যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া পর্ব -৮+৯

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৮

মাত্র ঘুম থেকে উঠে বারান্দা ধরে ধীর পায়ে চোখ দুটো কচলাতে কচলাতে যাচ্ছিল স্বচ্ছ। আজ সকাল সকাল উঠতে চেয়েছিল সে। বেশ কয়েকদিন হচ্ছে বাহিরে শরীর চর্চা বা জগিংয়ের জন্য যাওয়া হয় না। বড় হাই তুলে ফারাহর ঘরটা পাশ কাটিয়ে যেতেই হঠাৎ বোনের ডাক শুনে চকিতে তাকাল স্বচ্ছ।
“হেই ইউ! একরোখা আহিয়ান স্বচ্ছ‌, কাম হেয়ার।”

পুরো দরজা ঠেলে বড়ো শ্বাস নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে স্বচ্ছ। আর বলে,
“আমি এখনো ফ্রেশও হইনি ফারাহ।”

ফারাহ প্রতিত্তোরে কিছু না বলে তার হাতে থাকা একটা গোল্ডেন শেরওয়ানি নিয়ে এসে স্বচ্ছের কাছে ধরে। ভ্রু কুঁচকে তাকায় স্বচ্ছ। বিরক্তি নিয়ে শুধায়,
“তোমার ডিজাইন করা বিচ্ছিরি শেরওয়ানি আমায় দিয়ে ট্রাই করছ কেন?”

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল ফারাহ। শেরওয়ানি সরিয়ে নিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলল,
“হিংসে হয়? আমার মতো হতে চাও? না, আমি তোমায় ম/দ খেতে বলব না। কারণ তুমি কোনোভাবেই আমার মতো মূল্যবান ডিজাইনার হতে পারবে না। তাছাড়াও তোমাকে আমার ডিজাইন করা সবচেয়ে প্রিসিয়াস শেরওয়ানি তো দিতেই চাইনি। কিন্তু কী করব? আমি নিরুপায়! তুমি কী করে জানবে ডিজাইন মার্কেটে আমার কদর কত! কত নামি-দামি কোম্পানি আমার পেছনে পড়ে আছে। শুধুমাত্র ফারাহ সাহেরের ডিজাইন করা কাপড় পরতে তারা অনুরোধও করে। দেশ তো ছাড়ো রিসেন্টলি বিদেশেও আমার নাম উঠছে। আর…”

“রিল্যাক্স সিস্টার! আমি তো মজা করি তোমার সাথে। তোমাকে জ্বালানোর জন্যই এসব বলি আর তুমি প্রতিবারের মতো ঠিকই জ্বলে ওঠো।”

শব্দ করে হাসি দিলো স্বচ্ছ। ফারাহ চোখ ছোটো করে একহাতে স্বচ্ছের গালে হাত দিয়ে জোরে অন্যদিকে ঠেলে দিয়ে বলল,
“চুপ করো! এই জ্বালানোর চক্করেই বোধহয় তোমার পছন্দ করা মেয়ে তোমায় পছন্দ করে না।”

ফারাহর শেষ কথাটা স্বচ্ছের কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই তার হাসিটি বিলীন হয়ে দেখা যায় সীমাহীন বিভ্রান্তী। চরম হতবাক হয়ে সে প্রশ্ন করে,
“কী? আমার পছন্দ করা মেয়ে? আশ্চর্য! আমি কখন, কাকে পছন্দ করলাম?”

ফারাহ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
“অনেক মিথ্যে নাটক করেছ আর করবে না। ফারাহ সব জেনে গেছে।”

“কী জানার কথা হচ্ছে? আমি বুঝতে পারছি না।”

“ঠিক বুঝতে পারবে বিয়ের সময়। যামিনী আন্টি তো মাকে পুরো পটিয়ে মেয়েদের বাড়ি চলে গিয়েছে। আর যেখানে যামিনী আন্টি উপস্থিত আছে সেখানে উনি বিয়ের ডেট ফিক্সড করেই ফিরবে।”

বলেই একগাল হাসি দিলো ফারাহ। প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল,
“যাক অন্তত তোমার দৌলতে আমার পেছন ছেড়েছে। নয়ত আমার বিয়ে নিয়েও কাণ্ড করত।”

স্বচ্ছের মাঝে উচাটন সৃষ্টি হলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফারাহর সব কথা বোঝার চেষ্টা করেও যখন বুঝল না তখন উদ্ভ্রান্তের মতো বলল,
“আরে কিন্তু কার বাড়ি গিয়েছে? আমি তো কাউকেই পছন্দ করি না! এই আন্টি কার সাথে আমায় ফাঁ/সাতে চাইছে? আর পছন্দ করার কথা উঠল কোথা থেকে?”

“আমি তো জানি না। আন্টি শুধু বলে গেলেন তোমার বিয়ের জন্য এখন থেকেই যেন ড্রেস ডিজাইন করা শুরু করে দিই। আর তুমি তো জানো আমি পরিবারের বাধ্য মেয়ে।”

স্বচ্ছ আর বিলম্ব করল না। তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো ফারাহর ঘর থেকে।

সকাল দশটার কাঁটায় ছুঁইছুঁই। সরোয়ার সাহেব আয়েশ করে খবরের কাগজ দেখে চলেছেন। একটু পরই বাহিরে বের হবেন কাজে। পাশেই সবসময়ের মতো তার কাজে সহযোগী কামাল স্থির দাঁড়িয়ে। তার কাজই হলো সরোয়ার সাহেবের প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখা।
“তো ওই মেয়েটার কী খবর পাওয়া গেল যে আমার ছেলেকে চ/ড় মে;রেছিল?”

