যে পাখি ঘর বোঝে না পর্ব -০৬

#যে_পাখি_ঘর_বোঝে_না
পর্ব-০৬
লেখনীতে-তানিয়া শেখ

বহ্নিশিখা মনস্থির করেছে কোল থেকে নামানোর সাথে সাথে কষে এক চড় বসাবে আফরাজের গালে। কত বড়ো সাহস লোকটার ওর অনুমতি ছাড়া কোলে তুলেছে!

“আপনার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি আমি মি.শেখ।”

“আপনাকে অবাক করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে আজ।”

বিদ্রুপের সুরে বলল আফরাজ। বহ্নিশিখা হাত পা ছোড়াছুড়ি করল।

“নামান আমাকে, নামান। অসভ্য, ইতর কোথাকার। আপনার নামে আমি মামলা করব দেইখেন। একে তো বলা নেই কওয়া নেই কোলে তুলে নিয়েছে, আবার মজা করছে। নামান বলছি।”

আফরাজ ততক্ষণে সিঁড়ির নিচে নেমে এসেছে। বহ্নিশিখার চিৎকারে কোল থেকে নামাতে হলো। নামানোর সাথে সাথে অপ্রত্যাশিতভাবে ডান গালে সজোরে পড়ল এক চড়। মেয়েদের হাত কোমল হলে কী হবে সেই কোমল হাতের চড় কিন্তু বেশ কঠিন হয়। আফরাজের গালটা অবশ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। ক্ষুব্ধ চোখে তাকাল সামনে দাঁড়ান রাগান্বিত চেহারার বহ্নিশিখার দিকে। মেয়েদের গায়ে হাত তোলা কাপুরুষোচিত কাজ। আফরাজ ওমন হীন কর্ম কস্মিনকালেও করবে না।

“চড় মারলেন কেন?”

“বিনা অনুমতিতে কোলে তুললেন কেন?” প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন। আফরাজের কপালের রগ দপদপ করে। সে কেন এই মেয়েকে কোলে তুলেছিল? কেন এমন করে ছুটে এসেছিল ও মরবে ভেবে! নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। একটা নয় আরো দশটা চড় ওর পাওনা। এমন না সে যাকে তাকে যখন তখন কোলে তুলে নেয়। না, আজ পর্যন্ত কাওকে কোলে তোলেনি। একটা বাচ্চাকে পর্যন্ত না। আফরাজ ঘুরে দাঁড়ায়। এই মেয়ের থেকে শ ক্রোশ দূরে যাবে।

“লজ্জা হওয়া উচিত আপনার।” চেঁচিয়ে বলে বহ্নিশিখা। ওর গলার স্বর কাঁপছে।

“ওকে আ’ম সরি। হয়েছে?”

দু-হাত জড়ো করে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়ায় আফরাজ। বহ্নিশিখার চোখ টলমল করে। কেন যে কান্না আসছে কে জানে? আফরাজ গাড়ির কাছাকাছি যেতে পকেটের মোবাইল বেজে ওঠে। রোজিনা কল দিয়েছেন। গত দুইদিন এই নামটা মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে মানেই আফরাজের জন্য নয় নম্বর বিপদসংকেত।

“মামণি?”

“আব্বু তুমি কই? তোমার আব্বুর অবস্থা যে খুব খারাপ। তার শরীর অবশ হয়ে আসছে। চোখে ঠিকমতো দেখতে পারছেন না। তুমি কিছু করো আব্বু।” রোজিনা খুব কাঁদছেন। আফরাজ দুচোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস টানে। ও টের পাচ্ছে ভেতরের অস্থিরতা ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। কোনো সন্তানই পিতৃমৃত্যুর দায় কাঁধে নিতে চায় না। তাতে নিজের জীবন নরকসম হয় হোক।

“আব্বুকে বলো তাঁর বউ মাকে নিয়ে শীঘ্রই ফিরছি।”

রোজিনার কান্না থেমে যায়। কিছু বলবেন তার আগেই কল কেটে দিলো ও।

“কী হয়েছে?” গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে প্রশ্ন করল আরশাদ। বহ্নিশিখা এবং আফরাজকে প্রাইভেসি দিতে এতক্ষণ গাড়িতে আরামে বসে মোবাইল গেমস খেলছিল। তার আগে রাহাকে ট্রাই করেছিল। ও ধরেনি কল। বহ্নিশিখা আফরাজকে চড় দিয়েছে দেখেছে আরশাদ। ব্যাপারটা ওর কাছেও অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। কিন্তু এমন একটা ভাব করল কিছু জানেই না। আফরাজকে উদ্বিগ্ন দেখে ফের জিজ্ঞেস করল,

“বললি না কী হয়েছে?”

