম লাগবে। এই নাও টাকা। আবিদ ওদের হাতে একটা টাকার বান্ডেল দিলো।

ওদের জোরাজুরি আর আবিদের আবদারে রাজী হতে বাধ্য হলাম।
বের হওয়ার আগে মায়ের সাথে কথা বললাম। কারণ আমার মন বেশী ভালো থাকে মায়ের সাথে বলার পরেই। মাকে জানিয়ে দিলাম। মা তোমার কথা রাখলাম। আবিদের সাথেই সংসার করবো জনমভর। মা ফোনের ওপাশে কেঁদে ফেললো। আমিও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। মা অনেক খুশি হলো আমার সিদ্ধান্ত শুনে। বলল আবিদ যেভাবে চায় তোকে সেভাবেই চলিস মা। মেয়েদের ঘর বারবার ভাঙলে এ সমাজে সে মেয়েটাকে আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে সবাই মন্দ মেয়ে হিসেবেই জানে সারাজীবন। খোঁটার আর শেষ নেই। বলে মা প্রাণ উজাড় করে প্রার্থনা করল আমি যেন সুখী হই। সময় করেই আবিদকে নিয়ে আমাদের বাড়ি যেতে বলে রাখলো।

আবিদ যখন আমার ননদের হাজব্যান্ড ছিল। মা তখন থেকেই একজন ব্যক্তি হিসেবে আবিদকে খুব পছন্দ করতো। ফয়সালকেও ভারী পছন্দ করতো। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসের সাথে কেউই টিকে উঠতে পারেনা। সময় এই নিদারুণ নির্মমতাকে সয়ে নিতে সাহায্য করে। মায়ের মন ভালো দেখে আমার ও ভালো লাগছে বেশ। তবে আবিদকে সেটা বুঝতে দিলাম না।

চার বন্ধু মিলে একটা শপিং কমপ্লেক্স এ ঢুকলাম। ওরা ওদের জন্য কিছু কেনাকাটা করলো। আবিদের দেয়া টাকা থেকে আমার পছন্দে ওরা লাল খয়েরী কাতান শাড়ী কিনল। বেশ সুন্দর। তার সাথে মিলিয়ে ব্লাউজ, পেটিকোট কিনে নিলো। এবং বউ সাজতে মিনিমাম যা প্রয়োজন সবি কিনলো।

আমরা শপিং কমপ্লেক্সের তিন তলায় ফাস্টফুড খেতে বসলাম। লাচ্ছি আর শর্মা অর্ডার দিলাম। লাচ্ছি আমার ভীষণ পছন্দের। গ্রামে কাকাদের গরুর দুধ নিয়ে মা তেঁতুল আর দুধ দিয়ে দইয়ের বীজ তৈরি করতো। একদিন পর সেই বীজ দিয়ে, দুধ জ্বাল দিয়ে মা এক হাঁড়ি দই বসাতো। যে যার মতো করে খেতো। মা এমনিই খেতো। বাবা দইভাত খেতো খেজুরের গুড় মিশিয়ে। রাসেল মুড়ি মিশিয়ে খেতো। আমি এক গ্লাসে দই অর্ধেক নিতাম। কাকাদের ফ্রীজ থেকে বরফ কুচি দিতাম কিছু। বিট লবন দিতাম। এক চামচ লাল চিনি। তারপর কাঁটাচামচ দিয়ে নেড়েনেড়ে লাচ্ছি বানিয়ে ঘরের পিছনে দাওয়ায় বসে লুকিয়ে লুকিয়ে খেতাম।

রাসেল টের পেলেই আমাকে খুঁজে বের করে গ্লাস টেনে নিতো। আর দুই চুমুকেই সাবাড় করে দিতো।

শর্মায় কামড় বসিয়ে হিমা বললো, বাকি রয়েছে কাঁচাফুল। হোটেলের পাশেই ফুলের দোকান আছে। সন্ধ্যার পর সেখান থেকে কিনে নিবো। সায়না বলল, এখন নিলে শুকিয়ে বাঁশপাতা হয়ে যাবে। পরে আবিদ ভাই সেই ফুল মুচমুচিয়ে গুড়ো করবে আর গাইবে,তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়…শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি…
সায়না থামবি। এত ফাজিল হয়েছিস কবে থেকে?

সায়না ভেংচি কেটে থেমে গেলো। রিমা বলল,আবিদ ভাইয়ের পছন্দের ফুল হলে জোস হবে ফুলসজ্জা। এইই ঝুমুর… বেচারার প্রিয় ফুল কিরে?

বললাম তোদের ঢং দেখলে বাঁচিনা। ওর প্রিয় চালতা ফুল। কদম ফুল। কলমী ফুল।

ওরা হো হো করে হেসে বলল,বেশ মজারতো। কিন্তু কই পাই এসব ফুল। দূর দোকানে যা পাই তা দিয়েই সাজাবো বাসর।

এভাবে দুপুর গডিয়ে বিকেল হলো। আমরা বের হয়ে দোতলায় নামলাম। সায়না একটি লেডিস ব্যাগের দোকানে ঢুকলো। তার পিছন দিয়ে রিমা হিমা আমিও ঢুকলাম। দারুণ সব আকর্ষণীয় ব্যাগ ঝুলে আছে। পুরো দোকান খালি। আমরা ব্যাগ পছন্দ করছি আর বলছি দোকানের স্টাপ মালিক কেউই নেই কেন।

এমন সময় পিছন থেকে একটি ভারী গলা কানে এলো। আমরা ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলাম। রিমা বলল, ভাইয়া এ ব্যাগের দাম কত? আমি জমে গেলাম তাকে দেখে। সে রহস্যময় হাসি দিয়ে ঝুমুর তুমি সিলেটে? তোমার না হাজব্যান্ড মারা গিয়েছে?

আমি ওদেরকে বললাম এই চল তাড়াতাড়ি। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার পছন্দ হয়নি ব্যাগ।

আমরা চারজন পা বাড়াতেই সে খোয়াড় থেকে খপ করে মুরগী ধরার মতো আমার সরু হাতটাকে মুঠোবন্দী করে ফেললো। বন্ধুরা ক্ষেপে গিয়ে কে আপনি? ছেড়ে দেন বলছি ওকে। নয়তো পুলিশ ডাকবো।

ছাড়ার জন্য ধরেছি? ওর সাথে আমার লেনাদেনা রয়েছে। তা মিটবে ওকে বিয়ে করলেই। তুমি এখন বিধবা। আমাকে বিয়ে করতে কি আপত্তি ঝুমুর?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here