সরোয়ার সাহেবের আচমকা করা প্রশ্নে কামাল কিছুটা থতমত খেয়ে বলল,
“জী, স্যার। খোঁজ তো নেওয়া হয়েছে। মেয়েটার নাম মোহ আনবীর। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। শহরে নিজেদের বাড়িও নেই। ভাড়া থাকে। আর ওর বাবা…”

“আমি মেয়েটার সাথে আমার ছেলের বিয়ে দেব না যে মেয়ের সমস্ত কোয়ালিফিকেশন লাগবে। ব্যস…ওই মেয়েটাকে ওর পুরো পরিবার সহ আমার সামনে হাজির করো। আমিও তো দেখি কত দুঃসাহস মেয়েটার!”

“জি স্যার কালকের মধ্যে হাজির হয়ে যাবে।”

সরোয়ার সাহেব আবার মনোযোগ দিলেন খবরের কাগজের পাতায়। পরক্ষণেই কিছু একটা মনে হতেই আবার জিজ্ঞাসা করলেন,
“আর ওই কেক বানানোর ফ্যাক্টরির কী হাল? পুরো ফ্যাক্টরি ফাঁকা হয়েছে নাকি হয়নি?”

কামাল যান্ত্রিক স্বরে বলল,
“লোকজন পাঠিয়েছি সেখানে। ফাঁকা করে দেওয়ার কথা এতক্ষণে।”

“আর ফ্যাক্টরির মালিক কি জেনেছে ওর সাথে পাঁচ লাখের এগ্রিমেন্ট করেছিলাম?”

“জি, স্যার। ওটাও দেখানো হয়েছে।”

সরোয়ার সাহেব মৃদু হাসলেন। তাচ্ছিল্যের সহিত বললেন,
“বেচারা! সে তো জানেও না বাকি পনেরো লাখ আমার কাছে!”

কামাল সরোয়ার সাহেবের সাথে তালে তাল মিলিয়ে হাসল। কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ। সরোয়ার সাহেব কাগজ রেখে উঠে দাঁড়ালেন। বাহিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। পাঞ্জাবির কলার ঠিক করতে করতে শুনতে পেলেন বাহির থেকে চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। কপালে ভাঁজ পড়ল উনার।
“কামাল, যাও তো।দেখে এসো বাহিরে কী হচ্ছে।”

কামাল মাথা দুলিয়ে বাহিরে বিষয়টি দেখার জন্য ছোটে। কিছুটা সময় পর হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এসে বলে,
“স্যার, বাহিরে ফ্যাক্টরির লোকজন রীতিমতো গ্যাঞ্জাম পাকিয়ে ফেলছে। একদম আন্দোলন করা শুরু করছে।”

সরোয়ার সাহেবের মুখের রঙ যেন পাল্টে গেল। কিছুক্ষণ থম মে/রে দাঁড়িয়ে রইলেন উনি। কামাল আবার বলতে শুরু করল,
“গার্ড মিলেও তাদের থামানো যাচ্ছে না, স্যার।”

সরোয়ার সাহেব চশমা হাতে নিয়ে বললেন,
“কোনো ব্যাপার না। আমি যাচ্ছি ওদের সাথে কথা বলতে।”

“তবে স্যার….”

সরোয়ার সাহেব কামালের কথায় কর্ণপাত করলেন না আর। সদর দরজা পেরিয়ে বাহিরে আসতেই শোরগোল প্রগাঢ় শোনা গেল। হৈচৈ বাঁধিয়ে দিয়েছে সকলে।

ঝামেলা থেকে খানিকটা দূরেই সাইফুল সাহেব নিজের ভাগ্নীকে দূরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। উনার ইচ্ছে ছিল না মোহকে নিয়ে আসার। তবে তিনি মোহকে খুব ভালো করে জানেন। মোহ এখানে আসতে চেয়েছো যেহেতু সেহেতু এখানে আসবেই।
“ওইযে মন্ত্রী সাহেব আসছেন। মনে হয় আমার সাথেই কোনো কথা বলবেন। যা বলার আমি বলব। তুই শুধু শুনবি। কথা বলবি না। মনে থাকবে?”

মোহ স্পষ্ট বলল,
“চেষ্টা করব।”

“চেষ্টা হয় মোহ। বড়োদের ব্যাপার। তুই এর মাঝে ঢুকলে কিন্তু আমি রাগ করব।”

মোহ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালে সরোয়ার সাহেব কামালের সাথে এসে সাইফুলের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। সাইফুল উন্মুখিয়ে চেয়ে রইলেন। সরোয়ার সাহেবকে দেখে বিক্ষোভ বাড়ল সকলের। প্রতিবাদ দৃঢ় হলো। সরোয়ার সাহেব জোরে বলে উঠলেন,
“সবাই থামুন। আমায় কথা বলতে দিন। নাহলে সমস্যার সমাধান হবে কী করে?”