“আব্বুর অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে শাদ। আমি কী করব এখন?” গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে দুহাতে চুল টানতে লাগল।

“রাজ, শান্ত হ।”

“কীভাবে? কীভাবে শান্ত হব বল? তিনি জানেন বৈবাহিক সম্পর্কে বিশ্বাস রাখি না, কারো সাথে কমিটেড হতে চাই না তারপরও জেদ করে মরতে বসেছেন।”

গাড়ির কাঁচে সজোরে ঘুষি মারতে ব্যথায় ককিয়ে উঠল। আরশাদ শান্ত করার চেষ্টা করছিল। আফরাজের চিৎকার শুনে বহ্নিশিখা এসে দাঁড়াল সেখানে। কৌতূহলী দৃষ্টি ওর। আফরাজ ওকে দেখে রক্তিম চোখে এগিয়ে আসে।

“এই যে আপনি, আজ যা হচ্ছে সব আপনার কারণে। না আপনার সাথে আব্বুর দেখা হতো আর না বিয়ে নিয়ে এমন জেদ করতেন তিনি। বিয়ে, বিয়ে, বিয়ে উফ! আমি জাস্ট হেট করি এই শব্দটা।”

“আপনি মিসোগ্যামিস্ট!”

“হোয়াট!

“এই যে বললেন বিয়ে শব্দটাকে ঘৃণা করেন। এর মানে তো আপনি বিয়ে বিদ্বেষী।”

আফরাজ বড়োসড়ো ঢোক গিলতে বহ্নিশিখা চোখ কপালে তুললো,

“ও আল্লাহ, সিরিয়াসলি মি.শেখ? একজন মিসোগ্যামিস্ট হয়েও আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন আপনি? প্লান কী ছিল হুমম? আমার লাইফ নষ্ট করার? স্বার্থের জন্য একটা মেয়ের লাইফ নিয়ে খেলতেও আপনার বাধত না?”

রাগে মুখ লাল হয়ে উঠল বহ্নিশিখার। আরেকটা কী চড় দেওয়া উচিত? আফরাজের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বুকের ওপর চাপ বাড়ছে ক্রমশ।

“শুনুন, বহ্নিশিখা, আমি মোটেও মিসোগ্যামিস্ট নই। জাস্ট বিয়েতে ইচ্ছুক না।”

“কিন্তু একটু আগে ভিন্ন কথা বলেছেন।”

“রাগের বশে বলেছি ফর গডস সেক। নাও জাস্ট শাট ইওর মাউথ অ্যান্ড ম্যারি মি।” শেষটায় গলার স্বর নরম হলো ওর। বহ্নিশিখা বিস্ময়াহত হয়।

“এক্সকিউজ মি?”

আফরাজ ওর কাছে এগিয়ে এলো,

“প্লিজ আমাকে বিয়ে করুন বহ্নিশিখা। আমার আব্বুর জীবন বাঁচাতে এ ছাড়া আর কোনো পথ দেখছি না।”

কিছুক্ষণ মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না বহ্নিশিখার। তারপর উলটো দিকে ঘুরে হাঁটা ধরল।

“আপনি একটা পাগল। না, পাগল নন কী যেন বলে ওটাকে? ও হ্যাঁ, সাইকোপ্যাথ। ভাগ্যিস বিয়েটা হয়নি আমাদের!”

“বহ্নিশিখা প্লিজ আমার কথা শুনুন।”

“খবরদার আমার পিছু নেবেন না।”

“বহ্নিশিখা__”

আফরাজের কথা থেমে যায় বহ্নিশিখার ছোঁড়া ইটের টুকরো থেকে বাঁচতে গিয়ে। পথের পাশে পড়ে থাকা ইটের টুকরো কুড়িয়ে ওর দিকে ছুঁড়ে মারছে। এই মেয়ে ওকে সাইকোপ্যাথ বলেছে। ও কী তবে?

