রংধনুর রং কালো পর্ব -০৫

#রঙধনুর_রঙ_কালো(৫)
***********************

আমি তো ভাই রিক্সাওয়ালা, পাইলট কারো দলেই পড়ি না রে । আর শোন মারলে যদি কাজ হতো তো ভাবতাম । একটা কথা বলতো, মারলে কী হয় ? মনটা যেখানে নষ্ট হয়ে যায় সেখানে শরীরের আঘাত কোনো মানে রাখে? জোর করে ধরে বেঁধে শরীরটাকে আটকানো যায় হয়ত কিন্তু মন ফেরানো যায়, বলতো? বিষয়টা মারপিটের না শিহাব।

মাইরের ওপর ওষুধ নাই রে মামুন ।

তুই মারতে পারতি তোর বউকে?

আরে আমার বউয়ের এইসব নরকীয়ার দিকে ঝোঁক নাই রে। থাকলে তো ওর জীবন নরক করে দিতাম ।

নরকীয়া আবার কী জিনিষ?

এইটা তো নরকের দরজার চাবি তাই নরকীয়া, বুঝলি না?

বুঝলাম তোর চিন্তা ভাবনা । তোরটার সাথে আমারটা মিলবে না । আমি মারামারির লোক না ভাই, বাদ দে । দুপুরে মিলা’দের বাসায় গিয়েছিলাম ।

মিলা সহ!!

আরে না । আমার শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলতে । ওনাকে বললাম সবকিছু ।

কী বলিস! তোর কী মাথা নষ্ট? শ্বাশুড়ির সাথে কেউ এইসব আলাপ করে, পাগল ।

আমি রাতে নিশোকে ফোন করেছিলাম বিষয়টা ওকে বলার জন্য কিন্তু ও নিজের ব্যবসা নিয়ে খুব ঝামেলায় আছে । তাই ওর টেনশন আর বাড়ালাম না । আর শ্বাশুড়িকে বলতে লজ্জা পাবো কেন? তারা আমাদের বাবা মা না? সারাজীবন আমাদের যতো সমস্যা, যতো কষ্ট তাদের সাথে শেয়ার করিনি? তাঁর মেয়ে যদি এমন কাজে লজ্জা না পায় তো আমি বলতে লজ্জা পাবো কেন?

তুই ভাল মতো ধমক দে মিলা’রে । বুঝা, না বুঝলে জোর কর । আচ্ছা একটা কথা বল তো মামুন, এই যে মিলা’র এই বিষয়টা জানলি তারপর কী আর আগের মতো থাকতে পারবি ওর সাথে ?

শিহাব, একটা কথা বলি শোন – টিন এইজে প্রেমে পড়লে অথবা কোনো ভুল করলে বাবা মা তাদের ছেলে মেয়েকে শাসন করে, ধমক দেয় । বাবা মা’র ভয়ে বাচ্চারা অনেক সময় ফিরে আসে । মিলা তো আজকে নিজেই বাচ্চার মা । সে তো কাউকে ভয় পায় না । তার তো ছেলেমানুষী করার বয়স নাই । প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষ যখন কোনো ভুল, কোনো অন্যায় করে তখন তাকে চোখে আঙুল দিয়ে ভুল গুলো ধরিয়ে দেয়া যায় না । সে তো তখন জেগে ঘুমায় । আর যদি সম্পর্কের কথা বলিস তো একটা কথা বলি- মিলা’র সাথে আমার একটা বিশ্বাসের সম্পর্ক ছিলো । আমার দিক থেকে সে বিশ্বাসটা বিশাল ঝাঁকুনি খেয়েছে । পায়ের তলার মাটি সরে গেছে যেন । আমার অনুভূতিগুলো এখনো সেভাবে কাজ করছে না । এখন সম্পর্কটা ঠিক রাখার চেষ্টা করছি শুধুমাত্র আমার দুই বাচ্চার জন্য । থাক বাদ দে ওসব কথা । দেখা যাক কী হয় ।

সরি মামুন, খারাপ লাগছে ভীষন কিন্তু কিছুই করতে পারছি না তোর জন্যে ।

টেনশন করিস না । পরে কথা হবে শিহাব । হাতের কাজগুলো শেষ করি ।

ঠিক আছে । ভালো থাকিস আর জানাস কী হয় । দরকার লাগলে ডাকিস দোস্তো ।

মিলা জানেতে পারে না যে মামুন তাদের বাড়িতে গিয়েছিলো । ব্যাংক থেকে বেরিয়ে প্রতিদিনের মতো গাড়িতে উঠে বসে । এখন ক’দিন আর কথাবার্তা হয় না দু’জনের। মামুন বুঝতে পারে না কী বলবে । খুব অবাক লাগে ভাবতে যে এই মানুষটাই তার পুরোটা হৃদয় জুড়ে ছিলো । অথচ এমন একটা দিন তার জীবনেও আসবে এটা কখনো ভাবতেই পারেনি মামুন ।

বাড়িতে ঢুকেই মা’কে দেখে মিলা একটু অবাক হয় । একটু আগেই তো কথা হলো মা’র সাথে অথচ আসার কথা তো মা কিছু বলেই নি। মা’র মুখটা এমন থমথমে কেন! কারো কিছু হলো নাকি?