নিজের ঘরে বসে বারংবার মায়ের ফোনে কল করে যাচ্ছে স্বচ্ছ। কিন্তু মায়ের কোনো খবর নেই। বিরক্তি নিয়ে যখন ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ল তখন তার মনে হলো বেশ কিছু সময় ধরে বাহিরে জটলার আওয়াজ আসছে। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী দৃষ্টিতে বাহিরে এত লোক দেখে উদ্বেগ বাড়ল তার। নিজের বাবাকে নিচে দেখে সেও তৎক্ষনাৎ নিজের ঘর প্রস্থান করে।

সাইফুল সাহেব আকুতি করে বললেন,
“আপনি মন্ত্রী মানুষ। অনেক সম্মানীয় ব্যক্তি! আপনি তো জনসাধারণের ভালোমন্দ দেখবেন। আমার মনে হয় আমার যে ফ্যাক্টরি আছে তার যেই চুক্তি হয়েছিল সেখানে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।”

সাইফুলের সম্পূর্ণ কথা গুরুত্ব না দিয়ে সরোয়ার সাহেব বলেন,
“আপনার নাম?”

“সাইফুল হোসেন। ফ্যাক্টরির মালিক।”

“তো কী ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল আপনার সামান্য ফ্যাক্টরি নিয়ে?”

“আমার সাথে বিশ লাখ টাকার চুক্তি করা হয়েছিল। কিন্তু এখন অন্য কাগজ দেখিয়ে পাঁচ লাখ আমার হাতে ধরিয়ে ফ্যাক্টরি থেকে আমাদের বের করে দেওয়া হয়েছে। আপনি কিছু করুন স্যার প্লিজ! আমি এভাবে পথে বসে যাব। এখানে যারা সবাই আছে তারাও দিশাহারা হয়ে যাবে।”

বেশ আকুতি নিয়ে কথাগুলো অনবরত বলে থামলেন সাইফুল। সরোয়ার সাহেব কামালের উদ্দেশ্যে বললেন,
“কামাল! উনার ফ্যাক্টরির চুক্তির পেপারগুলো দেখি?”

কামাল চুক্তির কাগজপত্র সরোয়ার সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিলেন। সরোয়ার সাহেব সেসব দেখার ভান করে সাইফুলের সামনে ধরে বললেন,
“এটা মেইন পেপার। এখানে তো পাঁচ লাখের কথায় উল্লেখ আছে। আপনার যদি চুক্তি পছন্দ না হয় তবে সাইন করেছিলেন কেন?”

“বিশ্বাস করুন! আমি ভালো করে সব চেক করে বিশ লাখ টাকার কথা পেপারে দেখে তারপরেই সাইন করেছি পেপারে। আমার সাথে ছলনা করা হচ্ছে।”

সরোয়ার সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আপনার নিজের সাইন তো এটা? ঠিক বলছি তো? আপনারই হয়ত কোথাও ভুল হয়েছে। আপনার এসব সাইন করার আগে ভাবা উচিত ছিল। তখন আমার কাছে এলে আমি কোনো সমাধান বের করে দিতে পারতাম। হয়ত আপনার জন্য উপরমহলে খবর পাঠাতে পারতাম। কিন্তু আপনি সই করেছেন মানে আপনি চুক্তিতে রাজি। এতে আমার আর কিছু করার নেই।”

“আমার সাথে বেইমানি করা হয়েছে স্যার। আপনি এমনটা করবেন না। অন্তত আপনি সাহায্য করুন।”

সরোয়ার সাহেব চলেই যাচ্ছিলেন। সাইফুলের কথায় ঘুরে তাকিয়ে গাম্ভীর্যের সাথে বলেন,
“হয়ত আরো কোনো সমাধান দিতে পারতাম। কিন্তু এটা ভদ্রলোকের বাড়ি। আপনি আমার বাড়ির সামনে ঝামেলা বাঁধিয়ে আমাকে বদনাম করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাই সমাধান নিয়ে আপনার সাথে আর কথা বলতে চাই না।”

“ভদ্র বাড়ির মানুষজনকেও তো ভদ্র হওয়া উচিত। যাতে লোকজন আঙ্গুল তুলতে না পারে। তাই নয় কী?”

মেয়েলি কণ্ঠ পেয়ে সরোয়ার সাহেব ফের সন্দিহান চেহারায় পিছু ফিরে তাকান। কিছুটা দূরে চুপচাপ সাদা ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে গলার সুর নামিয়ে রাখা মোহের চিরচেনা রূপ বেরিয়ে এলো। কালো মেঘ থেকে বেরিয়ে সূর্যের মতো ঝলমলিয়ে উঠে নিজের কথা দ্বারা অন্যকে পু ড়িয়ে দেওয়ার মতো নিজেকে আড়াল থেকে বের করল সে। সরোয়ার সাহেব যেন জহুরি চোখে দেখে নিলেন মোহকে। চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল করলেন না তিনি। এতক্ষণ নিজের ক্রোধ আঁটকে রাখতে পারলেও এখন দাবানলের মতো জ্বলে উঠতে চাইছে। তবুও তিনি গলা নামিয়ে বললেন,
“তার মানে তুমি কী বোঝাতে চাইছ? আমরা অভদ্র লোকজন?”