“আরেক পা এগোবেন তো এই ইট মেরে আপনার মাথা ফাটিয়ে দেবো। ভেবেছেন কী, মেয়ে বলে দুর্বল আমি? জোর খাটিয়ে কার্যোদ্ধার করবেন?”

“আমি এসব কিছুই ভাবিনি। প্লিজ শান্ত হয়ে আমার কথা তো শুনুন।”

“না, আপনি চলে যান।” হাতের বড়ো ইটটা শূন্যে তুলল ও। আফরাজ দু কদম পিছিয়ে যায়। এই মেয়েকে ওর বিয়ে করতে হবে! এই মেয়েকে! ওর মরে যেতে ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে। আরশাদ অদূরে দাঁড়িয়ে বোকার মতো এতক্ষণ এদের কাণ্ড দেখছিল। এবার সে এগিয়ে এলো,

“বহ্নি, রিল্যাক্স। রাজ মোটেও সাইকোপ্যাথ না। ওর সামান্য বিয়ে ভীতি আছে এই আরকি। প্লিজ ইটটা ফেলে শান্ত হয়ে আমাদের কথা শুনুন। আমি ওয়াদা করছি সব শোনার পর কোনো প্রকারের জোর করব না। সসম্মানে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব।”

একটু যেন ভাবল বহ্নিশিখা। রাগের বশে একটু বেশিই রিয়াক্ট করে ফেলেছে ও। ইটটা নামিয়ে বলল,

“আপনাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে।”

“খুশি হলাম শুনে।”

আফরাজের দিকে চেয়ে হাসল আরশাদ। হাতের ইট ফেলে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এলো বহ্নিশিখা। তবুও যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়েছে।

“বলুন।”

একটু সময় নিয়ে আফরাজ বলতে লাগল,

“বিয়ে ভীতি আছে আমার।”

“শুনলাম একটু আগে। তারপর বলুন।”

বহ্নিশিখার আচরণে এবার খানিক বিরক্ত হলো আফরাজ। সেটা কোনোমতে চেপে বলল,

“বিয়ে মানে সঙ্গীর সাথে কমিটেড রিলেশন। একই ছাদের নিচে থাকা। শেয়ারিং কেয়ারিং ব্লা ব্লা। এসব আমার দ্বারা অসম্ভব। আমার জীবনে কোনো নারীর প্রয়োজন নেই, অন্তত স্ত্রী হিসেবে নয়। শেষ কথাটা কিছুক্ষণ আগ পর্যন্তও আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম। কিন্তু এখন আমি আমার বিশ্বাস পরিবর্তন করতে চাইছি।”

“কেন? কারণ আপনার আব্বু অসুস্থ বলে?”

“হ্যাঁ, আমি নিরুপায় বহ্নিশিখা। পিতাকে বাঁচাতে আজ সব পারব আমি। হাজার কষ্ট হলেও। চাইলে আপনাকে মিথ্যা বলতে পারতাম। কিন্তু তা আমি করব না। আমি চাই আমার সত্যিটাকে আপনি গ্রহণ করুন। আমি আমার সর্বোচ্চ দেওয়ার চেষ্টা করব এই সম্পর্কে। নিজেকে বদলাবো। শুধু একটু সময় আমাকে দিতে হবে।”

বড্ড অসুস্থ অনুভব করছে ও। বহ্নিশিখাকে মিথ্যা বলতে পারবে না। এই মাত্র যা বলেছে তা সত্য। সম্পর্কে জড়ানো সহজ ব্যাপার না ওর জন্য। কিন্তু ও চেষ্টা করবে। বাবার জন্য, মামনির জন্য আর বহ্নিশিখার জন্য। স্বামীর কাছে অনেককিছু প্রত্যাশা করে মেয়েরা। আফরাজ জানে না বহ্নিশিখার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে কি না, কিন্তু সম্পর্কে জড়ালে তাকে চেষ্টা করতেই হবে। মেয়েটার জীবন নষ্ট করতে পারবে না। এতটা স্বার্থপর সে নয়। এবার বহ্নিশিখা একটুখানি বিশ্বাস করলে ও এই সংকট থেকে বাঁচে। বহ্নিশিখা ওর অসহায় মুখ দেখেও মায়া করল না।