মা তুমি আসবে বলনি তো?

কথা আছে তোর সাথে ফ্রেশ হয়ে আয় ।

ফ্রেশ হয়ে এসে মিলা বসে মা’র সামনে । পূর্বা নানীর কাছে বসে গল্প করছে । মিলা দেখে এসেছে অপূর্বকে কম্পাউন্ডে ব্যাডমিন্টন খেলতে । মিলা এসে বসলো রুমে –

আচ্ছা মা তুমি আসবে বললে তো আমরা আসার সময় তোমাকে নিয়েই আসতাম । ওখান দিয়েই তো আসলাম ।

কেন আমি একা আসলে কী কোনো সমস্যা?

আরে সমস্যা হবে কেন?

তোর রুমে চল, কথা আছে । আপু তোমার ড্রইংটা শেষ কর । আমি মা’র সাথে কথা বলে এসে দেখবো, ঠিক আছে?

হুম, ঠিক আছে । পূর্বা ওর রুমে চলে যায় ।

রুমে ঢুকেই আমিনা বেগম দরজা বন্ধ করে দেন । মিলা অবাক হয়, কী হলো আজ মা’র? এমন আজব আচরণ করছে কেন?

কী সমস্যা তোর বল?

আমার আবার কী সমস্য, কী বল তুমি?

তোর কোনো সমস্যা নাই? কোনো ঝামেলা চলছে না তোদের?

তুমি না বললে বুঝি কী করে মা, কী বল তুমি?

সাইফ কে?

ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায় মিলা । সাথে সাথে সামলেও নেয় নিজেকে । ওহ,, আচ্ছা, ঐ যে ভাইয়ার বন্ধু ঐ লোক । আমার ক্লায়েন্ট তো । কেন বলতো?

ঐ লোকের সাথে তোর কী?

বললাম না, ক্লায়েন্ট । আর আমার অনুষ্ঠানের সমস্ত আয়োজন তো উনিই করেন। তোমাকে বলেছি তো ওনার কথা ।

মিলা মামুন দুপুরে বাসায় গিয়েছিলো । আমাকে কোনো মিথ্যে কথা বলবি না । ঠিক করে বল, কী করছিস তুই?

মিলা এবার সত্যি একটু ঘাবড়ে যায় । মা’কে সে এখনো কিছুটা ভয় পায় । মামুন যে এভাবে মা’র কাছে চলে যাবে এটা সে চিন্তাও করতে পারেনি । সে পুরোই অস্বীকার করে বিষয়টা । মা এগুলো কিছুই না । মামুন একটু ভুল বুঝেছে । আর তুমিও কী বলতো, ওর কথায় তুমি আমাকে জেরা করতে শুরু করে দিলে?

মিলা আমি পূর্বা না । আমাকে এটা ওটা বলে বুঝাতে চেষ্টা করবি না । এমন একটা বিষয় নিয়ে তোর সাথে আমার কথা বলতে হবে এটা আমি চিন্তাও করিনি । কী হয়েছে এগুলো আমি জানতে চাইও না । শুধু সাবধান করে দিচ্ছি, ওরকম নোংরা কোনো কাজের কথা ভাবিস না । মামুন যখন আমাকে বলছিলো, লজ্জায় আমি ছেলেটার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না । মনে হচ্ছি, আমিই যেন অন্যায় টা করেছি । সবাই জানার আগে এই পাপের ভেতর থেকে বের হ। তোর বাচ্চাদের কথা ভাবলি না একবারও!

মিলা কোনো কথা বলে না । ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসতে থাকে । এতো বড় সাহস মামুনের! তার মা’র কাছে বিচার দেয় । আজ এর শেষ দেখেই সে থামবে ।

আমিনা বেগম আরো কী সব কথা বলতে থাকেন মিলা কিছুই শোনে না । সে মনে মনে তার প্ল্যান ঠিক করে ফেলে ।

মাকে বিদায় দিয়ে মিলা দেখে মামুন বাসায় নেই। মেয়েকে নিয়ে বেরিয়েছে । সে সাইফের সাথে কথা বলে নেয় ফোনে । মামুনের ফেরার অপেক্ষা করতে থাকে মিলা ।

মামুন ছেলেমেয়ে দু’জনকে সাথে নিয়ে ফেরে । ফিরে এসেই কিছুক্ষণ হৈ হল্লা চলে তিনজনে । বাচ্চারা রুমে গেলে মামুন এসে রুমে ঢোকে । ঢুকতেই মিলা সামনে এসে দাঁড়ায় –

মাকে কী বলেছো তুমি?

তুমি যা যা করেছো ঠিক সেগুলোই বলেছি ।

তোমার এতোবড় দুঃসাহ, তুমি আমার মা’র সাথে কথা বলতে গেছো! কী ভেবেছো মাকে নালিশ করে আমাকে আটকে রাখবে?