“সেটা তো আমি বলার কেউ না। আমরা এসেছিলাম আপনার কাছ থেকে সমস্যার সমাধান নিতে। আপনি আমাদের এড়িয়ে যাচ্ছেন। আর এমনভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন যেন এই ঠকানো কাজটা আপনার। আর আপনাকে বদনাম করে এসব সাধারণ মানুষজন কত করে টাকা পাবে বলুন তো? একজন মন্ত্রী হিসেবে আপনার তো জনসাধারণের বিক্ষোভ সম্পর্কে খুব ভালো করে জানা উচিত।”

মোহের সাথে আর এসব কথা বলে তর্কে জড়াতে চাইলেন না সরোয়ার সাহেব। এতে তাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা খবর তৈরি হতে পারে। তিনি মৃদু হেসে বললেন,
“তুমি যেই সাহসী মেয়ে না যে আমার ছেলেকে রাস্তার থা/প্পড় দিয়েছিলে?”

মোহের দৃষ্টি সরু হয়ে এলো। সরোয়ার সাহেব একটু থেমে অদ্ভুত মৃদু হেসে বললেন,
“তোমার দুঃসাহস আমার ভালো লেগেছে।”

মোহ সবিনয়ের বলে ওঠে,
“আমরা যদি প্রধান বিষয়বস্তু নিয়ে কথা বলি তাহলে ভালো লাগবে স্যার। আমরা সবাই জানতে চাই কেন বিশ লাখের চুক্তি করে মাত্র পাঁচ লাখ দেওয়া হলো?”

“এর উত্তর আমি আগেই দিয়ে দিয়েছি। তুমি হয়ত শোনো নি।”

“আমি সব শুনেছি। তবে উত্তর ছিল না সেটা। ওটাকে বলে এড়িয়ে যাওয়া। ছোটো মুখে বড়ো কথা হবে তবে প্রশ্ন করতেই হচ্ছে যে, একজন মানুষ কোনো বিষয় থেকে কখন পালিয়ে বা এড়িয়ে যায় জানেন?”

সরোয়ার সাহেব চশমা ঠিকঠাক করে মোহের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। মেয়েটার স্পর্ধা উনাকে হতবাক করেই যাচ্ছে। তিনি কঠোর সুরে বললেন,
“তোমার মতো সাধারণ মানুষদের আমি ভালো করে চিনি বুঝলে মেয়ে? তোমরা বিপরীত পক্ষ থেকে টাকা খেয়ে দালালি করতে আসো তাদের হয়ে আর আমাদের বদনাম ছড়াও। কত টাকা দিয়েছে তোমাদের ওরা?”

সাইফুল সাহেব মোহের হাতখানা চেপে ধরলেন। ফিসফিস করে অনুরোধ করলেন যেন মোহ চুপ থাকে। কিন্তু মোহ উল্টে বলল,
“না মামা! আমি চুপ থাকতাম যদি জোর গলায় আপনি নিজের দাবী চাইতে পারতেন। কিন্তু আপনার এই নিচু কণ্ঠস্বর আপনার দুর্বলতা ভাবছেন উনি। আর সেটা হতে দেওয়া যাবে না।”

মোহ কথার মাঝে একটু থেমে ফের কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে সরোয়ার সাহেবকে বলল,
“স্যার, আমরা আমাদের দাবী নিয়ে এসেছি। কারোর দালালি করার গুন হয়ত আপনাদের মাঝে থাকতেই পারে। কিন্তু আমাদের সাধারণের মাঝে নেই। এখন আপনি যদি সমস্যার সমাধান না করে দেন তবে আমরা…”

“তবে তোমরা কী?”

“তবে আমরা বাধ্য হবো উপরমহলে যেতে।”

সরোয়ার সাহেব বিস্তর হাসেন। যেন মোহ কোনো মজার কথা বলে ফেলেছে।
“তোমাদের যেখানে যাওয়ার আছে যেতে পারো। স্বাগত জানাব আমি তোমাদের সেখানে। এখন আসতে পারো।”

স্বচ্ছের আগমন ঘটল তখনি। তাড়াহুড়ো করে এসে পড়ল মোহের বরাবর। দিনের আলোয় কুঁচকানো মোহের ঘর্মাক্ত মুখশ্রীর রঙ বদলায়। দেখা মিলে বিস্ময়ের। কিছুটা স্তব্ধ থেকে পরিলক্ষিত করে ঘোলাটে রঙের লোচনের মাঝে কী চমৎকার অস্থিরতা। বুঝতে পারে, এই সেই মন্ত্রীর ছেলে।
“তুমি এখানে কী করছ? কেন এসেছ?”