“আপনাকে বিশ্বাস করি না আমি। কী করে ভাবলেন এই এত কিছু শোনার পরও আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হব? আপনাকে বিয়ে করা মানে আত্মহত্যার শামীল। জেনে-বুঝে মরতে যাব এমন বোকা মেয়ে আমি নই মি.শেখ।”

আফরাজের মাথা ঠিক নেই। হাসপাতালে ওর বাবা মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে আছে। মামণি কাঁদছেন। আচমকা কমিটেড হওয়ার সিদ্ধান্ত সব মিলিয়ে ব্রেন স্ট্রোক করার উপক্রম। বহ্নিশিখা কাপড়ের ব্যাগ হাতে তুলে নিলো।

“আপনাদের আর পৌঁছে দেওয়া লাগবে না। একাই যেতে পারব আমি।”

ও চলেই যাচ্ছিল আফরাজ ফের পিছু ডাকল,

“বহ্নিশিখা, আপনার বিশ্বাস অর্জনের জন্য যা প্রয়োজন আমি তাই করব। আজই বিয়ে করতে বলছি না। কেবল আব্বুর সামনে গিয়ে বলবেন বিয়েতে রাজি আপনি।”

“মিথ্যা বলব না আমি।”

“আমার আব্বু বেঁচে যাবে আপনার একটা মিথ্যাতে বহ্নিশিখা। এইটুকু দয়া আমার ওপর করুন প্লিজ। বিনিময় চাইলে তাও দিতে রাজি আছি।”

বহ্নিশিখা কিছুদূর গিয়ে থেমে যায়। আলিম শেখ-এর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা ভেসে ওঠে ওর চোখের সামনে। যতবার দেখা হয়েছে মা ছাড়া কথা বলেননি। পিতার প্রতিচ্ছবি দেখেছিল মানুষটার মধ্যে। বিবেক যেন একটু নাড়া দিলো। নিজের জীবনের পরিস্থিতিও স্মরণ হলো ওর। ব্যাগ হাতে বেরিয়েছিল আফরাজকে বিয়ে করবে বলে। এতক্ষণে হয়তো ওর মা ওকে বিছানায় না পেয়ে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। রাত দুপুরে মেয়ে গায়েব। কলঙ্কের লেপন ভালো মতোই কপালে লাগবে এভাবে ফিরে গেলে। আফরাজ তখন চুপচাপ সব গোপন করে বিয়েটা করে নিতে পারত। কিন্তু তা সে করেনি। বহ্নিশিখার কি বিশ্বাস করা উচিত ওকে? অনেকক্ষণ আকাশ পাতাল ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলো। আফরাজকে একটা সুযোগ ও দেবে। ওর বিয়ে ভীতি দূরীকরণে সাহায্য করবে। এমন নয় এখনই বিয়ে করছে। শুধু ওর বাবার সামনে গিয়ে বলবে ও রাজি। তারপর আফরাজের কাজ বহ্নিশিখার বিশ্বাস অর্জন করা। যদি সফল হয় তবে ভালো নয়তো নিজের পথ নিজে দেখবে। ততদিনে একটা চাকরি যে করেই হোক জুটিয়ে নেবে। আপাতত মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই তো হবে। ঘুরে দাঁড়াল। আফরাজ ফ্যাকাশে মুখে চেয়ে আছে। বহ্নিশিখা এক পা বাড়াল ওর দিকে। বলল,

“আপনার বাবাকে বাঁচাতে রিস্কটা নিচ্ছি মি.শেখ। তবে মনে রাখুন, বিয়ে আপনাকে এত জলদি করছি না।”

আফরাজের ফ্যাকাশে মুখ খানিক উজ্জ্বল হলো। ম্লান হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটের কোণে। হাসিটুকু ঠিক চোখ পর্যন্ত পৌঁছাল না।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here