না, তোমাকে আটকে রাখার কোনো ইচ্ছে আমার নেই মিলা । মনটা নষ্ট হয়ে গেলে শরীর আটকে করব টা কী বল? মা তো দু’দিন পর সব জানতে পারবেন তাই না? আচ্ছা তুমি শুধু আমার একটা কথার উত্তর দাও, আমার সাথে কেন এমন করলে? আমার দোষটা কী ছিলো?

তোমার কোনো দোষ নেই ।

আমার কোনো দোষ না থাকলে তো তোমার এই নোংরামি, এই আলাদা হতে চাওয়া আমি মেনে নেবো না । উত্তর আমাকে জানতেই হবে ।

সাইফকে আমি ভালবাসি । কখন কীভাবে এই ভালো লাগা তৈরি হয়েছে আমি জানিনা । শুধু জানি, ওর চাওয়ার সাথে আমার চাওয়াগুলো খুব মিলে যায় । আমরা একসাথে থাকতে চাই । এটা আমাদের দুজনের সিদ্ধান্ত । আর তোমাকে এতো প্রশ্নের উত্তর আমি কেন দিচ্ছি? তোমার সাথে থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে । আমি এবার একদম নিজের মতো করে বাঁচবো ।

এতদিনও তুমি তোমার খুশী মতই বেঁচেছো । একদিন আমরাও একসাথে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলাম । সেই জন্যেই আজ একসাথে থাকা । তুমি তোমার স্বপ্নের মোড় কখন ঘুরিয়ে নিলে, কেন ঘুরিয়ে নিলে? বলতে হবে আমাকে । আমি আমার উত্তর পাচ্ছি না মিলা । আমার সাথে কেন এমন করলে? আমার দোষটা বল । আমার বাচ্চা দু’টোর সাথে এমন করার অধিকার কোথায় পেলে তুমি?

শোনো, ডিসিশন তো আমি নিয়েই নিয়েছি, আমি সাইফের কাছে চলে যাবো তবে আজ মা’কে ডেকে এনে তুমি বিষয়টা খুব তাড়াতাড়ি ঘটিয়ে দিলে । একদিক দিয়ে ভালোই হলো, যতো তাড়াতাড়ি ঝামেলা মেটে, আমি একটু নিশ্বাস নিতে পারি । আমি কাল সকালে চলে যাচ্ছি এ বাড়ি ছেড়ে । আশা করছি তুমি কোনো ঝামেলার চেষ্টা করবে না । তুমি যাকেই ডেকে আনো কোনো লাভ নেই। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি ।

মা সাইফ কে? ওনার সাথে কোথায় যাবে তুমি?

মামুনের বুকটা ধুক করে ওঠে। দরজাটা খোলা ছিলো সে একবারও খেয়াল করেনি । পূর্বা এসে মাঝখানে দাঁড়িয়েছে। অপূর্ব দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়ানো । দুজনের চোখেই বিস্ময়। তারা বুঝতে পারছে না মা বাবার মধ্যে কাকে নিয়ে কথা হচ্ছে!

সবাই কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে থাকে । হঠাৎ বাচ্চাদের চলে আসায় খুব অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায় । মিলা আর লুকানোর কোনো চেষ্টা করে না –

মা আর এখানে থাকছে না তোমাদের সাথে ।

কেন মা, কোথায় যাচ্ছো তুমি? কবে আসবে?

মা’র একটু কাজ আছে, কিছুদিন দুরে থাকতে হবে ।

কতোদিন মা? তুমি যে বললে, সাইফের কাছে চলে যাবো । সাইফ কে মা?

মামুন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে । কোনো কথা পাচ্ছে না বলার মতো । এই মুহূর্তটাকে সে খুব বেশী ভয় পাচ্ছিলো । বাচ্চারা যখন জানবে, ওদের কী প্রতিক্রিয়া হবে এটা ভেবেই কয়টা দিন তার মনটা খুব অস্থির হয়েছিলো ।

মা তুমি কী ওনাকে বিয়ে করছো ? হঠাৎ বলে ওঠে অপূর্ব ।

কেউ কোনো কথা বলতে পারে না । চারিদিকে যেন শুনশান নিরবতা । সবাই যেন সবার হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে ।

মিলা চলে গেছে দুদিন হলো । প্রতিদিনকার জীবন ঠিকঠাক মতই চলছে তবে সবার মাঝে কেমন একটা হতবিহ্বল ভাব । বাচ্চারা স্কুলে যাওয়ার পর মামুন অফিসে যায় । বাচ্চাদের স্কুল ইউনিফর্ম, ওদের টিফিন রেডি করা এ কাজ গুলো সবসময় বিনুই করে আসছে তাই তেমন বেগ পেতে হয় না । ছেলেমেয়ে দু’টো একদম চুপ হয়ে গেছে । একবারও মা’র কথা জিজ্ঞেস করছে না । মামুন একটু অবাক হয়, একই সাথে স্বস্তিও পায় । ওদের প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতো কোনো উত্তর তার জানা নেই । বাচ্চারা মনে হলো হঠাৎ করে অনেক বড় হয়ে গেছে………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here