স্বচ্ছের বিভ্রান্ত হয়ে করা প্রশ্নে মোহের তেজী জবাব ছিল,
“সচক্ষে দেখতে এলাম বাবা ছেলের কত মিল! আপনার বাবা অন্যায় করছেন আমাদের সাথে। আমাদের পাওনা মিটিয়ে দিতে নারাজ তিনি।”

স্বচ্ছ দেরি না করেই তীরের ন্যায় নিজের গমগমে সুরে কথা ছুঁড়ল।
“খবরদার মেয়ে! তুমি আমায় অপমান করেছ আমি সহ্য করেছি। কিন্তু বাবার বিরুদ্ধে একটা কথাও সহ্য করব না। এর জন্য কিন্তু তোমাকে ভুগতে হবে। এক চুলও ছাড় পাবে না।”
#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৯

বাড়ি ফিরে এসে কাঁধের ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সোফা গা এলিয়ে মোহের ক্লান্তিতে পরিপূর্ণ চোখজোড়া বুঁজল। মায়ের আগমন বুঝতে পেরে ইথান দৌড়ে মায়ের নিকটে চলে আসে। তার ধুপধাপ ছোটার শব্দে মোহ চোখ মেলে তাকায় ইথানের সরল চেহারাটির দিকে। ইথানের জোড়া ভদ্রু দেখে একজনের কথা খুব মনে পড়ে মোহের। সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়। ইথান মায়ের গলা জড়িয়ে আহ্লাদী সুরে বলে,
“আই মিস ইউ মাম্মা!”

“আই মিস ইউ টু ইথান সোনা!”

“এইযে! সারাদিন কিছু খেয়েছিস? মিস পরে করিস। এখন কিছু মুখে দে ধর।”

এক বাটি মিষ্টি নিয়ে হাজির হলেন মিসেস. সুফিয়া। মায়ের খুশি খুশি মুখটি দেখে সন্দিহান হয়ে তাকিয়ে রইল মোহ। মিসেস. সুফিয়া মোহের পাশে বসে তার মুখশ্রীর দিকে নজর পড়তেই বিচলিত হলেন তিনি।
“চোখমুখের এ কী হাল? এমন লাল লাল হয়ে গেছিস কেন?”

“রোদে ছিলাম তাই। তোমার কী ব্যাপার বলো তো? হঠাৎ অসময়ে মিষ্টি? তুমি জানো আমি মিষ্টি পছন্দ করিনা।”

“মাঝে মাঝে শুভ কাজের জন্য মিষ্টি খেতে হয়। হা কর।”

মোহকে জোর করে হা করিয়ে পুরো মিষ্টি ঢুকিয়ে দিলেন মিসেস. সুফিয়া। মোহ হিমশিম খেল মুখের ভেতরের পুরো মিষ্টি শেষ করতে। তার অবস্থা দেখে ফিক করে হাসল ইথান। মোহ উদগ্রীব হয়ে শুধাল,
“শুভ কাজ? কী এমন শুভ কাজ সম্পন্ন হলো বাড়িতে যেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম না?”

মিসেস. সুফিয়া নড়েচড়ে বসলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলেন,
“আগে বল শোনার পর চিল্লাচিল্লি অথবা রাগ করবি না!”

“রাগ করার মতো বিষয় হলে রাগ দমাব কী করে?”

মিসেস. সুফিয়া মুখ ফিরিয়ে বললেন,
“তাহলে বলব না।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে। রাগ না করার চেষ্টা করব। এবার বলো!”

মিসেস. সুফিয়া আশ্বাস পেলেন। সাহস নিয়ে বলতে লাগলেন,
“আজ দুজন মহিলা এসেছিলেন। পাত্রপক্ষ আর কী! তোকে পছন্দ হয়েছে উনাদের। তাই বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসলেন।”

মোহের দৃষ্টি তৎক্ষনাৎ সরু হয়ে এলো। ক্ষীণ হয়ে এলো কন্ঠস্বর।
“হুমম! তো?”

“উনারা এমনভাবে আমায় বললেন যেন আমি মানা করতে পারিনি। ছেলে তোকে আগে থেকে পছন্দ করে। তাই আমি আরো বারণ করতে পারিনি।”

মোহ উঠে দাঁড়াল। মায়ের প্রতি তীব্র আক্রোশ ঢেলে এবং চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,
“মানে? তুমি সম্বন্ধে রাজি হয়ে গেলে? আমার অনুমতি না নিয়ে কী করে তুমি রাজি হতে পারলে? বাবাকে জানিয়ে করেছ এসব?”

মোহের তীব্র উত্তজেনায় ঘাবড়ে গেলেন মিসেস. সুফিয়া। তাকে পুনরায় সোফায় বসিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলেন,
“আরে বাবা শান্ত হ। আমি সম্বন্ধে রাজি হওয়ার কথা বলছিনা। আমি বলেছি ছেলে আর মেয়ে দুজন কথা বলে দেখুক তারপর বাকিটা দেখা যাবে। তুই শুধু কথা বলবি পাত্রের সাথে গিয়ে। তাছাড়া ছেলেটা কীভাবে যে প্রেমে পড়েছে ছেলেটা তুই না শুনলে বিশ্বাস করবি না। এসব প্রেম মিথ্যে হয়না!”

“মানে? কীভাবে প্রেমে পড়েছে? আর ছেলে কী করে? ছেলে জানে আমার ইথান সম্পর্কে?”

“তোকে পরে বলব এসব। সে সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলে। আমি তো তোর মা! তোর জন্য খারাপ চাইতে পারি বল?”

মোহ তেতে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। ইথানের হাত ধরে বলল,
“তোমার ওই এক কথা! মা সন্তানের খারাপ চাইতে পারেনা আমিও জানি। তুমি ইথানের কথা জানিয়েছ নাকি সেটা বলো।”

মিসেস. সুফিয়া এবার সংকোটে পড়ে গেলেন। হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে মিনমিন করে বলে ওঠেন,
“এখনো তো বলিনি। কিন্তু…”

“তাহলে আমাকে পাত্রের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হলে আগে আমি ইথানের কথায় জানাব। তারপর দেখব প্রেম কোথায় থাকে। এই বাচ্চাওয়ালা মেয়ের জন্য প্রেম হৃদয়ে থাকে নাকি ধরণী ছেড়েই পালায় সেটাই দেখব।”

মোহ নিজের স্পষ্ট কথা বলে ইথানকে নিয়ে ঘরে চলে গেল। মিসেস. সুফিশা হতাশ হলেন। এ জীবনে কি মেয়ের বিয়ে হবে না?

নিজের ঘরের কাউচে মাথার চুলগুলো রূঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে বসে আছে স্বচ্ছ। কপালের রগ দপদপ করছে তার। সৌমিত্রও এই মুহূর্তে চুপ রয়েছে। হঠাৎ সে বলে উঠল,
“এত কিছু হয়ে গেল কিন্তু আমি জানতেও পারলাম না?”

স্বচ্ছ মাথা সোজা করে নিভে যাওয়া গলায় উত্তর দিল,
“জানবি কী করে? সারাদিন গার্লফ্রেন্ডস্, পার্ট, ক্লাব নিয়ে পড়ে থাকলে ঘরের কথা মাথায় থাকে না।”

সৌমিত্র স্বচ্ছের পিঠে হাত বুলিয়ে নিবৃত হয়ে বলল,
“আহ ভাই! রাগ করো না এত। রাগী মানুষ বেশিদিন বাঁচে না জানো তো! কুল, ব্রাদার! কুল!”

স্বচ্ছ তো শান্ত হলোই না। বরং আরো তেজী গলায় বলল,
“শান্ত? তুই কীভাবে শান্ত থাকতে পারছিস আমি তো সেটাই বুঝতে পারছি না। আজ ওই মেয়েটা আমাকে নয় আমার বাবাকে অপমান করেছে। যেটা আমার সহ্যের সীমার বাহিরে।”

“আমি জানি ওই মেয়েটা এটা ঠিক করেনি। করিম আমার মনে হয় মেয়েটা ওর পরিস্থিতি থেকে এমন করেছে। ওদের কথাও তো ভাবো। হঠাৎ করেই তারা জানতে পারল তাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিশ লাখ নয় মাত্র পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। সেই রাগ থেকে ও এমনটা হয়ত বলে ফেলেছে। সিরিয়াসলি কেন নিচ্ছো?”

“স্বচ্ছ মোটেও ওভার রিয়েক্ট করছে না সৌমিত্র। হি ইজ রাইট। ওর যেমন প্রতিক্রিয়া করার কথা তেমনই করছে।”

কথাগুলো স্বচ্ছের নয়। বরং ভরাট কণ্ঠের অধিকারী সারোয়ার সাহেবের ছিল। ধীর পায়ে স্বচ্ছের ঘরে প্রবেশ করেন তিনি। কাউচের সামনে বিছানায় বসলেন। সৌমিত্রের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে লাগলেন,
“তোমাকে তো কেউ ইনসাল্ট করলেও তুমি হেসে তাকে ছেড়ে দাও।”

সৌমিত্র যেন এই কথাটাও মোটেই আমলে নিলো না। হেসে দিয়ে বলল,
“বাবা, জীবন তো একাই। তাই সেটাকে উপভোগ করা উচিত বলে আমি মনে করি। তুমি তো সারাজীবন রাজনীতির পেছনে ঘুরতে ঘুরতে চুল পাকিয়ে ফেলেছ। আমি এসবে মোটেও নেই। তাছাড়া এখন আমার আনন্দ করার বয়স। আমার মাথায় এসব সিরিয়াসনেস ঢুকিয়ে দিও না প্লিজ।”

সারোয়ার সাহেব সৌমিত্রকে ধমকালেন এবার।
“চুপ করো। আমি জানি তুমি কোনো কাজের না। সারাদিন শুধু মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তা ঘোরে তোমার। এজন্য আমি ঠিক করেছি রাজনীতির সব দায়িত্ব স্বচ্ছ পাবে আমার পর।”

স্বচ্ছ গোল গোল চোখে তাকাল। সৌমিত্র দায়সারা ভাব নিয়ে বলল,
“এমনিতেও এসব আমার দ্বারা হবে না। স্বচ্ছ ভাই তোমারই কার্বন কপি বাবা। তাকেই দায়িত্ব দাও। শুধু ভাই একটা বিষয়ের খেয়াল রেখো প্লিজ! মন্ত্রীর আসন পাওয়ার পর ঘোষণা দিয়ে দিও সৌমিত্রের এট লিস্ট দশটা বউ লাগবে।”

ছেলের আজগুবি আলাপ শুনে এবার চোখ গরম করলেন সারোয়ার সাহেব। সৌমিত্র শুঁকনো ঢক গিলে আস্তে করে ভাইয়ের ঘর থেকে চলে যায়। স্বচ্ছ নিস্তেজ গলায় বাবাকে জিজ্ঞেস করে,
“এখনো কি বিষয়টা নিয়ে তুমি আপসেট বাবা?”

সারোয়ার সাহেব চাপা হাসলেন।
“ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে তোমার বাবা আপসেট হয় না। আমি এসব ঠিক সামলে নেব। কিন্তু এবার তোমাকে আমার পাশে দাঁড়াতে হবে। আমারও তো বয়স হয়েছে। আমি সৌমিত্রকে দায়িত্ব দিতে চাইছি না কারণ ওর মন মানসিকতা এখনো বাচ্চাদের মতো।”

কিন্তু বাবা এসব রাজনীতি সম্পর্কে আমি আহামরি খুব একটা তো জানি না। তাছাড়া এসবে আমি কখনো কৌতূহলী ছিলামও না।”

“তাহলে আমার রাজনীতি আমি তো এভাবে ধ্বংস হতে দেব না স্বচ্ছ। তুমি আমার ছেলে। তাই তোমাকেই কৌতূহল দেখাতে হবে। শুধু তোমার রাগটা তুমি যেখানে সেখানে দেখিয়ে ফেলো। সেটা চলবে না। রাগ সেখানেই দেখাবে যেখানে প্রয়োজন পড়ে। ততক্ষণ রাগ দমিয়ে রাখবে যতক্ষণ সেই রাগ তোমার কোনো কাজে না আসে।”

স্বচ্ছ জবাবে হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। তার বাবা আবার বলেন,
“আমি চাই তুমি এই নির্বাচনেই আমার জায়গা নাও।”

স্বচ্ছ বিষয়টিতে অস্বস্তিবোধ করে। সামনেই নির্বাচন। এত দ্রুত কীভাবে সে কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে আমতা আমতা করে বলল,
“বাবা আমি…”

“আর কোনো কথা নয়। যা বলছি সেটাই। বয়স কম হয়নি তোমার। এখন আর দায়িত্ব এড়িয়ে যেও না।”

কথাগুলো বলে থামলেন না সারোয়ার সাহেব। স্বচ্ছের জবাবের অপেক্ষা না করেই বাহিরের দিকে পা বাড়ালেন তিনি।

রাতের খাওয়া শেষ করে মোহকে নিজের কাছে ডাকলেন আজহার সাহেব। মোহ বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তিনি গাম্ভীর্যের সাথে বলতে শুরু করেন,
“তোমার মামার সাথে কথা হয়েছে আমার। তুমি আজকে মন্ত্রী সারোয়ার সাহের এর বাড়িতে গিয়েছিলে? উনার সাথে মুখে মুখে কথা বলেছ?”

মোহ বিলম্ব না করেই স্পষ্ট জবাবে বলে দিলো,
“হ্যাঁ বাবা বলেছি। আজকে আমার কাজের প্রথম দিন ছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি লোকজনের হাহাকার পড়ে গেছে। আর ওই লোক কন্টিনিউয়াসলি মিথ্যে বলে যাচ্ছিলেন। আর বাবা তুমি জানো আমি এসব সহ্য করতে পারিনা। আমি কি কোনো ভুল করেছি? যদি তাই হয় আমি কাল আবার উনার বাড়িতে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসব।”

আজহার সাহেব তৎক্ষনাৎ বলেন,
“না, মোহ। আমি সেটা বলিনি। একজন বাবা হিসেবে আমি বলব তুমি একদম ঠিক কাজ করেছ। তোমাকে আমি ছোটো থেকে প্রতিবাদ করতেই শিখিয়েছি। কিন্তু তুমি কি নিশ্চিত যে ওই লোকটাই মিথ্যা কথা বলছে? ভুল বোঝাবুঝিও তো হতে পারে!”

“বাবা আমি শতভাগ নিশ্চিত। সমস্যাটা উনিই সৃষ্টি করেছেন। মামার কাছে চুক্তিপত্রের কপি ছিল সেসব আমি দেখেছি।”

“তাহলে এটা তো চিন্তার বিষয়। তোমার মামা এই মুহূর্তে অনেক ভেঙে পড়েছে। তোমার মাকে এখনো আমি কিছু বলিনি। শুনলে হয়ত সেও খুবই চিন্তিত হবে। এমনিতেই তার নিম্ন র/ক্তচাপ!”

“ঠিকই করেছ না বলে। আমি তো বুঝতেই পারছি না উনার মতো একজন মানুষ এসব করেন কী করে! রক্ষক যদি ভ;ক্ষক হয় তবে আমরা কার কাছে যাব? সবচেয়ে বড়ো কথা কী জানো? আমি যেই ছেলেকে ভুল করে থা/প্পড় মে/রেছিলাম সেই ছেলেটারই বাবা উনি। ওই লোকটাও আবার আমাকে হু/মকি দিয়েছে।”

আজহার সাহেব মোহের মাথায় হাত রাখলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে নরম সুরে সাহস জোগান দিলেন,
“সাহস হারাবে না। সাহস হারানো মানে সব হারানো। বুঝতে পেরেছ? আমিও তোমার পাশে আছি।”

বাবার কথায় সাহসটা বৃদ্ধি লাভ করে মোহের। পরক্ষণেই মোহের মায়ের কণ্ঠ শুনে হকচকিয়ে ওঠে বাবা, মেয়ে দুজনেই।
“কী কথা হচ্ছে এখানে?”।

মোহ জিহ্বা কে/টে মজা করে বলে,
“বাবা-মেয়ের সব কথা শুনতে নেই মা!”

“যা তোদের কথা আমার শোনারও আগ্রহ নেই। আমি তো আমার কথা বলতে এলাম।”

আজহার সাহেব বেশ আগ্রহী হয়ে শুধালেন,
“হ্যাঁ, বলো কী কথা?”

“তোমার মেয়ের জন্য আজ আবার সম্বন্ধ এসেছিল। আজ আমি মানা করতে পারিনি। ছেলে ভালো পরিবারের। কাল ছেলের সাথে মোহ দেখা করবে।”

আজহার সাহেব চকিতে মোহের দিকে তাকান। বি/স্ফোরিত কণ্ঠে বলেন,
“কী? আমায় এসব জানাও নি কেন? তুমি একা একা সব ঠিক করে ফেললে?”

“মা তো আমাকেই পরে জানিয়েছে। আমাকে তাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগে গিয়েছে। বুঝলে বাবা?”

মিসেস. সুফিয়া দেরি করলেন না মোহের পিঠে চা/পড় লাগাতে।
“শয়/তান মেয়ে! সারাজীবন এভাবে একা কাটিয়ে দিবি? ছেলে তোকে পছন্দ করেছে বলেই কথা বাড়িয়েছি। এইযে ছেলের নম্বর! এটা ছেলের আন্টি দিয়ে গিয়েছে। যেকোনো সময় ছেলে কল করতে পারে।”

মিসেস. সুফিয়া মোহের হাতে কাগজ গুঁজে দিলেন। মোহ মুখটা গোমড়া করে সেটা নিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

ড্রয়িংরুমে সোফায় সকলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে বসে আছে স্বচ্ছ। তাকে ঘিরে বসে রয়েছেন তার মা মিসেস. জেবা এবং মিসেস. যামিনী। দাঁড়িয়ে উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে সৌমিত্র। মিসেস. জেবা এবার নিজের জবান খুললেন,
“তুই একটা মেয়েকে পছন্দ করিস সেটা আমাকে কেন বলিসনি?”

স্বচ্ছের ভ্রু দুটো আপনাআপনি কুঁচকে যায় এ কথা শুনে। রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে খানিকটা উচ্চস্বরে বলে,
“আরে আমি কখন কাকে পছন্দ করলাম? তোমরা কী বলছ? আন্টি তুমি সকালে ফারাহকে কী বলে গিয়েছ? আমার বিয়ের জন্য ড্রেস ডিজাইন করতে? কী শুরু করেছ তোমরা?”

মিসেস. যামিনী স্বচ্ছকে সাহস দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন,
“স্বচ্ছ মিথ্যা বলছিস কেন? আমরা আমরাই তো! আমাদের নিজের পছন্দের কথা না বললে কাদের বলবি? তুই লজ্জা পাচ্ছিস কেন এভাবে?”

“আমি লজ্জা কেন পাব? তোমাদের মাথায় এসব কথা কে ঢুকিয়েছে বলো তো?”

সৌমিত্রের গলা শুকিয়ে এলো যেন। হালকা কেশে অন্যদিকে তাকাল সে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে গলা খাঁকারি দিতেই স্বচ্ছ সৌমিত্রের ঘাড় ধরে বলল,
“ও বলেছে?”

“আরে ভাই! সবসময় আমাকে কেন সন্দেহ করো? আন্টি আমাকে বাঁচাও! নয়ত তোমার হিরার টুকরো ছেলে আমায় মে/রেই ফেলবে।”

স্বচ্ছ ছেড়ে দেয় সৌমিত্রকে। নিজের টিশার্টের কলার ঠিক করতে করতে নিজের মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। মিসেস. যামিনী স্বচ্ছের উদ্দেশ্যে বলেন,
“এমন করছিস কেন? তোর পছন্দ তো অনেক সুন্দর! এই দেখ আমরা মেয়ের বাড়ি থেকে মেয়ের নম্বরও নিয়ে এসেছি। আমি চাই তুই এখনি কথা বলে নে ওর সাথে। আমরা মেয়ের মাকে বলেছি তুই কাল মেয়ের সাথে দেখা করবি।”

স্বচ্ছের বিস্ময়বিষ্ট হয়ে তার ধূসর চোখজোড়া বেরিয়ে আসার উপক্রম। সৌমিত্র মুখে হাত চেপে শব্দ করে হাসছে। তবে তারও জানা ছিল না তার সামান্য মজা করে বলা মিথ্যা এতদূর নিয়ে চলে যেতে পারেন যামিনী আন্টি। মিসেস. যামিনীর জোরাজুরিতে স্বচ্ছকে বাধ্য হয়ে মেয়েটিকে কল করতেই হলো। তারও জানারও আগ্রহ হলো কে সেই মেয়ে?

ফোনের রিংটা বেজে উঠতেই চমকে উঠল মোহ। ইথান প্রায় ঘুমে নিমগ্ন। রিংটোনের আওয়াজে ইথানের ঘুম হালকা হয়ে আসছে দেখে দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়েই কিছু না দেখে কল রিসিভ করে ফেলল মোহ। ওপাশ থেকে স্বচ্ছ এবং এপাশ থেকে মোহ দুজন একসাথে বলল,
“হ্যালো!”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here